ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৪৪
রাজলক্ষ্মী যখন স্পষ্টই দেখিলেন, আশা মহেন্দ্রের মন বাঁধিতে পারিতেছে না, তখন
তাঁহার মনে হইল, “অন্তত আমার ব্যামো উপলক্ষ করিয়াও যদি মহেন্দ্রকে থাকিতে হয় সেও
ভালো।” তাঁহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাঁহার অসুখ একেবারে সারিয়া যায়। আশাকে ভাঁড়াইয়া
ওষুধ তিনি ফেলিয়া দিতে আরম্ভ করিলেন।
অন্যমনস্ক মহেন্দ্র বড়ো-একটা খেয়াল করিত না। কিন্তু আশা দেখিতে পাইত রাজলক্ষ্মীর
রোগ কিছুই কমিতেছে না, বরঞ্চ যেন বাড়িতেছে। আশা ভাবিত, মহেন্দ্র যথেষ্ট যত্ন ও
চিন্তা করিয়া ঔষধ নির্বাচন করিতেছে না–মহেন্দ্রের মন এতই উদ্ান্িত যে, মাতার পীড়াও
তাহাকে চেতাইয়া তুলিতে পারিতেছে না। মহেন্দ্রের এতবড়ো দুর্গতিতে আশা তাহাকে মনে মনে
ধিক্কার না দিয়া থাকিতে পারিল না। এক দিকে নষ্ট হইলে মানুষ কি সকল দিকেই এমনি
করিয়া নষ্ট হয়।
একদিন সন্ধ্যাকালে রোগের কষ্টের সময় রাজলক্ষ্মীর বিহারীকে মনে পড়িয়া গেল। কতদিন
বিহারী আসে নাই, তাহার ঠিক নাই। আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বউমা, বিহারী এখন কোথায়
আছে জান?” আশা বুঝিতে পারিল, চিরকাল রোগতাপের সময় বিহারীই মার সেবা করিয়া আসিয়াছে।
তাই কষ্টের সময় বিহারীকেই মাতার মনে পড়িতেছে। হায়, এই সংসারের অটল নির্ভর সেই
চিরকালের বিহারীও দূর হইল। বিহারী-ঠাকুরপো থাকিলে এই দুঃসময়ে মার যত্ন হইত–ইঁহার
মতো তিনি হৃদয়হীন নহেন। আশার হৃদয় হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।
রাজলক্ষ্মী। বিহারীর সঙ্গে মহিন বুঝি ঝগড়া করিয়াছে? বড়ো অন্যায় করিয়াছে বউমা। তাহার
মতো এমন হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু মহিনের আর কেহ নাই।
বলিতে বলিতে তাঁহার দুই চক্ষুর কোণে অশ্রুজল জড়ো হইল।
একে একে আশার অনেক কথা মনে পড়িল। অন্ধ মূঢ় আশাকে যথাসময়ে সতর্ক করিবার জন্য বিহারী
কতরূপে কত চেষ্টা করিয়াছে এবং সেই চেষ্টার ফলে সে ক্রমশই আশার অপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে,
সেই কথা মনে করিয়া আজ আশা মনে মনে নিজেকে তীব্রভাবে অপমান করিতে লাগিল। একমাত্র
সুহৃৎকে লাজ্ঞিত করিয়া একমাত্র শত্রুকে যে বক্ষে টানিয়া লয়, বিধাতা সেই কৃতঘ্ন
মূর্খকে কেন না শাস্তি দিবেন। ভগ্নহৃদয় বিহারী যেনিশ্বাস ফেলিয়া এ ঘর হইতে বিদায়
হইয়া গেছে, সে-নিশ্বাস কি এ ঘরকে লাগিবে না।
আবার অনেকক্ষণ চিন্তিতমুখে স্থির থাকিয়া রাজলক্ষ্মী হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “বউমা,
বিহারী যদি থাকিত, তবে এই দুর্দিনে সে আমাদের রক্ষা করিতে পারিত–এতদূর পর্যন্ত
গড়াইতে পাইত না।”
আশা নিস্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “সে যদি খবর
পায় আমার ব্যামো হইয়াছে, তবে সে না আসিয়া থাকিতে পারিবে না।” আশা বুঝিল,
রাজলক্ষ্মীর ইচ্ছা বিহারী এই খবরটা পায়। বিহারীর অভাবে তিনি আজকাল একেবারে নিরাশ্রয়
হইয়া পড়িয়াছেন।
ঘরের আলো নিবাইয়া দিয়া মহেন্দ্র জ্যোৎস্নায় জানলার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
পড়িতে আর ভালো লাগে না। গৃহে কোনো সুখ নাই। যাহারা পরমাত্মীয়, তাহাদের সঙ্গে
সহজভাবের সম্বন্ধ দূর হইয়া গেলে, তাহাদিগকে পরের মতো অনায়াসে ফেলিয়া দেওয়া যায় না,
আবার প্রিয়জনের মতো অনায়াসে তাহাদিগকে গ্রহণ করা যায় না–তাহাদের সেই অত্যাজ্য
আত্মীয়তা অহরহ অসহ্য ভারের মতো বক্ষে চাপিয়া থাকে। মার সম্মুখে যাইতে মহেন্দ্রের
ইচ্ছা হয় না–তিনি হঠাৎ মহেন্দ্রকে কাছে আসিতে দেখিলেই এমন একটা শঙ্কিত উদ্বেগের
সহিত তাহার মুখের দিকে চান যে, মহেন্দ্রকে তাহা আঘাত করে। আশা কোনো উপলক্ষে কাছে
আসিলে তাহার সঙ্গে কথা কহাও কঠিন হয়, চুপ করিয়া থাকাও কষ্টকর হইয়া উঠে। এমন করিয়া
দিন আর কাটিতে চাহে না। মহেন্দ্র দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, অন্তত সাত দিন সে
বিনোদিনীর সঙ্গে একেবারেই দেখা করিবে না। আরো দুই দিন বাকি আছে–কেমন করিয়া সে দুই
দিন কাটিবে।
মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিল। বুঝিল, আশা ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। যেন শুনিতে পায়
নাই, এই ভান করিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আশা সে ভানটুকু বুঝিতে পারিল, তবু ঘর
হইতে চলিয়া গেল না। পশ্চাতে দাঁড়াইয়া কহিল, “একটা কথা আছে, সেইটে বলিয়াই আমি
যাইতেছি।”
মহেন্দ্র ফিরিয়া কহিল, “যাইতে হইবে কেন, একটু বোসোই না।”
আশা এই ভদ্রতাটুকুতে কান
না দিয়া স্থির দাঁড়াইয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপোকে মার অসুখের খবর দেওয়া উচিত।”
বিহারীর নাম শুনিয়াই মহেন্দ্রের গভীর হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়িল। নিজেকে একটুখানি সামলাইয়া
লইয়া কহিল,
“কেন উচিত। আমার চিকিৎসায় বুঝি বিশ্বাস হয় না?”
মহেন্দ্র মাতার চিকিৎসায় যথোচিত যত্ন করিতেছে না, এই ভর্ৎসনায় আশার হৃদয় পরিপূর্ণ
হইয়া ছিল, তাই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, “কই, মার ব্যামো তো কিছুই ভালো হয় নাই,
দিনে দিনে আরো যেন বাড়িয়া উঠিতেছে।”
এই সামান্য কথাটার ভিতরকার উত্তাপ মহেন্দ্র বুঝিতে পারিল। এমন গূঢ়ভর্ৎসনা আশা আর
কখনোই মহেন্দ্রকে করে নাই। মহেন্দ্র নিজের অহংকারে আহত হইয়া বিস্মিত বিদ্রূপের সহিত
কহিল, “তোমার কাছে ডাক্তারি শিখিতে হইবে দেখিতেছি!”
আশা এই বিদ্রূপে তাহার পুজ্ঞীভূত বেদনার উপরে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত আঘাত পাইল; তাহার
উপরে ঘর অন্ধকার ছিল, তাই সেই চিরকালের নিরুত্তর আশা আজ অসংকোচে উদ্দীপ্ত তেজের
সহিত বলিয়া উঠিল,
“ডাক্তারি না শেখ, মাকে যত্ন করা শিখিতে পার।”
আশার কাছে এমন জবাব পাইয়া মহেন্দ্রের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এই অনভ্যস্ত তীব্র
বাক্যে মহেন্দ্র
নিষ্ঠুর হইয়া উঠিল। কহিল, “তোমার বিহারী-ঠাকুরপোকে কেন এই বাড়িতে আসিতে নিষেধ
করিয়াছি, তাহা তো তুমি জান–আবার তাহাকে স্মরণ করিয়াছ বুঝি!”
আশা দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেল। লজ্জার ঝড়ে যেন তাহাকে ঠেলিয়া লইয়া গেল। লজ্জা
তাহার
নিজের জন্য নহে। অপরাধে যে-ব্যক্তি মগ্ন হইয়া আছে, সে এমন অন্যায় অপবাদ মুখে
উচ্চারণ করিতে পারে!
এতবড়ো নির্লজ্জতাকে পর্বতপ্রমাণ লজ্জা দিয়াও ঢাকা যায় না।
আশা চলিয়া গেলেই মহেন্দ্র নিজের সম্পূর্ণ পরাভব অনুভব করিতে পারিল। আশা যে কোনো
কালে কোনো অবস্থাতেই মহেন্দ্রকে এমন ধিক্কার করিতে পারে, তাহা মহেন্দ্র কল্পনাও
করিতে পারে নাই। মহেন্দ্র দেখিল, যেখানে তাহার সিংহাসন ছিল সেখানে সে ধুলায়
লুটাইতেছে। এতদিন পরে তাহার আশঙ্কা হইল, পাছে আশার বেদনা ঘৃণায় পরিণত হয়।
ও দিকে বিহারীর কথা মনে আসিতেই বিনোদিনী সম্বন্ধে চিন্তা তাহাকে অধীর করিয়া তুলিল।
বিহারী পশ্চিম হইতে ফিরিয়াছে কি না, কে জানে। ইতিমধ্যে বিনোদিনী তাহার ঠিকানা
জানিতেও পারে, বিনোদিনীর সঙ্গে বিহারীর দেখা হওয়াও অসম্ভব নহে। মহেন্দ্রের আর
প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয় না।
রাত্রে রাজলক্ষ্মীর বক্ষের কষ্ট বাড়িল, তিনি আর থাকিতে না পারিয়া নিজেই মহেন্দ্রকে
ডাকিয়া পাঠাইলেন। কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া কহিলেন, “মহিন, বিহারীকে আমার বড়ো
দেখিতে ইচ্ছা হয়, অনেক দিন সে আসে নাই।”
আশা শাশুড়িকে বাতাস করিতেছিল। সে মুখ নিচু করিয়া রহিল। মহেন্দ্র কহিল, “সে এখানে
নাই, পশ্চিমে কোথায় চলিয়া গেছে।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার মন বলিতেছে, সে এখানেই আছে, কেবল তোর উপর অভিমান করিয়া
আসিতেছে না। আমার মাথা খা, কাল একবার তুই তাহার বাড়িতে যাস।”
মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা যাব।”
আজ সকলেই বিহারীকে ডাকিতেছে। মহেন্দ্র নিজেকে বিশ্বের পরিত্যক্ত বলিয়া বোধ করিল।