ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
জগৎ একটি প্রকাণ্ড পীড়া। অস্বাস্থ্যকে পরাভূত করিবার জন্য
স্বাস্থ্যের প্রাণপণ চেষ্টাকে বলে পীড়া। জগৎও তাহাই। জগৎও অস্বাস্থ্যকে অতিক্রম
করিয়া উঠিবার জন্য স্বাস্থ্যের উদ্যম। অভাবকে দুর করিবার জন্য পূর্ণতাকাঙ্ক্ষার
উদ্যোগ। সুখ পাইবার জন্য অসুখের বোঝাবুঝি। জীবন পাইবার জন্য মৃত্যুর প্রযত্ন।
অভিব্যক্তিবাদ (
লিখিলে লেখা শেষ হয় না। পুঁথি যে
ক্রমেই বাড়িতে চলিল। আর, সকল কথা লিখিলেই বা পড়িবে কে? কাজেই এইখানেই লেখা সাঙ্গ
করিলাম।
আমার ভয় হইতেছে, পাছে এ লেখাগুলি
লইয়া কেহ তর্ক করিতে বসেন। পাছে কেহ প্রমাণ জিজ্ঞাসা করিতে আসেন। পাছে কেহ ইহাদের
সত্য-অসত্য আবশ্যক-অনাবশ্যক উপকার-অপকার লইয়া আন্দোলন উপস্থিত করেন। কারণ,
এ বইখানি সে ভাবে লেখাই হয় নাই।
ইহা, একটি
মনের কিছুদিনকার ইতিহাস মাত্র। ইহাতে যে সকল মত ব্যক্ত হইয়াছে তাহারা সকলগুলি কি
আমি মানি, না, বিশ্বাস করি? সেগুলি আমার চিরগঠনশীল মনে উদিত হইয়াছিল এইমাত্র। তাহারা
সকলগুলিই সত্য, অর্থাৎ ইতিহাসের হিসাবে সত্য, যুক্তিতে মেলে কি না মেলে সে কথা আমি
জানি না! যুক্তির সহিত না মিলিলে যে একেবারে কোন কথাই বলিব না এমন প্রতিজ্ঞা করিয়া
বসিলে কি জানি পাছে এমন অনেক কথা না বলা হয় যেগুলি আসলে সত্য! কি জানি এমন হয়ত
সূক্ষ্ম যুক্তি থাকিতে পারে, এমন অলিখিত তর্কশাস্ত্র থাকিতে পারে , যাহার সহিত আমার
কথাগুলি কোন না কোন পাঠক মিলাইয়া লইতে পারেন! আর, যদি নাই পারেন ত সেগুলা চুলায়
যাক। তাই বলিয়া প্রকাশ করিতে আপত্তি কি?
আর চুলাতেই বা যাইব কেন? মিথ্যাকে ব্যবচ্ছেদ করিয়া দেখ না,
ভ্রমের বৈজ্ঞানিক দেহতত্ত্ব শিক্ষা কর না। জীবিত দেহের নিয়ম জানিবার জন্য অনেক সময়
মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিতে হয়। তেমনি অনেক সময়ে এমন হয় না কি, পবিত্র জীবন্ত সত্যের
গায়ে অস্ত্র চালাইতে কোনমতে মন উঠে না, হৃদয়ের প্রিয় সত্যগুলিকে অসঙ্কোচে কাটাকাটি
ছেঁড়াছেঁড়ি করিতে প্রাণে আঘাত লাগে ও সেই জন্য মৃত ভ্রম মৃত মিথ্যাগুলিকে কাটিয়া
কুটিয়া সত্যের জীবন-তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে হয়!
