ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৩২
আশা ভাবিতে লাগিল, “এমন কেন হইল। আমি কী করিয়াছি।” যে জায়গায় যথার্থ বিপদ, সে
জায়গায় তাহার চোখ পড়িল না। বিনোদিনীকে যে মহেন্দ্র ভালোবাসিতে পারে, এ সম্ভাবনাও
তাহার মনে উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তা ছাড়া বিবাহের
অনতিকালে পর হইতে সে মহেন্দ্রকে যাহা বলিয়া নিশ্চয় জানিয়াছিল, মহেন্দ্র যে তাহা
ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে, ইহা তাহার কল্পনাতেও আসে নাই।
মহেন্দ্র আজ সকাল সকাল কালেজে গেল। কালেজযাত্রাকালে আশা বরাবর জানলার কাছে আসিয়া
দাঁড়াইত, এবং মহেন্দ্র গাড়ি হইতেই একবার মুখ তুলিয়া দেখিত, ইহা তাহাদের চিরকালের
নিত্য প্রথা ছিল। সেই অভ্যাস অনুসারে গাড়ির শব্দ শুনিবামাত্র যন্ত্রচালিতের মতো আশা
জানলার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রও অভ্যাসের খাতিরে একবার চকিতের মতো উপরে
চোখ তুলিল; দেখিল, আশা দাঁড়াইয়া আছে–তখনো তাহার স্নান হয় নাই, মলিন বস্ত্র, অসংযত
কেশ, শুষ্ক মুখ–দেখিয়া নিমেষের মধ্যেই মহেন্দ্র চোখ নামাইয়া কোলের বই দেখিতে লাগিল।
কোথায় চোখে চোখে সেই নীরব সম্ভাষণ, সেই ভাষাপূর্ণ হাসি!
গাড়ি চলিয়া গেল; আশা সেইখানেই মাটির উপর বসিয়া পড়িল। পৃথিবী সংসার সমস্ত বিস্বাদ
হইয়া গেল। কলিকাতার কর্মপ্রবাহে তখন জোয়ার আসিবার সময়। সাড়ে দশটা বাজিয়াছে–আপিসের
গাড়ির বিরাম নাই, ট্রামের পশ্চাতে ট্রাম ছুটিতেছে–সেই ব্যস্ততাবেগবান কর্মকল্লোলের
অদূরে এই একটি বেদনাস্তম্ভিত মুহ্যমান হৃদয় অত্যন্ত বিসদৃশ।
হঠাৎ এক সময় আশার মনে হইল, “বুঝিয়াছি। ঠাকুরপো কাশী গিয়াছিলেন, সেই খবর পাইয়া উনি
রাগ করিয়াছেন। ইহা ছাড়া ইতিমধ্যে আর তো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই। কিন্তু আমার
তাহাতে কী দোষ ছিল।”
ভাবিতে ভাবিতে অকস্মাৎ এক মুহূর্তের জন্য যেন আশার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হইয়া গেল। হঠাৎ
তাহার আশঙ্কা হইল, মহেন্দ্র বুঝি সন্দেহ করিয়াছেন, বিহারীর কাশী যাওয়ার সঙ্গে আশারও
কোনো যোগ আছে। দুইজনে পরামর্শ করিয়া এই কাজ। ছি ছি ছি। এমন সন্দেহ! কী লজ্জা! একে
তো বিহারীর সঙ্গে তাহার নাম জড়িত হইয়া ধিক্কারের কারণ ঘটিয়াছে, তাহার উপরে
মহেন্দ্র যদি এমন সন্দেহ করে, তবে তো আর প্রাণ রাখা যায় না। কিন্তু যদি কোনো
সন্দেহের কারণ হয়, যদি কোনো অপরাধ ঘটিয়া থাকে, মহেন্দ্র কেন স্পষ্ট করিয়া বলে
না–বিচার করিয়া তাহার উপযুক্ত দণ্ড কেন না দেয়। মহেন্দ্র খোলসা কোনো কথা না বলিয়া
কেবলই আশাকে যেন এড়াইয়া বেড়াইতেছে, তাই আশার বার বার মনে হইতে লাগিল, মহেন্দ্রের
মনে এমন কোনো সন্দেহ আসিয়াছে, যাহা নিজেই সে অন্যায় বলিয়া জানে, যাহা সে আশার কাছে
