ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
২
মেয়ে দেখিবার কথা মহেন্দ্র প্রায় ভুলিয়াছিল, অন্নপূর্ণা
ভোলেন নাই। তিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জেঠার বাড়িতে
পত্র লিখিয়া দেখিতে যাইবার দিন স্থির করিয়া পাঠাইলেন।
দিন স্থির হইয়াছে শুনিয়াই মহেন্দ্র কহিল, “এত তাড়াতাড়ি
কাজটা করিলে কেন কাকী। এখনো বিহারীকে বলাই হয় নাই।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি হয় মহিন। এখন না দেখিতে গেলে
তাহারা কী মনে করিবে।”
মহেন্দ্র বিহারীকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল। কহিল, “চলো তো,
পছন্দ না হইলে তো তোমার উপর জোর চলিবে না।”
বিহারী কহিল, “সে কথা বলিতে পারি না। কাকীর বোনঝিকে দেখিতে
গিয়া পছন্দ হইল না বলা আমার মুখ দিয়া আসিবে না।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো উত্তম কথা।”
বিহারী কহিল, “কিন্তু তোমার পক্ষে অন্যায় কাজ হইয়াছে
মহিনদা। নিজেকে হালকা রাখিয়া পরের স্কন্ধে এরূপ ভার চাপানো
তোমার উচিত হয় নাই। এখন কাকীর মনে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে
বড়োই কঠিন হইবে।”
মহেন্দ্র একটু লজ্জিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল, “তবে কী করিতে
চাও!”
বিহারী কহিল, “যখন তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহাকে আশা দিয়াছ,
তখন আমি বিবাহ করিব- দেখিতে যাইবার ভড়ং করিবার দরকার নাই।”
অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত।
অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয়
বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি
পছন্দ না হয়, তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার
শপথ রহিল।”
নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে
কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া
দাও।”
মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি।”
মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে
বলিব।”
মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরের জন্য
হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই
যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ
ঢালে। দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল। কন্যার জেঠা
শ্যামবাজারের অনুকূলবাবু–নিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায়
তাঁহার বাগানসমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর
তুলিয়াছেন।
দরিদ্র পিতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পুত্রীকে
তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেন। মাসি অন্নপূর্ণা
বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে থাক্।” তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা
ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকূল রাজি হইলেন না।
এমন-কি, দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি
পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া
ছিলেন।
কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল কিন্তু আজকালকার দিনে
কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি
তাদৃশী” কথাটা খাটে না। ভাবনার সঙ্গে খরচও চাই। কিন্তু
পণের কথা উঠিলেই অনুকূল বলেন, “আমার তো নিজের মেয়ে আছে,
আমি একা আর কত পারিয়া উঠিব।” এমনি করিয়া দিন বহিয়া
যাইতেছিল। এমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে
বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন।
তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখ। দোতলার
দক্ষিণবারান্দায় চিত্রিত চিক্কণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই
প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে
শোভমান এবং বরফজলপূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দু জালে
মণ্ডিত। মহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে
বসিয়াছেন। নীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল
দিতেছিল; সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া
চৈত্রের দক্ষিণ বাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত
চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিল। আশপাশের
দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি,
ফিসফিস কথা, দুটা-একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়।
আহারের পর অনুকূলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চুনি,
পান নিয়ে আয় তো রে।”
কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতের একটা দরজা খুলিয়া গেল
এবং একটি বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া
আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকূলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।”
বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের বাটা অতিথিদের
আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দায় পশ্চিম-প্রান্ত
হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল।
সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ
মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল।
বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকূলবাবু কহিলেন,
“একটু দাঁড়া চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটো ভাই অপূর্বর
কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই।”
বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-এক বার
চাহিয়া দেখিল।
কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, “এই
বারো-তেরো হইবে।” অর্থাৎ চৌদ্দেপনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই
অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরু ভাবে
তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।”
অনুকূলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।”
বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশপালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার
নাম আশালতা।”
আশা! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো
কোমল। অনাথা আশা!
দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্র
কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ো না।”
বিহারী তাহার
স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার
মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ
হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।”
বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ্য করিতে পারিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা না
হয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”
বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল,
“মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ
করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন-তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে
সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে
হইয়া যাইত।”
বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ
ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহুবিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া
পৌঁছিল।
মা তখন লুচিভাজা-ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনো তাঁহার
বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই।
মহেন্দ্র একা নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল।
কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুজ্ঞের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র
নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন
খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলসস্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন
আর উঠিতে পারি না।”
মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই না?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব।”
মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো
উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।
তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসংবরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র
কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো।”
মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী!”
এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ৎক্ষণ মান-অভিমানের পর
মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল।