ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 


চোখের বালি

১৩

    বিনোদিনী যখন নিতান্তই ধরা দিল না তখন আশার মাথায় একটা ফন্দি আসিল। সে বিনোদিনীকে কহিল, “ভাই বালি, তুমি আমার স্বামীর সম্মুখে বাহির হও না কেন। পলাইয়া বেড়াও কী জন্য।”
    বিনোদিনী অতি সংক্ষেপে এবং সতেজে উত্তর করিল, “ছি ছি।”
    আশা কহিল, “কেন। মার কাছে শুনিয়াছি, তুমি তো আমাদের পর নও।”
    বিনোদিনী গম্ভীরমুখে কহিল, “সংসারে আপন-পর কেহই নাই। যে আপন মনে করে সেই আপন–যে পর বলিয়া জানে, সে আপন হইলেও পর।”
    আশা মনে মনে ভাবিল, এ কথার আর উত্তর নাই। বাস্তবিকই তাহার স্বামী বিনোদিনীর প্রতি অন্যায় করেন, বাস্তবিকই তাহাকে পর ভাবেন এবং তাহার প্রতি অকারণে বিরক্ত হন।
    সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আশা স্বামীকে অত্যন্ত আবদার করিয়া ধরিল, “আমার চোখের বালির সঙ্গে তোমাকে আলাপ করিতে হইবে।”
    মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “তোমার সাহস তো কম নয়।”
    আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, ভয় কিসের।”
    মহেন্দ্র। তোমার সখীর যেরকম রূপের বর্ণনা কর, সে তো বড়ো নিরাপদ জায়গা নয়!
    আশা কহিল, “আচ্ছা, সে আমি সামলাইতে পারিব। তুমি ঠাট্টা রাখিয়া দাও–তার সঙ্গে আলাপ করিবে কি না বলো।”
    বিনোদিনীকে দেখিবে বলিয়া মহেন্দ্রের যে কৌতূহল ছিল না, তাহা নহে। এমনকি, আজকাল তাহাকে দেখিবার জন্য মাঝে মাঝে আগ্রহও জন্মে। সেই অনাবশ্যক আগ্রহটা তাহার নিজের কাছে উচিত বলিয়া ঠেকে নাই।
    হৃদয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মহেন্দ্রের উচিত-অনুচিতের আদর্শ সাধারণের অপেক্ষা কিছু কড়া। পাছে মাতার অধিকার লেশমাত্র ক্ষুণ্ন হয়, এইজন্য ইতিপূর্বে সে বিবাহের প্রসঙ্গমাত্র কানে আনিত না। আজকাল, আশার সহিত সম্বন্ধকে সে এমনভাবে রক্ষা করিতে চায় যে, অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি সামান্য কৌতূহলকেও সে মনে স্থান দিতে চায় না। প্রেমের বিষয়ে সে যে বড়ো খুঁতখুঁতে এবং অত্যন্ত খাঁটি, এই লইয়া তাহার মনে একটা গর্ব ছিল। এমন কি, বিহারীকে সে বন্ধু বলিত বলিয়া অন্য কাহাকেও বন্ধু বলিয়া স্বীকার করিতেই চাহিত না। অন্য কেহ যদি তাহার নিকট আকৃষ্ট হইয়া আসিত, তবে মহেন্দ্র যেন তাহাকে গায়ে পড়িয়া উপেক্ষা দেখাইত, এবং বিহারীর নিকটে সেই হতভাগ্য সম্বন্ধে উপহাসতীব্র অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া ইতরসাধারণের প্রতি নিজের একান্ত ঔদাসীন্য ঘোষণা করিত। বিহারী ইহাতে আপত্তি করিলে মহেন্দ্র বলিত, “তুমি পার বিহারী, যেখানে যাও তোমার বন্ধুর অভাব হয় না; আমি কিন্তু যাকে-তাকে বন্ধু বলিয়া টানাটানি করিতে পারি না।”
    সেই মহেন্দ্রের মন আজকাল যখন মাঝে মাঝে অনিবার্য ব্যগ্রতা ও কৌতূহলের সহিত এই অপরিচিতার প্রতি আপনি ধাবিত হইতে থাকিত তখন সে নিজের আদর্শের কাছে যেন খাটো হইয়া পড়িত। অবশেষে বিরক্ত হইয়া বিনোদিনীকে বাটী হইতে বিদায় করিয়া দিবার জন্য সে তাহার মাকে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল।
মহেন্দ্র কহিল, “থাক্‌ চুনি। তোমার চোখের বালির সঙ্গে আলাপ করিবার সময় কই। পড়িবার সময় ডাক্তারি বই পড়িব, অবকাশের সময় তুমি আছ, ইহার মধ্যে সখীকে কোথায় আনিবে।”