আর, পূর্ব্বেই বলিয়াছি এ গ্রন্থ মনের ইতিহাসের এক অংশ। জীবনের
প্রতি মুহূর্ত্তে মনের গঠনকার্য্য চলিতেছে। এই মহা শিল্পশালা এক নিমেষ কালও বন্ধ
থাকে না। এই কোলাহলময় পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানবের অদৃশ্য অভ্যন্তরে অনবরত
কি নির্ম্মাণকার্য্যই চলিতেছে ! অবিশ্রাম কত কি আসিতেছে যাইতেছে, ভাঙ্গিতেছে
গড়িতেছে, বর্ধিত হইতেছে, পরিবর্ত্তিত হইতেছে,তাহার ঠিকানা নাই। এই গ্রন্থে সেই
অবিশ্রান্ত কার্যশীল পরিবর্ত্ত্যমান মনের কতকটা ছায়া পড়িয়াছে। কাজেই ইহাতে বিস্তর
অসম্পূর্ণ মত, বিরোধী কথা,ক্ষণস্থায়ী ভাবের নিবেশ থাকিতেও পারে। জীবনের লক্ষণই
এইরূপ। একেবারে স্থৈর্য্য, সমতা ও ছাঁচে-ঢালা ভাব মৃতের লক্ষণ। এই জন্যই মৃত
বস্তুকে আয়ত্তের মধ্যে আনা সহজ। চলন্ত স্বাধীন ক্রীড়াশীল জীবনকে আয়ত্ত করা সহজ
নহে,সে কিছু দুরন্ত। জীবন্ত উদ্ভিদে আজ যেখানে অঙ্কুর, কাল সেখানে চারা; আজ দেখিলাম
সবুজ কিশলয়, কাল দেখিলাম সে পীতবর্ণ পাতা হইযা ঝরিয়া পড়িয়াছে; আজ দেখিলাম কুঁড়ি,
কাল দেখিলাম ফুল, পরশু দেখিলাম ফল। আমার লেখাগুলিকেও সেই ভাবে দেখ । এই গ্রন্থে যে
মতগুলি সবুজ দেখিতেছ, আজ হয়ত সেগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে। ইহাতে যে ভাবের ফুলটি
দেখিতেছ, আজ হয়ত সে ফল হইয়া গিয়াছে, দেখিলে চিনিতে পারিবে না। আমাদের হৃদয়বৃক্ষে
প্রত্যহ কত শত পাতা জন্মিতেছে ঝরিতেছে, ফুল ফুটিতেছে শুকাইতেছে — কিন্তু তাই বলিয়া
তাহাদের শোভা দেখিবে না? আজ যাহা আছে আজই তাহা দেখ, কাল থাকিবে না বলিয়া চোখ বুজিব
কেন? আমার হৃদয়ে প্রত্যহ জন্মিয়াছে, যাহা ফুটিয়াছে,তাহা পাতার মত, ফুলের মত তোমাদের
সম্মুখে প্রসারিত করিয়া দিলাম। ইহারা আমার মনের পোষণকার্য্যের সহায়তা করিয়াছে,
তোমাদেরও হয়ত কাজে লাগিতে পারে।
আমি যখন লিখি তখন আমি মনে করি যাঁহারা আমাকে ভালবাসেন তাঁহারাই
আমার বই পড়িতেছেন। আমি যেন এককালে
শত শত পাঠকের ঘরের মধ্যে বসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেছি। আমি এই বঙ্গদেশের কত
স্থানের কত শত পবিত্র গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছি। আমি যাঁহাদের চিনি না
তাঁহারা আমার কথা শুনিতেছেন, তাঁহারা আমার পাশে বসিয়া আছেন,আমার মনের ভিতরে চাহিয়া
দেখিতেছেন। তাঁহাদের ঘরকন্নার মধ্যে আমি আছি, তাঁহাদের কত শত সুখ দুঃখের মধ্যে আমি
জড়িত হইয়া গেছি! ইঁহাদের মধ্যে কেহই কি আমাকে ভালবাসেন নাই? কোন জননী কি তাঁহার
স্নেহের শিশুকে স্তনদান করিতে করিতে আমার লেখা পড়েন নাই ও সেই সঙ্গে সেই অসীম
স্নেহের কিছু ভাগ আমাকে দেন নাই? সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় আমার মমতা, আমার স্নেহ,
সহসা কি সান্ত্বনার মত কাহারও কাহারও প্রাণে গিয়া প্রবেশ করে নাই ও সেই সময়ে কি
প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে দূর হইতে আমাকে বন্ধু বলিয়া তাঁহারা ডাকেন নাই? কেহ যেন না মনে
