ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৫১
হিমালয়শিখর যে যমুনাকে তুষারস্রুত অক্ষয় জলধারা দিতেছে, কতকালের কবিরা মিলিয়া সেই
যমুনার মধ্যে যে কবিত্বস্রোত ঢালিয়ছেন, তাহাও অক্ষয়। ইহার কল-ধ্বনির মধ্যে কত
বিচিত্র ছন্দ ধ্বনিত এবং ইহার তরঙ্গলীলায় কতকালের পুলকোচ্ছ্বসিত ভাবাবেগ উদ্বেলিত
হইয়া উঠিতেছে।
প্রদোষে সেই যমুনাতীরে মহেন্দ্র আসিয়া যখন বসিল, তখন ঘনীভূত প্রেমের আবেশ তাহার
দৃষ্টিতে, তাহার নিশ্বাসে, তাহার শিরায়, তাহার অস্থিগুলির মধ্যে প্রগাঢ মোহরসপ্রবাহ
সঞ্চার করিয়া দিল। আকাশে সূর্যাস্তকিরণের স্বর্ণবীণা বেদনার মূর্ছনায় অলোকশ্রুত
সংগীতে ঝংকৃত হইয়া উঠিল।
বিস্তীর্ণ নির্জন বালুতটে বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় দিন ধীরে ধীরে অবসান হইয়া গেল।
মহেন্দ্র চক্ষু অর্ধেক মুদ্রিত করিয়া কাব্যলোক হইতে গোখুর-ধূলিজালের মধ্যে
বৃন্দাবনের ধেনুদের গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তনের হাম্বারব শুনিতে পাইল।
বর্ষার মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইয়া আসিল। অপরিচিত স্থানের অন্ধকার কেবল কৃষ্ণবর্ণের
আবরণ মাত্র নহে, তাহা বিচিত্র রহস্যে পরিপূর্ণ। তাহার মধ্য দিয়া যেটুকু আভা যেটুকু
আকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অজ্ঞাত অনুচ্চারিত ভাষায় কথা কহে। পরপারবর্তী বালুকার
অস্ফুট পাণ্ডুরতা, নিস্তরঙ্গ জলের মসীকৃষ্ণ কালিমা, বাগানে ঘনপল্লব বিপুল
নিম্ববৃক্ষের পুজ্ঞীভূত স্তব্ধতা, তরুহীন মলান ধূসর তটের বঙ্কিম রেখা, সমস্ত সেই
আষাঢ়-সন্ধ্যার অন্ধকারে বিবিধ অনির্দিষ্ট অপরিস্ফুট আকারে মিলিত হইয়া মহেন্দ্রকে
চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরিল।
পদাবলীর বর্ষাভিসার মহেন্দ্রের মনে পড়িল। অভিসারিকা বাহির হইয়াছে। যমুনার ঐ
তটপ্রান্তে সে একাকিনী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। পার হইবে কেমন করিয়া। “ওগো পার করো গো,পার
করো”–মহেন্দ্রের বুকের মধ্যে এই ডাক আসিয়া পৌঁছিতেছে–”ওগো, পার করো।”
নদীর পরপারে অন্ধকারে সেই অভিসারিণী বহুদূরে–তবু মহেন্দ্র তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে
পাইল। তাহার কাল নাই তাহার বয়স নাই, সে চিরন্তন গোপবালা–কিন্তু তবু মহেন্দ্র তাহাকে
চিনিল–সে এই বিনোদিনী! সমস্ত বিরহ, সমস্ত বেদনা, সমস্ত যৌবনভার লইয়া তখনকার কাল
হইতে সে অভিসারে যাত্রা করিয়া, কত গান কত ছন্দের মধ্য দিয়া এখনকার কালের তীরে আসিয়া
উত্তীর্ণ হইয়াছে–আজিকার এই জনহীন যমুনাতটের উপরকার আকাশে তাহারই কণ্ঠস্বর শুনা
যাইতেছে–”ওগো,পার করো গো”–খেয়া-নৌকার জন্য সে এই অন্ধকারে আর কতকাল এমন একলা
দাঁড়াইয়া থাকিবে–”ওগো, পার করো।”
মেঘের এক প্রান্ত অপসারিত হইয়া কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদ দেখা দিল। জ্যোৎস্নার
মায়ামন্ত্রে সেই নদী ও নদীতীর, সেই আকাশ ও আকাশের সীমান্ত, পৃথিবীর অনেকবাহিরে
চলিয়া গেল। মর্তের কোনো বন্ধন রহিল না। কালের সমস্ত ধরাবাহিকতা ছিঁড়িয়া
গেল–অতীতকালের সমস্ত ইতিহাস লুপ্ত, ভবিষ্যৎ কালের সমস্ত ফলাফল অন্তর্হিত–শুধু এই
রজতধারা-প্লাবিত বর্তমানটুকু যমুনা ও যমুনাতটের মধ্যে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীকে লইয়া
বিশ্ববিধানের বাহিরে চিরস্থায়ী।
মহেন্দ্র মাতাল হইয়া উঠিল। বিনোদিনী যে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিবে,
