ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 


চোখের বালি

৩০

    আশা একদিন অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা মাসিমা, মেসোমশায়কে তোমার মনে পড়ে?”
    অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আমি এগারো বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছি, স্বামীর মূর্তি ছায়ার মতো মনে হয়।”
    আশা জিজ্ঞাসা করিল, “মাসি, তবে তুমি কাহার কথা ভাব।”
    অন্নপূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমার স্বামী এখন যাঁহার মধ্যে আছেন, সেই ভগবানের কথা ভাবি।”
    আশা কহিল, “তাহাতে তুমি সুখ পাও?”
    অন্নপূর্ণা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমার সে মনের কথা তুই কি বুঝবি বাছা। সে আমার মন জানে, আর যাঁর কথা ভাবি তিনিই জানেন।”
    আশা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “আমি যাঁর কথা রাত্রিদিন ভাবি, তিনি কি আমার মনের কথা জানেন না। আমি ভালো করিয়া চিঠি লিখিতে পারি না বলিয়া তিনি কেন আমাকে চিঠি লেখা ছাড়িয়া দিয়াছেন।”
    আশা কয়দিন মহেন্দ্রের চিঠি পায় নাই। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সে ভাবিল, “চোখের বালি যদি হাতের কাছে থাকিত, সে আমার মনের কথা ঠিকমতো করিয়া লিখিয়া দিতে পারিত।”
    কুলিখিত তুচ্ছপত্র স্বামীর কাছে আদর পাইবে না মনে করিয়া চিঠি লিখিতে কিছুতে আশার হাত সরিত না। যতই যত্ন করিয়া লিখিতে চাহিত, ততই তাহার অক্ষর খারাপ হইয়া যাইত। মনের কথা যতই ভালো করিয়া গুছাইয়া লইবার চেষ্টা করিত ততই তাহার পদ কোনোমতেই সম্পূর্ণ হইত না। যদি একটিমাত্র “শ্রীচরণেষু” লিখিয়া নাম সহি করিলেই মহেন্দ্র অন্তর্যামী দেবতার মতো সকল কথা বুঝিতে পারিত, তাহা হইলেই আশার চিঠিলেখা সার্থক হইত। বিধাতা এতখানি ভালোবাসা দিয়াছিলেন, একটুখানি ভাষা দেন নাই কেন।
    মন্দিরে সন্ধ্যারতির পরে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আশা অন্নপূর্ণার পায়ের কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ নিঃশব্দের পর বলিল, “মাসি, তুমি যে বল, স্বামীকে দেবতার মতো করিয়া সেবা করা স্ত্রীর ধর্ম, কিন্তু যে স্ত্রী মূর্খ, যাহার বুদ্ধি নাই, কেমন করিয়া স্বামীর সেবা করিতে হয় যে জানে না, সে কী করিবে।”
    অন্নপূর্ণা কিছুক্ষণ আশার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন–একটি চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বাছা, আমিও তো মূর্খ, তবুও তো ভগবানের সেবা করিয়া থাকি।”
    আশা কহিল, “তিনি যে তোমার মন জানেন, তাই খুশি হন। কিন্তু মনে করো, স্বামী যদি মূর্খের সেবায় খুশি না হন?”
    অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সকলকে খুশি করিবার শক্তি সকলের থাকে না, বাছা। স্ত্রী যদি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তিযত্নের সঙ্গে স্বামীর সেবা ও সংসারের কাজ করে, তবে স্বামী তাহা তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিলেও স্বয়ং জগদীশ্বর তাহা কুড়াইয়া লন।”
    আশা নিরুত্তরে চুপ করিয়া রহিল। মাসির এই কথা হইতে সান্ত্বনা গ্রহণের অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু স্বামী যাহাকে তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিবেন, জগদীশ্বরও যে তাহাকে সার্থকতা দিতে পারিবেন, এ কথা কিছুতেই তাহার মনে হইল না। সে নতমুখে বসিয়া তাহার মাসির পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।
    অন্নপূর্ণা তখন আশার হাত ধরিয়া তাহাকে আরো কাছে টানিয়া লইবেন। তাহার মস্তক চুম্বন করিলেন; রুদ্ধকণ্ঠকে দৃঢ়চেষ্টায় বাধামুক্ত করিয়া কহিলেন, “চুনি, দুঃখে কষ্টে যে শিক্ষালাভ হয় শুধু কানে শুনিয়া তাহা পাইবি না। তোর এই মাসিও একদিন তোর বয়সে তোরই মতো সংসারের সঙ্গে মস্ত করিয়া দেনাপাওনার সম্পর্ক পাতিয়া বসিয়াছিল। তখন আমিও তোরই মতো মনে করিতাম, যাহার সেবা করিব তাহার সন্তোষ না জন্মিবে কেন। যাহার পূজা করিব তাহার প্রসাদ না পাইব কেন। যাহার ভালোর চেষ্টা করিব, সে আমার চেষ্টাকে ভালো বলিয়া না বুঝিবে কেন। পদে পদে দেখিলাম, সেরূপ হয় না। অবশেষে একদিন অসহ্য হইয়া মনে হইল, পৃথিবীতে আমার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে–সেইদিনই সংসার ত্যাগ করিয়া আসিলাম। আজ দেখিতেছি, আমার কিছুই নিষ্ফল হয় নাই। ওরে বাছা, যাঁর সঙ্গে আসল দেনাপাওনার সম্পর্ক, যিনি এই সংসার-হাটের মূল মহাজন, তিনিই আমার সমস্তই লইতেছিলেন, হৃদয়ে বসিয়া আজ সে কথা স্বীকার করিয়াছেন। তখন যদি জানিতাম! যদি তাঁর কর্ম বলিয়া সংসারের কর্ম করিতাম, তাঁকে দিলাম বলিয়াই সংসারকে হৃদয় দিতাম,তা হইলে কে আমাকে দুঃখ দিতে পারিত।”
    আশা বিছানায় শুইয়া শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত অনেক কথা ভাবিল, তবু ভালো করিয়া কিছুই বুঝিতে পারিল না। কিন্তু পুণ্যবতী মাসির প্রতি তাহার অসীম ভক্তি ছিল, সেই মাসির কথা সম্পূর্ণ না বুঝিলেও একপ্রকার শিরোধার্য করিয়া লইল। মাসি সকল সংসারের উপরে যাঁহাকে হৃদয়ে স্থান দিয়াছেন, তাঁহার উদ্দেশে অন্ধকারে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া গড় করিয়া প্রণাম করিল। বলিল, “আমি বালিকা, তোমাকে জানি না, আমি কেবল আমার স্বামীকে জানি, সেজন্য অপরাধ লইয়ো না। আমার স্বামীকে আমি যে পূজা দিই, ভগবান, তুমি তাঁহাকে তাহা গ্রহণ করিতে বলিয়ো তিনি যদি তাহা পায়ে ঠেলিয়া দেন, তবে আর বাঁচিব না। আমি আমার মাসিমার মতো পুণ্যবতী নই, তোমাকে আশ্রয় করিয়া আমি রক্ষা পাইব না।” এই বলিয়া আশা বার বার বিছানার উপর গড় করিয়া প্রণাম করিল।
    আশার জেঠামশায়ের ফিরিবার সময় হইল। বিদায়ের পূর্বসন্ধ্যায় অন্নপূর্ণা আশাকে আপনার কোলে বসাইয়া কহিলেন, “চুনি, মা আমার, সংসারের শোক-দুঃখ-অমঙ্গল হইতে তোকে সর্বদা রক্ষা করিবার শক্তি আমার নাই। আমার এই উপবেশ, যেখান থেকে যত কষ্টই পাস, তোর বিশ্বাস তোর ভক্তি স্থির রাখিস, তোর ধর্ম যেন অটল থাকে।”
    আশা তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, “আশীর্বাদ করো মাসিমা, তাই হইবে।”


৩১

    আশা ফিরিয়া আসিল। বিনোদিনী তাহার ‘পরে খুব অভিমান করিল–”বালি, এতদিন বিদেশে রহিলে, একখানা চিঠি লিখিতে নাই?”
