ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


চোখের বালি

    বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িল। দুই জনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন।
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ধরিয়া পড়িলেন, “বাবা মহিন, গরিবের মেয়েটিকে উদ্ধার করিতে হইবে। শুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছে– তোদের আজকালকার পছন্দর সঙ্গে মিলিবে।”
    মহেন্দ্র কহিল, “মা, আজকালকার ছেলে তো আমি ছাড়াও আরো ঢের আছে।”
    রাজলক্ষ্মী। মহিন, ঐ তোর দোষ, তোর কাছে বিয়ের কথাটি পাড়িবার জো নাই।
    মহেন্দ্র। মা , ও কথাটা বাদ দিয়াও সংসারে কথার অভাব হয় না। অতএব ওটা মারাত্মক দোষ নয়।
    মহেন্দ্র শৈশবেই পিতৃহীন। মা-সম্বন্ধে তাহার ব্যবহার সাধারণ লোকের মতো ছিল না। বয়স প্রায় বাইশ হইল, এম. এ. পাস করিয়া ডাক্তারি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, তবু মাকে লইয়া তাহার প্রতিদিন মান-অভিমান আদর-আবদারের অন্ত ছিল না। কাঙারু-শাবকের মতো মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াও মাতার বহির্গর্ভের থলিটির মধ্যে আবৃত থাকাই তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। মার সাহায্য ব্যতীত তাহার আহার বিহার আরাম বিরাম কিছুই সম্পন্ন হইবার জো ছিল না।
    এবারে মা যখন বিনোদিনীর জন্য তাহাকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িলেন, তখন মহেন্দ্র বলিল, “আচ্ছা, কন্যাটি একবার দেখিয়া আসি।”
দেখিতে যাইবার দিন বলিল, “দেখিয়া আর কী হইবে। তোমাকে খুশি করিবার জন্য বিবাহ করিতেছি, ভালোমন্দ বিচার মিথ্যা।”
কথাটার মধ্যে একটু রাগের উত্তাপ ছিল, কিন্তু মা ভাবিলেন, শুভদৃষ্টির সময় তাঁহার পছন্দর সহিত যখন পুত্রের পছন্দর নিশ্চয় মিল হইবে তখন মহেন্দ্রের কড়ি-সুর কোমল হইয়া আসিবে।
    রাজলক্ষ্মী নিশ্চিন্তচিত্তে বিবাহের দিন স্থির করিলেন। দিন যত নিকটে আসিতে লাগিল, মহেন্দ্রের মন ততই উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল– অবশেষে দুই-চার দিন আগে সে বলিয়া বসিল, “না মা, আমি কিছুতেই পারিব না।”
    বাল্যকাল হইতে মহেন্দ্র দেবতা ও মানবের কাছে সর্বপ্রকারে প্রশ্রয় পাইয়াছে, এইজন্য তাহার ইচ্ছার বেগ উচ্ছৃঙ্খল। পরের ইচ্ছার চাপ সে সহিতে পারে না। তাহাকে নিজের প্রতিজ্ঞা এবং পরের অনুরোধ একান্ত বাধ্য করিয়া তুলিয়াছে বলিয়াই বিবাহ-প্রস্তাবের প্রতি তাহার অকারণ বিতৃষ্ণা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল এবং আসন্নকালে সে একেবারেই বিমুখ হইয়া বসিল।
