ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
জমা খরচ
এক গণিত লইয়া এত কথা যদি হইল তবে আরো একটা বলি; পাঠকেরা ধৈর্য
সংগ্রহ করুন। পাটীগণিতের যোগ এবং গুণ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য আছে। সংসারের খাতায়
আমরা এক একটা সংখ্যা, আমাদের লইয়া অদৃষ্ট অঙ্ক কষিতেছে। কখন বা শ্রীযুক্ত বাবু ৬এর
সহিত শ্রীমতী ৩এর যোগ হইতেছে, কখন বা শ্রীযুক্ত ১এর সহিত শ্রীমান ১/২এর বিয়োগ
হইতেছে ইত্যাদি। দেখা যায়, এ সংসারে যোগ সর্ব্বদাই হয়, কিন্তু গুণ প্রায় হয় না। গুণ
কাহাকে বলে? না, যোগের অপেক্ষা যাহাতে অধিক যোগ হয়। ৩এ ৩ যোগ করিলে ৬ হয়, ৩এ ৩গুণ
করিলে ৯ হয়। অতএব দেখা যাইতেছে গুণ করিলে যতটা যোগ করা হয়, এমন যোগ করিলে হয় না।
মনোগণিতশাস্ত্রে প্রাণে প্রাণে গুণে গুণে মিলকে গুণ বলে ও সামান্যতঃ মিলন হইলে যোগ
বলে। সামান্যতঃ বিচ্ছেদ হইলে বিয়োগ বলে ও প্রাণে প্রাণে বিচ্ছেদ হইলে ভাগ বলে। বলা
বাহুল্য গুণে যেমন সর্ব্বাপেক্ষা অধিক যোগ হয়, ভাগে তেমনি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক বিয়োগ
হয়। এমন-কি, আমার বিশ্বাস এই যে, অদৃষ্ট পাটীগণিতের যোগ বিয়োগ ও গুণ পর্য্যন্ত
শিখিয়াছে, কিন্তু ভাগটা এখনো শিখে নাই, সেইটে কষিতে অত্যন্ত ভুল করে। মনে কর, ৩কে
২দিয়া গুণ করিয়া ৬ হইল। সেই ৬কে পুনর্ব্বার ২ দিয়া ভাগ কর, ৩ অবশিষ্ট থাকিবে। তেমনি
রাধাকে শ্যাম দিয়া গুণ কর রাধাশ্যাম হইল; আবার রাধাশ্যামকে শ্যাম দিয়া ভাগ কর, রাধা
অবশিষ্ট থাকা উচিত, কিন্তু তাহা থাকে না কেন? রাধারও অনেকটা চলিয়া যায় কেন? শ্যামের
সহিত গুণ হইবার পূর্ব্বে রাধা যাহা ছিল, শ্যামের সহিত ভাগ হইবার পরেও রাধা কেন
পুনশ্চ তাহাই হয় না? অদৃষ্টের এ কেমনতর অঙ্ক কষা! হিসাবের খাতায় এই দারুণ ভুলের
দরুন তো কম লোকসান হয় না! প্রস্তাব-লেখক এইখানে একটি বিজ্ঞাপন দিতেছেন। একটি
অত্যন্ত দুরূহ অঙ্ক কষিবার আছে, এ পর্য্যন্ত কেহ কষিতে পারে নাই । যে পাঠক কষিয়া
দিতে পারিবেন তাঁহাকে পুরস্কার দিব। আমার এই হৃদয়টি একটি ভগ্নাংশ; আর একটি সংখ্যার
সহিত গুণ করিয়া ইহা যিনি পূরণ করিয়া দিবেন তাঁহাকে আমার সর্বস্ব পারিতোষিক দিব।
