ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
এই জন্যই বহুকাল হইতে লোকে বলিয়া আসিতেছে— আমরা অদৃষ্টের
খেলেনা। আমাদের লইয়া সে খেলা করিতেছে। সুখের বিষয় এই যে, নিতান্ত ছেলেখেলা নয়। একটা
নিয়ম আছে, একটা ফল আছে। অভিনয়ের সঙ্গে মনুষ্যজীবনের তুলনা পুরাণো হইয়া গিয়াছে,
কিন্তু কেবল মাত্র সেই অপরাধে সে তুলনাকে যাবজ্জীবন নির্বাসিত করা যায় না। অভিনয়ের
সঙ্গে মনুষ্যজীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়। প্রত্যেক অভিনেতার অভিনয় আলাদা আলাদা করিয়া
দেখিলে সকলি ছাড়া-ছাড়া বিশৃঙ্খল বলিয়া মনে হয়, একটা অর্থ পাওয়া যায় না। তেমনি
প্রত্যেক মনুষ্যের জীবনলীলা সাধারণ মনুষ্যজীবন হইতে পৃথক্ করিয়া দেখিলে নিতান্ত
অর্থশূন্য বলিয়া বোধ হয়, অদৃষ্টের ছেলেখেলা বলিয়া মনে হয়। কিন্তু তাহা নহে; আমরা
একটা মহানাটক অভিনয় করিতেছি, প্রত্যেকের অভিনয়ে তাহার উপাখ্যানভাগ পরিপুষ্ট হইতেছে।
এক এক জন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে,নিজের নিজের পালা অভিনয় করিতেছে ও
নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতেছে, সে জানে না তাহার ঐ জীবনাংশের অভিনয়ে সমস্ত নাটকের
উপাখ্যানভাগ কিরূপে সৃজিত হইতেছে। সে নিজের অংশটুকু জানে মাত্র; সমস্তটার সহিত
যোগটুকু জানে না। কাজেই সে মনে করিল, 'আমার পালা সাঙ্গ হইল এবং সমস্তই সাঙ্গ হইল।'
প্রত্যহ যে শত সহস্র অভিনেতা, সামান্যই হউক আর মহৎই হউক,
রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে ও নিষ্ক্রান্ত হইতেছে, সকলেই সেই মহা-উপাখ্যানের সহিত
জড়িত, কেহ অধিক, কেহ অল্প; কেহ বা নিজের অভিনয়াংশের সহিত সাধারণ উপাখ্যানের যোগ
কিয়ৎপরিমাণে জানে, কেহ বা একেবারেই জানে না। মনে কর, এই মহা নাটকের
"ফরাসীবিপ্লব"-নামক একটা গর্ভাঙ্ক অভিনয় হইয়া গেল, কত শত বৎসর ধরিয়া কত শত রাজা
হইতে কত শত দীনতম ব্যক্তি না জানিয়া না শুনিয়া ইহার অভিনয় করিয়া আসিতেছে; তাহাদের
প্রত্যেকের জীবন পৃথক্ করিয়া পড়িলে এক একটি প্রলাপ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু সমস্তটা
একত্র করিয়া পড়িবার ক্ষমতা থাকিলে প্রকাণ্ড একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নাটক পড়া যায়। একবার
কল্পনা করা যাক্, পৃথিবীর বহির্ভাগে দেবতারা সহস্র তারকানেত্র মেলিয়া এই অভিনয়
দেখিতেছেন। কি আগ্রহের সহিত তাঁহারা চাহিয়া রহিয়াছেন! প্রতি শতাব্দীর অঙ্কে অঙ্কে
উপাখ্যান একটু একটু করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। প্রতি দৃশ্যপরিবর্তনে তাঁহাদের কত প্রকার
কল্পনার উদয় হইতেছে, কত কি অনুমান করিতেছেন! যদি পূর্ব্ব হইতেই এই কাব্য, এই নাটক
পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলেও কি ব্যগ্রতার সহিত প্রত্যেক অভিনয়ের ফল দেখিবার জন্য উৎসুক
রহিয়াছেন! যেখানে একটা ঔৎসুক্যজনক গর্ভাঙ্ক আসন্ন হইয়াছে , সেইখানে তাঁহারা
আগ্রহরুদ্ধ নিঃশ্বাসে মনে মনে বলিতে থাকেন, এইবার সেই মহা-ঘটনা ঘটিবে। কী মহান্
অভিনয়! কি বিচিত্র দৃশ্য! কি প্রকাণ্ড রঙ্গবেদী!
