ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
দয়ালু মাংসাশী
বাঙ্গালীদের মাংস খাওয়ার পক্ষে অনেকগুলি যুক্তি আছে, তাহা
আলোচিত হওয়া আবশ্যক। আমার বিশ্বজনীন প্রেম, সকলের প্রতি দয়া এত প্রবল যে, আমি মাংস
খাওয়া কর্ত্তব্য কাজ মনে করি। আমাদের দেশের প্রাচীন দার্শনিক বলিয়া গিয়াছেন, আমাদের
এই অসম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব পূর্ণ-আত্মার মধ্যে লীন করিয়া দেওয়াই সাধনার চরম
ফল! পূর্ণতর জীবের মধ্যে অপূর্ণতর জীবের নির্ব্বাণমুক্তি প্রার্থনীয় নহে ত কি? একটা
পশুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্য আর কি হইতে পারে যে, সে মানুষ হইয়া গেল; মানুষের
জীবনীশক্তিতে অভাব পড়িলে একটা পশু তাহা পূরণ করিতে পারিল; মানুষের দেহের মধ্যে
প্রবেশ করিয়া মিলাইয়া গিয়া মানুষের রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা, সুখ, স্বাস্থ্য,
উদ্যম তেজ নির্ম্মাণ করিতে পারিল, ইহা কি তাহার সাধারণ সৌভাগ্যের বিষয়! প্রথমত সে
নিজে স্বপ্নের অগোচর সম্পূর্ণতা লাভ করিল, দ্বিতীয়তঃ মানুষের মতো একটা উন্নত জীবকে
সম্পূর্ণতর করিল। ছাগলদের মধ্যে এমন দার্শনিক কি আজ পর্য্যন্ত কেহ জন্মায় নাই, যে
তাহার লম্বা দাড়ি নাড়িয়া সমবেত শিষ্যশিশুবর্গকে এই নির্ব্বাণমুক্তির সম্বন্ধে
ব্যাকরণ-শুদ্ধ উপদেশ দেয়! আহা, যদি কেহ এমন ছাগহিতৈষী জন্মিয়া থাকে তবে তাহার নিকট
আমার ঠিকানাটা পাঠাইয়া দিই এবং সেই সঙ্গে লিখিয়া দিই যে, জ্ঞানালোকিত ইয়ং-ছাগদের
মধ্যে যাঁহার মুক্তিকামনা আছে তিনি উক্ত ঠিকানায় আগমন করিলে সদয়হৃদয় উপস্থিত লেখক
মহাশয় তাঁহাকে মুক্তিদানপূর্ব্বক বাধিত করিতে প্রস্তুত আছেন। যাহা হউক, পশুদের
উপকার করিবার জন্য, ব্যয়সাধ্য হইলেও, দয়ার্দ্রচিত্ত লোকদের মাংস খাওয়া কর্তব্য।
আমাদের দেশে এমন অনেক পণ্ডিত আছেন যাঁহাদের মত এই যে, ভারতবর্ষীয়েরা ইংরাজত্ব
অর্থাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া যদি ইংরাজদের মধ্যে একেবারে লীন হইয়া যাইতে পারে, তবে
সুখের বিষয় হয়।
বিখ্যাত ইংরাজ কবি বলিয়াছেন যে, আমরা বোকা জানোয়ারের মাংস খাই,
যেমন ছাগল, ভেড়া, গরু। অধিক উদাহরণের আবশ্যক নাই— মুসলমানেরা আমাদের খাইয়াছেন,
ইংরাজেরা আমাদের খাইতেছেন। যদি প্রমাণ হইল যে, আমরা বোকা জানোয়ারের মাংস খাইয়া
থাকি, তবে দেখা যাক— বোকা জানোয়ারেরা কি খায়। তাহারা উদ্ভিজ্জ খায়। অতএব উদ্ভিজ্জ
যাহারা খায় তাহারা বোকা। এমন দ্রব্য খাইবার আবশ্যক? নির্ব্বোধদের আমরা গাধা, গরু,
মেড়া, হস্তিমূর্খ কহিয়া থাকি। কখনো বিড়াল, ভল্লুক, সিংহ, ব্যাঘ্রমূর্খ বলি না।
উদ্ভিজ্জভোজীদের এমন নাম খারাপ হইয়া গিয়াছে যে, বুদ্ধির যথেষ্ট লক্ষণ প্রকাশ করিলেও
তাহাদের দুর্নাম ঘুচে না। নহিলে "বাঁদর" বলিয়া সম্ভাষণ করিলে লোকে কেন মনে করে,
তাহাকে নির্ব্বোধ বলা হইল? পশুদের মধ্যে বানরের বুদ্ধির অভাব বিশেষ লক্ষিত হয় নাই,
তাহার একমাত্র অপরাধ সে বেচারী উদ্ভিদ্ভোজী। অতএব অনর্থক এমন একটা দুর্নামভাজন
হইয়া থাকিবার আবশ্যক কি? আর একটা কথা— উদ্ভিদ্ভোজী ভারতবর্ষকে ইংরাজ-শ্বাপদেরা
দিব্য হজম করিতে পারিয়াছেন; কিন্তু পাকযন্ত্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকাতে মাংসাশী
কান্দাহার গ্রাস করিলেন, ভাল হজম হইল না; পেটের মধ্যে বিষম গোলযোগ বাধাইয়া দিল।
মাংসাশী জুলুভূমি ও ট্রান্সবাল পেটে মূলেই সহিল না, আহার করিতে চেষ্টা করিতে গিয়া
মাঝের হইতে বলহানি হইল, রোগ হইবার উপক্রম হইল। অতএব মাসাংশী প্রাণীর লোভ এড়াইতে যদি
ইচ্ছা থাকে, তবে মাংসাশী হওয়া আবশ্যক। নহিলে আত্মত্ব বিসর্জ্জন করিয়া পরের দেহের
রক্ত নির্মাণ করাই আমাদের চরম সিদ্ধি হইবে। মাংস খাইবার এক আপত্তি আছে যে, শাস্ত্রে
মাংসকে অপবিত্র বলে। কিন্তু সে কোনো কাজের কথাই নহে। শাস্ত্রেই আছে, মেদিনী মাংসেই
নির্মিত। আমরা মাংসের উপরেই বাস করি। এ মাংসের পৃথিবীতে মাংসেরই জয়।
পূর্ব্বাকালে
মহারাজ জনকের রাজ্যে এক ব্রাহ্মণ কোন গুরুতর অপরাধ করাতে জনকরাজ তাঁহাকে শাসন
করিবার নিমিত্ত কহিয়াছিলেন, "হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার অধিকার-মধ্যে বাস করিতে
পারিবেন না।" মহাত্মা জনক এইরূপ আজ্ঞা করিলে ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্বক
কহিলেন, "মহারাজ, কোন্ কোন্ স্থানে আপনার অধিকার আছে আপনি তাহা নির্দ্দেশ করুন;
আমি অবিলম্বেই আপনার বাক্যানুসারে সেই সমুদয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া অন্য রাজার
রাজ্যে গমন করিব।" ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে, মহারাজ জনক তাহা শ্রবণ করিয়া
দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ-পূর্বক মৌনভাবে চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ রাহুগ্রস্ত
দিবাকরের ন্যায় মহামোহে সমাক্রান্ত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহার মোহ অপনীত হইলে
ব্রাহ্মণকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, "ভগবন্, যদিও এই পুরুষপরম্পরাগত রাজ্য আমার
বশীভূত রহিয়াছে, তথাপি আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, পৃথিবীস্থ কোনো পদার্থেই
আমার সম্পূর্ণ অধিকার নাই। আমি প্রথমে সমুদয় পৃথিবীতে, তৎপরে একমাত্র মিথিলানগরীতে,
ও পরিশেষে স্বীয় প্রজামণ্ডলী-মধ্যে আপনার অধিকার অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোন
পদার্থেই আমার স্বত্ব প্রতীত হইল না।"
—কালীসিংহের অনুবাদিত মহাভারত । আশ্বমেধিক পর্ব
। অনুগীতা পর্বাধ্যায় ।
দ্বাত্রিংশত্তম অধ্যায় । পৃ ৪২
জনক রাজার উক্তির তাৎপর্য এই যে, যাহা কিছুকে আমরা আমার বলি তাহার কিছুই আমার নয়। আমার সহিত তাহাদের ন্যূনাধিক সম্বন্ধ আছে এই পর্য্যন্ত, কিন্তু তাহাদের প্রতি আমার কিছু মাত্র অধিকার নাই। আমরা ষষ্ঠীকে যে সম্বন্ধ-কারক বলি তাহা অতি যথার্থ, কিন্তু ইংরাজেরা যে তাহাকে Possessive Case বলে তাহা অতি ভুল। মানুষের ব্যকরণে সম্বন্ধ-কারক আছে কিন্তু Possessive Case নাই। একটি পরমাণুও আমরা সম্পূর্ণ ভোগ করিতে পারি না, সম্পূর্ণ জানিতে পারি না, ধ্বংস করিতে পারি না, নিয়মিত কালের অধিক রাখিতে পারি না। এমন কি, আমাদের শরীর ও মনের সহিত আমাদের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু তাহাদের উপর আমাদের অধিকার নাই। আমরা নিতান্ত দরিদ্র, একটি ধনীর প্রাসাদে বাস করিতেছি। তিনি আমাদিগকে তাঁহার কতকগুলি গৃহসজ্জা ব্যবহার করিতে দিয়াছেন মাত্র। একটি মন দিয়াছেন, একটি শরীর দিয়াছেন, আরো কতকগুলি ব্যবহার্য পদার্থ দিয়াছেন। তাহার একটিকেও আমরা ভাঙিতে পারি না, স্থানান্তর করিতে পারি না। যদি তাহা করিতে চেষ্টা করি, তৎক্ষণাৎ তাহার শাস্তি ভোগ করিতে হয়। যদি কখনো ভ্রমক্রমে আমরা মনে করি 'আমার শরীর আমার' ও সেই মনে করিয়া তাহার প্রতি যথেচ্ছাচার করি, তৎক্ষণাৎ রোগ আসিয়া তাহার শাস্তি দেয়। এই জন্যই আমার শরীরকে পরের শরীরের মত অতি সন্তর্পণে রাখিতে হয়, যেন কে তাহা আমার জিম্মায় রাখিয়াছে; সর্ব্বদা সশঙ্কিত, পাছে তাহাতে আঘাত লাগে, পাছে তাহাতে আঁচড় পড়ে, পাছে তাহা মলিন হয়। মনকে যদি তুমি মনে কর 'আমার' ও তাহার প্রতি যথেচ্ছা ব্যবহার কর, তবে চিরজীবন মনের যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। এই জন্য আমরা মনকে অতি সাবধানে রাখি, একটি কঠোর হস্ত তাহাকে ছুঁইবামাত্র আমরা সশঙ্কিত হইয়া উঠি। মন যদি আমার নয়, শরীর যদি আমার নয় ত কে আমার?
জনক রাজা কহিলেন, "এক্ষণে আমার মোহ নির্মুক্ত হওয়াতে আমি নিশ্চয়
বুঝিতে পারিয়াছি যে, কোন পদার্থেই আমার অধিকার নাই, অথবা আমি সমুদয় পদার্থেরই
অধিকারী। আমার আত্মাও আমার নহে; অথবা সমুদয় পৃথিবীই আমার। ফলত ইহলোক সকল বস্তুতেই
সকলের সমান অধিকার বিদ্যমান রহিয়াছে।"—
—মহাভারত । আশ্বমেধিক পর্ব । অনুগীতা পর্বাধ্যায় । দ্বাত্রিংশত্তম অধ্যায় । পৃ ৪৩
জনক রাজার উপরি-উক্ত উক্তি লইয়া একটা তর্ক উপস্থিত হইল, নিম্নে
তাহা প্রকাশ করিলাম।
আমি। যাহা কিছু আমি দেখিতে পাই, সকলি আমার।
তুমি। সে কিরকম কথা?
আমি। নহে ত কি? যে গুণে তুমি একটা পদার্থকে আমার বলো, সে গুণটি
কি?
তুমি। অন্য সকলে যে পদার্থকে উপভোগ করিতে পায় না, অথবা আংশিক
ভাবে পায়, আমিই কেবল যাহাকে সর্ব্বতোভাবে উপভোগ করিতে পাই, তাহাই আমার।
আমি। পৃথিবীতে এমন কি পদার্থ আছে, যাহাকে আমরা সর্ব্বতোভাবে
উপভোগ করিতে পারি? কোনটার ঘ্রাণ, কোনটার শব্দ, কোনটার স্বাদ, কোনটার দৃশ্য, কোনটার
স্পর্শ আমরা ভোগ করি, অথবা একাধারে ইহাদের দুই-তিনটাও ভোগ করিতে পারি। কিংবা হয়ত
ইহাদের সকলগুলিকেই এক পদার্থের মধ্যে পাইলাম, কিন্তু তবু তাহাকে সর্ব্বতোভাবে উপভোগ
করিতে পারি কই? জগতে আমরা কিছুই সর্ব্বতোভাবে জানি না, একটি তৃণকেও না— তবে
সর্ব্বতোভাবে ভোগ করিব কি করিয়া? কে বলিতে পারে আমাদের যদি আর একটি ইন্দ্রিয় থাকিত
তবে এই তৃণটির মধ্যে দৃষ্টি স্বাদ গন্ধ স্পর্শ প্রভৃতি ব্যতীতও আরো অনেক উপভোগ্য
গুণ দেখিতে না পাইতাম?
তুমি। তুমি অত সূক্ষ্মে গেলে চলিবে কেন? "সর্বতোভাবে উপভোগ
করা"র অর্থ এই যে, মানুষের পক্ষে যত দূর সম্ভব তত দূর উপভোগ করা।
আমি। এ স্থলে তুমি উপভোগ শব্দ ব্যবহার করিয়া অতিশয় ভ্রমাত্মক
কথা কহিতেছ। প্রচলিত ভাষায় স্বত্ব থাকা, উপভোগ করা, উভয়ের এক অর্থ নহে। মনে কর একজন
হতভাগ্য নিজে ভাঙ্গা ঘরে কুশ্রী পদার্থের মধ্যে বাস করে ও গৌরাঙ্গ প্রভুদের জন্য
একটি অট্টালিকা ভাল ভাল ছবি, রঙ্গীন কার্পেট ও ঝাড়-লণ্ঠন দিয়া সুসজ্জিত করিয়া
রাখিয়াছে— সে অট্টালিকা, সে ছবি, সে উপভোগ করে না বলিয়াই কি তাহা তাহার নহে?
তুমি। উপভোগ করে না বটে, কিন্তু ইচ্ছা করিলেই করিতে পারে।
আমি। সে কথা নিতান্তই ভুল, যদি সে কোন অবস্থায় ছবি উপভোগ করিতে
পারিত তবে তাহা নিজের ঘরেই টাঙ্গাইত। মূর্খ একটি বই কিনিয়া কোন মতেই তাহা বুঝিতে না
পারুক, তথাপি সে বইটিকে আপনার বলিতে সে ছাড়িবে না।
তুমি। আচ্ছা, উপভোগ করা চুলায় যাউক। যে বস্তুর উপর
সর্ব্বসাধারণের অপেক্ষা তোমার অধিক ক্ষমতা খাটে, যে বইটিকে তুমি ইচ্ছা করিলে অবাধে
পোড়াইতে পার, রাখিতে পার, দান করিতে পার, অন্যের হাত হইতে কাড়িয়া লইতে পার, তাহাতেই
তোমার অধিকার আছে।
আমি। তবুও কথাটা ঠিক হইল না। শারীরিক ক্ষমতাকেই ত ক্ষমতা বলে
না। মানসিক ক্ষমতা তদপেক্ষা উচ্চশ্রেণীস্থ। তাহা যদি স্বীকার কর, তাহা হইলে তোমার
ভ্রম সহজেই দেখিতে পাইবে। তুমি অরসিক, তোমার বাগানের গাছ হইতে একটি গোলাব ফুল
তুলিয়াছ, তোমার হাতে সেটি রহিয়াছে, আমি দূর হইতে দেখিতেছি। তুমি ইচ্ছা করিলে সে
গোলাবটি ছিঁড়িয়া কুটিকুটি করিতে পার, সে ক্ষমতা তোমার আছে, কিন্তু সে গোলাবটির
সৌন্দর্য্য উপভোগ করিবার ক্ষমতা তোমার নাই—ইচ্ছা করিলে আর সব করিতে পার, কিন্তু
মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে উপভোগ করিতে পার না— আর, আমি তাহাকে ছিঁড়িতে পারি না
বটে, কিন্তু দূর হইতে দেখিয়া তাহার সৌন্দর্য উপভোগ করিতে পারি। তাহার গোলাব
ছিঁড়িবার ক্ষমতা আছে, আমার গোলাব উপভোগ করিবার ক্ষমতা আছে, কোন্ ক্ষমতাটি গুরুতর?