করেন আমি গর্ব্ব করিতেছি। আমার যাহা বাসনা তাহাই ব্যক্ত করিতেছি মাত্র। মনে মনে
মিলন হয় এমন লোক সচরাচর কই দেখিতে পাই? এই জন্য মনের ভাবগুলিকে যথাসাধ্য সাজাইয়া
চারি দিকে পাঠাইয়া দিতেছি যদি কাহারো ভাল লাগে! যাঁহারা আমার যথার্থ বন্ধু, আমার
প্রাণের লোক, কেবলমাত্র দৈববশতই যাঁহাদের সহিত আমার কোনো কালে দেখা হয় নাই,
তাঁহাদের সহিত যদি মিলন হয়! সেই সকল পরমাত্মীয়দিগকে উদ্দেশ করিয়া আমার এই প্রাণের
ফুলগুলি উৎসর্গ করি।
আমি কল্পনা করিতেছি, পাঠকদের মধ্যে এইরূপ আমার কতকগুলি অপরিচিত
বন্ধু আছেন, আমার হৃদয়ের ইতিহাস পড়িতে তাঁহাদের ভালো লাগিতেও পারে। তাঁহারা আমার
লেখা লইয়া অকারণ তর্কবিতর্ক অনর্থক সমালোচনা করিবেন না, তাঁহারা কেবল আমাকে চিনিবেন
ও পড়িবেন । যদি এ কল্পনা মিথ্যা হয় ত হৌক, কিন্তু ইহারই উপর নির্ভর করিয়া আমার লেখা
প্রকাশ করি। নহিলে কেবলমাত্র শকুনি গৃধিনীদের দ্বারা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য
নির্ম্মমতার অনাবৃত শ্মশানক্ষেত্রের মধ্যে নিজের হৃদয়খানা কে ফেলিয়া রাখিতে পারে ?
আর, আমার পাঠকদিগের মধ্যে একজন লোককে বিশেষ করিয়া আমার এই
ভাবগুলি উৎসর্গ করিতেছি । — এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরো কিছু দিলাম, সে তুমিই
দেখিতে পাইবে! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই
দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুই
জনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া! এক দিন
সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতি গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে !
কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছু
দিনের গোটাকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক-একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের স্নেহের
চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না! আমার এই লেখার মধ্যে
লেখা রহিল — এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে ।
১৮০৫ শকের ভাদ্র মাসে (১১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ ) 'বিবিধ প্রসঙ্গ' পুস্তকাকারে প্রকাশিত
হয়। তৎপূর্ব্বে ইহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রসঙ্গগুলি ১২৮৮ ও ১২৮৯ সালের 'ভারতী'তে
বাহির হইয়াছিল। কেবল শেষ প্রবন্ধ "সমাপন" নূতন সংযোজন। পুস্তকাকারে প্রকাশের সময়
'ভারতী'র কোনো কোনো অংশ পরিত্যক্ত হয়; বসেগুলি নিম্নে নির্দিষ্ট ও সংযোজিত হইল ।
একেবারে প্রারম্ভে একটু ভূমিকার মত ছিল।—
স্মরণ হইতেছে, ফরাসীস পণ্ডিত প্যাস্কাল একজনকে একটি দীর্ঘ পত্র
লিখিয়া অবশেষে উপসংহারে লিখিয়াছিলেন, —"মার্জ্জনা করিবেন, সময় অল্প থাকাতে বড় চিঠি
লিখিতে হইল, ছোট চিঠি লিখিবার সময় নাই ।" আমাদের হাতে যখন বিশেষ সময় থাকিবে তখন
মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ পাঠকদের উপহার দিব।
—ভারতী, শ্রাবণ ১২৮৮, বিবিপ্রসঙ্গ, পৃ ১৯০