    আশা কহিল, “আচ্ছা, তোমার ডাক্তারিতে ভাগ বসাইব না, আমারই অংশ আমি বালিকে দিব।”
    মহেন্দ্র কহিল, “তুমি তো দিবে, আমি দিতে দিব কেন।”
    আশা যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে, মহেন্দ্র বলে, ইহাতে তাহার স্বামীর প্রতি প্রেমের খর্বতা প্রতিপন্ন হয়। মহেন্দ্র অহংকার করিয়া বলিত, “আমার মতো অনন্যনিষ্ঠ প্রেম তোমার নহে।” আশা তাহা কিছুতেই মানিত না–ইহা লইয়া ঝগড়া করিত, কাঁদিত, কিন্তু তর্কে জিতিতে পারিত না।
    মহেন্দ্র তাহাদের দুজনের মাঝখানে বিনোদিনীকে সূচ্যগ্র স্থান ছাড়িয়া দিতে চায় না, ইহাই তাহার গর্বের বিষয় হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের এই গর্ব আশার সহ্য হইত না, কিন্তু আজ সে পরাভব স্বীকার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, আমার খাতিরেই তুমি আমার বালির সঙ্গে আলাপ করো।”
    আশার নিকট মহেন্দ্র নিজের ভালোবাসার দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিয়া অবশেষে বিনোদিনীর সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অনুগ্রহপূর্বক রাজি হইল। বলিয়া রাখিল, “কিন্তু তাই বলিয়া যখন-তখন উৎপাত করিলে বাঁচিব না।”
    পরদিন প্রত্যুষে বিনোদিনীকে আশা তাহার বিছানায় গিয়া জড়াইয়া ধরিল। বিনোদিনী কহিল, “এ কী আশ্চর্য। চকোরী যে আজ চাঁদকে ছাড়িয়া মেঘের দরবারে!”
    আশা কহিল, “তোমাদের ও-সব কবিতার কথা আমার আসে না ভাই, কেন বেনাবনে মুক্ত ছড়ানো। যে তোমার কথার জবাব দিতে পারিবে, একবার তাহার কাছে কথা শোনাও এসে।”
    বিনোদিনী কহিল, “সে রসিক লোকটি কে।”
    আশা কহিল, “তোমার দেবর, আমার স্বামী। না ভাই, ঠাট্টা নয়–তিনি তোমার সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছেন।”
    বিনোদিনী মনে মনে কহিল, “স্ত্রীর হুকুমে আমার প্রতি তলব পড়িয়াছে, আমি অমনি ছুটিয়া যাইব, আমাকে তেমন পাও নাই।”
    বিনোদিনী কোনোমতেই রাজি হইল না। আশা তখন স্বামীর কাছে বড়ো অপ্রতিভ হইল।
    মহেন্দ্র মনে মনে বড়ো রাগ করিল। তাহার কাছে বাহির হইতে আপত্তি! তাহাকে অন্য সাধারণ পুরুষের মতো জ্ঞান করা! আর কেহ হইলে তো এতদিনে অগ্রসর হইয়া নানা কৌশলে বিনোদিনীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় করিত। মহেন্দ্র যে তাহার চেষ্টামাত্রও করে নাই, ইহাতেই কি বিনোদিনী তাহার পরিচয় পায় নাই। বিনোদিনী যদি একবার ভালো করিয়া জানে, তবে অন্য পুরুষ এবং মহেন্দ্রের প্রভেদ বুঝিতে পারে।
    বিনোদিনীও দুদিন পূর্বে আক্রোশের সহিত মনে মনে বলিয়াছিল, “এতকাল বাড়িতে আছি, মহেন্দ্র যে একবার আমাকে দেখিবার চেষ্টাও করে না। যখন পিসিমার ঘরে থাকি তখন কোনো ছুতা করিয়াও যে মার ঘরে আসে না। এত ঔদাসীন্য কিসের। আমি কি জড়পদার্থ। আমি কি মানুষ না। আমি কি স্ত্রীলোক নই। একবার যদি আমার পরিচয় পাইত, তবে আদরের চুনির সঙ্গে বিনোদিনীর প্রভেদ বুঝিতে পারিত।”
    আশা স্বামীর কাছে প্রস্তাব করিল, “তুমি কালেজে গেছ বলিয়া চোখের বালিকে আমাদের ঘরে আনিব, তাহার পরে বাহির হইতে তুমি হঠাৎ আসিয়া পড়িবে–তা হইলেই সে জব্দ হইবে।”
    মহেন্দ্র কহিল, “কী অপরাধে তাহাকে এতবড়ো কঠিন শাসনের আয়োজন।”
