ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 


চোখের বালি

    একদিন নববর্ষার বর্ষণমুখরিত মেঘাচ্ছন্ন সায়াহ্নে গায়ে একখানি সুবাসিত ফুরফুরে চাদর এবং গলায় একগাছি জুঁইফুলের গোড়ে মালা পরিয়া মহেন্দ্র আনন্দমনে শয়নগৃহে প্রবেশ করিল। হঠাৎ আশাকে বিস্ময়ে চকিত করিবে বলিয়া জুতার শব্দ করিল না। ঘরে উঁকি দিয়া দেখিল, পুবদিকের খোলা জানালা দিয়া প্রবল বাতাস বৃষ্টির ছাঁট লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, বাতাসে দীপ নিবিয়া গেছে এবং আশা নীচের বিছানার উপরে পড়িয়া অব্যক্তকণ্ঠে কাঁদিতেছে।
    মহেন্দ্র দ্রুতপদে কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইয়াছে।”
    বালিকা দ্বিগুণ আবেগে কাঁদিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র ক্রমশ উত্তর পাইল যে, মাসিমা আর সহ্য করিতে না পারিয়া তাঁহার পিসতুত ভাইয়ের বাসায় চলিয়া গেছেন।
    মহেন্দ্র রাগিয়া মনে করিল, “গেলেন যদি, এমন বাদলার সন্ধ্যাটা মাটি করিয়া গেলেন।”
    শেষকালে সমস্ত রাগ মাতার উপরে পড়িল। তিনিই তো সকল অশান্তির মূল।
    মহেন্দ্র কহিল, “কাকী যেখানে গেছেন, আমরাও সেইখানে যাইব, দেখি, মা কাহাকে লইয়া ঝগড়া করেন।”
    বলিয়া অনাবশ্যক শোরগোল করিয়া জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি মুটে- ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিল।
    রাজলক্ষ্মী সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিলেন। ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের কাছে আসিয়া শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতেছিস।”
    মহেন্দ্র প্রথমে কোনো উত্তর করিল না। দুই-তিনবার প্রশ্নের পর উত্তর করিল, “কাকীর কাছে যাইব।”
    রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোদের কোথাও যাইতে হইবে না, আমিই তোর কাকীকে আনিয়া দিতেছি।”
    বলিয়া তৎক্ষণাৎ পালকি চড়িয়া অন্নপূর্ণার বাসায় গেলেন। গলায় কাপড় দিয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, “প্রসন্ন হও মেজোবউ, মাপ করো।”
    অন্নপূর্ণা শশব্যস্ত হইয়া রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধূলা লইয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “দিদি, কেন আমাকে অপরাধী করিতেছ। তুমি যেমন আজ্ঞা করিবে তাই করিব।”
    রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুমি চলিয়া আসিয়াছ বলিয়া আমার ছেলে-বউ ঘর ছাড়িয়া আসিতেছে।” বলিতে বলিতে অভিমানে ক্রোধে ধিক্‌কারে তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন।
    দুই জা বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। তখনো বৃষ্টি পড়িতেছে। অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের ঘরে যখন গেলেন তখন আশার রোদন শান্ত হইয়াছে এবং মহেন্দ্র নানা কথার ছলে তাহাকে হাসাইবার চেষ্টা করিতেছে। লক্ষণ দেখিয়া বোধ হয় বাদলার সন্ধ্যাটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ না যাইতেও পারে।
    অন্নপূর্ণা কহিলেন, “চুনি, তুই আমাকে ঘরেও থাকতে দিবি না, অন্য কোথাও গেলেই সঙ্গে লাগিবি? আমার কি কোথাও শান্তি নাই?”
