ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
২১
ইতিমধ্যে আরো এক চিঠি আসিয়া উপস্থিত হইল।−
'তুমি আমার চিঠির উত্তর দিলে না? ভালোই করিয়াছ। ঠিক কথা তো লেখা যায় না; তোমার যা
জবাব,
সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম। ভক্ত যখন তাহার দেবতাকে ডাকে, তিনি কি মুখের কথায়
তাহার উত্তর
দেন। দুখিনীর বিলবপত্রখানি চরণতলে বোধ করি স্থান পাইয়াছে!
'কিন্তু ভক্তের পূজা লইতে গিয়া শিবের যদি তপোভঙ্গ হয়, তবে
তাহাতে রাগ করিয়ো না, হৃদয়দেব! তুমি বর দাও, চোখ মেলিয়া চাও বা না চাও, জানিতে পার
বা না পার, পূজা না দিয়া ভক্তের আর গতি নাই। তাই আজিও এই দু-ছত্র চিঠি লিখিলাম–হে
আমার পাষাণ-ঠাকুর, তুমি অবিচলিত হইয়া থাকো।'−
মহেন্দ্র আবার চিঠির উত্তর লিখিতে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু আশাকে লিখিতে গিয়া
বিনোদিনীর উত্তর কলমের মুখে আপনি আসিয়া পড়ে। ঢাকিয়া লুকাইয়া কৌশল করিয়া লিখিতে পারে
না। অনেকগুলি ছিঁড়িয়া রাত্রের অনেক প্রহর কাটাইয়া একটা যদি বা লিখিল, সেটা লেফাফায়
পুরিয়া উপরে আশার নাম লিখিবার সময় হঠাৎ তাহার পিঠে যেন কাহার চাবুক পড়িল−
কে যেন
বলিল, "পাষণ্ড, বিশ্বস্ত বালিকার প্রতি এমনি করিয়া প্রতারণা?" চিঠি মহেন্দ্র সহস্র
টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল, এবং বাকি রাতটা টেবিলের উপর দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢাকিয়া
নিজেকে যেন নিজের দৃষ্টি হইতে লুকাইবার চেষ্টা করিল।
তৃতীয় পত্র−'যে একেবারেই অভিমান করিতে জানে না, সে কি ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসাকে
যদি অনাদর-অপমান হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে না পারি, তবে সে ভালোবাসা তোমাকে দিব কেমন
করিয়া।
'তোমার মন হয়তো ঠিক বুঝি নাই, তাই এত সাহস করিয়াছি। তাই যখন ত্যাগ করিয়া গেলে, তখনো
নিজে অগ্রসর হইয়া চিঠি লিখিয়াছি; যখন চুপ করিয়া ছিলে, তখনো মনের কথা বলিয়া
ফেলিয়াছি। কিন্তু তোমাকে যদি ভুল করিয়া থাকি, সে কি আমারই দোষ। একবার শুরু হইতে শেষ
পর্যন্ত সব কথা মনে করিয়া দেখো দেখি, যাহা বুঝিয়াছিলাম, সে কি তুমিই বোঝাও নাই।
'সে যাই হোক, ভুল হোক সত্য হোক, যাহা লিখিয়াছি সে আর মুছিবে না,
যাহা দিয়াছি সে আর ফিরাইতে পারিব না, এই আক্ষেপ। ছি ছি, এমন লজ্জাও নারীর ভাগ্যে
ঘটে। কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, ভালো যে বাসে সে নিজের ভালোবাসাকে বরাবর
অপদস্থ করিতে পারে। যদি আমার চিঠি না চাও তো থাক্, যদি উত্তর না লিখিবে তবে এই
পর্যন্ত−'
ইহার পর মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না। মনে করিল, “অত্যন্ত রাগ করিয়াই ঘরে ফিরিয়া
যাইতেছি।
বিনোদিনী মনে করে, তাহাকে ভুলিবার জন্যই ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছি!' বিনোদিনীর সেই
স্পর্ধাকে হাতে হাতে অপ্রমাণ করিবার জন্যই তখনি মহেন্দ্র ঘরে ফিরিবার সংকল্প করিল।
এমন সময় বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। বিহারীকে দেখিবামাত্র মহেন্দ্রের ভিতরের পুলক যেন
দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল। ইতিপূর্বে নানা সন্দেহে ভিতরে ভিতরে বিহারীর প্রতি তাহার
ঈর্ষা জন্মিতেছিল, উভয়ের বন্ধুত্ব ক্লিষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। পত্রপাঠের পর আজ সমস্ত
ঈর্ষাভার বিসর্জন দিয়া বিহারীকে সে অতিরিক্ত আবেগের সহিত আহ্বান করিয়া লইল। চৌকি
হইতে উঠিয়া, বিহারীর পিঠে চাপড় মারিয়া, তাহার হাত ধরিয়া, তাহাকে একটা কেদারার উপরে
টানিয়া বসাইয়া দিল।
কিন্তু বিহারীর মুখ আজ বিমর্ষ। মহেন্দ্র ভাবিল, বেচারা নিশ্চয় ইতিমধ্যে বিনোদিনীর
সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছে এবং সেখান হইতে ধাক্কা খাইয়া আসিয়াছে। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা
করিল, "বিহারী, এর মধ্যে আমাদের ওখানে গিয়াছিলে?"