    আশা কহিল, “তুমিই কোন্‌ লিখিলে ভাই, বালি।”
    বিনোদিনী। আমি কেন প্রথমে লিখিব। তোমারই তো লিখিবার কথা।
    আশা বিনোদিনীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া লইল। কহিল, “জান তো ভাই, আমি ভালো লিখিতে জানি না। বিশেষ, তোমার মতো পণ্ডিতের কাছে লিখিতে আমার লজ্জা করে।”
    দেখিতে দেখিতে দুইজনের বিবাদ মিটিয়া গিয়া প্রণয় উদ্‌বেলিত হইয়া উঠিল।
    বিনোদিনী কহিল, “দিনরাত্রি সঙ্গ দিয়া তোমার স্বামীটির অভ্যাস তুমি একেবারে খারাপ করিয়া দিয়াছ। একটি কেহ কাছে নহিলে থাকিতে পারে না।”
আশা। সেইজন্যই তো তোমার উপরে ভার দিয়া গিয়াছিলাম। কেমন করিয়া সঙ্গ দিতে হয়, আমার চেয়ে তুমি ভালো জান।
    বিনোদিনী। দিনটা তো একরকম করিয়া কালেজে পাঠাইয়া নিশ্চিন্ত হইতাম, কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় কোনোমতেই ছাড়াছুড়ি নাই–গল্প করিতে হইবে, বই পড়িয়া শুনাইতে হইবে, আবদারের শেষ নাই।
    আশা। কেমন জব্দ! লোকের মন ভুলাইতে যখন পার তখন লোকেই বা ছাড়িবে কেন।
    বিনোদিনী। সাবধান থাকিস, ভাই। ঠাকুরপো যেরকম বাড়াবাড়ি করেন, এক-একবার সন্দেহ হয়, বুঝি বশ করিবার বিদ্যা জানি বা।
    আশা হাসিয়া কহিল, “তুমি জান না তো কে জানে। তোমার বিদ্যা আমি একটুখানি পাইলে বাঁচিয়া যাইতাম।” বিনোদিনী। কেন, কার সর্বনাশ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে। ঘরে যেটি আছে, সেইটিকে রক্ষা কর্‌, পরকে
    ভোলাইবার চেষ্টা করিস নে ভাই বালি। বড়ো ল্যাঠা। আশা বিনোদিনীকে হস্তদ্বারা তর্জন করিয়া বলিল, “আঃ, কী বকিস, তার ঠিক নেই।” কাশী হইতে ফিরিয়া আসার পর প্রথম সাক্ষাতেই মহেন্দ্র কহিল, “তোমার শরীর বেশ ভালো ছিল
দেখিতেছি, দিব্য মোটা হইয়া আসিয়াছ।”
    আশা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করিল। কোনোমতেই তাহার শরীর ভালো থাকা উচিত ছিল না–কিন্তু মূঢ় আশার কিছুই ঠিকমত চলে না; তাহার মন যখন এত খারাপ ছিল, তখনো তাহার পোড়া শরীর মোটা হইয়া উঠিয়াছিল; একে তো মনের ভাব ব্যক্ত করিতে কথা জোটে না, তাহাতে আবার শরীরটাও উলটা বলিতে থাকে।
    আশা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কেমন ছিলে।” আগে হইলে মহেন্দ্র কতক ঠাট্টা, কতক মনের সঙ্গে বলিত, “মরিয়া ছিলাম।” এখন আর ঠাট্টা করিতে পারিল না, গলার কাছে আসিয়া বাধিয়া গেল। কহিল, “বেশ ছিলাম, মন্দ ছিলাম না।”
    আশা চাহিয়া দেখিল, মহেন্দ্র পূর্বের চেয়ে যেন রোগাই হইয়াছে–তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ, চোখে একপ্রকার তীব্র দীপ্তি। একটা যেন আভ্যন্তরিক ক্ষুধায় তাহাকে অগ্নিজিহ্বা দিয়া লেহন করিয়া খাইতেছে। আশা মনে মনে ব্যথা অনুভব করিয়া ভাবিল, “আহা, আমার স্বামী ভালো ছিলেন না, কেন আমি উঁহাকে ফেলিয়া কাশী চলিয়া গেলাম।” স্বামী রোগা হইলেন, অথচ নিজে মোটা হইল, ইহাতেও নিজের স্বাসেথ্যর প্রতি আশার অত্যন্ত ধিক্‌কার জন্মিল।
মহেন্দ্র আর কী কথা তুলিবে ভাবিতে ভাবিতে খানিক বাদে জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা ভালো আছেন তো?”
    সে প্রশ্নের উত্তরে কুশল-সংবাদ পাইয়া তাহার আর দ্বিতীয় কথা মনে আনা দুঃসাধ্য হইল। কাছে একটা ছিন্ন পুরাতন খবরের কাগজ ছিল, সেইটে টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র অন্যমনস্কভাবে পড়িতে লাগিল। আশা মুখ নিচু করিয়া ভাবিতে লাগিল, “এতদিন পরে দেখা হইল, কিন্তু উনি আমার সঙ্গে কেন ভালো করিয়াকথা কহিলেন না, এমন-কি, আমার মুখের দিকেও যেন চাহিতে পারিলেন না। আমি তিন-চার দিন চিঠি লিখিতে পারি নাই বলিয়া কি রাগ করিয়াছেন, আমি মাসির অনুরোধে বেশি দিন কাশীতে ছিলাম বলিয়া কি বিরক্ত হইয়াছেন।” অপরাধ কোন্‌ ছিদ্র দিয়া কেমন করিয়া প্রবেশ করিল, ইহাই সে নিতান্ত ক্লিষ্টহৃদয়ে সন্ধান করিতে লাগিল।
    মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিল। অপরাহ্নে জলপানের সময় রাজলক্ষ্মী ছিলেন, আশাও ঘোমটা দিয়া অদূরে দুয়ার ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, কিন্তু আর কেহই ছিল না।
    রাজলক্ষ্মী উদ্‌বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কি তোর অসুখ করিয়াছে মহিন।”
    মহেন্দ্র বিরক্তভাবে কহিল, “না মা, অসুখ কেন করবে।”
    রাজলক্ষ্মী। তবে তুই যে কিছু খাইতেছিস না!
    মহেন্দ্র পুনর্বার উত্ত্যক্তস্বরে কহিল, “এই তো, খাচ্ছি না তো কী।”
    মহেন্দ্র গ্রীষেমর সন্ধ্যায় একখানা পাতলা চাদর গায়ে ছাদের এধারে ওধারে বেড়াইতে লাগিল। মনে বড়ো আশা ছিল, তাহাদের নিয়মিত পড়াটা আজ ক্ষান্ত থাকিবে না। আনন্দমঠ প্রায় শেষ হইয়াছে, আর গুটি দুই-তিন অধ্যায় বাকি আছে মাত্র। বিনোদিনী যত নিষ্ঠুর হোক সে-কয়টা অধ্যায় আজ তাহাকে নিশ্চয় শুনাইয়া যাইবে। কিন্তু সন্ধ্যা অতীত হইল, সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেল, গুরুভার নৈরাশ্য বহিয়া মহেন্দ্রকে শুইতে যাইতে হইল।
    সজ্জিত লজ্জান্বিত আশা ধীরে ধীরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। দেখিল, বিছানায় মহেন্দ্র শুইয়া পড়িয়াছে। তখন, কেমন করিয়া অগ্রসর হইবে ভাবিয়া পাইল না। বিচ্ছেদের পর কিছুক্ষণ একটা নূতন লজ্জা আসে-যেখানটিতে ছাড়িয়া যাওয়া যায় ঠিক সেইখানটিতে মিলিবার পূর্বে পরস্পর পরস্পরের নিকট হইতে নূতন সম্ভাষণের প্রত্যাশা করে। আশা তাহার সেই চিরপরিচিত আনন্দশয্যাটিতে আজ অনাহূত কেমন করিয়া প্রবেশ করিবে। দ্বারের কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল–মহেন্দ্রের কোনো সাড়া পাইল না। অত্যন্ত ধীরে ধীরে এক পা এক পা করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। যদি অসতর্কে দৈবাৎ কোনো গহনা বাজিয়া উঠে তো সে লজ্জায় মরিয়া যায়। কম্পিতহৃদয়ে আশা মশারির কাছে আসিয়া অনুভব করিল, মহেন্দ্র ঘুমাইতেছে। তখন তাহার নিজের সাজসজ্জা তাহাকে সর্বাঙ্গে বেষ্টন করিয়া পরিহাস করিতে লাগিল। ইচ্ছা হইল, বিদ্যুদ্‌বেগে এ ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্য কোথাও গিয়া শোয়।
    আশা যথাসাধ্য নিঃশব্দে সংকুচিত হইয়া খাটের উপর গিয়া উঠিল। তবু তাহাতে এতটুকু শব্দ ও নড়াচড়া হইল যে, মহেন্দ্র যদি সত্যই ঘুমাইত, তাহা হইলে জাগিয়া উঠিত। কিন্তু আজ তাহার চক্ষু খুলিল না, কেননা, মহেন্দ্র ঘুমাইতেছিল না। মহেন্দ্র খাটের অপর প্রান্তে পাশ ফিরিয়া শুইয়া ছিল, সুতরাং আশা তাহার পশ্চাতে শুইয়া রহিল। আশা যে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করিতেছিল, তাহা পিছন ফিরিয়াও মহেন্দ্র স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিল। নিজের নিষ্ঠুরতায় তাহার হৃৎপিণ্ডটাকে যেন জাঁতার মতো পেষণ করিয়া ব্যথা দিতেছিল। কিন্তু কী কথা বলিবে, কেমন করিয়া আদর করিবে, মহেন্দ্র তাহা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না; মনে মনে নিজেকে সুতীব্র কশাঘাত করিতে লাগিল, তাহাতে আঘাত পাইল, কিন্তু উপায় পাইল না। ভাবিল, “প্রাতঃকালে তো ঘুমের ভান করা যাইবে না, তখন মুখোমুখি হইলে আশাকে কী কথা বলিব।”
    আশা নিজেই মহেন্দ্রের সে সংকট দূর করিয়া দিল। সে অতি প্রত্যুষেই অপমানিত সাজসজ্জা লইয়া বিছানা ছাড়িয়া চলিয়া গেল, সে-ও মহেন্দ্রকে মুখ দেখাইতে পারিল না।