ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
১৯
বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “ব্যাপারখানা কী! অভিমান, না রাগ, না ভয়? আমাকে
দেখাইতে চান, আমাকে কেয়ার করেন না? বাসায় গিয়া থাকিবেন? দেখি কত দিন থাকিতে পারেন?”
কিন্তু বিনোদিনীরও মনে মনে একটা অশান্ত ভাব উপস্থিত হইল।
মহেন্দ্রকে সে প্রতিদিন নানা পাশে বদ্ধ ও নানা বাণে বিদ্ধ করিতেছিল, সে-কাজ গিয়া
বিনোদিনী যেন এ-পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। বাড়ি হইতে তাহার সমস্ত নেশা চলিয়া গেল।
মহেন্দ্রবর্জিত আশা তাহার কাছে নিতান্তই স্বাদহীন। আশার প্রতি মহেন্দ্রের
সোহাগ-যত্ন বিনোদিনীর প্রণয়বঞ্চিত চিত্তকে সর্বদাই আলোড়িত করিয়া তুলিত–তাহাতে
বিনোদিনীর বিরহিণী কল্পনাকে যে বেদনায় জাগরূক করিয়া রাখিত তাহার মধ্যে উগ্র
উত্তেজনা ছিল। যে-মহেন্দ্র তাহাকে তাহার সমস্ত জীবনের সার্থকতা হইতে ষ্টি করিয়াছে,
যে-মহেন্দ্র তাহার মতো স্ত্রীরত্নকে উপেক্ষা করিয়া আশার মতো ক্ষীণবুদ্ধি দীনপ্রকৃতি
বালিকাকে বরণ করিয়াছে, তাহাকে বিনোদিনী ভালোবাসে কি বিদ্বেষ করে, তাহাকে কঠিন
শাস্তি দিবে না তাহাকে হৃদয়সমর্পণ করিবে, তাহা বিনোদিনী ঠিক করিয়া বুঝিতে পারে নাই।
একটা জ্বালা মহেন্দ্র তাহারঅন্তরে জ্বালাইয়াছে, তাহা হিংসার না প্রেমের, না দুয়েরই
মিশ্রণ, বিনোদিনী তাহা ভাবিয়া পায় না; মনে মনে তীব্র হাসি হাসিয়া বলে, “কোনো নারীর
কি আমার মতো এমন দশা হইয়াছে। আমি মরিতে চাই কি মারিতে চাই, তাহা বুঝিতেই পারিলাম
না।” কিন্তু যে কারণেই বল, দগ্ধ হইতেই হউক বা দগ্ধ করিতেই হউক, মহেন্দ্রকে তাহার
একান্ত প্রয়োজন। সে তাহার বিষদিগ্ধ অগ্নিবাণ জগতে কোথায় মোচন করিবে। ঘন নিশ্বাস
ফেলিতে ফেলিতে বিনোদিনী কহিল, “সে যাইবে কোথায়। সে ফিরিবেই। সে আমার।”
আশা ঘর পরিষ্কার করিবার ছুতা করিয়া সন্ধ্যার সময় মহেন্দ্রের বাহিরের ঘরে,
মাথার-তেলে-দাগ-পড়া মহেন্দ্রের বসিবার কেদারা, কাগজপত্র-ছড়ানো ডেসক্, তাহার বই,
তাহার ছবি প্রভৃতি জিনিসপত্র বার বার নাড়াচাড়া এবং অঞ্চল দিয়া ঝাড়-পোঁচ করিতেছিল।
এইরূপে মহেন্দ্রের সকল জিনিস নানা রূপে স্পর্শ করিয়া, একবার রাখিয়া, একবার তুলিয়া,
আশার বিরহসন্ধ্যা কাটিতেছিল। বিনোদিনী ধীরে ধীরে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; আশা ঈষৎ
লজ্জিত হইয়া তাহার নাড়াচাড়ার কাজ রাখিয়া দিয়া, কী যেন খুঁজিতেছে এমনিতরো ভান করিল।
বিনোদিনী গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল, “কী হচ্ছে তোর, ভাই!”
আশা মুখে একটুখানি হাসি জাগাইয়া কহিল, “কিছুই না, ভাই।”
বিনোদিনী তখন আশার গলা জড়াইয়া কহিল, “কেন ভাই বালি, ঠাকুরপো এমন করিয়া চলিয়া গেলেন
কেন।”
আশা বিনোদিনীর এই প্রশ্নমাত্রেই সংশয়ান্বিত সশঙ্কিত হইয়া উত্তর করিল, “তুমি তো
জানই, ভাই-কোলেজে তাঁহার বিশেষ কাজ পড়িয়াছে বলিয়া গেছেন।”
বিনোদিনী ডান হাতে আশার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া যেন করুণায় বিগলিত হইয়া স্তব্ধভাবে
একবার তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
আশার বুক দমিয়া গেল। নিজেকে সে নির্বোধ এবং বিনোদিনীকে বুদ্ধিমতী বলিয়া জানিত।
বিনোদিনীর ভাবখানা দেখিয়া হঠাৎ তাহার বিশ্বসংসার অন্ধকার হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে
স্পষ্ট করিয়া কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না। দেয়ালের কাছে একটা সোফার
উপরে বসিল। বিনোদিনীও তাহার পাশে বসিয়া দৃঢ় বাহু দিয়া আশাকে বুকের কাছে বাঁধিয়া
ধরিল। সখীর সেই আলিঙ্গনে আশা আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, তাহার দুই চক্ষু দিয়া জল
ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দ্বারের কাছে অন্ধ ভিখারি খঞ্জনি বাজাইয়া গাহিতেছিল, “চরণতরণী
দে মা, তারিণী তারা।”
বিহারী মহেন্দ্রের সন্ধানে আসিয়া দ্বারের কাছে পৌঁছিতেই দেখিল–আশা কাঁদিতেছে, এবং
বিনোদিনী তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে তাহার চোখ মুছাইয়া দিতেছে। দেখিয়াই
বিহারী সেখান হইতে সরিয়া দাঁড়াইল। পাশের শূন্য ঘরে গিয়া অন্ধকারে বসিল। দুই করতলে
মাথা চাপিয়া ধরিয়া ভাবিতে লাগিল, আশা কেন কাঁদিবে। যে মেয়ে স্বভাবতই কাহারো কাছে
লেশমাত্র অপরাধ করিতে অক্ষম, তাহাকেও কাঁদাইতে পারে এমন পাষণ্ড জগতে কে আছে! তার
পরে বিনোদিনী যেমন করিয়া সান্ত্বনা করিতেছিল, তাহা মনে আনিয়া মনে মনে কহিল,
“বিনোদিনীকে ভারি ভুল বুঝিয়াছিলাম। সেবায় সান্ত্বনায়, নিঃস্বার্থ সখীপ্রেমে সে
মর্তবাসিনী দেবী।”
বিহারী অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসিয়া রহিল। অন্ধের গান থামিয়া গেলে বিহারী সশব্দে পা
ফেলিয়া, কাশিয়া, মহেন্দ্রের ঘরের দিকে চলিল। দ্বারের কাছে না যাইতেই ঘোমটা টানিয়া
আশা দ্রুতপদে অন্তঃপুরের দিকে ছুটিয়া গেল।
ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “এ কী বিহারীবাবু! আপনার কি অসুখ করিয়াছে।”
বিহারী। কিছু না।
বিনোদিনী। চোখ দুটো অমন লাল কেন।
বিহারী তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মহেন্দ্র কোথায় গেল।”
বিনোদিনী মুখ গম্ভীর করিয়া কহিল, “শুনিলাম, হাসপাতালে তাঁহার কাজ পড়িয়াছে বলিয়া
কালেজের কাছে তিনি বাসা করিয়া আছেন। বিহারীবাবু একটু সরুন, আমি তবে আসি।”
অন্যমনস্ক বিহারী দ্বারের কাছে বিনোদিনীর পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। চকিত হইয়া
তাড়াতাড়ি পথ ছাড়িয়া দিল। সন্ধ্যার সময় একলা বাহিরের ঘরে বিনোদিনীর সঙ্গে কথাবার্তা
লোকের চক্ষে সুদৃশ্য নয়, সে কথা হঠাৎ মনে পড়িল। বিনোদিনীর চলিয়া যাইবার সময় বিহারী
তাড়াতাড়ি বলিয়া লইল, “বিনোদ-বোঠান, আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত
করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাঁচাইতেও পারে না।”
বিহারী অন্ধকারে বিনোদিনীর মুখ দেখিতে পাইল না, সে মুখে হিংসার বিদ্যুৎ খেলিতে
লাগিল। আজ বিহারীকে দেখিয়াই সে বুঝিয়াছিল যে, আশার জন্য করুণায় তাহার হৃদয় ব্যথিত।
বিনোদিনী নিজে কেহই নহে! আশাকে ঢাকিয়া রাখিবার জন্য, আশার পথের কাঁটা তুলিয়া দিবার
জন্য, আশার সমস্ত সুখ সম্পূর্ণ করিবার জন্যই তাহার জন্ম! শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রবাবু
আশাকে বিবাহ করিবেন, সেইজন্য অদৃষ্টের তাড়নায় বিনোদিনীকে বারাসতের বর্বর বানরের
সহিত বনবাসিনী হইতে হইবে। শ্রীযুক্ত বিহারীবাবু সরলা আশার চোখের জল দেখিতে পারেন
না, সেইজন্য বিনোদিনীকে তাহার আঁচলের প্রান্ত তুলিয়া সর্বদা প্রস্তুত হইয়া থাকিতে
হইবে। একবার এই মহেন্দ্রকে, এই বিহারীকে, বিনোদিনী তাহার পশ্চাতের ছায়ার সহিত ধুলায়
লুণ্ঠিত করিয়া বুঝাইতে চায়, আশাই বা কে আর বিনোদিনীই বা কে! দুজনের মধ্যে কত
প্রভেদ! প্রতিকূল ভাগ্য-বশত বিনোদিনী আপন প্রতিভাকে কোনো পুরুষের চিত্তক্ষেত্রে
অব্যাহতভাবে জয়ী করিতে না পারিয়া জ্বলন্ত শক্তিশেল উদ্যত করিয়া সংহারমূর্তি ধরিল।
অত্যন্ত মিষ্টস্বরে বিনোদিনী বিহারীকে বলিয়া গেল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন,
বিহারীবাবু। আমার চোখের বালির জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া নিজেকে বেশি কষ্ট দিবেন না।”