ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৩৪
রাজলক্ষ্মী আজ সকাল হইতে আর বিনোদিনীকে ডাকেন নাই। বিনোদিনী নিয়মমত ভাঁড়ারে গেল,
দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া চাহিলেন না।
সে তাহা লক্ষ্য করিয়াও বলিল, “পিসিমা, তোমার অসুখ করিয়াছে বুঝি? করিবারই কথা। কাল
রাত্রে ঠাকুরপো যে কীর্তি করিলেন। একেবারে পাগলের মতো আসিয়া উপস্থিত। আমার তো তার
পরে ঘুম হইল না।”
রাজলক্ষ্মী মুখ ভার করিয়া রহিলেন, হাঁ-না কোনো উত্তরই করিলেন না।
বিনোদিনী বলিল, “হয়তো চোখের বালির সঙ্গে সামান্য কিছু খিটিমিটি হইয়া থাকিবে, আর
দেখে কে। তখনই নালিশ কিংবা নিষ্পত্তির জন্যে আমাকে ধরিয়া লইয়া যাওয়া চাই, রাত
পোহাইতে তর সয় না। যাই বল পিসিমা, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার ছেলের সহস্র গুণ থাকিতে
পারে, কিন্তু ধৈর্যের লেশমাত্র নাই। ঐজন্যেই আমার সঙ্গে কেবলই ঝগড়া হয়।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ, তুমি মিথ্যা বকিতেছ–আমার আজ আর কোনো কথা ভালো লাগিতেছে
না।”
বিনোদিনী কহিল, “আমারও কিছু ভালো লাগিতেছে না, পিসিমা। তোমার মনে আঘাত লাগিবে, এই
ভয়ে মিথ্যা কথা দিয়া তোমার ছেলের দোষ ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু এমন হইয়াছে যে
আর ঢাকা পড়ে না।”
রাজলক্ষ্মী। আমার ছেলের দোষ-গুণ আমি জানি–কিন্তু তুমি যে কেমন মায়াবিনী, তাহা আমি
জানিতাম না!
বিনোদিনী কী একটা বলিবার জন্য উদ্যত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিল–কহিল, “সে কথা ঠিক
পিসিমা, কেহ কাহাকেও জানে না। নিজের মনও কি সবাই জানে। তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের
উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর
করিয়া দেখো দেখি।”
রাজলক্ষ্মী অগ্নির মতো উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন–কহিলেন, “হতভাগিনী, ছেলের সম্বন্ধে মার
নামে তুই এমন অপবাদ দিতে পারিস? তোর জিব খসিয়া পড়িবে না!”
বিনোদিনী অবিচলিতভাবে
কহিল, “পিসিমা, আমরা মায়াবিনীর জাত, আমার মধ্যে কী মায়া ছিল, তাহা আমি ঠিক জানি
নাই, তুমি জানিয়াছ–তোমার মধ্যেও কী মায়া ছিল, তাহা তুমি ঠিক জান নাই, আমি জানিয়াছি।
কিন্তু মায়া ছিল, নহিলে এমন ঘটনা ঘটিত না। ফাঁদ আমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না
জানিয়া পাতিয়াছি। ফাঁদ তুমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না জানিয়া পাতিয়াছ। আমাদের
জাতের ধর্ম এইরূপ–আমরা মায়াবিনী।”
রোষে রাজলক্ষ্মীর যেন কণ্ঠরোধ হইয়া গেল–তিনি ঘর ছাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।
বিনোদিনী একলা ঘরে ক্ষণকালের জন্য স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল–তাহার দুই চক্ষে আগুন
জ্বলিয়া উঠিল।
সকালবেলাকার গৃহকার্য হইয়া গেলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মহেন্দ্র
বুঝিল, কাল রাত্রিকার ব্যাপার লইয়া আলোচনা হইবে। তখন বিনোদিনীর কাছ হইতে পত্রোত্তর
পাইয়া তাহার মন বিকল হইয়া উঠিয়াছিল। সেই আঘাতের প্রতিঘাত স্বরূপে তাহার সমস্ত
তরঙ্গিত হৃদয় বিনোদিনীর দিকে সবেগে ধাবমান হইতেছিল। ইহার উপরে আবার মার সঙ্গে
উত্তর-প্রত্যুত্তর করা তাহার পক্ষে অসাধ্য। মহেন্দ্র জানিত, মা তাহাকে বিনোদিনী
সম্বন্ধে ভর্ৎসনা করিলেই বিদ্রোহিভাবে সে যথার্থ মনের কথা বলিয়া ফেলিবে এবং বলিয়া
ফেলিলেই নিদারুণ গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হইবে।
অতএব এ সময়ে বাড়ি হইতে দূরে গিয়া সকল কথা পরিষ্কার করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার।
মহেন্দ্র চাকরকে বলিল, “মাকে বলিস, আজ কালেজে আমার বিশেষ কাজ আছে, এখনই যাইতে হইবে,
ফিরিয়া আসিয়া দেখা হইবে।” বলিয়া পলাতক বালকের মতো তখনই তাড়াতাড়ি কাপড় পরিয়া না
খাইয়া ছুটিয়া বাহির হইতে গেল। বিনোদিনীর যে দারুণ চিঠিখানা আজ সকাল হইতে বার বার
করিয়া সে পড়িয়াছে এবং পকেটে লইয়া ফিরিয়াছে, আজ নিতান্ত তাড়াতাড়িতে সেই চিঠিসুদ্ধ
জামা ছাড়িয়াই সে চলিয়া গেল।
এক পশলা ঘন বৃষ্টি হইয়া তাহার পরে বাদলার মতো করিয়া রহিল। বিনোদিনীর মন আজ অত্যন্ত
বিরক্ত হইয়া আছে। মনের কোনো অসুখ হইলে বিনোদিনী কাজের মাত্রা বাড়ায়। তাই সে আজ যত
রাজ্যের কাপড় জড়ো করিয়া চিহ্ন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার নিকট হইতে কাপড় চাহিতে গিয়া
আশার মুখের ভাব দেখিয়া তাহার মন আরো বিগড়াইয়া গেছে। সংসারে যদি অপরাধীই হইতে হয় তবে
অপরাধের যত লাঞ্ছনা তাহাই কেন ভোগ করিবে, অপরাধের যত সুখ তাহা হইতে কেন বঞ্চিত
হইবে।
ঝুপ ঝুপ শব্দে চাপিয়া বৃষ্টি আসিল। বিনোদিনী তাহার ঘরে মেঝের উপর বসিয়া। সম্মুখে
কাপড় স্তূপাকার। খেমি দাসী এক-একখানি কাপড় অগ্রসর করিয়া দিতেছে, আর বিনোদিনী মার্কা
দিবার কালি দিয়া তাহাতে অক্ষর মুদ্রিত করিতেছে। মহেন্দ্র কোনো সাড়া না দিয়া দরজা
খুলিয়া একেবারে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। খেমি দাসি কাজ ফেলিয়া মাথায় কাপড় দিয়া ঘর
ছাড়িয়া ছুট দিল।
বিনোদিনী কোলের কাপড় মাটিতে ফেলিয়া দিয়া বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “যাও,
আমার এ ঘর হইতে চলিয়া যাও।”
মহেন্দ্র কহিল, “কেন, কী করিয়াছি।”
বিনোদিনী। কী করিয়াছি। ভীরু কাপুরুষ! কী করিবার সাধ্য আছে তোমার। না জান
ভালোবাসিতে, না জান কর্তব্য করিতে। মাঝে হইতে আমাকে কেন লোকের কাছে নষ্ট করিতেছ!
মহেন্দ্র। তোমাকে আমি ভালোবাসি নাই, এমন কথা বলিলে?
বিনোদিনী। আমি সেই কথাই বলিতেছি। লুকাচুরি ঢাকাঢাকি, একবার এদিক, একবার ওদিক–তোমার
এই চোরের মতো প্রবৃত্তি দেখিয়া আমার ঘৃণা জন্মিয়া গেছে। আর ভালো লাগে না। তুমি যাও।
মহেন্দ্র একেবারে মুহ্যমান হইয়া কহিল, “তুমি আমাকে ঘৃণা কর, বিনোদ!”
বিনোদিনী। হাঁ, ঘৃণা করি।
মহেন্দ্র। এখনো প্রায়শ্চিত্ত করিবার সময় আছে, বিনোদ। আমি যদি আর দ্বিধা না করি,
সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই, তুমি আমার সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত আছ?
বলিয়া মহেন্দ্র বিনোদিনীর দুই হাত সবলে ধরিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া লইল। বিনোদিনী
কহিল, “ছাড়ো, আমার লাগিতেছে।”
মহেন্দ্র। তা লাগুক। বলো, তুমি আমার সঙ্গে যাইবে?
বিনোদিনী। না, যাইব না। কোনোমতেই না।
মহেন্দ্র। কেন যাইবে না। তুমিই আমাকে সর্বনাশের মুখে টানিয়া আনিয়াছ, আজ তুমি আমাকে
পরিত্যাগ করিতে পারিবে না। তোমাকে যাইতেই হইবে।
বলিয়া মহেন্দ্র সুদৃঢ়বলে বিনোদিনীকে বুকের উপর টানিয়া লইল, জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া
রাখিয়া কহিল, “তোমার ঘৃণাও আমাকে ফিরাইতে পারিবে না, আমি তোমাকে লইয়া যাইবই, এবং
যেমন করিয়াই হউক, তুমি আমাকে ভালোবাসিবেই।”
বিনোদিনী সবলে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইল।
মহেন্দ্র কহিল, “চারি দিকে আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছ, এখন আর নিবাইতেও পারিবে না,
পালাইতেও পারিবে না।”
বলিতে বলিতে মহেন্দ্রের গলা চড়িয়া উঠিল, উচ্চৈঃস্বরে সে কহিল, “এমন খেলা কেন
খেলিলে, বিনোদ। এখন আর ইহাকে খেলা বলিয়া মুক্তি পাইবে না। এখন তোমার আমার একই
মৃত্যু।”
রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া কহিলেন, “মহিন, কী করছিস।”
মহেন্দ্রের উন্মত্ত দৃষ্টি এক নিমেষমাত্র মাতার মুখের দিকে ঘুরিয়া আসিল; তাহারপরে
পুনরায় বিনোদিনীর দিকে চাহিয়া মহেন্দ্র কহিল, “আমি সব ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছি, বলো,
তুমি আমার সঙ্গে যাইবে?”
বিনোদিনী ক্রুদ্ধা রাজলক্ষ্মীর মুখের দিকে একবার চাহিল। তাহার পর অগ্রসর হইয়া
অবিচলিতভাবে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, “যাইব।”
মহেন্দ্র কহিল, “তবে আজকের মতো অপেক্ষা করো, আমি চলিলাম, কাল হইতে তুমি ছাড়া আর
আমার কেহই রহিবে না।”
বলিয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেল।
এমন সময় ধোবা আসিয়া বিনোদিনীকে কহিল, “মাঠাকরুন, আর তো বসিতে পারি না। আজ যদি
তোমাদের ফুরসৎ না থাকে তো আমি কাল আসিয়া কাপড় লইয়া যাইব।”
খেমি আসিয়া কহিল, “বউঠাকরুন, সহিস বলিতেছে দানা ফুরাইয়া গেছে।”
বিনোদিনী সাত দিনের দানা ওজন করিয়া আস্তাবলে পাঠাইয়া দিত, এবং নিজে জানালায়
দাঁড়াইয়া ঘোড়ার খাওয়া দেখিত।
গোপাল-চাকর আসিয়া কহিল, “বউঠাকরুন, ঝড়ু-বেহারা আজ দাদামশায়ের (সাধুচরণের) সঙ্গে
ঝগড়া করিয়াছে। সে বলিতেছে, তাহার কেরোসিনের হিসাব বুঝিয়া লইলেই সে সরকারবাবুর কাছ
হইতে বেতন চুকাইয়া লইয়া কাজ ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইবে।”
সংসারের সমস্ত কর্মই পূর্ববৎ চলিতেছে।