ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
ফল ফুল
পাঠক-খরিদ্দার লেখক-ব্যাপারীর প্রতি— "কেন হে, আজকাল তোমার
এখানে তেমন ভালো ভাব পাওয়া যায় না কেন?"
লেখক— "মহাশয়, আমার এ ফল ফুলের দোকান। মিঠাই মণ্ডার নহে, যে,
নিজের হাতে গড়িয়া দিব। আমার মাথার জমিতে কতকগুলো গাছ আছে। আপনি আমার সঙ্গে
বন্দোবস্ত করিয়াছেন, আপনাকে নিয়মিত ফল ফুল যোগাইতে হইবে। কিন্তু ঠিক নিয়ম-অনুসারে
ফল ফুল ফলেও না, ফুটেও না; কখন্ ফলে, কখন্ ফুটে বলিয়া অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হয়।
কিন্তু তাহা করিলে চলে না, আপনি প্রত্যহ তাগাদা করিতে থাকেন, কই হে , ফুল কই, ফল
কই? ফল ধোঁয়া দিয়া বলপূর্বক পাকাইতে হয়, কাজেই আপানারা গাছপাকা ভাবটি পান না। এমন
একটা প্রবন্ধ তৈরি হয়, তাহার আঁঠির কাছটা হয়ত টক, খোসার কাছে হয়ত ঈষৎ মিষ্ট; তাহার
এক জায়গায় হয়ত থল্থোলে, আর এক জায়গায় হয়ত কাঁচা শক্ত। ফুল ছিঁড়িয়া ফোটাইতে হয়;
এমন একটা কবিতা তৈরি হয় যাহার ভালোরূপ রঙ্ ধরে নাই, গন্ধ জন্মে নাই, পাপ্ড়িগুলি
কোঁকড়ানো। রহিয়া বসিয়া কিছু করিতে পারি না, সমস্তই তাড়াতাড়ি করিতে হয়। দেখুন দেখি
গাছে কত কুঁড়ি ধরিয়াছে! কি দুঃখ যে, গাছে রাখিয়া ফুটাইতে পারি না! আমাদের দেশীয়
কন্যার পিতারা যেমন মেয়েকুঁড়ি গাছে রাখিতে পারেন না, ৮ বৎসরের কুঁড়িটিকে ছিঁড়িয়া
বিবাহ দিয়া বলপূর্ব্বক ফুটাইয়া তুলেন ও বেচারীদের বিশ বৎসরের মধ্যে ঝরিয়া পড়িবার
লক্ষণ প্রকাশিত হয়। আমার বলপূর্ব্বক-ফোটান’ কবিতার কুঁড়িগুলিও দেখিতে দেখিতে ঝরিয়া
পড়ে। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও আমার আর একটা আপ্শোষ আছে; আমার যে কুঁড়িগুলি ফুটিল না
সেগুলি যদি ফুটিত, যে মুকুলগুলি ঝরিয়া গেল তাহাতে যদি ফল ধরিত, তবে কি কীর্ত্তীই
লাভ করিতাম!"
মাছ ধরা
উপরের কথা হইতে একটা দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়িতেছে। ভাবের সরোবরে আমরা জাল ফেলিয়া মাছ ধরিতে পারি না; ছিপ ফেলিয়া ধরিতে হয়। মাছ ধরিবার জাল আবিষ্কার হয় নাই; জানি না, কোন কালে হইবে কি না। ছিপ ফেলিয়া বসিয়া আছি, কখন্ মাছ আসিয়া ঠোক্রায়; কিন্তু ঠোক্রাইলেই হইল না, মাছকে ডাঙ্গায় তোলাই আসল কাজ। জলের মধ্যে অনেক ভাব্ কিল্বিল্ করিয়া থাকে, কিন্তু তাহাদের ডাঙ্গায় উঠাইয়া তোলা সাধারণ ব্যাপার নহে। ঠোক্রাইল, বঁড়শি লাগিল না; বঁড়শি লাগিল, ছিঁড়িয়া পলাইল। অনেক মাছ যতক্ষণ জলে আছে, যতক্ষণ খেলাইতেছি, ততক্ষণ মনে হইতেছে প্রকাণ্ড; তুলিয়া দেখি, যত বড় মনে হইয়াছিল তত বড়টা নয়। ভাব আকর্ষণ করিবার জন্য কত প্রকার চার ফেলিতে হয়, কত কৌশল করিতে হয়, তাহা ভাবব্যবসায়ীরা জানেন। জল নাড়া না পায়, খুব স্থির থাকে; ভাব যখন বঁড়শিবিদ্ধ হইল তবুও জোর করিতেছে, উঠিতেছে না, তখন যেন অধীর হইয়া টানাহেঁচড়া করিয়া উঠাইবার চেষ্টা না করা হয়— তাহা হইলে সূতা ছিঁড়িয়া যায়— যথেষ্ট খেলাইয়া আয়ত্ত করিয়া তুলিবে। আমরা পরের মনঃসরোবর হইতেও মাছ তুলিয়া থাকি। আমার এক সহচর আছেন, তাঁহার পুষ্করিণী আছে কিন্তু ছিপ নাই। অবসরমত আমি তাঁহার মন হইতে মাছ ধরিয়া থাকি, খ্যাতিটা আমার। নানা প্রকার কথোপকথনের চার ফেলিয়া তাঁহার মাছগুলাকে আকর্ষণ করিয়া আনি ও খেলাইয়া খেলাইয়া জমিতে তুলি।