জ্যোৎস্নারাত্রির এই নির্জন স্বর্গখণ্ডকে লক্ষ্মীরূপে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবে না,
ইহা সে কল্পনা করিতে পারিল না। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া সে বিনোদিনীকে খুঁজিতে বাড়ির দিকে
চলিয়া গেল।
শয়নগৃহে আসিয়া দেখিল, ঘর ফুলের গন্ধে পূর্ণ। উন্মুক্ত জানালা-দরজা দিয়া জ্যোৎস্নার
আলো শুভ্র বিছানার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। বিনোদিনী বাগান হইতে ফুল তুলিয়া মালা গাঁথিয়া
খোঁপায় পরিয়াছে, গলায় পরিয়াছে, কটিতে বাঁধিয়াছে–ফুলে ভূষিত হইয়া সে বসন্তকালের
পুষ্পভারলুণ্ঠিত লতাটির ন্যায় জ্যোৎস্নায় বিছানার উপরে পড়িয়া আছে।
মহেন্দ্রের মোহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, আমি যমুনার
ধারে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলাম, তুমি যে এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ, আকাশের চাঁদ
আমাকে সেই সংবাদ দিল, তাই আমি চলিয়া আসিলাম।”
এই কথা বলিয়া মহেন্দ্র বিছানায় বসিবার জন্য অগ্রসর হইল।
বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চকিত হইয়া উঠিয়া দক্ষিণবাহু প্রসারিত করিয়া কহিল, “যাও যাও, তুমি
এ বিছানায় বসিয়ো না।”
ভরাপালের নৌকা চড়ার ঠেকিয়া গেল–মহেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। অনেকক্ষণ তাহার মুখ
দিয়া কথা বাহির হইল না। পাছে মহেন্দ্র নিষেধ না মানে, এইজন্য বিনোদিনী শয্যা ছাড়িয়া
আসিয়া দাঁড়াইল।
মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাহার জন্য সাজিয়াছ। কাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছ।”
বিনোদিনী আপনার বুক চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “যাহার জন্য সাজিয়াছি, সে আমার অন্তরের
ভিতরে আছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে কে। সে বিহারী?”
বিনোদিনী কহিল, “তাহার নাম তুমি মুখে উচ্চারণ করিয়ো না।”
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি পশ্চিমে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ?
বিনোদিনী। তাহারই জন্য।
মহেন্দ্র। তাহারই জন্য তুমি এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ?
বিনোদিনী। তাহারই জন্য।
মহেন্দ্র। তাহার ঠিকানা জানিয়াছ?
বিনোদিনী। জানি না, কিন্তু যেমন করিয়া হউক,
জানিবই।
মহেন্দ্র। কোনোমতেই জানিতে দিব না।
বিনোদিনী। না যদি জানিতে দাও, আমার হৃদয়
হইতে তাহাকে কোনোমতেই বাহির করিতে পারিবে না।
এই বলিয়া বিনোদিনী চোখ বুজিয়া আপনার
হৃদয়ের মধ্যে বিহারীকে একবার অনুভব করিয়া লইল।
মহেন্দ্র সেই পুষ্পাভরণা
বিরহবিধুরমূর্তি বিনোদিনীর দ্বারা একই কালে প্রবলবেগে আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত
হইয়া হঠাৎ ভীষণ হইয়া উঠিল–মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “ছুরি দিয়া কাটিয়া তোমার বুকের
ভিতর হইতে তাহাকে বাহির করিব।”
বিনোদিনী অবিচলিতমুখে কহিল, “তোমার ভালোবাসার চেয়ে
তোমার ছুরি আমার হৃদয়ে সহজে প্রবেশ
করিবে।”
মহেন্দ্র। তুমি আমাকে ভয় কর না কেন, এখানে তোমার রক্ষক কে আছে।
বিনোদিনী।
তুমি আমার রক্ষক আছ। তোমার নিজের কাছ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা করিবে।
মহেন্দ্র।
এইটুকু শ্রদ্ধা, এইটুকু বিশ্বাস, এখনো বাকি আছে!
