ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
বধিরতার সুখ
অদ্বিতীয় রমণী ও অসাধারণ পুরুষ জর্জ এলিয়ট তাঁহার একটি উপন্যাসে লিখিয়াছেন যে, আমরা
জীবনে অনেক ছোট ছোট দুঃখঘটনা দেখিতে পাই, কিন্তু তাহা এত সাধারণ ও সামান্যকারণজাত
যে, তাহাতে আর আমাদের করুণা উদ্রেক করিতে পারে না, তাহা যদি পারিত তবে জীবন কি
কষ্টেরই হইত! যদি আমরা কাঠবিড়ালীর হৃদয়স্পন্দন শুনিতে পাইতাম, যখন একটি ঘাস
মৃত্তিকা ভেদ করিয়া গজাইতেছে তখন তাহার শব্দটুকুও শুনিতে পাইতাম, তবে আমাদের কানের
পক্ষে কি দুর্দশাই হইত! আমরা যেমন দিগন্ত পর্য্যন্ত সমুদ্র
প্রসারিত দেখিতে পাই, কিন্তু সমুদ্রের সীমা সেইখানেই নয়, তাহা অতিক্রম করিয়াও
সমুদ্র আছে— তেমনি আমরা যাহাকে স্তব্ধতার দিগন্ত পর্যন্ত বলি তাহার পরপারেও শব্দের
সমুদ্র আছে, তাহা আমাদের শ্রবণের অতীত। পিপীলিকা যখন চলে তখন তাহারো পদশব্দ হয়, ফুল
হইতে শিশির যখন পড়ে তখন সেও নীরব অশ্রুজল নহে সেও বিলাপ করিয়া ঝরিয়া পড়ে।
জর্জ এলিয়ট অন্যের সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন আমরা নিজের সম্বন্ধেও
তাহাই প্রয়োগ করিয়া দেখিব। মনে কর, আমাদের নিজের হৃদয়ের মধ্যে যাহা চলে তাহা সমস্তই
আমরা যদি দেখিতে পাইতাম, শুনিতে পাইতাম, তাহা হইলে আমাদের কি দুর্দশাই হইত! জর্জ
এলিয়ট দৃষ্টান্তস্বরূপে কাঠবিড়ালীর হৃদয়স্পন্দন ও তৃণউদ্ভেদের শব্দ উল্লেখ
করিয়াছেন, কিন্তু আমরা যদি নিজের দেহের ক্ষীণতম হৃদয়স্পন্দন, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস-পতন,
রক্তচলাচলের শব্দ, নখ ও কেশ -বৃদ্ধি, এবং বয়োবৃদ্ধি সহকারে দেহায়তনবৃদ্ধির
শব্দটুকুও অনবরত শুনিতে পাইতাম, তবে আমাদের কি দশাই হইত! যখন আমরা প্রাণ খুলিয়া
হাসিতেছি তখনো আমাদের হৃদয়ের মর্ম্মস্থলে অতিপ্রচ্ছন্নভাবে বসিয়া যে একটি বিষাদ,
একটি অভাব নিঃশ্বাস ফেলিতেছে, তাহা যদি শুনিতে পাইতাম তবে কি আর হাসি বাহির হইত?
