ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
কিছুকাল অনাবৃষ্টিতে যে শস্যদল শুষ্ক পীতবর্ণ হইয়া আসে,
বৃষ্টি পাইবামাত্র সে আর বিলম্ব করে না; হঠাৎ বাড়িয়া উঠিয়া
দীর্ঘকালের উপবাসদৈন্য দূর করিয়া দেয়, দুর্বল নত ভাব ত্যাগ
করিয়া শস্যক্ষেত্রের মধ্যে অসংকোচে অসংশয়ে আপনার অধিকার
উন্নত ও উজ্জ্বল করিয়া তোলে, আশার সেইরূপ হইল। যেখানে
তাহার রক্তের সম্বন্ধ ছিল, সেখানে সে কখনো আত্মীয়তার দাবি
করিতে পায় নাই; আজ পরের ঘরে আসিয়া সে যখন বিনা প্রার্থনায়
এক নিকটতম সম্বন্ধ এবং নিঃসন্দিগ্ধ অধিকার প্রাপ্ত হইল,
যখন সেই অযত্নলালিতা অনাথার মস্তকে স্বামী স্বহস্তে
লক্ষ্মীর মুকুট পরাইয়া দিলেন, তখন সে আপন গৌরবপদ গ্রহণ
করিতে লেশমাত্র বিলম্ব করিল না, নববধূযোগ্য লজ্জাভয় দূর
করিয়া দিয়া সৌভাগ্যবতী স্ত্রীর মহিমায় মুহূর্তের মধ্যেই
স্বামীর পদপ্রান্তে অসংকোচে আপন সিংহাসন অধিকার করিল।
রাজলক্ষ্মী সেদিন মধ্যাহ্নে সেই সিংহাসনে এই নূতন-আগত পরের
মেয়েকে এমন চিরাভ্যস্তবৎ স্পর্ধার সহিত বসিয়া থাকিতে
দেখিয়া দুঃসহ বিস্ময়ে নীচে নামিয়া আসিলেন। নিজের চিত্তদাহে
অন্নপূর্ণাকে দগ্ধ করিতে গেলেন। কহিলেন, “ওগো, দেখো গে,
তোমার নবাবের পুত্রী নবাবের ঘর হইতে কী শিক্ষা লইয়া
আসিয়াছেন। কর্তারা থাকিলে আজ–”
অন্নপূর্ণা কাতর হইয়া
কহিলেন, “দিদি, তোমার বউকে তুমি শিক্ষা দিবে, শাসন করিবে,
আমাকে কেন বলিতেছ।”
রাজলক্ষ্মী ধনুষ্টংকারের মতো বাজিয়া উঠিলেন, “আমার বউ?
তুমি মন্ত্রী থাকিতে সে আমাকে গ্রাহ্য করিবে!”
তখন অন্নপূর্ণা সশব্দপদক্ষেপে দম্পতিকে সচকিত সচেতন করিয়া
মহেন্দ্রের শয়নগৃহে উপস্থিত হইলেন। আশাকে কহিলেন, “তুই
এমনি করিয়া আমার মাথা হেঁট করিবি পোড়ারমুখী? লজ্জা নাই,
শরম নাই, সময় নাই, অসময় নাই, বৃদ্ধা শাশুড়ির উপর সমস্ত
ঘরকন্না চাপাইয়া তুমি এখানে আরাম করিতেছ? আমার পোড়াকপাল,
আমি তোমাকে এই ঘরে আনিয়াছিলাম!”
বলিতে বলিতে তাঁহার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, আশাও নতমুখে
বসত্রাঞ্চল খুঁটিতে খুঁটিতে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া কাঁদিতে
লাগিল।
মহেন্দ্র কহিল, “কাকী, তুমি বউকে কেন অন্যায় ভর্ৎসনা
করিতেছ। আমিই তো উহাকে ধরিয়া রাখিয়াছি।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি ভালো কাজ করিয়াছ? ও বালিকা,
অনাথা, মার কাছ হইতে কোনোদিন কোনো শিক্ষা পায় নাই, ও
ভালোমন্দর কী জানে। তুমি উহাকে কী শিক্ষা দিতেছ?”
মহেন্দ্র কহিল, “এই দেখো, উহার জন্যে স্লেট খাতা বই কিনিয়া
আনিয়াছি। আমি বউকে লেখাপড়া শিখাইব, তা লোকে নিন্দাই করুক
আর তোমরা রাগই কর।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “তাই কি সমস্ত দিনই শিখাইতে হইবে।
সন্ধ্যার পর এক-আধ ঘণ্টা পড়ালেই তো ঢের হয়।”
মহেন্দ্র। অত সহজ নয় কাকী, পড়াশুনায় একটু সময়ের দরকার হয়।
অন্নপূর্ণা বিরক্ত হইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আশাও
ধীরে ধীরে তাঁহার অনুসরণের উপক্রম করিল– মহেন্দ্র দ্বার রোধ
করিয়া দাঁড়াইল, আশার করুণ সজল নেত্রের কাতর অনুনয় মানিল
না। কহিল, “রোসো, ঘুমাইয়া সময় নষ্ট করিয়াছি, সেটা পোষাইয়া
লইতে হইবে।”
এমন গম্ভীরপ্রকৃতির শ্রদ্ধেয় মূঢ় থাকিতেও পারেন যিনি
মনে করিবেন, মহেন্দ্র নিদ্রাবেশে পড়াইবার সময় নষ্ট
করিয়াছে; বিশেষরূপে তাঁহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে,
মহেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে অধ্যাপনকার্য যেরূপে নির্বাহ হয়,
কোনো স্কুলের ইন্সপেকটর তাহার অনুমোদন করিবেন না।
আশা তাহার স্বামীকে বিশ্বাস করিয়াছিল; সে বস্তুতই মনে
করিয়াছিল লেখাপড়া শেখা তাহার পক্ষে নানা কারণে সহজ নহে
বটে, কিন্তু স্বামীর আদেশবশত নিতান্তই কর্তব্য। এইজন্য সে
প্রাণপণে অশান্ত বিক্ষিপ্ত মনকে সংযত করিয়া আনিত, শয়নগৃহের
মেঝের উপর ঢালা বিছানার এক পার্শ্বে অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া
বসিত এবং পুঁথিপত্রের দিকে একেবারে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মাথা
দুলাইয়া মুখস্থ করিতে আরম্ভ করিত। শয়নগৃহের অপর প্রান্তে
ছোটো টেবিলের উপর ডাক্তারি বই খুলিয়া মাস্টারমশায় চৌকিতে
বসিয়া আছেন, মাঝে মাঝে কটাক্ষপাতে ছাত্রীর মনোযোগ লক্ষ্য
করিয়া দেখিতেছেন। দেখিতে দেখিতে হঠাৎ ডাক্তারি বই বন্ধ
করিয়া মহেন্দ্র আশার ডাক-নাম ধরিয়া ডাকিল, “চুনি।” চকিত
আশা মুখ তুলিয় চাহিল। মহেন্দ্র কহিল, “বইটা আনো দেখি, দেখি
কোন্খানটা পড়িতেছ।”
আশার ভয় উপস্থিত হইল, পাছে মহেন্দ্র পরীক্ষা করে। পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হইবার আশা অল্পই ছিল। কারণ, চারুপাঠের
চারুত্ব-প্রলোভনে তাহার অবাধ্য মন কিছুতেই বশ মানে না;
বল্মীক সম্বন্ধে সে যতই জ্ঞানলাভের চেষ্টা করে, অক্ষরগুলো
ততই তাহার দৃষ্টিপথের উপর দিয়া কালো পিপীলিকার মতো সার
বাঁধিয়া চলিয়া যায়।
পরীক্ষকের ডাক শুনিয়া অপরাধীর মতো আশা
ভয়ে ভয়ে বইখানি লইয়া মহেন্দ্রের চৌকির পাশে আসিয়া উপস্থিত
হয়। মহেন্দ্র এক হাতে কটিদেশ বেষ্টনপূর্বক তাহাকে দৃঢ়রূপে
বন্দী করিয়া অপর হাতে বই ধরিয়া কহে, “আজ কতটা পড়িলে দেখি।”
আশা যতগুলা লাইনে চোখ বুলাইয়াছিল, দেখাইয়া দেয়। মহেন্দ্র
ক্ষুণ্নস্বরে বলে, “উঃ! এতটা পড়িতে পারিয়াছ? আমি কতটা
পড়িয়াছি দেখিবে?” বলিয়া তাহার ডাক্তারি বইয়ের কোনো-একটা
অধ্যায়ের শিরোনামটুকু মাত্র দেখাইয়া দেয়। আশা বিস্ময়ে
চোখদুটা ডাগর করিয়া বলে, “তবে এতক্ষণ কী করিতেছিলে।”
মহেন্দ্র তাহার চিবুক ধরিয়া বলে, আমি একজনের কথা
ভাবিতেছিলাম, কিন্তু যাহার কথা ভাবিতেছিলাম সেই নিষ্ঠুর
তখন চারুপাঠে উইপোকার অত্যন্ত মনোহর বিবরণ লইয়া ভুলিয়া
ছিল।” আশা এই অমূলক অভিযোগের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দিতে
পারিত–কিন্তু হায়, কেবলমাত্র লজ্জার খাতিরে প্রেমের
প্রতিযোগিতায় অন্যায় পরাভব নীরবে মানিয়া লইতে হয়।
ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হইবে, মহেন্দ্রের এই পাঠশালাটি
সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিদ্যালয়ের কোনো নিয়ম মানিয়া চলে
না।
হয়তো একদিন মহেন্দ্র উপস্থিত নাই– সেই সুযোগে আশা পাঠে মন
দিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় কোথা হইতে মহেন্দ্র আসিয়া
তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল, পরে তাহার বই কাড়িয়া লইল, কহিল,
“নিষ্ঠুর, আমি না থাকিলে তুমি আমার কথা ভাব না, পড়া লইয়া
থাক?”
আশা কহিল, “তুমি আমাকে মূর্খ করিয়া রাখিবে?”
মহেন্দ্র
কহিল, “তোমার কল্যাণে আমারই বা বিদ্যা এমনই কী অগ্রসর
হইতেছে।”
কথাটা আশাকে হঠাৎ বাজিল; তৎক্ষণাৎ চলিয়া যাইবার উপক্রম
করিয়া কহিল, “আমি তোমার পড়ায় কী বাধা দিয়াছি।”
মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “তুমি তাহার কী বুঝিবে।
আমাকে ছাড়িয়া তুমি যত সহজে পড়া করিতে পার, তোমাকে ছাড়িয়া
তত সহজে আমি আমার পড়া করিতে পারি না।”
গুরুতর দোষারোপ।
ইহার পরে স্বভাবতই শরতের এক পসলার মতো এক দফা কান্নার
সৃষ্টি হয় এবং অনতিকালমধ্যেই কেবল একটি সজল উজ্জ্বলতা
রাখিয়া সোহাগের সূর্যালোকে তাহা বিলীন হইয়া যায়।
শিক্ষক যদি শিক্ষার সর্বপ্রধান অন্তরায় হন, তবে অবলা
ছাত্রীর সাধ্য কী বিদ্যারণ্যের মধ্যে পথ করিয়া চলে। মাঝে
মাঝে মাসিমার তীব্র ভর্ৎসনা মনে পড়িয়া চিত্ত বিচলিত
হয়–বুঝিতে পারে, লেখাপড়া একটা ছুতা মাত্র; শাশুড়িকে দেখিলে
লজ্জায় মরিয়া যায়। কিন্তু শাশুড়ি তাহাকে কোনো কাজ করিতে
বলেন না, কোনো উপদেশ দেন না; অনাদিষ্ট হইয়া আশা শাশুড়ির
গৃহকার্যে সাহায্য করিতে গেলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলেন,
“কর কী, কর কী, শোবার ঘরে যাও, তোমার পড়া কামাই যাইতেছে।”
অবশেষে অন্নপূর্ণা আশাকে কহিলেন, “তোর যা শিক্ষা হইতেছে সে
তো দেখিতেছি, এখন মহিনকেও কি ডাক্তারি দিতে দিবি না।”
শুনিয়া আশা মনকে খুব শক্ত করিল, মহেন্দ্রকে বলিল, “তোমার
এক্জামিনের পড়া হইতেছে না, আজ হইতে আমি নীচে মাসিমার ঘরে
গিয়া থাকিব।”
এ বয়সে এতবড়ো কঠিন সন্ন্যাসব্রত! শয়নালয় হইতে একেবারে
মাসিমার ঘরে আত্মনির্বাসন! এই কঠোর প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ
করিতে তাহার চোখের প্রান্তে জল আসিয়া পড়িল, তাহার অবাধ্য
ক্ষুদ্র অধর কাঁপিয়া উঠিল এবং কণ্ঠস্বর রুদ্ধপ্রায় হইয়া
আসিল।
মহেন্দ্র কহিল, “তবে তাই চলো, কাকীর ঘরেই যাওয়া যাক– কিন্তু
তাহা হইলে তাঁহাকে উপরে আমাদের ঘরে আসিতে হইবে।”
আশা এতবড়ো উদার গম্ভীর প্রস্তাবে পরিহাস প্রাপ্ত হইয়া রাগ
করিল। মহেন্দ্র কহিল, “তার চেয়ে তুমি স্বয়ং দিনরাত্রি
আমাকে চোখে চোখে রাখিয়া পাহারা দাও, দেখো আমি এক্জামিনের
পড়া মুখস্থ করি কি না।”
অতি সহজেই সেই কথা স্থির হইল। চোখে চোখে পাহারার কার্য
কিরূপ ভাবে নির্বাহ হইত তাহার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া
অনাবশ্যক, কেবল এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, সে বৎসর
মহেন্দ্র পরীক্ষায় ফেল করিল এবং চারুপাঠের বিস্তারিত
বর্ণনা সত্ত্বেও পুরুভুজ সম্বন্ধে আশার অনভিজ্ঞতা দূর হইল
না।
এইরূপ অপূর্ব পঠন-পাঠন-ব্যাপার যে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে
সম্পন্ন হইয়াছিল তাহা বলিতে পারি না। বিহারী মাঝে মাঝে
আসিয়া অত্যন্ত গোল বাধাইয়া দিত। “মহিনদা মহিনদা” করিয়া সে
পাড়া মাথায় করিয়া তুলিত। মহেন্দ্রকে তাহার শয়নগৃহের বিবর
হইতে টানিয়া না বাহির করিয়া সে কোনোমতেই ছাড়িত না। পড়ায়
শৈথিল্য করিতেছে বলিয়া সে মহেন্দ্রকে বিস্তর ভর্ৎসনা করিত।
আশাকে বলিত, “বউঠান্, গিলিয়া খাইলে হজম হয় না, চিবাইয়া
খাইতে হয়। এখন সমস্ত অন্ন এক গ্রাসে গিলিতেছ, ইহার পরে
হজমি গুলি খুঁজিয়া পাইবে না।”
মহেন্দ্র বলিত, “চুনি ও কথা
শুনিয়ো না– বিহারী আমাদের সুখে হিংসা করিতেছে।”
বিহারী বলিত, “সুখ যখন তোমার হাতেই আছে, তখন এমন করিয়া ভোগ
করো যাহাতে পরের হিংসা না হয়।”
মহেন্দ্র উত্তর করিত, “পরের হিংসা পাইতে যে সুখ আছে। চুনি,
আর-একটু হইলেই আমি গর্দভের মতো তোমাকে বিহারীর হাতে সমর্পণ
করিতেছিলাম।”
বিহারী রক্তবর্ণ হইয়া বলিয়া উঠিত, “চুপ!”
এই-সকল ব্যাপারে আশা মনে মনে বিহারীর উপরে ভারি বিরক্ত
হইত। এক সময়ে তাহার সহিত বিহারীর বিবাহ-প্রস্তাব হইয়াছিল
বলিয়াই বিহারীর প্রতি তাহার একপ্রকার বিমুখ ভাব ছিল,
বিহারী তাহা বুঝিত এবং মহেন্দ্র তাহা লইয়া আমোদ করিত।
রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ডাকিয়া দুঃখ করিতেন। বিহারী কহিত,
“মা, পোকা যখন গুটি বাঁধে তখন তত বেশি ভয় নয়, কিন্তু যখন
কাটিয়া উড়িয়া যায় তখন ফেরানো শক্ত। কে মনে করিয়াছিল, ও
তোমার বন্ধন এমন করিয়া কাটিবে।”
মহেন্দ্রের ফেল-করা সংবাদে রাজলক্ষ্মী গ্রীষ্মকালের
আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের মতো দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন,
কিন্তু তাহার গর্জন এবং দাহনটা সম্পূর্ণ ভোগ করিলেন
অন্নপূর্ণা। তাঁহার আহারনিদ্রা দূর হইল।