ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৪৫
পরদিন প্রত্যুষেই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, দ্বারের কাছে
অনেকগুলা গোরুর গাড়িতে ভৃত্যগণ আসবাব বোঝাই করিতেছে। ভজুকে মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল,
“ব্যাপারখানা কী!” ভজু কহিল, “বাবু বালিতে গঙ্গার ধারে একটি বাগান লইয়াছেন, সেইখানে
জিনিসপত্র চলিয়াছে।” মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু বাড়িতে আছেন না কি।” ভজু কহিল,
“তিনি দুই দিন মাত্র কলিকাতায় থাকিয়া কাল বাগানে চলিয়া গেছেন।”
শুনিয়া মহেন্দ্রের মন আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া গেল। সে অনুপস্থিত ছিল, ইতিমধ্যে বিনোদিনী
ও বিহারীতে যে দেখা হইয়াছে, ইহাতে তাহার মনে কোনো সংশয় রহিল না। সে কল্পনাচক্ষে
দেখিল, বিনোদিনীর বাসার সম্মুখেও এতক্ষণে গোরুর গাড়ি বোঝাই হইতেছে। তাহার নিশ্চয়
বোধ হইল, “এইজন্যই নির্বোধ আমাকে বিনোদিনী বাসা হইতে দূরে রাখিয়াছিল।”
মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া মহেন্দ্র তাহার গাড়িতে চড়িয়া কোচম্যানকে হাঁকাইতে কহিল।
ঘোড়া যথেষ্ট দ্রুত চলিতেছে না বলিয়া মহেন্দ্র মাঝে মাঝে কোচম্যানকে গালি দিল। গলির
মধ্যে সেই বাসার দ্বারের সম্মুখে পৌঁছিয়া দেখিল, সেখানে যাত্রার কোনো আয়োজন নাই। ভয়
হইল, পাছে সে-কার্য পূর্বেই সমাধা হইয়া থাকে। বেগে দ্বারে আঘাত করিল। ভিতর হইতে
বৃদ্ধ চাকর দরজা খুলিয়া দিবামাত্র মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সব খবর ভালো তো?” সে
কহিল, “আজ্ঞা হাঁ, ভালো বৈকি।”
মহেন্দ্র উপরে গিয়া দেখিল, বিনোদিনী স্নানে গিয়াছে। তাহার নির্জন শয়নঘরে প্রবেশ
করিয়া মহেন্দ্র বিনোদিনীর গতরাত্রে ব্যবহৃত শয্যার উপর লুটাইয়া পড়িল–সেই কোমল
আস্তরণকে দুই প্রসারিত হস্তে বক্ষের কাছে আকর্ষণ করিল এবং তাহাকে ঘ্রাণ করিয়া তাহার
উপরে মুখ রাখিয়া বলিতে লাগিল, “নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!”
এইরূপে হৃদয়োচ্ছ্বাস উন্মুক্ত করিয়া দিয়া শয্যা হইতে উঠিয়া মহেন্দ্র অধীরভাবে
বিনোদিনীর প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতে করিতে দেখিল, একখানা
বাংলা খবরের কাগজ নীচের বিছানায় খোলা পড়িয়া আছে। সময় কাটাইবার জন্য কতকটা
অন্যমনস্কভাবে সেখানা তুলিয়া লইল, যেখানে চোখ পড়িল, মহেন্দ্র সেইখানেই বিহারীর নাম
দেখিতে পাইল। এক মুহূর্তে তাহার সমস্ত মন খবরের কাগজের সেই জায়গাটাতেই ঝুঁকিয়া
পড়িল। একজন পত্রপ্রেরক লিখিতেছে, অল্প বেতনের দরিদ্র কেরানিগণ রুগ্ণ হইয়া পড়িলে
তাহাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সেবার জন্য বিহারী বালিতে গঙ্গার ধারে একটি বাগান
লইয়াছেন-সেখানে এক কালে পাঁচজনকে আশ্রয় দিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে, ইত্যাদি।
বিনোদিনী এই খবরটা পড়িয়াছে। পড়িয়া তাহার কিরূপ ভাব হইল। নিশ্চয় তাহার মনটা সেইদিকে
পালাইপোলাই করিতেছে। শুধু সেজন্য নহে, মহেন্দ্রের মন এই কারণে আরো ছটফট করিতে লাগিল
যে, বিহারীর এই সংকল্পে তাহার প্রতি বিনোদিনীর ভক্তি আরো বাড়িয়া উঠিবে। বিহারীকে
মহেন্দ্র মনে মনে “হাম্বাগ” বলিল, বিহারীর এই কাজটাকে “হুজুগ” বলিয়া অভিহিত
করিল–কহিল, “লোকের হিতকারী হইয়া উঠিবার হুজুগ বিহারীর ছেলেবেলা হইতেই আছে।”
মহেন্দ্র নিজেকে বিহারীর তুলনায় একান্ত অকৃত্রিম বলিয়া বাহবা দিবার চেষ্টা
করিল–কহিল, “ঔদার্য ও আত্মত্যাগের ভড়ঙে মূঢ়লোক ভুলাইবার চেষ্টাকে আমি ঘৃণা করি।”
কিন্তু হায়, এই পরমনিশ্চেষ্ট অকৃত্রিমতার মাহাত্ম্য লোকে অর্থাৎ বিশেষ কোনো-একটি
লোক হয়তো বুঝিবে না। মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, বিহারী যেন তাহার উপরে এও একটা চাল
চালিয়াছে।
বিনোদিনীর পদশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কাগজখানা মুড়িয়া তাহার উপরে চাপিয়া
বসিল। স্নাত বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিলে, মহেন্দ্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত
হইয়া উঠিল। তাহার কী-এক অপরূপ পরিবর্তন হইয়াছে। সে যেন এই কয়দিন আগুন জ্বালিয়া
তপস্যা করিতেছিল। তাহার শরীর কৃশ হইয়া গেছে, এবং সেই কৃশতা ভেদ করিয়া তাহার
পাণ্ডুবর্ণ মুখে একটি দীপ্তি বাহির হইতেছে।
বিনোদিনী বিহারীর পত্রের আশা ত্যাগ করিয়াছে। নিজের প্রতি বিহারীর নিরতিশয় অবজ্ঞা
কল্পনা করিয়া সে অহোরাত্রি নিঃশব্দে দগ্ধ হইতেছিল। এই দাহ হইতে নিষ্কৃতি পাইবার
কোনো পথ তাহার কাছে ছিল না। বিহারী যেন তাহাকেই তিরস্কার করিয়া পশ্চিমে চলিয়া
গেছে–তাহার নাগাল পাইবার কোনো উপায় বিনোদিনীর হাতে নাই। কর্মপরায়ণা নিরলসা বিনোদিনী
কর্মের অভাবে এই ক্ষুদ্র বাসার মধ্যে যেন রুদ্ধশ্বাস হইয়া উঠিতেছিল–তাহার সমস্ত
উদ্যম তাহার নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া আঘাত করিতেছিল। তাহার সমস্ত ভাবী জীবনকে এই
প্রেমহীন কর্মহীন আনন্দহীন বাসার মধ্যে, এই রুদ্ধগলির মধ্যে চিরকালের জন্য আবদ্ধ
কল্পনা করিয়া তাহার বিদ্রোহী প্রকৃতি আয়ত্তাতীত অদৃষ্টের বিরুদ্ধে যেন আকাশে মাথা
ঠুকিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছিল। যে মূঢ় মহেন্দ্র বিনোদিনীর সমস্ত মুক্তি পথ
চারিদিক হইতে রুদ্ধ করিয়া তাহার জীবনকে এমন সংকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে, তাহার প্রতি
বিনোদিনীর ঘৃণা ও বিদ্বেষের সীমা ছিল না। বিনোদিনী বুঝিতে পারিয়াছিল, সেই
মহেন্দ্রকে সে কিছুতেই আর দূরে ঠেলিয়া রাখিতে পারিবে না। এই ক্ষুদ্র বাসায় মহেন্দ্র
তাহার কাছে ঘেঁষিয়া সম্মুখে আসিয়া বসিবে–প্রতিদিন অলক্ষ্য আকর্ষণে তিলে তিলে তাহার
দিকে অধিকতর অগ্রসর হইতে থাকিবে–এই অন্ধকূপে, এই সমাজষ্টি জীবনের পঙ্কশয্যায় ঘৃণা
এবং আসক্তির মধ্যে যে প্রাত্যহিক লড়াই হইতে থাকিবে, তাহা অত্যন্ত বীভৎস। বিনোদিনী
স্বহস্তে স্বচেষ্টায় মাটি খুঁড়িয়া মহেন্দ্রের হৃদয়ের অন্তস্থল হইতে এই যে একটা
লোলজিহ্বা লোলুপতার ক্লেদাক্ত সরীসৃপকে বাহির করিয়াছে, ইহার পুচ্ছপাশ হইতে সে
নিজেকে কেমন করিয়া রক্ষা করিবে। একে বিনোদিনীর ব্যথিত হৃদয়, তাহাতে এই ক্ষুদ্র
অবরুদ্ধ বাসা, তাহাতে মহেন্দ্রের বাসনা-তরঙ্গের অহরহ অভিঘাত–ইহা কল্পনা করিয়াও
বিনোদিনীর সমস্ত চিত্ত আতঙ্কে পীড়িত হইয়া উঠে। জীবনে ইহার সমাপ্তি কোথায়। কবে সে এই
সমস্ত হইতে বাহির হইতে পারিবে।
বিনোদিনীর সেই কৃশপাণ্ডুর মুখ দেখিয়া মহেন্দ্রের মর্ োনল জ্বলিয়া উঠিল। তাহার কি
এমন কোনো শক্তি নাই, যাহা দ্বারা সে বিহারীর চিন্তা হইতে এই তপস্বিনীকে বলপূর্বক
উৎপাটিত করিয়া লইতে পারে। ঈগল যেমন মেষশাবককে এক নিমেষে ছোঁ মারিয়া তাহার সুদুর্গম
অভিবার্দী পর্বতনীড়ে উত্তীর্ণ করে, তেমনি এমন কি কোনো মেঘপরিবৃত নিখিলবিসমৃত স্থান
নাই, যেখানে একাকী মহেন্দ্র তাহার এই কোমল-সুন্দর শিকারটিকে আপনার বুকের কাছে
লুকাইয়া রাখিতে পারে। ঈর্ষার উত্তাপে তাহার ইচ্ছার আগ্রহ চতুর্গুণ বাড়িয়া উঠিল। আর
কি সে একমুহূর্তও বিনোদিনীকে চোখের আড়াল করিতে পারিবে। বিহারীর বিভীষিকাকে অহরহ
ঠেকাইয়া রাখিতে হইবে, তাহাকে সূচ্যগ্রমাত্র অবকাশ দিতে আর তো মহেন্দ্রের সাহস হইবে
না।
বিরহতাপে রমণীর সৌন্দর্যকে সুকুমার করিয়া তোলে, মহেন্দ্র এ কথা সংস্কৃতকাব্যে
পড়িয়াছিল, আজ বিনোদিনীকে দেখিয়া সে তাহা যতই অনুভব করিতে লাগিল, ততই সুখমিশ্রিত
দুঃখের সুতীব্র আলোড়নে তাহার হৃদয় একান্ত মথিত হইয়া উঠিল।
বিনোদিনী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি চা খাইয়া
আসিয়াছ।”
মহেন্দ্র কহিল, “নাহয় খাইয়া আসিয়াছি, তাই বলিয়া স্বহস্তে আর-এক পেয়ালা
দিতে কৃপণতা করিয়ো না-প্যালা মুঝ ভর দে রে।”
বিনোদিনী বোধ হয় ইচ্ছা করিয়া নিতান্ত
নিষ্ঠুরভাবে মহেন্দ্রের এই উচ্ছ্বাসে হঠাৎ আঘাত দিল–কহিল,
“বিহারী-ঠাকুরপো এখন কোথায় আছেন খবর জান?”
মহেন্দ্র নিমেষের মধ্যে বিবর্ণ হইয়া
কহিল, “সে তো এখন কলিকাতায় নাই।”
বিনোদিনী। তাহার ঠিকানা কী।
মহেন্দ্র। সে তো
কাহাকেও বলিতে চাহে না।
বিনোদিনী। সন্ধান করিয়া কি খবর লওয়া যায় না।
মহেন্দ্র। আমার তো তেমন জরুরি দরকার
কিছু দেখি না।
বিনোদিনী। দরকারই কি সব। আশৈশব বন্ধুত্ব কি কিছুই নয়।
মহেন্দ্র।
বিহারী আমার আশৈশব বন্ধু বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্ব দুদিনের–তবু
তাগিদটা
তোমারই যেন অত্যন্ত বেশি বোধ হইতেছে।
বিনোদিনী। তাহাই দেখিয়া তোমার লজ্জা পাওয়া
উচিত। বন্ধুত্ব কেমন করিয়া করিতে হয়, তাহা তোমার অমন বন্ধুর কাছ হইতেও শিখিতে
পারিলে না?
মহেন্দ্র। সেজন্য তত দুঃখিত নহি, কিন্তু ফাঁকি দিয়া স্ত্রীলোকের মন হরণ কেমন করিয়া
করিতে হয়, সে বিদ্যা তাহার কাছে শিখিলে আজ কাজে লাগিতে পারিত।
বিনোদিনী। সে বিদ্যা কেবল ইচ্ছা থাকিলেই শেখা যায় না, ক্ষমতা থাকা চাই।
মহেন্দ্র। গুরুদেবের ঠিকানা যদি তোমার জানা থাকে তো বলিয়া দাও, এ বয়সে তাঁহার কাছে
একবার মন্ত্র লইয়া আসি, তাহার পরে ক্ষমতার পরীক্ষা হইবে।
বিনোদিনী। বন্ধুর ঠিকানা যদি বাহির করিতে না পার, তবে প্রেমের কথা আমার কাছে
উচ্চারণ করিয়ো না। বিহারী-ঠাকুরপোর সঙ্গে তুমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, তোমাকে কে
বিশ্বাস করিতে পারে।
মহেন্দ্র। আমাকে যদি সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করিতে, তবে আমাকে এত অপমানকরিতে না। আমার
ভালোবাসা সম্বন্ধে যদি এত নিঃসংশয় না হইতে, তবে হয়তো আমার এত অসহ্য দুঃখ ঘটিত না।
বিহারী পোষ না-মানিবার বিদ্যা জানে, সেই বিদ্যাটা যদি সে এই হতভাগ্যকে শিখাইত, তবে
বন্ধুত্বের কাজ করিত।
“বিহারী যে মানুষ, তাই সে পোষ মানিতে পারে না,” এই বলিয়া বিনোদিনী খোলা চুল পিঠে
মেলিয়া যেমন জানালার কাছে দাঁড়াইয়া ছিল তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল। মহেন্দ্র হঠাৎ
দাঁড়াইয়া উঠিয়া মুষ্টি বদ্ধ করিয়া রোষগর্জিতস্বরে কহিল, “কেন তুমি আমাকে বার বার
অপমান করিতে সাহস কর। এত অপমানের কোনো প্রতিফল পাও না, সে কি তোমার ক্ষমতায় না আমার
গুণে। আমাকে যদি পশু বলিয়াই স্থির করিয়া থাক, তবে হিংস্র পশু বলিয়াই জানিয়ো। আমি
একেবারে আঘাত করিতে জানি না, এতবড়ো কাপুরুষ নই।” বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া
ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল–তাহার পর বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, এখান হইতে কোথাও চলো। আমরা
বাহির হইয়া পড়ি। পশ্চিমে হউক, পাহাড়ে হউক, যেখানে তোমার ইচ্ছা, চলো। এখানে বাঁচিবার
স্থান নাই। আমি মরিয়া যাইতেছি।”
বিনোদিনী কহিল, “চলো, এখনই চলো–পশ্চিমে যাই।”
মহেন্দ্র। পশ্চিমে কোথায় যাইবে।
বিনোদিনী। কোথাও নহে। এক জায়গায় দুদিন থাকিব না–ঘুরিয়া বেড়াইব।
মহেন্দ্র কহিল, “সেই ভালো, আজ রাত্রেই চলো।”
বিনোদিনী সম্মত হইয়া মহেন্দ্রের জন্য রন্ধনের উদ্যোগ করিতে গেল।
মহেন্দ্র বুঝিতে পারিল, বিহারীর খবর বিনোদিনীর চোখে পড়ে নাই। খবরের কাগজে মন দিবার
মতো অবধানশক্তি বিনোদিনীর এখন আর নাই। পাছে দৈবাৎ সে-খবর বিনোদিনী জানিতে পারে, সেই
উদ্বেগে মহেন্দ্র সমস্ত দিন সতর্ক হইয়া রহিল।