বিনোদিনী। তা না হইলে আমি
আত্মহত্যা করিয়া মরিতাম, তোমার সঙ্গে বাহির হইতাম না।
মহেন্দ্র। কেন মরিলে না–ঐটুকু
বিশ্বাসের ফাঁসি আমার গলায় জড়াইয়া আমাকে দেশদেশান্তরে টানিয়া
মারিতেছ কেন। তুমি মরিলে কত মঙ্গল হইত ভাবিয়া দেখো।
বিনোদিনী। তাহা জানি, কিন্তু
যতদিন বিহারীর আশা আছে, ততদিন আমি মরিতে পারিব না।
মহেন্দ্র। যতদিন তুমি না মরিবে,
ততদিন আমার প্রত্যাশাও মরিবে না–আমিও নিষ্কৃতি পাইব না। আমি
আজ হইতে ভগবানের কাছে সর্বান্তঃকরণে তোমার মৃত্যু কামনা করি। তুমি আমারও হইয়ো না,
তুমি বিহারীরও হইয়ো না। তুমি যাও। আমাকে ছুটি দাও।
আমার মা কাঁদিতেছেন, আমার স্ত্রী কাঁদিতেছে–তাঁহাদের অশ্রু আমাকে দূর হইতে দগ্ধ
করিতেছে। তুমি না মরিলে, তুমি আমারএবং পৃথিবীর সকলের আশার অতীত না হইলে, আমি
তাঁহাদের চোখের জল মুছাইবার অবসর পাইব না।
এই বলিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। বিনোদিনী একলা পড়িয়া আপনার চারি দিকে যে
মোহজাল রচনা করিতেছিল, তাহা সমস্ত ছিঁড়িয়া দিয়া গেল। চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বিনোদিনী
বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল–আকাশভরা জ্যোৎস্না শূন্য করিয়া দিয়া তাহার সমস্ত সুধারস
কোথায় উবিয়া গেছে। সেই কেয়ারি-করা বাগান, তাহার পরে বালুকাতীর, তাহার পরে নদীর কালো
জল, তাহার পরে ওপারের অস্ফুটতা–সমস্তই যেন একখানা বড়ো সাদা কাগজের উপরে
পেনসিলে-আঁকা একটি চিত্র মাত্র–সমস্তই নীরস এবং নিরর্থক।
মহেন্দ্রকে বিনোদিনী কিরূপ প্রবলবেগে আকর্ষণ করিয়াছে, প্রচণ্ড ঝড়ের মতো কিরূপ সমস্ত
শিকড়-সুদ্ধ তাহাকে উৎপাটিত করিয়াছে, আজ তাহা অনুভব করিয়া তাহার হৃদয় আরো যেন অশান্ত
হইয়া উঠিল। তাহার তো এই সমস্ত শক্তিই রহিয়াছে, তবে কেন বিহারী পূর্ণিমার রাত্রির
উদ্বেলিত সমুদ্রের ন্যায় তাহার সন্মুখে আসিয়া ভাঙিয়া পড়ে না। কেন একটা অনাবশ্যক
ভালোবাসার প্রবল অভিঘাত প্রত্যহ তাহার ধ্যানের মধ্যে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িতেছে,
আর-একটা আগন্তুক রোদন বারংবার আসিয়া তাহার অন্তরের রোদনকে কেন পরিপূর্ণ অবকাশ
দিতেছে না। এই যে একটা প্রকাণ্ড আন্দোলনকে সে জাগাইয়া তুলিয়াছে, ইহাকে লইয়া সমস্ত
জীবন সে কী করিবে, এখন ইহাকে শান্ত করিবে কী উপায়ে।
আজ যে-সমস্ত ফুলের মালায় সে নিজেকে ভূষিত করিয়াছিল, তাহার উপরে মহেন্দ্রের মুগ্ধ
দৃষ্টি পড়িয়াছিল জানিয়া সমস্ত টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল। তাহার সমস্ত শক্তি বৃথা,
চেষ্টা বৃথা, জীবন বৃথা–এই কানন, এই জ্যোৎস্না, এই যমুনাতট,এই অপূর্বসুন্দর পৃথিবী,
সমস্তই বৃথা।
এত ব্যর্থতা, তবু যে যেখানে সে সেখানেই দাঁড়াইয়া আছে–জগতে কিছুরই লেশমাত্র ব্যত্যয়
হয় নাই। তবু কাল সূর্য উঠিবে এবং সংসার তাহার ক্ষুদ্রতম কাজটুকু পর্যন্ত ভুলিবে
না–এবং অবিচলিত বিহারী যেমন
দূরে ছিল, তেমনি দূরে থাকিয়া ব্রাক্ষণ বালককে তাহার বোধোদয়ের নূতন পাঠ অভ্যাস
করাইবে। বিনোদিনীর চক্ষু ফাটিয়া অশ্রু বাহির হইয়া পড়িল। সে তাহার সমস্ত বল ও
আকাঙ্ক্ষা লইয়া কোন্ পাথরকে ঠেলিতেছে। তাহার হৃদয় রক্তে ভাসিয়া গেল, কিন্তু তাহার
অদৃষ্ট সুচ্যগ্রপরিমাণ সরিয়া বসিল না।