এক জন কবি স্মৃতি সম্বন্ধে
বলিতেছেন যে, জীবনের প্রতি বিধাতার এ কি অভিশাপ যে, কাহারও প্রতি অনুরাগ বা কোন
একটা প্রবৃত্তি ভুলিয়া যাওয়া যখন আমাদের আবশ্যক হয়— মহত্তর উন্নততর প্রশান্ততর
কর্ত্তব্য আসিয়া যখন আদেশ করে 'ভুলিয়া যাও'— তখন আমরা ভুলি না; কিন্তু প্রতি
মুহূর্ত, প্রতি দিন, সামান্য ঘটনার তুচ্ছ ধূলিকণাসমূহ আনিয়া আমাদের স্মৃতি ঢাকিয়া
দেয় ও অবশেষে আমরা ভুলি; ভুলিতেই হইবে বলিয়া ভুলি, ভুলিতে চাহিয়াছিলাম বলিয়া ভুলি
না। — বাস্তবিক, এ কি দুঃখ! আমরা নিজের মনের উপর নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করিলাম, সে
কোনো কাজে লাগিল না, আর আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বহিঃস্থিত সামান্য কতকগুলা জড় ঘটনা
সেই কাজ সিদ্ধ করিল! একটা কেন, এমন সহস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। এক জন সর্ব্বতোভাবে
ভালবাসিবার যোগ্যপাত্র— জানি তাহাকে ভালবাসিলে সুখী হইব ও আমার সকল বিষয়ে মঙ্গল
হইবে— প্রতিনিয়ত ইচ্ছা করিয়াও তাহাকে ভালবাসিতে পারিলাম না। আর এক জনকে ভালবাসিলাম
কেন? না, তাহার সঙ্গে কি লগ্নে, কি মাহেন্দ্র ক্ষণে দেখা হইয়াছিল, তাহার কি একটি
সামান্য কথার ভাব,কি একটি তুচ্ছ ভাবের আধখানা মাত্র দেখিয়াছিলাম, বলা নাই কহা নাই,
ব্যস্তসমস্ত হইয়া একেবারে সমস্ত হৃদয়টা তাহার পায়ের তলায় ফেলিয়া দিলাম। কোনো লেখক
যখন কেবলমাত্র ইচ্ছাকে ভাব শিকার করিতে পাঠান, তখন ইচ্ছার পায়ের শব্দ পাইলেই ভাবেরা
কে কোথায় পলাইয়া যায় তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না ও সমস্ত দিনের পর শ্রান্ত ইচ্ছা
তাহার বড় বড় কামান বন্দুক ফেলিয়া কপালের ঘর্ম্মজল মুছিতে থাকে, অথচ
কোথা-হইতে-কি-একটা সামান্য বিষয় সহসা ভাসিয়া বিনা আয়াসে এক মুহূর্ত্তের মধ্যে শত
সহস্র জীবন্ত ভাব আনিয়া উপস্থিত করে ও ইচ্ছার পশ্চাতে করতালি দিতে থাকে। কবিদের
জিজ্ঞাসা কর, তাঁহাদের কত বড় বড় ভাব দৈবাৎ কথার মিল করিতে গিয়া মনে পড়িয়াছে, ইচ্ছা
করিলে মনে পড়িত না। মানুষের অনেক বড় বড় আবিষ্ক্রিয়ার মূল অনুসন্ধান করিতে যাও,
দেখিবে— একটা সামান্য একরত্তি ব্যাপার।
দেখা যাইতেছে আমাদের ইচ্ছা বলিয়া একটা বিষম দাম্ভিক ব্যক্তিকে
আমাদের মন-গাঁয়ে অতি অল্প লোকেই মানিয়া থাকে, অথচ সে এক জন আপনি-মোড়ল। ছোট ছোট
কতকগুলি সামান্য বিষয়ের উপর তাঁহার আধিপত্য, অথচ সকলকেই তিনি আদেশ করিয়া বেড়ান।
একটা কাজ সমাধা হইলে তিনি জাঁক করিয়া বেড়ান 'এ কাজের কল আমি টিপিয়া দিয়াছিলাম'। অথচ
কত ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম বিষয় তাঁহার নিজের কল টিপিয়া দিয়াছে তাহার খবর রাখেন না।
তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখে, তিনি দেখিতেছেন দুচ্ছেদ্য লৌহের লাগাম দিয়া সমস্ত কাজকে
তিনি চালাইয়া বেড়াইতেছেন, পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখেন না তাঁহাকে কে মাকড়্ষার জালের
চেয়ে সূক্ষ্মতর তুচ্ছতর সহস্র সূত্রে বাঁধিয়া নিয়মিত করিতেছে! মনে করিতে কষ্ট হয়—
কত অল্প বিষয়ই আমাদের ইচ্ছার অধীন ও কত সহস্র ক্ষুদ্র বিষয়ের অধীন আমাদের ইচ্ছা!