    আশা অকস্মাৎ বিদ্ধ মৃগীর মতো চকিত হইয়া উঠিল।
    মহেন্দ্র একান্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, “কেন কাকী, চুনি তোমার কী করিয়াছে।”
    অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বউ-মানুষের এত বেহায়াপনা দেখিতে পারি না বলিয়াই চলিয়া গিয়াছিলাম, আবার শাশুড়িকে কাঁদাইয়া কেন আমাকে ধরিয়া আনিল পোড়ারমুখী।”
    জীবনের কবিত্ব-অধ্যায়ে মা খুড়ী যে এমন বিঘ্ন, তাহা মহেন্দ্র জানিত না।
    পরদিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ডাকাইয়া কহিলেন, “বাছা, তুমি একবার মহিনকে বলো, অনেক দিন দেশে যাই নাই, আমি বারাসতে যাইতে চাই।”
    বিহারী কহিল, “অনেক দিনই যখন যান নাই তখন আর নাই গেলেন। আচ্ছা, আমি মহিনদাকে বলিয়া দেখি, কিন্তু সে যে কিছুতেই রাজি হইবে তা বোধ হয় না।”
    মহেন্দ্র কহিল, “তা, জন্মস্থান দেখিতে ইচ্ছা হয় বটে। কিন্তু বেশি দিন মার সেখানে না থাকাই ভালো–বর্ষার সময় জায়গাটা ভালো নয়।”
    মহেন্দ্র সহজেই সম্মতি দিল দেখিয়া বিহারী বিরক্ত হইল। কহিল, “মা একলা যাইবেন, কে তাঁহাকে দেখিবে। বোঠানকেও সঙ্গে পাঠাইয়া দাও-না!” বলিয়া একটু হাসিল।
    বিহারীর গূঢ় ভর্ৎসনায় মহেন্দ্র কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, “তা বুঝি আর পারি না।”
    কিন্তু কথাটা ইহার অধিক আর অগ্রসর হইল না।
    এমনি করিয়াই বিহারী আশার চিত্ত বিমুখ করিয়া দেয়, এবং আশা তাহার উপরে বিরক্ত হইতেছে মনে করিয়া সে যেন একপ্রকারের শুষ্ক আমোদ অনুভব করে।
    বলা বাহুল্য, রাজলক্ষ্মী জন্মস্থান দেখিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন না। গ্রীষ্মে নদী যখন কমিয়া আসে তখন মাঝি যেমন পদে পদে লগি ফেলিয়া দেখে কোথায় কত জল, রাজলক্ষ্মীও তেমনি ভাবান্তরের সময় মাতাপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে লগি ফেলিয়া দেখিতেছিলেন। তাঁহার বারাসতে যাওয়ার প্রস্তাব যে এত শীঘ্র এত সহজেই তল পাইবে, তাহা তিনি আশা করেন নাই। মনে মনে কহিলেন, “অন্নপূর্ণার গৃহত্যাগে এবং আমার গৃহত্যাগে প্রভেদ আছে–সে হইল মন্ত্র-জানা ডাইনী আর আমি হইলাম শুদ্ধমাত্র মা, আমার যাওয়াই ভালো।”
    অন্নপূর্ণা ভিতরকার কথাটা বুঝিলেন, তিনি মহেন্দ্রকে বলিলেন, “দিদি গেলে আমিও থাকিতে পারিব না।”
    মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে কহিল, “শুনিতেছ মা? তুমি গেলে কাকীও যাইবেন, তাহা হইলে আমাদের ঘরের কাজ চলিবে কী করিয়া।”
    রাজলক্ষ্মী বিদ্বেষবিষে জর্জরিত হইয়া কহিলেন, “তুমি যাইবে মেজোবউ? এও কি কখনো হয়। তুমি গেলে চলিবে কী করিয়া। তোমার থাকা চাই-ই।”
    রাজলক্ষ্মীর আর বিলম্ব সহিল না। পরদিন মধ্যাহ্নেই তিনি দেশে যাইবার জন্য প্রস্তুত। মহেন্দ্রই যে তাঁহাকে দেশে রাখিয়া আসিবে, এ বিষয়ে বিহারীর বা আর-কাহারো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সময়কালে দেখা গেল, মহেন্দ্র মার সঙ্গে একজন সরকার ও দারোয়ান পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছে।
    বিহারী কহিল, “মহিনদা, তুমি যে এখনো তৈরি হও নাই?”
    মহেন্দ্র লজ্জিত হইয়া কহিল, “আমার আবার কালেজের–”
    বিহারী কহিল, “আচ্ছা তুমি থাকো, মাকে আমি পৌঁছাইয়া দিয়া আসিব।”
    মহেন্দ্র মনে মনে রাগিল। বিরলে আশাকে কহিল, “বাস্তবিক, বিহারী বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে। ও দেখাইতে চায়, যেন ও আমার চেয়ে মার কথা বেশি ভাবে।”
    অন্নপূর্ণাকে থাকিতে হইল, কিন্তু তিনি লজ্জায় ক্ষোভে ও বিরক্তিতে সংকুচিত হইয়া রহিলেন। খুড়ির এইরূপ দূরভাব দেখিয়া মহেন্দ্র রাগ করিল এবং আশাও অভিমান করিয়া রহিল।