বিহারী গম্ভীরমুখে কহিল, "এখনি সেখান হইতে আসিতেছি।"
মহেন্দ্র বিহারীর বেদনা কল্পনা করিয়া মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করিল। মনে মনে কহিল,
'হতভাগ্য
বিহারী। স্ত্রীলোকের ভালোবাসা হইতে বেচারা একেবারে বঞ্চিত।' বলিয়া নিজের বুকের
পকেটের কাছটায়
এক বার হাত দিয়া চাপ দিল−ভিতর হইতে তিনটে চিঠি খড়খড় করিয়া উঠিল।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, "সবাইকে কেমন দেখিলে?"
বিহারী তাহার উত্তর না করিয়া কহিল,
"বাড়ি ছাড়িয়া তুমি যে এখানে?"
মহেন্দ্র কহিল, "আজকাল প্রায় নাইট-ডিউটি পড়ে−বাড়িতে
অসুবিধা হয়।"
বিহারী কহিল, "এর আগেও তো নাইট-ডিউটি পড়িয়াছে, কিন্তু তোমাকে তো বাড়ি ছাড়িতে দেখি
নাই।"
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, "মনে কোনো সন্দেহ জন্মিয়াছে না কি।"
বিহারী কহিল, "না, ঠাট্টা নয়, এখনি বাড়ি চলো।"
মহেন্দ্র বাড়ি ফিরিবার জন্য উদ্যত হইয়াই ছিল; বিহারীর অনুরোধ শুনিয়া সে হঠাৎ নিজেকে
ভুলাইল, যেন বাড়ি যাইবার জন্য তাহার কিছুমাত্র আগ্রহ নাই। কহিল, "সে কি হয়, বিহারী।
তা হলে আমার বৎসরটাই নষ্ট হইবে।"
বিহারী কহিল, "দেখো মহিনদা, তোমাকে আমি এতটুকু বয়স হইতে দেখিতেছি, আমাকে ভুলাইবার
চেষ্টা করিয়ো না। তুমি অন্যায় করিতেছ।"
মহেন্দ্র। কার প'রে অন্যায় করিতেছি জজসাহেব!
বিহারী রাগ করিয়া বলিল, "তুমি যে চিরকাল হৃদয়ের বড়াই করিয়া আসিয়াছ, তোমার হৃদয় গেল
কোথায় মহিনদা।"
মহেন্দ্র। সম্প্রতি কালেজের হাসপাতালে।
বিহারী। থামো মহিনদা, থামো। তুমি এখানে আমার সঙ্গে হাসিয়া ঠাট্টা করিয়া কথা কহিতেছ,
সেখানে আশা তোমার বাহিরের ঘরে, অন্দরের ঘরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বেড়াইতেছে।
আশার কান্নার কথা শুনিয়া হঠাৎ মহেন্দ্রের মন একটা প্রতিঘাত পাইল। জগতে আর যে কাহারো
সুখদুঃখ আছে, সে কথা তাহার নূতন নেশার কাছে স্থান পায় নাই। হঠাৎ চমক লাগিল,
জিজ্ঞাসা করিল, "আশা কাঁদিতেছে কী জন্য।"
বিহারী বিরক্ত হইয়া কহিল, "সে কথা তুমি জান না, আমি জানি?"
মহেন্দ্র। তোমার মহিনদা সর্বজ্ঞ নয় বলিয়া যদি রাগ করিতেই হয় তো মহিনদার
সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ করো। তখন বিহারী যাহা দেখিয়াছিল, তাহা আগাগোড়া বলিল। বলিতে
বলিতে বিনোদিনীর বক্ষোলগ্ন আশার সেই অশ্রুসিক্ত মুখখানি মনে পড়িয়া বিহারীর প্রায়
কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।
বিহারীর এই প্রবল আবেগ দেখিয়া মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্র জানিত বিহারীর
হৃদয়ের বালাই নাই
−এ উপসর্গ কবে জুটিল। যেদিন কুমারী আশাকে দেখিতে গিয়াছিল, সেই দিন
হইতে নাকি। বেচারা বিহারী। মহেন্দ্র মনে মনে তাহাকে বেচারা বলিল বটে, কিন্তু
দুঃখবোধ না করিয়া বরঞ্চ একটু আমোদ পাইল। আশার মনটি একান্তভাবে যে কোন্ দিকে, তাহা
মহেন্দ্র নিশ্চয় জানিত। “অন্য লোকের কাছে যাহারা বাজ্ঞার ধন, কিন্তু আয়ত্তের অতীত,
আমার কাছে তাহারা চিরদিনের জন্য আপনি ধরা দিয়াছে, ইহাতে মহেন্দ্র বক্ষের মধ্যে
একটা গর্বের স্ফীতি অনুভব করিল।
মহেন্দ্র বিহারীকে কহিল, "আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক। তবে একটা গাড়ি ডাকো।"