পাটীগণিত, রেখাগণিত ও বীজগণিতের নিয়মসকল পণ্ডিতগণ বাহির করিলেন; কিন্তু এখনো মনোগণিতে কেহ হস্তক্ষেপ করেন নাই। প্রতিভাসম্পন্ন পাঠকদিগকে বলিয়া রাখিতেছি, একটা আবিষ্কারের পথ এই "উনবিংশ শতাব্দীতেও" গুপ্ত রহিয়াছে। অনেক অশিক্ষিত লোকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত প্রণালী ও নিয়ম না জানিয়াও কেবল বুদ্ধি অভ্যাস ও শুভঙ্করের নিয়মে অঙ্ক কষিতে পারে, তেমনি কবিগণ এত কাল ধরিয়া মনোগণিতের অঙ্ক কষিয়া আসিতেছেন। শকুন্তলা কষিতেছেন, হ্যামলেট কষিতেছেন এবং মহাভারত রামায়ণে অঙ্কের স্তূপ কষিতেছেন। এইরূপ করিয়াই, বোধ করি, ক্রমে মনোগণিতের নিয়মসকল বাহির হইবে। ইহা যে নিতান্ত দুরূহ তাহা বলা বাহুল্য; ফরাসি জাতি, ইংরাজ জাতি, জর্ম্মান জাতি এই মনোগণিতের এক একটা অঙ্কফল। ঐতিহাসিকগণ, কি কি অঙ্কের যোগে বিয়োগে এই সকল অঙ্কফল হইয়াছে তাহাই কষিয়া দেখিতে চেষ্টা করেন। কাহারও ভুল হয়, কাহারও ঠিক হয়, কিন্তু এত বড় অঙ্কবিৎ কেহ নাই যে, ঠিক মীমাংসা করিয়া দিতে পারে। আমাদের মধ্যে অদৃশ্য অলক্ষিতভাবে ভিতরে ভিতরে কী কম অঙ্ক-কষাকষি চলিতেছে! তোমাতে আমাতে মিলন হইল। তোমার খানিকটা আমাতে আসিল, আমার খানিকটা তোমাতে গেল, আমার একটা গুণ হয়ত হারাইলাম, তোমার একটা গুণ হয়ত পাইলাম ও তাহা আমার আর একটা গুণের সহিত মিশ্রিত হইয়া অপূর্ব আকার ধারণ করিল। এইরূপে মানুষ মানুষে ও তাহাই শৃঙ্খলবদ্ধ হইয়া সমস্ত জাতিতে ও অবশেষে জাতিতে জাতিতে যোগ গুণ ভাগ বিয়োগ হইয়া মনুষ্যজাতি-নামক একটা অতি প্রকাণ্ড অঙ্ক কষা হইতেছে। বিপ্লব (Revolution) -নাম কবিতায় Matthew Arnold বলেন যে "মানুষ যখন মর্ত্ত্যলাকে আসিবার উদ্যোগ করিল তখন ঈশ্বর তাহাদের হাতে রাশীকৃত অক্ষর দিলেন ও কহিলেন, এই অক্ষরগুলি যথারীতি সাজাইয়া এক একটা কথা বাহির কর। মানুষেরা অক্ষর উল্টাইয়া পাল্টাইয়া সাজাইতে আরম্ভ করিল; "গ্রীস" লিখিল, "রোম" লিখিল, "ফ্রান্স" লিখিল, "ইংলন্ড" লিখিল। কিন্তু কে ভিতরে ভিতরে বলিতেছে যে, ঈশ্বর যে কথাটি লিখাইতে চান সেটি এখনো বাহির হইল না। এই নিমিত্ত মানুষেরা অসন্তুষ্ট হইয়া এক একবার অক্ষর ভাঙ্গিয়া ফেলে; ইহাকেই বলে বিপ্লব।" কবি যাহা বলিয়াছেন আমি তাহাকে ঈষৎ পরিবর্ত্তিত করিতে চাহি। আমি বলি কি, ঈশ্বর মর্ত্ত্যভূমির অধিষ্ঠাতৃদেবতাকে মনুষ্য-নামক কতকগুলি সংখ্যা দিয়াছেন ও পূর্ণ সুখ (যাহার আর এক নাম মঙ্গল ) -নামক অঙ্কফল দিয়াছেন। এবং পৃথিবীর পত্রে এই অঙ্কফলটি কষিবার আদেশ দিয়াছেন। সে যুগ-যুগান্তর ধরিয়া এই নিতান্ত দুরূহ অঙ্কটি কষিয়া আসিতেছে, এখনো কষা ফুরায় নি, কবে ফুরাইবে কে জানে! তাহার এক একবার যখনি মনে হয় অঙ্কে ভুল হইল, তৎক্ষণাৎ সে সমস্তটা রক্ত দিয়া মুছিয়া ফেলে। ইহাকেই বলে বিপ্লব।
মানুষের মধ্যে এক একটা মাঝি
আছে— তাহাদের না আছে দাঁড় , না আছে পাল, না আছে গুণ; তাহাদের না আছে বুদ্ধি, না আছে
