ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
২৩
সংসারত্যাগিনী অন্নপূর্ণা বহুদিন পরে হঠাৎ মহেন্দ্রকে আসিতে দেখিয়া যেমন স্নেহে
আনন্দে আপ্লুত হইয়া গেলেন, তেমনি তাঁহার হঠাৎ ভয় হইল, বুঝি আশাকে লইয়া মার সঙ্গে
মহেন্দ্রের আবার কোনো বিরোধ ঘটিয়াছে এবং মহেন্দ্র তাঁহার কাছে নালিশ জানাইয়া
সান্ত্বনালাভ করিতে আসিয়াছে। মহেন্দ্র শিশুকাল হইতেই সকলপ্রকার সংকট ও সন্তাপের সময়
তাহার কাকীর কাছে ছুটিয়া আসে। কাহারো উপর রাগ করিলে অন্নপূর্ণা তাহার রাগ থামাইয়া
দিয়াছেন, দুঃখবোধ করিলে তাহা সহজে সহ্য করিতে উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু বিবাহের পর
হইতে মহেন্দ্রের জীবনে সর্বাপেক্ষা যে সংকটের কারণ ঘটিয়াছে, তাহার প্রতিকারচেষ্টা
দূরে থাক্, কোনোপ্রকার সান্ত্বনা পর্যন্ত তিনি দিতে অক্ষম। সে সম্বন্ধে যেভাবে
যেমন করিয়াই তিনি হস্তক্ষেপ করিবেন,তাহাতেই মহেন্দ্রের সাংসারিক বিপ্লব আরো দ্বিগুণ
বাড়িয়া উঠিবে ইহাই যখন নিশ্চয় বুঝিলেন, তখনই তিনি সংসার ত্যাগ করিলেন। রুগ্ণ শিশু
যখন জল চাহিয়া কাঁদে, এবং জল দেওয়া যখন কবিরাজের নিতান্ত নিষেধ, তখন পীড়িতচিত্তে মা
যেমন অন্য ঘরে চলিয়া যান, অন্নপূর্ণা তেমনি করিয়া নিজেকে প্রবাসে লইয়া গেছেন। দূর
তীর্থবাসে থাকিয়া ধর্মকর্মের নিয়মিত অনুষ্ঠানে এ কয়দিন সংসার অনেকটা ভুলিয়াছিলেন,
মহেন্দ্র আবার কি সেই-সকল বিরোধের কথা তুলিয়া তাঁহার প্রচ্ছন্ন ক্ষতে আঘাত করিতে
আসিয়াছে।
কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে লইয়া তাহার মার সম্বন্ধে কোনো নালিশের কথা তুলিল না। তখন
অন্নপূর্ণার আশঙ্কা অন্য পথে গেল। যে মহেন্দ্র আশাকে ছাড়িয়া কালেজে যাইতে পারিত না,
সে আজ কাকীর খোঁজ লইতে কাশী আসে কেন। তবে কি আশার প্রতি মহেন্দ্রর টান ক্রমে ঢিলা
হইয়া আসিতেছে। মহেন্দ্রকে তিনি কিছু আশঙ্কার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ রে মহিন,
আমার মাথা খা, ঠিক করিয়া বল্ দেখি, চুনি কেমন আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো বেশ ভালো আছে কাকীমা।”
“আজকাল সে কী করে, মহিন। তোরা কি এখনো তেমনি ছেলেমানুষ আছিস, না কাজকর্মে ঘরকন্নায়
মন দিয়াছিস?”
মহেন্দ্র কহিল, “ছেলেমানুষি একেবারেই বন্ধ। সকল ঝঞ্ঝাটের মূল সেই চারুপাঠখানা যে
কোথায় অদৃশ্য হইয়াছে, তাহার আর সন্ধান পাইবার জো নাই। তুমি থাকিলে দেখিয়া খুশি
হইতে–লেখাপড়া শেখায় অবহেলা করা স্ত্রীলোকের পক্ষে যতদূর কর্তব্য, চুনি তাহা একান্ত
মনে পালন করিতেছে।”
“মহিন, বিহারী কী করিতেছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “নিজের কাজ ছাড়া আর-সমস্তই করিতেছে। নায়েব-গোমস্তায় তাহার
বিষয়সম্পত্তি দেখে; কী চক্ষে দেখে, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। বিহারীর চিরকাল ঐ দশা।
তাহার নিজের কাজ পরে দেখে, পরের কাজ সে নিজে দেখে।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি বিবাহ করিবে না, মহিন।”
মহেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া কহিল, “কই, কিছুমাত্র উদ্যোগ তো দেখি না।”
শুনিয়া অন্নপূর্ণা হৃদয়ের গোপন স্থানে একটা আঘাত পাইলেন। তিনি নিশ্চয় বুঝিতে
পারিয়াছিলেন, তাঁহার বোনঝিকে দেখিয়া, একবার বিহারী আগ্রহের সহিত বিবাহ করিতে উদ্যত
হইয়াছিল, তাহার সেই উন্মুখ আগ্রহ অন্যায় করিয়া অকসমাৎ দলিত হইয়াছে। বিহারী
বলিয়াছিল, “কাকীমা, আমাকে আর বিবাহ করিতে কখনো অনুরোধ করিয়ো না।” সেই বড়ো অভিমানের
কথা অন্নপূর্ণার কানে বাজিতেছিল। তাঁহার একান্ত অনুগত সেই স্নেহের বিহারীকে তিনি
এমন মনভাঙা অবস্থায় ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারেন নাই।
অন্নপূর্ণা অত্যন্ত বিমর্ষ ও ভীত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, “এখনো কি আশায় প্রতি বিহারীর
মন পড়িয়া আছে।”
মহেন্দ্র কখনো ঠাট্টার ছলে, কখনো গম্ভীরভাবে, তাহাদের ঘরকন্নার আধুনিক সমস্ত
খবর-বার্তা জানাইল, বিনোদিনীর কথার উল্লেখমাত্র করিল না।
এখন কালেজ খোলা, কাশীতে মহেন্দ্রের বেশি দিন থাকিবার কথা নয়। কিন্তু কঠিন রোগের পর
স্বাসথ্যকর আবহাওয়ার মধ্যে গিয়া আরোগ্যলাভের যে সুখ, মহেন্দ্র কাশীতে অন্নপূর্ণার
নিকটে থাকিয়া প্রতিদিন সেই সুখ অনুভব করিতেছিল–তাই একে একে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল।
নিজের সঙ্গে নিজের যে একটা বিরোধ জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল, সেটা দেখিতে দেখিতে দূর
হইয়া গেল। কয়দিন সর্বদা ধর্মপরায়ণা অন্নপূর্ণার স্নেহমুখচ্ছবির সম্মুখে থাকিয়া,
সংসারের কর্তব্যপালন এমনি সহজ ও সুখকর মনে হইতে লাগিল যে, তাহার পূর্বেকার আতঙ্ক
হাস্যকর বোধ হইল। মনে হইল, বিনোদিনী কিছুই না। এমন কি, তাহার মুখের চেহারাই
মহেন্দ্র স্পষ্ট করিয়া মনে আনিতে পারে না। অবশেষে মহেন্দ্র খুব জোর করিয়াই মনে মনে
কহিল, “আশাকে আমার হৃদয় হইতে এক চুল সরাইয়া বসিতে পারে, এমন তো আমি কোথাও কাহাকেও
দেখিতে পাই না।”
মহেন্দ্র অন্নপূর্ণাকে কহিল, “কাকীমা, আমার কালেজ কামাই যাইতেছে–এবারকার মতো তবে
আসি। যদিও তুমি সংসারের মায়া কাটাইয়া একান্তে আসিয়া আছ–তবু অনুমতি করো মাঝে মাঝে
