ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৪০
মহেন্দ্র কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া গেল, সেই আশঙ্কায় রাজলক্ষ্মীর আহারনিদ্রা বন্ধ।
সাধুচরণ সম্ভব-অসম্ভব সকল স্থানেই তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে–এমন সময় মহেন্দ্র
বিনোদিনীকে লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল। পটলডাঙার বাসায় তাহাকে রাখিয়া রাত্রে
মহেন্দ্র তাহার বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল।
মাতার ঘরে মহেন্দ্র প্রবেশ করিয়া দেখিল, ঘর অন্ধকারপ্রায়, কেরোসিনের লণ্ঠন আড়াল
করিয়া রাখা হইয়াছে। রাজলক্ষ্মী রোগীর ন্যায় বিছানায় শুইয়া আছেন এবং আশা পদতলে বসিয়া
আস্তে আস্তে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। এতকাল পরে গৃহের বধূ শাশুড়ির পদতলের
অধিকার পাইয়াছে।
মহেন্দ্র আসিতেই আশা চকিত হইয়া উঠিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। মহেন্দ্র বলপূর্বক
সর্বপ্রকার দ্বিধা পরিত্যাগ করিয়া কহিল, “মা, এখানে আমার পড়ার সুবিধা হয় না; আমি
কালেজের কাছে একটা বাসা লইয়াছি; সেইখানেই থাকিব।”
রাজলক্ষ্মী বিছানার প্রান্তে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, একটু
বোস্।”
মহেন্দ্র সংকোচের সহিত বিছানায় বসিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মহিন, তোর যেখানে ইচ্ছা
তুই থাকিস, কিন্তু আমার বউমাকে তুই কষ্ট দিস নে।”
মহেন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার মন্দ কপাল, তাই আমি আমার এমন
লক্ষ্মী বউকে চিনিতে পারি নাই”–বলিতে বলিতে রাজলক্ষ্মীর গলা ভাঙিয়া আসিল–”কিন্তু
তুই তাহাকে এতদিন জানিয়া, এত ভালোবাসিয়া, শেষকালে এত দুঃখের মধ্যে ফেলিলি কী
করিয়া।” রাজলক্ষ্মী আর থাকিতে পারিলেন না, কাঁদিতে লাগিলেন।
মহেন্দ্র সেখান হইতে কোনোমতে উঠিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচে, কিন্তু হঠাৎ উঠিতে পারিল
না। মার বিছানার প্রান্তে অন্ধকারে নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
অনেকক্ষণ পরে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আজ রাত্রে তো এখানেই আছিস?”
মহেন্দ্র কহিল, “না।”
রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখন যাবি।”
মহেন্দ্র কহিল, “এখনই।”
রাজলক্ষ্মী কষ্টে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, “এখনই? একবার বউমার সঙ্গে ভালো করিয়া দেখাও
করিয়া
যাবি না?”
মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এ-কয়টা দিন বউমার কেমন করিয়া কাটিয়াছে, তাহা কি তুই একটু
বুঝিতেও পারিলি না। ওরে নির্লজ্জ, তোর নিষ্ঠুরতায় আমার বুক ফাটিয়া গেল।” বলিয়া
রাজলক্ষ্মী ছিন্ন শাখার মতো শুইয়া পড়িলেন।
মহেন্দ্র মার বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল। অতি মৃদুপদে নিঃশব্দগমনে সে সিঁড়ি দিয়া
তাহার উপরের শয়নঘরে চলিল। আশার সহিত দেখা হয়, এ তাহার ইচ্ছা ছিল না।
মহেন্দ্র উপরে উঠিয়াই দেখিল, তাহার শয়নগৃহের সম্মুখে যে ঢাকা ছাদ আছে, সেইখানে আশা
মাটিতে পড়িয়া। সে মহেন্দ্রের পায়ের শব্দ পায় নাই, হঠাৎ তাহাকে সম্মুখে উপস্থিত
দেখিয়া তাড়াতাড়ি কাপড় সারিয়া লইয়া উঠিয়া বসিল। এই সময়ে মহেন্দ্র যদি একটিবার ডাকিত
“চুনি”–তবে তখনই সে মহেন্দ্রের সমস্ত অপরাধ যেন নিজেরই মাথায় তুলিয়া লইয়া
ক্ষমাপ্রাপ্ত অপরাধিনীর মতো মহেন্দ্রের দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার জীবনের সমস্ত
কান্নাটা কাঁদিয়া লইত।
কিন্তু মহেন্দ্র সে প্রিয় নাম ডাকিতে পারিল না। যতই সে চেষ্টা করিল, ইচ্ছা করিল,
যতই সে বেদনা পাইল, এ কথা ভুলিতে পারিল না যে, আজ আশাকে আদর করা শূন্যগর্ভ
পরিহাস-মাত্র। তাহাকে মুখে সান্ত্বনা দিয়া কী হইবে, যখন বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করিবার
পথ মহেন্দ্র নিজের হাতে একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
আশা সংকোচে মরিয়া গিয়া বসিয়া রহিল। উঠিয়া দাঁড়াইতে, চলিয়া যাইতে, কোনোপ্রকার গতির
চেষ্টামাত্র করিতে তাহার লজ্জাবোধ হইল। মহেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে ছাদে
পায়চারি করিতে লাগিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশে তখনো চাঁদ ওঠে নাই–ছাদের কোণে একটা ছোটো
গামলায় রজনীগন্ধার গাছে দুইটি ডাঁটায় ফুল ফুটিয়াছে। ছাদের উপরকার অন্ধকার আকাশে ঐ
নক্ষত্রগুলি–ঐ সপ্তর্ষি, ঐ কালপুরুষ, তাহাদের অনেক সন্ধ্যার অনেক নিভৃত
প্রেমাভিনয়ের নীরব সাক্ষী ছিল, আজও তাহারা নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
মহেন্দ্র ভাবিতে লাগিল, মাঝখানের কয়টিমাত্র দিনের বিপ্লবকাহিনী এই আকাশভরা অন্ধকার
দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া যদি আগেকার ঠিক সেই দিনের মতো এই খোলা ছাদে মাদুর পাতিয়া আশার
পাশে আমার সেই চিরন্তন স্থানটিতে অতি অনায়াসে গিয়া বসিতে পারি। কোনো প্রশ্ন নাই,
জবাবদিহি নাই, সেই বিশ্বাস, সেই প্রেম, সেই সহজ আনন্দ! কিন্তু হায়, জগৎসংসারে
সেইটুকুমাত্র জায়গায় ফিরিবার পথ আর নাই। এই ছাদে আশার পাশে মাদুরের একটুখানি ভাগ
মহেন্দ্র একেবারে হারাইয়াছে। এতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের অনেকটা স্বাধীন
সম্বন্ধ ছিল। ভালোবাসিবার উন্মত্ত সুখ ছিল, কিন্তু তাহার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল না।
এখন মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সমাজ হইতে স্বহস্তে ছিন্ন করিয়া আনিয়াছে, এখন আর
বিনোদিনীকে কোথাও রাখিবার, কোথাও ফিরাইয়া দিবার জায়গা নাই–মহেন্দ্রই তাহার একমাত্র
নির্ভর। এখন ইচ্ছা থাক্ বা না থাক্, বিনোদিনীর সমস্ত ভার তাহাকে বহন করিতেই হইবে।
এই কথা মনে করিয়া মহেন্দ্রের হৃদয় ভিতরে ভিতরে
পীড়িত হইতে লাগিল। তাহাদের ছাদের উপরকার এই ঘরকন্না, এই শান্তি, এই বাধাবিহীন
দাম্পত্যমিলনের নিভৃত রাত্রি, হঠাৎ মহেন্দ্রের কাছে বড়ো আরামের বলিয়া বোধ হইল।
কিন্তু এই সহজসুলভ আরাম, যাহাতে একমাত্র তাহারই অধিকার, তাহাই আজ মহেন্দ্রের পক্ষে
দুরাশার সামগ্রী। চিরজীবনের মতো যে-বোঝা সে মাথায় তুলিয়া লইয়াছে, তাহা নামাইয়া
মহেন্দ্র এক মুহূর্তও হাঁপ ছাড়িতে পারিবে না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহেন্দ্র একবার আশার দিকে চাহিয়া দেখিল। নিস্তব্ধ রোদনে বক্ষ
পরিপূর্ণ করিয়া আশা তখনো নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছে–রাত্রির অন্ধকার জননীর অঞ্চলের
ন্যায় তাহার লজ্জা ও বেদনা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
মহেন্দ্র পায়চারি ভঙ্গ করিয়া কী বলিবার জন্য হঠাৎ আশার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সমস্ত
শরীরের রক্ত আশার কানের মধ্যে গিয়া শব্দ করিতে লাগিল, সে চক্ষু মুদ্রিত করিল।
মহেন্দ্র কী বলিতে আসিয়াছিল, ভাবিয়া পাইল না, তাহার কীই বা বলিবার আছে। কিন্তু
কিছু-একটা না বলিয়া আর ফিরিতে পারিল না। বলিল, “চাবির গোছাটা কোথায়।”
চাবির গোছা ছিল বিছানার গদিটার নীচে। আশা উঠিয়া ঘরের মধ্যে গেল–মহেন্দ্র তাহার
অনুসরণ করিল। গদির নীচে হইতে চাবি বাহির করিয়া আশা গদির উপরে রাখিয়া দিল। মহেন্দ্র
চাবির গোছা লইয়া নিজের কাপড়ের আলমারিতে এক-একটি চাবি লাগাইয়া দেখিতে লাগিল। আশা আর
থাকিতে পারিল না, মৃদুস্বরে কহিল, “ও-আলমারির চাবি আমার কাছে ছিল না।”
কাহার কাছে চাবি ছিল সে কথা আশার মুখ দিয়া বাহির হইল না, কিন্তু মহেন্দ্র তাহা
বুঝিল। আশা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, ভয় হইল, পাছে মহেন্দ্রের কাছে আর
তাহার কান্না চাপা না থাকে। অন্ধকারে ছাদের প্রাচীরের এক কোণে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া
উচ্ছ্বসিত রোদনকে প্রাণপণে রুদ্ধ করিয়া সে কাঁদিতে লাগিল।
কিন্তু অধিকক্ষণ কাঁদিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, মহেন্দ্রের আহারের সময়
হইয়াছে। দ্রুতপদে আশা নীচে চলিয়া গেল।
রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন কোথায়, বউমা।”
আশা কহিল, “তিনি উপরে।”
রাজলক্ষ্মী। তুমি নামিয়া আসিলে যে!
আশা নতমুখে কহিল, “তাঁহার খাবার–”
রাজলক্ষ্মী। খাবারের আমি ব্যবস্থা করিতেছি, বউমা, তুমি একটু পরিষ্কার হইয়া লও।
তোমার সেই নূতন ঢাকাই শাড়িখানা শীঘ্র পরিয়া আমার কাছে এসো, আমি তোমার চুল বাঁধিয়া
দিই।
শাশুড়ির আদর উপেক্ষা করিতে পারে না, কিন্তু এই সাজসজ্জার প্রস্তাবে আশা মরমে মরিয়া
গেল। মৃত্যু ইচ্ছা করিয়া ভীষ্ম যেরূপ স্তব্ধ হইয়া শরবর্ষণ সহ্য করিয়াছিলেন, আশাও
সেরূপ রাজলক্ষ্মীর কৃত সমস্ত প্রসাধন পরমধৈর্যে সর্বাঙ্গে গ্রহণ করিল।
সাজ করিয়া আশা অতি ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিল। উঁকি দিয়া দেখিল,
মহেন্দ্র ছাদে নাই। আস্তে আস্তে দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ঘরেও নাই,
তাহার খাবার অভুক্ত পড়িয়া আছে।
চাবির অভাবে কাপড়ের আলমারি জোর করিয়া খুলিয়া আবশ্যক কয়েকখান কাপড় ও ডাক্তারি বই
লইয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেছে।
পরদিন একাদশী ছিল। অসুস্থ ক্লিষ্টদেহ রাজলক্ষ্মী বিছানায় পড়িয়া ছিলেন। বাহিরে ঘন
মেঘে ঝড়ের উপক্রম করিয়াছে। আশা ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আস্তে আস্তে রাজলক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত দিয়া কহিল, “তোমার দুধ ও ফল আনিয়াছি,
খাবে এসো।”
করুণমূর্তি বধূর এই অনভ্যস্ত সেবার চেষ্টা দেখিয়া রাজলক্ষ্মীর শুষ্ক চক্ষু প্লাবিত
হইয়া গেল। তিনি উঠিয়া বসিয়া আশাকে কোলে লইয়া তাহার অশ্রুজলসিক্ত কপোল চুম্বন
করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন এখন কী করিতেছে বউমা।”
আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইল–মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি চলিয়া গেছেন।”
রাজলক্ষ্মী। কখন চলিয়া গেল, আমি তো জানিতেও পারি নাই।
আশা নতশিরে কহিল, “তিনি কাল রাত্রেই গেছেন।”
শুনিবামাত্র রাজলক্ষ্মীর সমস্ত কোমলতা যেন দূর হইয়া গেল–বধূর প্রতি তাঁহার
আদরস্পর্শের মধ্যে আর রসলেশমাত্র রহিল না। আশা একটা নীরব লাঞ্ছনা অনুভব করিয়া
নতমুখে আস্তে আস্তে চলিয়া গেল।