যখন আমরা দান করিতেছি ও সেই সঙ্গ "নিঃস্বার্থ পরোপকার করিতেছি" মনে করিয়া মনে মনে
অতুল আনন্দ উপভোগ করিতেছি, তখন যদি আমরা আমাদের সেই পরোপচিকীর্ষার অতি প্রচ্ছন্ন
অন্তর্দেশে যশোলিপ্সা বা আর একটা কোন ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার বক্রমূর্ত্তি দেখিতে
পাই, তবে কি আর আমরা সেরূপ বিমলানন্দ উপভোগ করিতে পারি? আবার আর এক দিকে দেখ। যেমন,
এমন শব্দ আছে যাহা আমাদের কাছে নিস্তব্ধতা, তেমনি এমন স্মৃতি আছে যাহা আমাদের কাছে
বিস্মৃতি। আমরা যাহা একবার দেখিয়াছি, যাহা একবার শুনিয়াছি, তাহা আমাদের হৃদয়ে
চিরকালের মত চিহ্ন দিয়া গিয়াছে। কোনটা বা স্পষ্ট, কোনট বা অস্পষ্ট, কোনট বা এত
অস্পষ্ট যে আমাদের দর্শন শ্রবণের অতীত। কিন্তু আছে। আমাদর স্মৃতিতে যত জিনিষ আছে
তাহা ভাবিয়া দেখিলে অবাক্ হইয়া যাইতে হয়। আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া যে শত সহস্র
অচেনা লোককে চলিয়া যাইতে দেখিলাম তাহারা প্রত্যেকেই আমাদের মনের মধ্যে রহিয়া গেল।
উপরি উপরি যদি অনেক বার তাহাদের দেখিতাম, তবে তাহারা আমাদের স্মৃতিতে স্পষ্টতর ছাপ
দিতে পারিত এই মাত্র। এইরূপে বাল্যকাল হইতে যাহা কিছু দেখিয়াছি, যাহা কিছু
শুনিয়াছি, যাহা কিছু পড়িয়াছি, সমস্তই আমার হৃদয়ে আছে, তিলার্ধও এড়াইতে পারে নাই।
ছেলেবেলা হইতে কত গ্রন্থের কত হাজার হাজার পাতা পড়িয়াছি, যদিও তাহা আওড়াইতে পারি না
কিন্তু আমাদের হৃদয়ের মুদ্রাকর তাহার প্রত্যেক অক্ষর আমাদের স্মৃতির পটে মুদ্রিত
করিয়া রাখিয়াছে। ইহা মনে করিলে একেবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িতে হয়। যদি আমরা আমাদের এই
অতিবিশাল স্মৃতির স্পষ্ট ও অস্পষ্ট সমস্ত কণ্ঠস্বর একেবারেই শুনিতে পাইতাম, কিছুতেই
নিবারণ করিতে পারিতাম না, তাহা হইলে আমরা কি একেবারে পাগল হইয়া যাইতাম না? ভাগ্যে
আমাদের স্মৃতি তাহার সহস্র মুখে একেবারে কথা কহিতে আরম্ভ করে না, তাহার সহস্র চিত্র
একেবারে উদ্ঘাটন করিয়া দেয় না, তাই আমরা বাঁচিয়া আছি। আমরা আমাদের হৃদয়ের সমস্ত
কার্য্য দেখিতে পাই না বলিয়াই রক্ষা। আমাদের হৃদয়রাজ্যের অনেক বিস্তৃত প্রদেশ
আমাদের নিজের কাছেই যদি অনাবিষ্কৃত না থাকিত, কখন্ আমাদের অনুরাগের প্রথম সূত্রপাত
হইল, কখন্ আমাদের অনুরাগের প্রথম অবসানের দিকে গতি হইল, কখন্ আমাদের বিরাগের
প্রথম আরম্ভ হইল, কখন্ আমাদের বিষাদের প্রথম অঙ্কুর উঠিল, তাহা সমস্ত যদি আমরা
স্পষ্ট দেখিতাম তাহা হইলে আমাদের মায়া মোহ অনেকটা ছুটিয়া যাইত বটে, কিন্তু সেই
সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সুখশান্তিও অবসান হইত।