আসিয়া তোমার পায়ের ধূলা লইয়া যাইব।”
মহেন্দ্র গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন আশাকে তাহার মাসির স্নেহোপহার সিঁদুরের কৌটা ও একটি
সাদা পাথরের চুমকি ঘটি দিল, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। মাসিমার
সেই পরমস্নেহময় ধৈর্য ও মাসিমার প্রতি তাহাদের ও তাহার শাশুড়ির নানাপ্রকার উপদ্রব
স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। স্বামীকে জানাইল, “আমার বড়ো ইচ্ছা করে,
আমি একবার মাসিমার কাছে গিয়া তাঁহার ক্ষমা ও পায়ের ধূলা লইয়া আসি। সে কি কোনোমতেই
ঘটিতে পারে না।”
মহেন্দ্র আশার বেদনা বুঝিল, এবং কিছুদিনের জন্য কাশীতে সে তাহার মাসিমার কাছে যায়,
ইহাতে তাহার সম্মতিও হইল। কিন্তু পুনর্বার কালেজ কামাই করিয়া আশাকে কাশী পৌঁছাইয়া
দিতে তাহার দ্বিধা বোধ হইতে লাগিল।
আশা কহিল, “জেঠাইমা তো অল্পদিনের মধ্যেই কাশী যাইবেন, সেই সঙ্গে গেলে কি ক্ষতি
আছে।”
মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে গিয়া কহিল, “মা, বউ একবার কাশীতে কাকীমাকে দেখিতে যাইতে
চায়।”
রাজলক্ষ্মী শ্লেষবাক্যে কহিলেন, “বউ যাইতে চান তো অবশ্যই যাইবেন, যাও, তাঁহাকে লইয়া
যাও।”
মহেন্দ্র যে আবার অন্নপূর্ণার কাছে যাতায়াত আরম্ভ করিল, ইহা রাজলক্ষ্মীর ভালো লাগে
নাই। বধূর যাইবার প্রস্তাবে তিনি মনে মনে আরো বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।
মহেন্দ্র কহিল, “আমার কালেজ আছে, আমি রাখিতে যাইতে পারিব না। তাহার জেঠামশায়ের
সঙ্গে যাইবে।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে তো ভালো কথা। জেঠামশায়রা বড়োলোক, কখনো আমাদের মতো গরিবের
ছায়া মাড়ান না, তাঁহাদের সঙ্গে যাইতে পারিলে কত গৌরব!”
মাতার উত্তরোত্তর শ্লেষবাক্যে মহেন্দ্রের মন একেবারে কঠিন হইয়া বাঁকিল। সে কোনো
উত্তর না দিয়া আশাকে কাশী পাঠাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া চলিয়া গেল।
বিহারী যখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিল, রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও বিহারী,
শুনিয়াছিস, আমাদের বউমা যে কাশী যাইতে ইচ্ছা করিয়াছেন।”
বিহারী কহিল, “বল কী মা, মহিনদা আবার কালেজ কামাই করিয়া কাশী যাইবে?”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না না, মহিন কেন যাইবেন। তা হইলে আর বিবিয়ানা হইল কই। মহিন
এখানে থাকিবেন, বউ তাঁহার জেঠামহারাজের সঙ্গে কাশী যাইবেন। সবাই সাহেব-বিবি হইয়া
উঠিল।”
বিহারী মনে মনে উদ্বিগ্ন হইল, বর্তমান কালের সাহেবিয়ানা স্মরণ করিয়া নহে। বিহারী
ভাবিতে লাগিল, “ব্যাপারখানা কী। মহেন্দ্র যখন কাশী গেল আশা এখানে রহিল; আবার
মহেন্দ্র যখন ফিরিল তখন আশা কাশী যাইতে চাহিতেছে। দুজনের মাঝখানে একটা কী গুরুতর
ব্যাপার ঘটিয়াছে। এমন করিয়া কতদিন চলিবে? বন্ধু হইয়াও আমরা ইহার কোনো প্রতিকার
করিতে পারিবে না–দূরে দাঁড়াইয়া থাকিব?”