    মহেন্দ্রের পরম বন্ধু ছিল বিহারী; সে মহেন্দ্রকে দাদা এবং মহেন্দ্রের মাকে মা বলিত। মা তাহাকে স্টীমবোটের পশ্চাতে আবদ্ধ গাধাবোটের মতো মহেন্দ্রের একটি আবশ্যক ভারবহ আসবাবের স্বরূপ দেখিতেন ও সেই হিসাবে মমতাও করিতেন। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বলিলেন, “বাবা, এ কাজ তো তোমাকেই করিতে হয়, নহিলে গরিবের মেয়ে– ”
বিহারী জোড়হাত করিয়া কহিল, “মা, ঐটে পারিব না। যে-মেঠাই তোমার মহেন্দ্র ভালো লাগিল না বলিয়া রাখিয়া দেয়, সে-মেঠাই তোমার অনুরোধে পড়িয়া আমি অনেক খাইয়াছি, কিন্তু কন্যার বেলা সেটা সহিবে না।”
    রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘বিহারী আবার বিয়ে করিবে ! ও কেবল মহিনকে লইয়াই আছে, বউ আনিবার কথা মনেও স্থান দেয় না।”
    এই ভাবিয়া বিহারীর প্রতি তাঁহার কৃপামিশ্রিত মমতা আর-একটুখানি বাড়িল।
    বিনোদিনীর বাপ বিশেষ ধনী ছিল না, কিন্তু তাহার একমাত্র কন্যাকে সে মিশনারি মেম রাখিয়া বহুযত্নে পড়াশুনা ও কারুকার্য শিখাইয়াছিল। কন্যার বিবাহের বয়স ক্রমেই বহিয়া যাইতেছিল, তবু তাহার হুঁশ ছিল না। অবশেষে তাহার মৃত্যুর পরে বিধবা মাতা পাত্র খুঁজিয়া অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। টাকাকড়িও নাই, কন্যার বয়সও অধিক।
    তখন রাজলক্ষ্মী তাঁহার জন্মভূমি বারাসতের গ্রামসম্পর্কীয় এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সহিত উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ দেওয়াইলেন। অনতিকাল পরে কন্যা বিধবা হইল। মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাগ্যে বিবাহ করি নাই, স্ত্রী বিধবা হইলে তো এক দণ্ডও টিকিতে পারিতাম না।”
    বছর-তিনেক পরে আর-এক দিন মাতাপুত্রে কথা হইতেছিল। “বাবা, লোকে যে আমাকেই নিন্দা করে।”
    “কেন মা, লোকের তুমি কী সর্বনাশ করিয়াছ?”
    “পাছে বউ আসিলে ছেলে পর হইয়া যায়, এই ভয়ে তোর বিবাহ দিতেছি না, লোকে এইরূপ বলাবলি করে।
    "মহেন্দ্র কহিল, “ভয় তো হওয়াই উচিত। আমি মা হইলে প্রাণ ধরিয়া ছেলের বিবাহ দিতে পারিতাম না। লোকের নিন্দা মাথা পাতিয়া লইতাম।”
    মা হাসিয়া কহিলেন,”শোনো একবার ছেলের কথা শোনো।”
    মহেন্দ্র কহিল, “বউ আসিয়া তো ছেলেকে জুড়িয়া বসেই। তখন এত কষ্টের এত স্নেহের মা কোথায় সরিয়া যায়, এ যদি-বা তোমার ভালো লাগে, আমার ভালো লাগে না।”
    রাজলক্ষ্মী মনে মনে পুলকিত হইয়া তাঁহার সদ্যসমাগতা বিধবা জাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “শোনো ভাই মেজোবউ, মহিন কী বলে শোনো। বউ পাছে মাকে ছাড়াইয়া উঠে, এই ভয়ে ও বিয়ে করিতে চায় না। এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কখনো শুনিয়াছ?”