স্পষ্ট করিয়া স্বীকার করিতেও লজ্জা বোধ করিতেছে। নহিলে এমন অপরাধীর মতো তাহার
চেহারা হইবে কেন। ক্রুদ্ধ বিচারকের তো এমন কুণ্ঠিত ভাব হইবার কথা নহে।
মহেন্দ্র গাড়ি হইতে চকিতের মতো সেই যে আশার মলান করুণ মুখ দেখিয়া গেল, তাহা সমস্ত
দিনে সে মন হইতে মুছিতে পারিল না। কালেজের লেকচারের মধ্যে, শ্রেণীবদ্ধ ছাত্রমণ্ডলীর
মধ্যে, সেই বাতায়ন, আশার সেই অস্নাত রুক্ষ কেশ, সেই মলিন বস্ত্র, সেই
ব্যথিত-ব্যাকুল দৃষ্টিপাত সুস্পষ্টরেখায় বারংবার অঙ্কিত হইয়া উঠিতে লাগিল।
কালেজের কাজ সারিয়া সে গোলদিঘির ধারে বেড়াইতে লাগিল। বেড়াইতে বেড়াইতে সন্ধ্যা হইয়া
আসিল; আশার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার কর্তব্য তাহা সে কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না–সদয় ছলনা,
না অকপট নিষ্ঠুরতা, কোন্টা উচিত। বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করিবে কি না, সে-তর্ক আর মনে
উদয়ই হয় না। দয়া এবং প্রেম, মহেন্দ্র উভয়ের দাবি কেমন করিয়া রাখিবে।
মহেন্দ্র তখন মনকে এই বলিয়া বুঝাইল যে,আশার প্রতি এখনো তাহার যে ভালোবাসা আছে, তাহা
অল্প স্ত্রীর ভাগ্যে জোটে। সেই স্নেহ সেই ভালোবাসা পাইলে আশা কেন না সন্তুষ্ট
থাকিবে। বিনোদিনী এবং আশা, উভয়কেই স্থান দিবার মতো প্রশস্ত হৃদয় মহেন্দ্রের আছে।
বিনোদিনীর সহিত মহেন্দ্রের যে পবিত্র প্রেমের সম্বন্ধ তাহাতে দাম্পত্যনীতির কোনো
ব্যাঘাত হইবে না।
এইরূপ বুঝাইয়া মহেন্দ্র মন হইতে একটা ভার নামাইয়া ফেলিল। বিনোদিনী এবং আশা, কাহাকেও
ত্যাগ না করিয়া দুইচন্দ্রসেবিত গ্রহের মতো এইভাবেই সে চিরকাল কাটাইয়া দিতে পারিবে,
এই মনে করিয়া তাহার মন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। আজ রাত্রে সে সকাল সকাল বিছানায় প্রবেশ
করিয়া আদরে যত্নে স্নিগ্ধ আলাপে আশার মন হইতে সমস্ত বেদনা দূর করিয়া দিবে, ইহা
নিশ্চয় করিয়া দ্রুতপদে বাড়ি চলিয়া আসিল।
আহারের সময় আশা উপস্থিত ছিল না, কিন্তু সে এক সময় শুইতে আসিবে তো, এই মনে করিয়া
মহেন্দ্র বিছানার মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু নিস্তব্ধ ঘরে সেই শূন্য শয্যার মধ্যে
কোন্ সমৃতি মহেন্দ্রের হৃদয়কে আবিষ্ট করিয়া তুলিল। আশার সহিত নবপরিণয়ের নিত্যনূতন
লীলাখেলা? না। সূর্যালোকের কাছে জ্যোৎস্না যেমন মিলাইয়া যায়, সে-সকল সমৃতি তেমনি
ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে–একটি তীব্র-উজ্জ্বল তরুণীমূর্তি, সরলা বালিকার সলজ্জ
স্নিগ্ধচ্ছবিকে কোথায় আবৃত আচ্ছন্ন করিয়া দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে
বিষবৃক্ষ লইয়া সেই কাড়াকাড়ি মনে পড়িতে লাগিল; সন্ধ্যার পর বিনোদিনী কপালকুণ্ডলা
পড়িয়া শুনাইতে শুনাইতে ক্রমে রাত্রি হইয়া আসিত, বাড়ির লোক ঘুমাইয়া পড়িত, রাত্রে
নিভৃত কক্ষের সেই স্তব্ধ নির্জনতায় বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর যেন আবেশে মৃদুতর ও
রুদ্ধপ্রায় হইয়া আসিত, হঠাৎ সে আত্মসংবরণ করিয়া বই ফেলিয়া উঠিয়া পড়িত, মহেন্দ্র
বলিত, “তোমাকে সিঁড়ির নীচে পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া আসি।” সেই-সকল কথা বারংবার মনে
পড়িয়া তাহার সর্বাঙ্গে পুলকসঞ্চার করিতে লাগিল। রাত্রি বাড়িয়া চলিল–মহেন্দ্রের মনে
মনে ঈষৎ আশঙ্কা হইতে লাগিল, এখনই আশা আসিয়া পড়িবে–কিন্তু আশা আসিল না। মহেন্দ্র
ভাবিল, “আমি তো কর্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আশা যদি অন্যায় রাগ করিয়া না
আসে তো আমি কী করিব।” এই বলিয়া নিশীথরাত্রে বিনোদিনীর ধ্যানকে ঘনীভূত করিয়া তুলিল।
ঘড়িতে যখন একটা বাজিল, তখন মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না, মশারি খুলিয়া বাহির হইয়া
পড়িল। ছাদে আসিয়া দেখিল, গ্রীষেমর জ্যোৎস্নারাত্রি বড়ো রমণীয় হইয়াছে। কলিকাতার
প্রকাণ্ড নিঃশব্দতা এবং সুপ্তি যেন স্তব্ধ সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় স্পর্শগম্য বলিয়া
বোধ হইতেছে–অসংখ্য হর্ম্যশ্রেণীর উপর দিয়া মহানগরীর নিদ্রাকে নিবিড়তর করিয়া বাতাস
মৃদুগমনে পদচারণ করিয়া আসিতেছে।
মহেন্দ্রের বহুদিনের রুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা আপনাকে আর ধরিয়া রাখিতে পারিল না। আশা কাশী
হইতে ফিরিয়া অবধি বিনোদিনী তাহাকে দেখা দেয় নাই। জ্যোৎস্নামদবিহ্বল নির্জন রাত্রি
মহেন্দ্রকে মোহাবিষ্ট করিয়া বিনোদিনীর দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। মহেন্দ্র
সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল। বিনোদিনীর ঘরের সম্মুখের বারান্দায় আসিয়া দেখিল, ঘর বন্ধ হয়
নাই। ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, বিছানা তৈরি রহিয়াছে, কেহ শোয় নাই। ঘরের মধ্যে পদশব্দ
শুনিতে পাইয়া ঘরের দক্ষিণদিকের খোলা বারান্দা হইতে বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল,
“কে ও।”
মহেন্দ্র অভিভূত আর্দ্র কণ্ঠে উত্তর করিল, “বিনোদ, আমি।”
বলিয়া সে একেবারে বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইল।
গ্রীষ্মরাত্রিতে বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বিনোদিনীর সঙ্গে রাজলক্ষ্মী শুইয়া ছিলেন,
তিনি বলিয়া উঠিলেন, “মহিন, এত রাত্রে তুই এখানে যে!”
বিনোদিনী তাহার ঘনকৃষ্ণ ভ্রুযুগের নীচে হইতে মহেন্দ্রের প্রতি বজ্রাগ্নি নিক্ষেপ
করিল। মহেন্দ্র কোনো উত্তর না দিয়া দ্রুতপদে সেখান হইতে চলিয়া গেল।