তবে কেন সে তাহাকে "আমার গোলাপ" বলে, আর আমি পারি না? তবে, গোলাপ সম্বন্ধে যেটি
সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ক্ষমতা আমার তাহা আছে, তবু সে গোলাবের অধিকারী আমি নহি। এ
স্থলে দেখা যাইতেছে, যে বলদ চিনি বহন করিয়া থাকে প্রচলিত ভাষায় তাহাকেই চিনির
অধিকারী কহে। আর যে মানুষ ইচ্ছা করিলেই সে চিনি খাইতে পারে সে মানুষের সে চিনিতে
অধিকার নাই।
তুমি হয়ত বলিবে, যাহার উপর আমাদের শারীরিক ক্ষমতা খাটে, চলিত
ভাষায় তাহাকেই "আমার" কহে। তাহাও ঠিক নহে, যাহার সহিত আমার হৃদয়ে হৃদয়ে যোগ আছে
তাহাকেও ত আমি "আমার" কহি।
তুমি। আচ্ছা, আমি হার মানিলাম। কিন্তু তুমি কি সিদ্ধান্ত করিলে
শুনি।
আমি। যে কোনো পদার্থ আমরা দেখি, শুনি, ইন্দ্রিয় বা হৃদয় দিয়া
উপলব্ধি করি, তাহাই আমাদের। তুমি যে ফুলকে "আমার" বল তুমি তাহাকে দেখিতে পার,
স্পর্শ করিতে পার, ঘ্রাণ করিতে পাও; আমি আর কিছু পাই না, কিন্তু যদি তাহাকে দেখিতে
পাই, তবে সে মুহূর্ত্তেই তাহার সহিত আমার সম্বন্ধ বাধিয়া গেল, সে সম্বন্ধ হইতে কেহ
আমাকে আর বঞ্চিত করিতে পারিবে না! তুমিও তাহার সব পাও নি, আমিও তাহার সব পাই নি,
কারণ মানুষের পক্ষে তাহা অসম্ভব; তুমিও তাহার কিছু পাইলে, আমিও তাহার কিছু পাইলাম,
অতএব তোমারও সে, আমারও সে। এই জন্য জনক কহিয়াছিলেন, "কোন পদার্থেই আমার অধিকার নাই,
অথবা সমুদয় পদার্থেরই অধিকারী আমি। ফলতঃ ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার
রহিয়াছে।" সন্ধ্যা বা উষাকে কেহ "আমার সন্ধ্যা" "আমার উষা" বলে না কেন? যদি বল
তাহার কারণ তাহারা সকল মানুষের পক্ষে সমান, তাহা হইলে ভুল বলা হয়। আমি সন্ধ্যাকে
তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক উপভোগ করি,অতএব সেই উপভোগ- ক্ষমতার বলে তোমাদের কাছ হইতে
সন্ধ্যার দখলি-স্বত্ব কাড়িয়া লইয়া সন্ধ্যাকে বিশেষ করিয়া "আমার সন্ধ্যা" বলি না
কেন? তাহার কারণ আমি সন্ধ্যাকে সর্বপ্রকারে অধিক উপভোগ করিতেছি বটে, কিন্তু তাই
বলিয়া তোমাদের কাছ হইতে সে তো একেবারে ঢাকা পড়ে নাই। এইরূপে একটা পদার্থকে কেহ-বা
কিছু উপভোগ করে, কেহ-বা অধিক উপভোগ করে, কিন্তু সে পদার্থটা তাহাদের উভয়েরই।