খাঁটি বিনয়
ভাল জহরী নহিলে খাঁটি বিনয় চিনিতে পারে না। এক দল অহঙ্কারী আছে
তাহারা অহঙ্কার করা আবশ্যক বিবেচনা করে না। তাহাদের বিস্তৃত জমিদারী, বিস্তর লোকের
নিকট হইতে যশের খাজনা আদায় হয়, এই নিমিত্ত তাহাদের বিনয় করিবার উপযুক্ত সম্বল আছে।
তাহারা সখ করিয়া বিনয় করিয়া থাকে। বাহিরে নাকি জমিজমা যথেষ্ট আছে, এই জন্য বাড়ির
সমুখে একখানা বিনয়ের বাগান করিয়া রাখে। যে বেচারীর জমিদারী নাই, আধ পয়সা খাজনা মিলে
না, সে ব্যক্তি পেটের দায়ে নিজের বাড়ির উঠানে, "অহং"এর বাস্তুভিটার উপরে অহঙ্কারের
চাষ করিয়া থাকে, তাহার আর সখ করিবার জায়গা নাই। নিজমুখে অহঙ্কার করিলে যে দারিদ্র্য
প্রকাশ পায়, সে দারিদ্র্য ঢাকিতে পারে এত বড় অহঙ্কার ইহাদের নাই। যাহা হউক, ইহাদের
মধ্যে এক দল সখ করিয়া বিনয়ী, আর এক দল দায়ে পড়িয়া অহঙ্কারী, উভয়ের মধ্যে প্রভেদ
সামান্য।
নিজের গুণহীনতার বিষয়ে অনভিজ্ঞ এমন নির্গুণ শতকরা নিরেনব্বই জন,
কিন্তু নিজের গুণ একেবারে জানে না এমন গুণী কোথায়? তবে, চব্বিশ ঘণ্টা নিজের গুণগুলি
চোখের সাম্নে খাড়া করিয়া রাখে না এমন বিনয়ী সংসারে মেলে। অতএব কে বিনয়ী? না, যে
আপনাকে ভুলিয়া থাকে, যে আপনাকে জানে না, তাহার কথা হইতেছে না।
বড়মানুষ গৃহকর্ত্তা নিমন্ত্রিতদিগকে বলেন, "মহাশয়, দরিদ্রের
কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন; আপনাদিগকে আজ বড় কষ্ট দেওয়া হইল" ইত্যাদি। সকলে বলে, "আহা
মাটির মানুষ!" কিন্তু ইহারা কি সামান্য অহঙ্কারী! অপ্রস্তুত হইলে লোকে যে কারণে
কাঁদে না, হাসে, ইহারাও সেই কারণে বিনয়বাক্য বলিয়া থাকে। ইহারা কোনমতেই ভুলিতে পারে
না যে, ইহাদের বাসস্থান প্রাসাদ, কুটীর নহে। এ অহঙ্কার সর্ব্বদাই ইহাদের মনে জাগরূক
থাকে। এই নিমিত্ত ইহাদিগকে সারাক্ষণ শশব্যস্ত হইয়া থাকিতে হয়, পাছে বিনয়ের অভাব
প্রকাশ পায়। অভ্যাগত আসিলেই তাড়াতাড়ি ডাকিয়া বলিতে হয়, "মহাশয়, এ কুটীর, প্রাসাদ
নহে।" তেমন বৃষ যদি কেহ থাকে তবে এই অহঙ্কারী মশাদের বলে, "বাপু হে, তুমি যে এতক্ষণ
আমার শিঙ্গে বসিয়াছিলে, তাহা আমি মূলে জানিতেই পারি নাই, ভোঁ ভোঁ করিতে আসিয়াছ
বলিয়া এতক্ষণে টের পাইলাম। তোমার এ বাড়িটা প্রাসাদ কি কুটীর, সে বিষয়ে আমি
মুহূর্ত্তের জন্য ভাবিও নাই, আমার নজরেই পড়ে নাই, অতএব ও কথা তুলিবার আবশ্যক কি?"
আমাদের দেশে উক্ত প্রকার অহঙ্কারী বিনয়ের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। সুকণ্ঠ বলেন "আমার
গলা নাই", সুলেখক বলেন "আমি ছাই ভস্ম লিখি", সুরূপসী বলেন "এ পোড়ামুখ লোকের কাছে
দেখাইতে লজ্জা করে"! এ ভাবটা দূর হলেই ভাল হয়। ইহাতে না অহঙ্কার ঢাকা পড়ে, না সরলতা
প্রকাশ হয়! আর, এই সামান্য উপায়েই যদি বিনয় করা যাইতে পারে, তবে তো বিনয় খুব শস্তা!