    ‌আশা কহিল, “না সত্যই আমার ভারি রাগ হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দেখা করিতেও তার আপত্তি! প্রতিজ্ঞা ভাঙিব তবে ছাড়িব।”
    মহেন্দ্র কহিল, “তোমার প্রিয়সখীর দর্শনাভাবে আমি মরিয়া যাইতেছি না। আমি অমন চুরি করিয়া দেখা করিতে চাই না।”
    আশা সানুনয়ে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, “মাথা খাও, একটিবার তোমাকে এ কাজ করিতেই হইবে। একবার যে করিয়া হোক তাহার গুমর ভাঙিতে চাই, তার পর তোমাদের যেমন ইচ্ছা তাই করিয়ো।”
    মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল। আশা কহিল, “লক্ষ্মীটি, আমার অনুরোধ রাখো।”
    মহেন্দ্রের আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল–সেইজন্য অতিরিক্ত মাত্রায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া সম্মতি দিল।
    শরৎকালের স্বচ্ছ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে বিনোদিনী মহেন্দ্রের নির্জন শয়নগৃহে বসিয়া আশাকে কার্পেটের জুতা বুনিতে শিখাইতেছিল। আশা অন্যমনস্ক হইয়া ঘন ঘন দ্বারের দিকে চাহিয়া গণনায় ভুল করিয়া বিনোদিনীর নিকট নিজের অসাধ্য অপটুত্ব প্রকাশ করিতেছিল।
    অবশেষে বিনোদিনী বিরক্ত হইয়া তাহার হাত হইতে কার্পেট টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া কহিল, “ও তোমার হইবে না, আমার কাজ আছে আমি যাই।”
    আশা কহিল, “আর একটু বোসো, এবার দেখো, আমি ভুল করিব না।” বলিয়া আবার সেলাই লইয়া পড়িল।
    ইতিমধ্যে নিঃশব্দপদে বিনোদিনীর পশ্চাতে দ্বারের নিকট মহেন্দ্র আসিয়া দাঁড়াইল। আশা সেলাই হইতে মুখ না তুলিয়া আস্তে আস্তে হাসিতে লাগিল।
    বিনোদিনী কহিল, “হঠাৎ হাসির কথা কী মনে পড়িল।” আশা আর থাকিতে পারিল না। উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিয়া কার্পেট বিনোদিনীর গায়ের উপরে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “না ভাই, ঠিক বলিয়াছ–ও আমার হইবে না”–বলিয়া বিনোদিনীর গলা জড়াইয়া দ্বিগুণ হাসিতে লাগিল।
    প্রথম হইতেই বিনোদিনী সব বুঝিয়াছিল। আশার চাঞ্চল্যে এবং ভাবভঙ্গিতে তাহার নিকট কিছুই গোপন ছিল না। কখন মহেন্দ্র পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহাও সে বেশ জানিতে পারিয়াছিল। নিতান্ত সরল নিরীহের মতো সে আশার এই অত্যন্ত ক্ষীণ ফাঁদের মধ্যে ধরা দিল।
    মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “হাসির কারণ হইতে আমি হতভাগ্য কেন বঞ্চিত হই।”
    বিনোদিনী চমকিয়া মাথায় কাপড় টানিয়া উঠিবার উপক্রম করিল। আশা তাহার হাত চাপিয়া ধরিল।
    মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “হয় আপনি বসুন আমি যাই, নয় আপনিও বসুন আমিও বসি।”
    বিনোদিনী সাধারণ মেয়ের মতো আশার সহিত হাত-কাড়াকাড়ি করিয়া মহাকোলাহলে লজ্জায় ধুম বাধাইয়া দিল না। সহজ সুরেই বলিল, “কেবল আপনার অনুরোধেই বসিলাম, কিন্তু মনে মনে অভিশাপ দিবেন না।”
    মহেন্দ্র কহিল, “এই বলিয়া অভিশাপ দিব, আপনার যেন অনেকক্ষণ চলৎশক্তি না থাকে।”
    বিনোদিনী কহিল, “সে অভিশাপকে আমি ভয় করি না। কেননা, আপনার অনেকক্ষণ খুব বেশিক্ষণ হইবে না। বোধ হয়, সময় উত্তীর্ণ হইয়া আসিল।”
    বলিয়া আবার সে উঠিবার চেষ্টা করিল। আশা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “মাথা খাও আর একটু বোসো।”