"অনধিকার" ও "অধিকার" প্রসঙ্গের পরে "উপভোগ: শীর্ষক একটি প্রসঙ্গ ছিল । তাহা
এই —
উপভোগ
মনুষ্যের যতদুর উপভোগ করিবার, অধিকার করিবার ক্ষমতা আছে,
স্পর্শেই তাহার চূড়ান্ত। যাহাকে সে স্পর্শ করিতে পারে তাহাকেই সে সর্বাপেক্ষা আয়ত্ত
মনে করে। এই নিমিত্ত ঋষিরা আয়ত্ত পদার্থকে "করতলন্যস্ত আমলকবৎ" বলিতেন। এই জন্য
মানুষেরা ভোগ্য পদার্থকে প্রাণপণে স্পর্শ করিতে চায়। স্পর্শ করিতে পারাই তাহাদের
অভিলাষের উপসংহার। আমাদের হৃদয়ে স্পর্শের ক্ষুধা চির জাগ্রত, এই জন্য যাহা আমরা
স্পর্শ করিতে পারি তাহার ক্ষুধা আমাদের শীঘ্র মিটিয়া যায়, যাহা স্পর্শ করিতে পারি
না তাহার ক্ষুধা আর শীঘ্র মেটে না । কমলাকান্ত চক্রবর্তী তাঁহার দ্বাদশসংখ্যক
দপ্তরে একটি গীতের ব্যাখ্যা করিয়াছেন, সেই গীতের একস্থলে আছে —
"মণি নও মাণিক
নও যে হার করে গলে পরি,
ফুল নও যে কেশের করি বেশ ।"
ইহা মনুষ্যহৃদয়ের কাতর ক্রন্দন। তোমার ঐ রূপ যাহা দেখিতে
পাইতেছি, তোমার ঐ হৃদয় যাহা অনুভব করিতে পারিতেছি, উহা যদি মণির মত মাণিকের মত হইত,
উহা যদি হার করিয়া গলায় পরিতে পারিতাম, বুকের কাছে উহার স্পর্শ অনুভব করিতে
পারিতাম, আহা, তাহা হইলে কি হইত! উহার অর্থ এমন নহে যে "বিধাতা জগৎ জড়ময় করিয়াছেন
কেন? রূপ জড় পদার্থ কেন?" আমরা যখন বঁধুকে স্পর্শ করি, তখন তাহার দেহ স্পর্শ করি
মাত্র। তাহার দেহের কোমলতা, শীতোষ্ণতা অনুভব করিতে পারি মাত্র। কিন্তু তাহার রূপ
স্পর্শ করিতে পারি না ত, তাহার রূপ অনুভব করিতে পারি না ত। রূপ দৃশ্য হইল কেন, রূপ
মণি মাণিকের মত স্পৃশ্য হইল না কেন ? তাহা হইলে আমি রূপের হার করিতাম,রূপ দিয়া
কেশের বেশ করিতাম। যখন কবিরা অশরীরী পদার্থকে শরীরবদ্ধ করেন, তখন আমরা এত আনন্দ লাভ
করি কেন ? কবির কল্পনা-বলে মুহুর্ত্তে আমাদের মনে হয় যেন তাহার শরীর আছে, যেন
তাহাকে আমরা স্পর্শ করিতেছি। আমাদের বহুদিনের আকুল তৃষা যেন আজ মিটিল । যখন রাধিকা
শ্যামের মুখ বর্ণনা করিয়া কহিল "হাসিখানি তাহে ভায়" তখন হাসিকে "হাসিখানি" কহিল
কেন? যেন হাসি একটি স্বতন্ত্র পদার্থ, যেন হাসিকে ছুঁইতে পারি, যেন হাসিখানিকে লইয়া
গলার হার করিয়া রাখিতে পারি! তাহার প্রাণের বাসনা তাহাই! যদি হাসি "হাসিখানি" হইত,
শ্যাম যখন চলিয়া যাইত, তখন হাসিখানিকে লইয়া বসিয়া থাকিতাম! আমাদের অপেক্ষা কবিদের
একটি সুখ অধিক আছে। আমরা যাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না, কল্পনায় তাঁহারা তাহাকে
স্পর্শ করিতে পারেন। উষাকে তাঁহারা বালিকা মনে করেন, সঙ্গীতকে তাঁহারা নির্ঝর মনে
করেন, নবমালিকা ফুলকে তাঁহারা যেরূপ স্পর্শ করিতে পারেন জ্যোৎস্নাকে তাঁহারা সেইরূপ
স্পর্শ করিতে পারেন, এই নিমিত্তই তাঁহারা সাহস করিয়া নবমালিকা লতার "বনজ্যোৎস্না"
নামকরণ করিয়াছেন। পৃথিবীতে আমরা যাহাকে স্পর্শ করিতে পাইয়াছি তাহাকে আর স্পর্শ
করিতে চাই না, যাহাকে স্পর্শ করিতে পাই না তাহাকে স্পর্শ করিতে চাই । এ কি বিড়ম্বনা
!
—ভারতী, বৈশাখ ১২৮৯, বিবিধ প্রসঙ্গ, পৃ ২৭-২৮
"ফল ফুল" প্রসঙ্গের পূর্ব্বে নিমনলিখিত প্রসঙ্গটি ছিল —
অদূরদর্শীরা আক্ষেপ করেন আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ দরিদ্র।
দূরদর্শীরা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলেন আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ দরিদ্র হইতে
শিখিল না। সে দিন আমার বন্ধু ক দুঃখ করিতেছিলেন যে, আমাদের দেশে যথাসংখ্যক উপযুক্ত
মাসিক পত্রিকার নিতান্ত অভাব। পণ্ডিত খ কহিলেন, "আহা, আমাদের দেশে এমন দিন কবে
আসিবে যে দিন উপযুক্ত মাসিক পত্রিকার যথার্থ অভাব উপস্থিত হইবে !" আসল কথা এই যে,
দরিদ্র না হইলে বড়মানুষ হওয়া যায় না । নীচে না থাকিলে উপরে উঠা যায় না। বড়মানুষ নই
বলিয়া দুঃখ করিবার আগে, দরিদ্র নই বলিয়া দুঃখ কর। যাহার অভাব নাই তাহার 'অভাব মোচন
হইল না' বলিয়া বিলাপ করা বৃথা। এখন আমাদের সমাজকে এমন একটা ঔষধ দিতে হইবে যাহা
প্রথমে ঔষধরূপে ক্ষুধা জন্মাইয়া পরে পথ্যরূপে সেই ক্ষুধা মোচন করিবে। একেবারেই
খাদ্য দেওয়ার ফল নাই। আমাদের দেশে যাহারা খাবারের দোকান খোলে তাহারা ফেল হয় কেন ?
আমাদের সমাজে যখনি একখানি মাসিক পত্রের জন্ম হয় তখনি সমাজ রাজপুত পিতার ন্যায়
ভূমিষ্ঠশয্যাতেই তাহাকে বিনাশ করে কেন ? যাহার আবশ্যক কেহ বোধ করে না সে টেকিয়া
থাকিতে পারে না। অতএব আবশ্যকবোধ জন্মে নাই বলিয়াই দুঃখ, দ্রব্যটি নাই বলিয়া নহে ।
—ভারতী, আশ্বিন ১২৮৮, বিবিধ প্রসঙ্গ, পৃ ২৮৪-৮৫
"দ্রুত বুদ্ধি" প্রসঙ্গের নিমেনাদ্ধৃত শেষাংশ পরিত্যক্ত হইয়াছে —
কবিরা এইরূপ অসাধারণ বুদ্ধিমান। তাঁহারা বুঝেন, কিন্তু এত
বিদ্যুৎ-বেগে যুক্তির রাস্তা অতিক্রম করিয়া আসেন যে, রাস্তা মনে থাকে না, কেবল
বুঝেন মাত্র। কাজেই অনেক সমালোচককে রাস্তা বাহির করিবার জন্য জাহাজ পাঠাইতে হয়।
বিষম হাঙ্গামা করিতে হয়। কবি উপস্থিত আছেন, অথচ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তর
দিতে পারেন না। তিনি বসিয়া বসিয়া শুনিতেছেন — কেহ বলিতেছে উত্তরে পথ, কেহ বলিতেছে
দক্ষিণে পথ । দ্রুতগামী কবি সহসা এমন একটা দূর ভবিষ্যতের রাজ্যে গিয়া উপস্থিত হন
যে, বর্ত্তমান কাল তাঁহার ভাবভঙ্গী বুঝিতে পারে না। কি করিয়া বুঝিবে ? বর্ত্তমান
কালকে এক এক পা করিয়া রাস্তা খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেইখানে যাইতে হইবে; কাজেই সে হঠাৎ
মনে করে কবিটা বুঝি পথ হারাইয়া কোন অজায়গায় গিয়া উপস্থিত হইল; কবিরা মহা দার্শনিক।
কেবল দার্শনিকদের ন্যায় তাঁহারা ইচ্ছা করিলে নির্ব্বোধ হইতে পারেন না। কিয়ৎ-পরিমাণে
নির্ব্বোধ না হইলে এ সংসারে বুদ্ধিমান বলিয়া খ্যাতি হয় না ।
—ভারতী, আশ্বিন ১২৮৮, বিবিধ প্রসঙ্গ, পৃ ২৯২