    কাকী কহিলেন, “এ তোমার, বাছা, বাড়াবাড়ি। যখনকার যা তখন তাই শোভা পায়। এখন মার আঁচল ছাড়িয়া বউ লইয়া ঘরকন্না করিবার সময় আসিয়াছে, এখন ছোটো   ছেলেটির মতো ব্যবহার দেখিলে লজ্জা বোধ হয়।”
    এ কথা রাজলক্ষ্মীর ঠিক মধুর লাগিল না এবং এই প্রসঙ্গে তিনি যে-কটি কথা বলিলেন, তাহা সরল হইতে পারে, কিন্তু মধুমাখা নহে। কহিলেন, “আমার ছেলে যদি অন্যের ছেলেদের চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে, তোমার তাতে লজ্জা করে কেন মেজোবউ। ছেলে থাকিলে ছেলের মর্ম বুঝিতে।”
রাজলক্ষ্মী মনে করিলেন, পুত্রসৌভাগ্যবতীকে পুত্রহীনা ঈর্ষা করিতেছে।
    মেজোবউ কহিলেন, “তুমিই বউ আনিবার কথা পাড়িলে বলিয়া কথাটা উঠিল, নহিলে আমার অধিকার কী।”
    রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার ছেলে যদি বউ না আনে, তোমার বুকে তাতে শেল বেঁধে কেন। বেশ তো, এতদিন যদি ছেলেকে মানুষ করিয়া আসিতে পারি, এখনো উহাকে দেখিতে শুনিতে পারিব, আর কাহারো দরকার হইবে না।”
    মেজোবউ অশ্রুপাত করিয়া নীরবে চলিয়া গেলেন। মহেন্দ্র মনে মনে আঘাত পাইল এবং কালেজ হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়াই তাহার কাকীর ঘরে উপস্থিত হইল।
কাকী তাহাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহার মধ্যে স্নেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ইহা সে নিশ্চয় জানিত। এবং ইহাও তাহার জানা ছিল, কাকীর একটি পিতৃমাতৃহীনা বোনঝি আছে, এবং মহেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া সন্তানহীনা বিধবা কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে কাছে আনিয়া সুখী দেখিতে চান। যদিচ বিবাহে সে নারাজ, তবু কাকীর এই মনোগত ইচ্ছাটি তাহার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলিয়া মনে হইত।
    মহেন্দ্র তাঁহার ঘরে যখন গেল, তখন বেলা আর বড়ো বাকি নাই। কাকী অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের কাটা জানালার গরাদের উপর মাথা রাখিয়া শুষ্কবিমর্ষমুখে বসিয়াছিলেন। পাশের ঘরে ভাত ঢাকা পড়িয়া আছে, এখনো স্পর্শ করেন নাই।
    অল্প কারণেই মহেন্দ্রের চোখে জল আসিত। কাকীকে দেখিয়া তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। কাছে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে ডাকিল, “কাকীমা।”
    অন্নপূর্ণা হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “আয় মহিন, বোস।”
    মহেন্দ্র কহিল, “ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে, প্রসাদ খাইতে চাই।”
    অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝিয়া উচ্ছ্বসিত অশ্রু কষ্টে সংবরণ করিলেন এবং নিজে খাইয়া মহেন্দ্রকে খাওয়াইলেন।
    মহেন্দ্রের হৃদয় তখন করুণায় আর্দ্র ছিল। কাকীকে সান্ত্বনা দিবার জন্য আহারান্তে হঠাৎ মনের ঝোঁকে বলিয়া বসিল, “কাকী, তোমার সেই সে বোনঝির কথা বলিয়াছিলে, তাহাকে একবার দেখাইবে না?”
    কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে ভীত হইয়া পড়িল।
    অন্নপূর্ণা হাসিয়া কহিলেন, “তোর আবার বিবাহে মন গেল নাকি, মহিন।”
    মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “না, আমার জন্য নয় কাকী, আমি বিহারীকে রাজি করিয়াছি। তুমি দেখিবার দিন ঠিক করিয়া দাও।”
    অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আহা, তাহার কি এমন ভাগ্য হইবে। বিহারীর মতো ছেলে কি তাহার কপালে আছে।”
    কাকীর ঘর হইতে বাহির হইয়া মহেন্দ দ্বারের কাছে আসিতেই মার সঙ্গে দেখা হইল। রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী মহেন্দ্র, এতক্ষণ তোদের কী পরামর্শ হইতেছিল।”
    মহেন্দ্র কহিল, “পরামর্শ কিছুই না, পান লইতে আসিয়াছি।”
    মা কহিলেন, “তোর পান তো আমার ঘরে সাজা আছে।”
    মহেন্দ্র উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
    রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া অন্নপূর্ণার রোদনস্ফীত চক্ষু দেখিবামাত্র অনেক কথা কল্পনা করিয়া লইলেন।
    ফোঁস করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কী গো মেজোঠাকরুণ, ছেলের কাছে লাগালাগি করিতেছিলে বুঝি?”
    বলিয়া উত্তরমাত্র না শুনিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন।