ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 


চোখের বালি

৫০

    স্টেশনে আসিয়া বিনোদিনী একেবারে ইণ্টারমিডিয়েট ক্লাসে মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বসিল। মহেন্দ্র কহিল, “ও কী কর, আমি তোমার জন্য সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কিনিতেছি।”
    বিনোদিনী কহিল, “দরকার কী, এখানে আমি বেশ থাকিব।”
    মহেন্দ্র আশ্চর্য হইল। বিনোদিনী স্বাভাবতই শৌখিন ছিল। পূর্বে দারিদ্রের কোনো লক্ষণ তাহার কাছে প্রীতিকর ছিল না; নিজের সাংসারিক দৈন্য সে নিজের পক্ষে অপমানকর বলিয়াই মনে করিত। মহেন্দ্র এটুকু বুঝিয়াছিল যে, মহেন্দ্রের ঘরের অজস্র সচ্ছলতা, বিলাস উপকরণ এবং সাধারণের কাছে ধনী বলিয়া তাহাদের গৌরব, এক কালে বিনোদিনীর মনকে আকর্ষণ করিয়াছিল। সে অনায়াসেই এই ধনসম্পদ, এই-সকল আরাম ও গৌরবের ঈশ্বরী হইতে পারিত, সেই কল্পনায় তাহার মনকে একান্ত উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছিল। আজ যখন মহেন্দ্রের উপর প্রভুত্বলাভ করিবার সময় হইল, না চাহিয়াও সে যখন মহেন্দ্রের সমস্ত ধনসম্পদ নিজের ভোগে আনিতে পারে, তখন কেন সে এমন অসহ্য উপেক্ষার সহিত একান্ত উদ্ধতভাবে কষ্টকর লজ্জাকর দীনতা স্বীকার করিয়া লইতেছে। মহেন্দ্রের প্রতি নিজের নির্ভরকে সে যথাসম্ভব সংকুচিত করিয়া রাখিতে চায়। যে উন্মত্ত মহেন্দ্র বিনোদিনীকে তাহার স্বাভাবিক আশ্রয় হইতে চিরজীবনের জন্য চ্যুত করিয়াছে, সে মহেন্দ্রের হাত হইতে সে এমন কিছুই চাহে না, যাহা তাহার এই সর্বনাশের মূল্যস্বরূপ গণ্য হইতে পারে। মহেন্দ্রের ঘরে যখন বিনোদিনী ছিল, তখন তাহার আচরণে বৈধব্যব্রতের কাঠিন্য বড়ো একটা ছিল না, কিন্তু এতদিন পরে সে আপনাকে সর্বপ্রকার ভোগ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে। এখন সে একবেলা খায়, মোটা কাপড় পরে, তাহার সেই অনর্গল উৎসারিত হাস্যপরিহাসই বা গেল কোথায়। এখন সে এমন স্তব্ধ, এমন আবৃত, এমন সুদূর, এমন ভীষণ হইয়া উঠিয়াছে যে, মহেন্দ্র তাহাকে সামান্য একটা কথাও জোর করিয়া বলিতে সাহস পায় না। মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া, অধীর হইয়া, ক্রুদ্ধ হইয়া কেবলই ভাবিতে লাগিল, “বিনোদিনী আমাকে এত চেষ্টায় দুর্লভ ফলের মতো এত উচ্চশাখা হইতে পাড়িয়া লইল, তাহার পরে ঘ্রাণমাত্র না করিয়া আজ মাটিতে ফেলিয়া দিতেছে কেন।”
    মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কোথাকার টিকিট করিব বলো।”
    বিনোদিনী কহিল, “পশ্চিম দিকে যেখানে খুশি চলো–কাল সকালে যেখানে গাড়ি থামিবে, নামিয়া পড়িব।”
    এমনতরো ভ্রমণ মহেন্দ্রের কাছে লোভনীয় নহে। আরামের ব্যাঘাত তাহার পক্ষে কষ্টকর। বড়ো শহরে গিয়া ভালোরূপ আশ্রয় না পাইলে মহেন্দ্রের বড়ো মুশকিল। সে খুঁজিয়া-পাতিয়া করিয়া-কর্মিয়া লইবার লোক নহে। তাই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ-বিরক্ত মনে মহেন্দ্র গাড়িতে উঠিল। এ দিকে মনে কেবলই ভয় হইতে লাগিল, পাছে বিনোদিনী তাহাকে না জানাইয়াই কোথাও নামিয়া পড়ে।
    বিনোদিনী এইরূপ শনিগ্রহের মতো ঘুরিতে এবং মহেন্দ্রকে ঘুরাইতে লাগিল–কোথাও তাহাকে বিশ্রাম দিল না। বিনোদিনী অতি শীঘ্রই লোককে আপন করিয়া লইতে পারে; অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সে গাড়ির সহযাত্রিণীদের সহিত বন্ধুত্বস্থাপন করিয়া লইত। যেখানে যাইবার ইচ্ছা, সেখানকার সমস্ত খবর লইত-যোত্রিশালায় আশ্রয় লইত এবং যেখানে যাহা-কিছু দেখিবার আছে, ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বন্ধুসহায়ে দেখিয়া লইত। মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে নিজের অনাবশ্যকতায় প্রতিদিন আপনাকে হতমান বোধ করিতে লাগিল। টিকিট কিনিয়া দেওয়া ছাড়া তাহার কোনো কাজ ছিল না, বাকি সময়টা তাহার প্রবৃত্তি তাহাকে ও সে আপন প্রবৃত্তিকে দংশন করিতে থাকিত। প্রথম প্রথম কিছুদিন সে বিনোদিনীর সঙ্গে সঙ্গে পথে পথে ফিরিয়াছিল–কিন্তু ক্রমে তাহা অসহ্য হইয়া উঠিল; তখন মহেন্দ্র আহারাদি করিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিত, বিনোদিনী সমস্ত দিন ঘুরিয়া বেড়াইত। মাতৃস্নেহলালিত মহেন্দ্র যে এমন করিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িতে পারে, তাহা কেহ কল্পনাও করিতে পারিত না।
    একদিন এলাহাবাদ স্টেশনে দুইজনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। কোনো আকস্মিক কারণে ট্রেন আসিতে বিলম্ব হইতেছে। ইতিমধ্যে অন্যান্য গাড়ি যত আসিতেছে ও যাইতেছে, বিনোদিনী তাহার যাত্রীদের ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছে। পশ্চিমে ঘুরিতে ঘুরিতে চারি দিকে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে সে হঠাৎ কাহারো দেখা পাইবে, এই বোধ করি তাহার আশা। অন্তত, রুদ্ধ গলির মধ্যে জনহীন গৃহে নিশ্চল উদ্যমে নিজেকে প্রত্যহ চাপিয়া মারার চেয়ে এই নিত্যসন্ধানপরতার মধ্যে, এই উম্মুক্ত পথের জনকোলাহলের মধ্যে শান্তি আছে।
    হঠাৎ এক সময়ে স্টেশনে একটি কাচের বাক্সের উপর বিনোদিনীর দৃষ্টি পড়িতেই সে চমকিয়া উঠিল। এই পোস্ট-আপিসের বাক্সের মধ্যে, যে-সকল লোকের উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই তাহাদের পত্র প্রদর্শিত হইয়া থাকে। সেই বাক্সে সজ্জিত একখানি পত্রের উপরে বিনোদিনী বিহারীর নাম দেখিতে পাইল। বিহারীরলাল নামটি অসাধারণ নহে–পত্রের বিহারীই যে বিনোদিনীর অভীষ্ট বিহারী, এ কথা মনে করিবার কোনো হেতু ছিল না-তেবু বিহারীর পুরা নাম দেখিয়া সেই একটিমাত্র বিহারী ছাড়া আর-কোনো বিহারীর কথা তাহার মনে সন্দেহ হইল না। পত্রে লিখিত ঠিকানাটি সে মুখস্থ করিয়া লইল। অত্যন্ত অপ্রসন্নমুখে মহেন্দ্র একটা বেঞ্চের উপর বসিয়া ছিল, বিনোদিনী সেখানে আসিয়া কহিল,”কিছুদিন এলাহাবাদেই থাকিব।”
    বিনোদিনী নিজের ইচ্ছামত মহেন্দ্রকে চালাইতেছে, অথচ তাহার ক্ষুধিত অতৃপ্ত হৃদয়কে খোরাকমাত্র দিতেছে না, ইহাতে মহেন্দ্রের পৌরুষাভিমান আহত হইয়া তাহার হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল। এলাহাবাদে কিছুদিন থাকিয়া জিরাইতে পাইলে সে বাঁচিয়া যায়–কিন্তু ইচ্ছার অনুকূল হইলেও বিনোদিনীর খেয়ালমাত্রে সন্মতি দিতে তাহার মন হঠাৎ বাঁকিয়া দাঁড়াইল। সে রাগ করিয়া কহিল, “যখন বাহির হইয়াছি, তখন যাইবই। ফিরিতে পারিব না।”
    বিনোদিনী কহিল, “আমি যাইব না।”
    মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি একলা থাকো, আমি চলিলাম।”
    বিনোদিনী কহিল, “সেই ভালো।” বলিয়া দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া ইঈিতে মুটে ডাকিয়া স্টেশন ছাড়িয়া চলিল।
    মহেন্দ্র পুরুষের কর্তৃত্ব-অধিকার লইয়া অন্ধকার-মুখে বেঞ্চে বসিয়া রহিল। যতক্ষণ বিনোদিনীকে দেখা গেল, ততক্ষণ সে স্থির হইয়া থাকিল। যখন বিনোদিনী একবারও পশ্চাতে না ফিরিয়া বাহির হইয়া গেল, তখন সে তাড়াতাড়ি মুটের মাথায় বাক্স-বিছানা চাপাইয়া তাহার অনুসরণ করিল। বাহিরে আসিয়া দেখিলে, বিনোদিনী একখানি গাড়ি অধিকার করিয়া বসিয়াছে। মহেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া গাড়ির মাথায় মাল চাপাইয়া কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল। নিজের অহংকার খর্ব করিয়া গাড়ির ভিতরে বিনোদিনীর সন্মুখে বসিতে তাহার আর মুখ রহিল না।
    কিন্তু গাড়ি তো চলিয়াছেই। এক ঘণ্টা হইয়া গেল, ক্রমে শহরের বাড়ি ছাড়াইয়া চষা মাঠে আসিয়া পড়িল। গাড়োয়ানকে প্রশ্ন করিতে মহেন্দ্রের লজ্জা করিতে লাগিল, কারণ, পাছে গাড়োয়ান মনে করে ভিতরকার স্ত্রীলোকটিই কর্তৃপক্ষ, কোথায় যাইতে হইবে তাও সে এই অনাবশ্যক পুরুষটার সঙ্গে পরামর্শও করে নাই। মহেন্দ্র রুষ্ট অভিমান মনে মনে পরিপাক করিয়া স্তব্ধভাবে কোচবাক্সে বসিয়া রহিল।
    গাড়ি নির্জনে যমুনার ধারে একটি সযত্নরক্ষিত বাগানের মধ্যে আসিয়া থামিল। মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। এ কাহার বাগান, এ বাগানের ঠিকানা বিনোদিনী কেমন করিয়া জানিল।
    বাড়ি বন্ধ ছিল। হাঁকাহাঁকি করিতে বৃদ্ধ রক্ষক বাহির হইয়া আসিল। সে কহিল, “বাড়িওয়ালা ধনী, অধিক দূরে থাকেন না–তাঁহার অনুমতি লইয়া আসিলেই এ বাড়িতে বাস করিতে দিতে পারি।”
    বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে একবার চাহিল। মহেন্দ্র এই মনোরম বাড়িটি দেখিয়া লুব্ধ হইয়াছিল-দেীর্ঘকাল পরে কিছুদিন স্থিতির সম্ভাবনায় সে প্রফুল্ল হইল, বিনোদিনীকে কহিল, “তবে চলো সেই ধনীর ওখানে যাই, তুমি বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করিবে, আমি ভিতরে গিয়া ভাড়া ঠিক করিয়া আসিব।”
    বিনোদিনী কহিল, “আমি আর ঘুরিতে পারিব না–তুমি যাও, আমি ততক্ষণ এখানে বিশ্রাম করি। ভয়ের কোনো কারণ দেখি না।”
    মহেন্দ্র গাড়ি লইয়া চলিয়া গেল। বিনোদিনী বুড়া ব্রাক্ষণকে ডাকিয়া তাহার ছেলে-পুলের কথা জিজ্ঞাসা করিল–তাহারা কে, কোথায় চাকরি করে, তাহার মেয়েদের কোথায় বিবাহ হইয়াছে। তাহার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া করুণস্বরে কহিল,”আহা, তোমার তো বড়ো কষ্ট। এই বয়সে তুমি সংসারে একলা পড়িয়া গেছ। তোমাকে দেখিবার কেহ নাই!”
    তাহার পরে কথায় কথায় বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু এখানে ছিলেন না?”
    বৃদ্ধ কহিল, “হাঁ, কিছুদিন ছিলেন তো বটে। মাজি কি তাঁহাকে চেনেন।”
    বিনোদিনী কহিল, “তিনি আমাদের আত্মীয় হন।”
    বিনোদিনী বৃদ্ধের কাছে বিহারীর বিবরণ ও বর্ণনা যাহা পাইল, তাহাতে আর মনে কোনো সন্দেহ রহিল না। বুড়াকে দিয়া ঘর খুলাইয়া কোন্‌ ঘরে বিহারী শুইত, কোন্‌ ঘর তাহার বসিবার ছিল, তাহা সমস্ত জানিয়া লইল। তাহার যাওয়ার পর হইতে ঘরগুলি যে বন্ধ ছিল, তাহাতে মনে হইল, যেন সেখানে অদৃশ্য বিহারীর সঞ্চার সমস্ত ঘর ভরিয়া জমা হইয়া আছে, হাওয়ায় যেন তাহা উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারে নাই। বিনোদিনী তাহা ঘ্রাণের মধ্যে হৃদয় পূর্ণ করিয়া গ্রহণ করিল, স্তব্ধ বাতাসে সর্বাঙ্গে স্পর্শ করিল; কিন্তু বিহারী যে কোথায় গেছে, সে সন্ধান পাওয়া গেল না। হয়তো সে ফিরিতেও পারে–স্পষ্ট কিছুই জানা নাই। বৃদ্ধ তাহার প্রভুকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিয়া বলিবে, বিনোদিনীকে এরূপ আশ্বাস দিল।
    আগাম ভাড়া দিয়া বাসের অনুমতি লইয়া মহেন্দ্র ফিরিয়া আসিল।