আসল কথা এই যে, "বিনয়বচন" বলিয়া একটা পদার্থ মূলেই নাই। বিনয়ের
মুখে কথা নাই, বিনয়ের অর্থ চুপ করিয়া থাকা। বিনয় একটা অভাবাত্মক গুণ। আমার যে
অহঙ্কারের বিষয় আছে এইটে না মনে থাকাই বিনয়, আমাকে যে বিনয় প্রকাশ করিতে হইবে এইটে
মনে থাকার নাম বিনয় নহে। যে বলে 'আমি দরিদ্র' সে বিনয়ী নহে; যে স্বভাবতই প্রকাশ করে
না যে 'আমি ধনী' সেই বিনয়ী। যাহার বিনয়বাক্য বলিবার আবশ্যক পড়ে না সেই বিনয়ী। তবে
কি না, বিদেশী ভাষা শিখিতে হইলে ব্যাকরণ পড়িতে হয়, অভিধান মুখস্থ করিতে হয়; বিনয়
যাহাদের পক্ষে বিদেশী, তাহাদিগকে বিনয়ের অভিধান মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু এই প্রকার
মুখস্থ বিনয় সংসারের এক্জামিন পাস করিতেই কাজে দেখে, পরীক্ষাশালার বাহিরে কোনো
কাজে লাগে না।
সমস্ত জীবনের যে তত্ত্বগুলিকে জানিয়া আসিতেছি, মাঝে মাঝে তাহাদের এক একবার আবিষ্কার করিয়া ফেলি । তাড়াতাড়ি পাশের লোককে ডাকিয়া বলি, ওহে, আমি এই তত্ত্বটি জানিয়াছি। সে বিরক্ত হইয়া বলে, আঃ, ও তো জানা কথা ! কিন্তু ঠিক জানা কথা নয় । তুমি উহা জান বটে , তবুও জান না। একটা তুলনা দিলে স্পষ্ট হইবে। বাতাস সর্ব্বত্রই বিদ্যমান । তথাপি এক জন যদি বলিয়া উঠে 'ওহে এইখানে বাতাস আছে' তবে তাহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারি না, তেমনি আমরা যে সকল সাধারণ তত্ত্বের মধ্যে বাস করিয়া থাকি সেই তত্ত্বগুলি অবস্থাবিশেষে এক এক জনের গায়ে লাগে, অমনি সে বলে—অমুক তত্ত্বটি পাইতেছি । এক জন বন্ধু বলিতেছিলেন যে, আজকাল সার্ব্বজনীন-উদারতা (humanity) প্রভৃতি কতকগুলি প্রশস্ত কথা উঠিয়াছে, সহসা মনে হয়, কত কি মূল্যবান তত্ত্ব উপার্জন করিতেছি, কিন্তু সে সকল তত্ত্ব বাতাসের মতো। বাতাস অত্যন্ত উপকারী পদার্থ বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোন মূল্য নাই। তেমনি উপরি-উক্ত তত্ত্বগুলি বড় বড় তত্ত্ব বটে, কিন্তু এত সাধারণ যে তাহার কোন মূল্য নাই; অথচ আজকাল তাহাদের এমনি বিশেষরূপে উত্থাপিত করা হইতেছে যে, যেন তাহার কতই অসাধারণ ! তাঁহার কথাটা ঠিক মানি না। মহাত্মাদিগের "বসুধৈব কুটুম্বকং" এ কথাটি সকলেই জানেন। অথচ সকলের গায়ে লাগে না। এ তত্ত্বটি মাঝে মাঝে এক এক জনের গায়ে প্রবাহিত হয় অমনি সে বসুধৈব কুটুম্বকং প্রচার করিয়া বেড়ায়। পুরাণো-কথা ধরা-কথা পারতপক্ষে কেহ বলিতে চাহে না; অতএব পুরাণো কথা যখন কাহারও মুখে শুনা যায়, তখন বিবেচনা করা উচিত — সে তাহা জানিত বটে কিন্তু আজ নতুন পাইয়াছে, আমাদের ভাগ্যে এখনো তাহা ঘটে নাই। অনেক "উড়ো-কথা"র অপেক্ষা ধরা-কথাকে আমরা কম জানি। আমরা নিজের চোক দেখিতে পাই না, দর্পন পাইলেই দেখিতে পাই; ধরা-কথা ধরিতে পারি না, বিশেষ অভিজ্ঞতা পাইলে ধরি। অতএব যাহারা জানা-কথা জানে,তাহারা সাধারণের চেয়ে অধিক জানে।