মাতার ব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হইয়া মহেন্দ্র তাহার শয়নঘরে আসিয়া বসিয়া ছিল।
বিনোদিনী ইতিমধ্যে মহেন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাই–তাই আশা তাহাকে পাশের ঘর হইতে
মহেন্দ্রের কাছে লইয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিতেছিল।
এমন সময় বিহারী আসিয়া মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “আশা-বোঠানের কি কাশী যাওয়া স্থির
হইয়াছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “না হইবে কেন। বাধাটা কী আছে।”
বিহারী কহিল, “বাধার কথা কে বলিতেছে। কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল তোমাদের মাথায় আসিল যে?”
মহেন্দ্র কহিল, “মাসিকে দেখিবার ইচ্ছা–প্রবাসী আত্মীয়ের জন্য ব্যাকুলতা,
মানবচরিত্রে এমন মাঝে মাঝে ঘটিয়া থাকে।”
বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি সঙ্গে যাইতেছ?”
প্রশ্ন শুনিয়াই মহেন্দ্র ভাবিল, “জেঠার সঙ্গে আশাকে পাঠানো সংগত নহে, এই কথা লইয়া
আলোচনা করিতে বিহারী আসিয়াছে।” পাছে অধিক কথা বলিতে গেলে ক্রোধ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, তাই
সংক্ষেপে বলিল, “না।”
বিহারী মহেন্দ্রকে চিনিত। সে যে রাগিয়াছে, তাহা বিহারীর আগোচর ছিল না। একবার জিদ
ধরিলে তাহাকে টলানো যায় না, তাহাও সে জানিত। তাই মহেন্দ্রের যাওয়ার কথা আর তুলিল
না। মনে মনে ভাবিল, “বেচারা আশা যদি কোনো বেদনা বহন করিয়াই চলিয়া যাইতেছে হয়, তবে
সঙ্গে বিনোদিনী গেলে তাহার সান্ত্বনা হইবে।” তাই ধীরে ধীরে কহিল, “বিনোদ-বোঠান তাঁর
সঙ্গে গেলে হয় না?”
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিল, “বিহারী, তোমার মনের ভিতর যে-কথাটা আছে, তাহা স্পষ্ট
করিয়া বলো। আমার সঙ্গে অসরলতা করিবার কোনো দরকার দেখি না। আমি জানি, তুমি মনে মনে
সন্দেহ করিয়াছ, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি। মিথ্যা কথা। আমি বাসি না। আমাকে রক্ষা
করিবার জন্য তোমাকে পাহারা দিয়া বেড়াইতে হইবে না। তুমি এখন নিজেকে রক্ষা করো। যদি
সরল বন্ধুত্ব তোমার মনে থাকিত, তবে বহুদিন আগে তুমি আমার কাছে তোমার মনের কথা বলিতে
এবং নিজেকে বন্ধুর অন্তঃপুর হইতে বহু দূরে লইয়া যাইতে। আমি তোমার মুখের সামনে
স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি, তুমি আশাকে ভালোবাসিয়াছ।”
অত্যন্ত বেদনার স্থানে দুই পা দিয়া মাড়াইয়া দিলে, আহত ব্যক্তি মুহূর্তকাল বিচার না
করিয়া আঘাতকারীকে যেমন সবলে ধাক্কা দিয়া ফেলিতে চেষ্টা করে–রুদ্ধকণ্ঠ বিহারী তেমনি
পাংশুমুখে তাহার চৌকি হইতে উঠিয়া মহেন্দ্রের দিকে ধাবিত হইল–হঠাৎ থামিয়া বহুকষ্টে
স্বর বাহির করিয়া কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন, আমি বিদায় হই।” বলিয়া টলিতে
টলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল!
পাশের ঘর হইতে বিনোদিনী ছুটিয়া আসিয়া ডাকিল, “বিহারী-ঠাকুরপো!”
বিহারী দেয়ালে ভর করিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কী, বিনোদ-বোঠান!”
বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, চোখের বালির সঙ্গে আমিও কাশীতে যাইব।” বিহারী কহিল, “না
না, বোঠান, সে হইবে না, সে কিছুতেই হইবে না। তোমাকে মিনতি করিতেছি- আমার কথায় কিছুই
করিয়ো না। আমি এখানকার কেহ নই, আমি এখানকার কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না,
তাহাতে ভালো হইবে না। তুমি দেবী, তুমি যাহা ভালো বোধ কর, তাহাই করিয়ো। আমি চলিলাম।”
বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে বিনম্র নমস্কার করিয়া চলিল। বিনোদিনী কহিল, “আমি দেবী নই
ঠাকুরপো, শুনিয়া যাও। তুমি চলিয়া গেলে কাহারো ভালো হইবে না। ইহার পরে আমাকে দোষ
দিয়ো না।”
বিহারী চলিয়া গেল। মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল। বিনোদিনী তাহার প্রতি জ্বলন্ত
বজ্রের মতো একটা কঠোর কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল, সে-ঘরে আশা একান্ত
লজ্জায় সংকোচে মরিয়া যাইতেছিল। বিহারী তাহাকে ভালোবাসে, এ কথা মহেন্দ্রের মুখে
শুনিয়া সে আর মুখ তুলিতে পারিতেছিল না। কিন্তু তাহার উপর বিনোদিনীর আর দয়া হইল না।
আশা যদি তখন চোখ তুলিয়া চাহিত, তাহা হইলে সে ভয় পাইত। সমস্ত সংসারের উপর বিনোদিনীর
যেন খুন চাপিয়া গেছে। মিথ্যা কথা বটে! বিনোদিনীকে কেহই ভালোবাসে না বটে! সকলেই
ভালোবাসে এই লজ্জাবতী ননির পুতুলটিকে।
মহেন্দ্র সেই যে আবেগের মুখে বিহারীকে বলিয়াছিল, “আমি পাষণ্ড”–তাহার পর আবেগ
শান্তির পর হইতে সেই হঠাৎ আত্মপ্রকাশের জন্য সে বিহারীর কাছে কুণ্ঠিত হইয়া ছিল। সে
মনে করিতেছিল, তাহার সব কথাই যেন ব্যক্ত হইয়া গেছে। সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না, অথচ
বিহারী জানিয়াছে যে সে ভালোবাসে-ইহাতে বিহারীর উপরে তাহার বড়ো একটা বিরক্তি
জন্মিতেছিল। বিশেষত, তাহার পর হইতে যতবার বিহারী তাহার সম্মুখে আসিতেছিল তাহার মনে
হইতেছিল, যেন বিহারী সকৌতূহলে তাহার একটা ভিতরকার কথা খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। সেই-সমস্ত
বিরক্তি উত্তরোত্তর জমিতেছিল–আজ একটু আঘাতেই বাহির হইয়া পড়িল।
কিন্তু বিনোদিনী পাশের ঘর হইতে যেরূপ ব্যাকুলভাবে ছুটিয়া আসিল, যেরূপ আর্তকণ্ঠে
বিহারীকে রাখিতে চেষ্টা করিল এবং বিহারীর আদেশ পালন স্বরূপে আশার সহিত কাশী যাইতে
প্রস্তুত হইল, ইহা মহেন্দ্রের পক্ষে অভাবিতপূর্ব। এই দৃশ্যটি মহেন্দ্রকে প্রবল
আঘাতে অভিভূত করিয়া দিল। সে বলিয়াছিল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না; কিন্তু যাহা
শুনিল, যাহা দেখিল, তাহা তাহাকে সুস্থির হইতে দিল না, তাহাকে চারি দিক হইতে বিচিত্র
আকারে পীড়ন করিতে লাগিল। আর কেবলই নিষ্ফল পরিতাপের সহিত মনে হইতে লাগিল, “বিনোদিনী
শুনিয়াছে–আমি বলিয়াছি “আমি তাহাকে ভালোবাসি না”