প্রবৃত্তি, না আছে অধ্যবসায়। তাহারা ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া স্রোতের জন্য অপেক্ষা করিতে
থাকে। মাঝিকে জিজ্ঞাসা কর, "বাপু, বসিয়া আছ কেন? "সে উত্তর দেয়, "আজ্ঞা, এখনো জোয়ার
আসে নাই।" "গুণ টানিয়া চল না কেন?" "আজ্ঞা, সে গুণটি নাই।" "জোয়ার আসিতে আসিতে
তোমার কাজ যদি ফুরাইয়া যায়?" "পাল-তুলা, দাঁড়- টানা অনেক নৌকা যাইতেছে, তাহাদের
বরাত দিব।" অন্যান্য চল্তি নৌকাসকল অনুগ্রহ করিয়া ইহাদিগকে কাছি দিয়া পশ্চাতে
বাঁধিয়া লয়, এইরূপে এমন শত শত নৌকা পার পায়। সমাজের স্রোত নাকি একটানা, বিনাশের
সমুদ্রমুখেই তাহার স্বাভাবিক গতি। উন্নতির পথে অমরতার পথে যাহাকে যাইতে হয়, তাহাকে
উজান বাহিয়া যাইতে হয়। যে সকল দাঁড় ও পাল -বিহীন নৌকা স্রোতে গা-ভাসান দেয়, প্রায়
তাহারা বিনাশসমুদ্রে গিয়া পড়ে। সমাজের অধিকাংশ নৌকাই এইরূপ, প্রত্যহ রাম শ্যাম
প্রভৃতি মাঝিগণ আনন্দে ভাবিতেছে, 'যেরূপ বেগে ছুটিয়াছি, না জানি কোথায় গিয়া
পৌঁছাইব।' একটি একটি করিয়া বিস্মৃতির সাগরে গিয়া পড়ে ও চোখের আড়াল হইয়া যায়।
সমুদ্রের গর্ভে ইহাদের সমাধি, স্মরণস্তম্ভে ইহাদের নাম লিখা থাকে না।
বুদ্ধি খাটাইয়া যাহাদের অগ্রসর হইতে হয় তাহাদের বলে— দাঁড়টানা
নৌকা। অত্যন্ত মেহন্নত করিতে হয়, উঠিয়া পড়িয়া দাঁড় না টানিলে চলে না। কিন্তু তবুও
অনেক সময়ে স্রোত সামলাইতে পারে না। অসংখ্য দাঁড়ের নৌকা প্রাণপণে দাঁড় টানিয়াও হটিতে
থাকে, অবশেষে টানাটানি করিতে কাহারো বা দাঁড় হাল ভাঙ্গিয়া যায়। সকলের অপেক্ষা ভাল
চলে পালের নৌকা। ইহাদের বলে— প্রতিভার নৌকা। ইহারা হঠাৎ আকাশের দিক হইতে বাতাস পায়
ও তীরের মত ছুটিয়া চলে। স্রোতের বিরুদ্ধে ইহারাই জয়ী হয়। দোষের মধ্যে যখন বাতাস
বন্ধ হয়, তখন ইহাদিগকে নোঙর করিয়া থাকিতে হয়, আবার যখনি বাতাস আসে তখনি যাত্রা
আরম্ভ করে। আর একটা দোষ আছে— পালের নৌকা হঠাৎ কাৎ হইয়া পড়ে। পার্থিব নৌকা হাল্কা,
অথচ পালে স্বর্গীয় বাতাস খুব লাগিয়াছে, ঝট্ করিয়া উল্টাইয়া পড়ে। কেহ কেহ এমন কথা
বলেন যে, সকলেরই কল বাহির হইতেছে, বুদ্ধিরও কল বাহির হইবে, তখন আর প্রতিভার পালের
আবশ্যক করিবে না— মনুষ্যসমাজে ষ্টীমার চলিবে। মানুষ যতদিন অসম্পূর্ণ মানুষ থাকিবে
ততদিন প্রতিভার আবশ্যক। যদি কখনো সম্পূর্ণ দেবতা হইতে পারে তখন কি নিয়মে চলিবে, ঠিক
বলিতে পারিতেছি না। প্রতিভার কল বাহির করিতে পারে, এত বড়ো প্রতিভা কোথায়?