এক এক জন লোক আছে, তাহারা যতক্ষণ একলা থাকে ততক্ষণ কিছুই নহে, একটা শূন্য (০) মাত্র, কিন্তু একের সহিত যখনি যুক্ত হয় তখনি দশ (১০) হইয়া পড়ে। একটা আশ্রয় পাইলে তাহারা কি না করিতে পারে! সংসারে শত সহস্র 'শূন্য' আছে, বেচারীদের সকলেই উপেক্ষা করিয়া থাকে— তাহার একমাত্র কারণ সংসারে আসিয়া তাহারা উপযুক্ত 'এক' পাইল না, কাজেই তাহাদের অস্তিত্ব না থাকার মধ্যেই হইল। এই সকল শূন্যদের এক মহা দোষ এই যে, পরে বসিলে ইহারা ১কে ১০ করে বটে, কিন্তু আগে বসিলে দশমিকের নিয়মানুসারে ১কে তাহার শতাংশে পরিণত করে (.০১) অর্থাৎ ইহারা অন্যের দ্বারায় চালিত হইলেই চমৎকার কাজ করে বটে, কিন্তু অন্যকে চালনা করিলে সমস্ত মাটি করে। ইহারা এমন চমৎকার সৈন্য যে মন্দ সেনাপতিকেও জিতাইয়া দেয়, কিন্তু এমন খারাপ সেনাপতি যে ভাল সৈন্যদেরও হারাইয়া দেয়। স্ত্রী-মর্যাদা-অনভিজ্ঞ গোঁয়ারগণ বলেন যে, স্ত্রীলোকেরা এই শূন্য। ১এর সহিত যতক্ষণ তাহারা যুক্ত না হয় ততক্ষণ তাহারা শূন্য। কিন্তু ১এর সহিত বিধিমতে যুক্ত হইলে সে ১কে এমন বলীয়ান করিয়া তুলে যে, সে দশের কাজ করিতে পারে। কিন্তু এই শূন্যগণ যদি ১এর পূর্বে চড়িয়া বসেন তবে এই ১বেচারীকে তাহার শতাংশে পরিণত করেন। স্ত্রৈণ পুরুষের আর এক নাম .০১। কিন্তু এই অযৌক্তিক লোকদের সঙ্গে আমি মিলি না।
আমি দেখিতেছি মহিলারা রাগ করিতেছেন, অতএব স্ত্রৈণ কাহাকে বলে তাহার একটা মীমাংসা করা আবশ্যক বিবেচনা করিতেছি। এই কথাটা সকলেই ব্যবহার করেন, কিন্তু ইহার অর্থ অতি অল্প লোকেই সর্বতোভাবে বুঝেন। যে ব্যক্তি স্ত্রীকে কিছু বিশেষরূপ ভালোবাসে সাধারণতঃ লোকে তাহাকেই স্ত্রৈণ বলে। কিন্তু বাস্তবিক স্ত্রৈণ কে? না, যে ব্যক্তি স্ত্রীকে আশ্রয় দিতে পারে না, স্ত্রীর উপর নির্ভর করে। বলিষ্ঠ পুরুষ হইয়াও অবলা নারীকে ঠেসান দিয়া থাকে! যে ব্যক্তি পড়িয়া গেলে স্ত্রীকে ধরিয়া উঠে, মরিয়া গেলে স্ত্রীকে লইয়া মরে; যে ব্যক্তি সম্পদের সময় স্ত্রীকে পশ্চাতে রাখে ও বিপদের সময় স্ত্রীকে সম্মুখে ধরে; এক কথায় যে ব্যক্তি "আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি" ইহাই সার বুঝিয়াছে, সেই স্ত্রৈণ। অর্থাৎ ইহারা সমস্তই উল্টাপাল্টা করে। ইংরাজ জাতিরা স্ত্রৈণের ঠিক বিপরীত। কারণ, তাহারা স্ত্রীকে হাত ধরিয়া গাড়িতে উঠাইয়া দেয়, স্ত্রীর মুখে আহার তুলিয়া দেয়, স্ত্রীকে ছাতা ধরে ইত্যাদি। তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে এতই দুর্ব্বল মনে করে যে, সকল বিষয়েই তাহাদিগকে সাহায্য করে। ইহাদিগকে দেখিয়া স্ত্রৈণ জাতি মুখে কাপড় দিয়া হাসে ও বলে "ইংরাজেরা কি স্ত্রৈণ। কোথায় গর্ম্মি হইলে স্ত্রী সমস্ত রাত জাগিয়া তাহাকে বাতাস দিবে, না, সে স্ত্রীকে বাতাস দেয়! কোথায় যতক্ষণ না বলিষ্ঠ পুরুষদের তৃপ্তিপূর্ব্বক আহার নিঃশেষ হয় ততক্ষণ অবলা জাতিরা উপবাস করিয়া থাকিবে, না, বলীয়ান্ পুরুষ হইয়া অবলার মুখে আহার তুলিয়া দেয়! ছি ছি, কি লজ্জা! এমন যদি হইল তবে আর বল কিসের জন্য!"