ভাষাংশ
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
চতুরঙ্গ
দামিনী
১
গুহা হইতে ফিরিয়া আসিলাম। গ্রামে মন্দিরের কাছে গুরুজির কোনো শিষ্যবাড়ির দোতলার
ঘরগুলিতে আমাদের বাসা ঠিক হইয়াছিল।
গুহা হইতে ফেরার পর হইতে দামিনীকে আর বড়ো দেখা যায় না। সে
আমাদের জন্য রাঁধিয়া-বাড়িয়া দেয় বটে, কিন্তু পারতপক্ষে দেখা দেয় না। সে এখানকার
পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে ভাব করিয়া লইয়াছে, সমস্ত দিন তাদেরই মধ্যে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরিয়া
বেড়ায়।
গুরুজি কিছু বিরক্ত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, মাটির বাসার দিকেই
দামিনীর টান, আকাশের দিকে নয়। কিছুদিন যেমন সে দেবপূজার মতো করিয়া আমাদের সেবায়
লাগিয়াছিল এখন তাহাতে ক্লান্তি দেখিতে পাই, ভুল হয়, কাজের মধ্যে তার সেই সহজ শ্রী
আর দেখা যায় না।
গুরুজি আবার তাকে মনে মনে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। দামিনীর
ভুরুর মধ্যে কয়দিন হইতে একটা ভ্রূকুটি কালো হইয়া উঠিতেছে এবং তার মেজাজের হাওয়াটা
কেমন যেন এলোমেলো বহিতে শুরু করিয়াছে।
দামিনীর এলোখোঁপাবাঁধা ঘাড়ের দিকে, ঠোঁটের মধ্যে, চোখের কোণে
এবং ক্ষণে ক্ষণে হাতের একটা আক্ষেপে একটা কঠোর অবাধ্যতার ইশারা দেখা যাইতেছে।
আবার গুরুজি গানে কীর্তনে বেশি করিয়া মন দিলেন। ভাবিলেন,
মিষ্টগন্ধে উড়ো ভ্রমরটা আপনি ফিরিয়া আসিয়া মধুকোষের উপর স্থির হইয়া বসিবে। হেমন্তের
ছোটো ছোটো দিনগুলো গানের মদে ফেনাইয়া যেন উপ্চিয়া পড়িল।
কিন্তু কই, দামিনী তো ধরা দেয় না! গুরুজি ইহা লক্ষ্য করিয়া
একদিন হাসিয়া বলিলেন, ভগবান শিকার করিতে বাহির হইয়াছেন, হরিণী পালাইয়া এই শিকারের
রস আরো জমাইয়া তুলিতেছে; কিন্তু মরিতেই হইবে।
প্রথমে দামিনীর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় তখন সে ভক্তমণ্ডলীর মাঝে
প্রত্যক্ষ ছিল না, কিন্তু সেটা আমরা খেয়াল করি নাই। এখন সে যে নাই সেইটেই আমাদের
পক্ষে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল। তাকে না দেখিতে পাওয়াটাই ঝোড়ো হাওয়ার মতো আমাদিগকে এ
দিক ও দিক হইতে ঠেলা দিতে লাগিল। গুরুজি তার অনুপস্থিতিটাকে অহংকার বলিয়া ধরিয়া
লইয়াছেন, সুতরাং সেটা তাঁর অহংকারে কেবলই ঘা দিতে থাকিত। আর আমি—
আমার কথাটা বলিবার প্রয়োজন নাই।
একদিন গুরুজি সাহস করিয়া দামিনীকে যথাসম্ভব মৃদুমধুর সুরে
বলিলেন, দামিনী, আজ বিকালের দিকে তোমার কি সময় হইবে? তা হইলে—
দামিনী কহিল, না।
কেন বলো দেখি।
পাড়ায় নাডু কুটিতে যাইব।
নাডু কুটিতে? কেন?
নন্দীদের বাড়ি বিয়ে।
সেখানে কি তোমার নিতান্তই—
হাঁ,আমি তাদের কথা দিয়াছি।
আর কিছু না বলিয়া দামিনী একটা দমকা হাওয়ার মতো চলিয়া গেল। শচীশ
সেখানে বসিয়াছিল, সে তো অবাক। কত মানী গুণী ধনী বিদ্বান তার গুরুর কাছে মাথা নত
করিয়াছে, আর ঐ একটুখানি মেয়ে ওর কিসের এমন অকুণ্ঠিত তেজ!
আর-একদিন সন্ধ্যার সময় দামিনী বাড়ি ছিল। সেদিন গুরু একটু
বিশেষভাবে একটা বড়ো রকমের কথা পাড়িলেন। খানিক দূর এগোতেই তিনি আমাদের মুখের দিকে
তাকাইয়া একটা যেন ফাঁকা কিছু বুঝিলেন। দেখিলেন, আমরা অন্যমনস্ক। পিছন ফিরিয়া চাহিয়া
দেখিলেন, দামিনী যেখানে বসিয়া জামায় বোতাম লাগাইতেছিল সেখানে সে নাই। বুঝিলেন, আমরা
দুইজনে ঐ কথাটাই ভাবিতেছি যে, দামিনী উঠিয়া চলিয়া গেল। তাঁর মনে ভিতরে ভিতরে
ঝুম্ঝুমির মতো বার বার বাজিতে লাগিল যে দামিনী শুনিল না, তাঁর কথা শুনিতেই চাহিল
না। যাহা বলিতেছিলেন তার খেই হারাইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে আর থাকিতে পারিলেন না।
দামিনীর ঘরের কাছে আসিয়া বলিলেন, দামিনী, এখানে একলা কী করিতেছে? ও ঘরে আসিবে না?
দামিনী কহিল, না, একটু দরকার আছে।
গুরু উঁকি মারিয়া দেখিলেন, খাঁচার মধ্যে একটা চিল। দিন দুই হইল
কেমন করিয়া টেলিগ্রাফের তারে ঘা খাইয়া চিলটা মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল, সেখানে কাকের
দলের হাত হইতে দামিনী তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনে, তার পর হইতে শুশ্রূষা চলিতেছে।
এই তো গেল চিল।
আবার দামিনী একটা কুকুরের বাচ্ছা জোটাইয়াছে, তার রূপও যেমন কৌলীন্যও তেমনি। সে একটা
মূর্তিমান রসভঙ্গ। করতালের একটু আওয়াজ পাইবামাত্র সে আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া
বিধাতার কাছে আর্তস্বরে নালিশ করিতে থাকে; সে নালিশ বিধাতা শোনেন না বলিয়াই রক্ষা,
কিন্তু যারা শোনে তাদের ধৈর্য থাকে না।
একদিন যখন ছাদের কোণে একটা ভাঙা হাঁড়িতে দামিনী ফুলগাছের চর্চা
করিতেছে এমন সময় শচীশ তাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আজকাল তুমি ওখানে যাওয়া একেবারে
ছাড়িয়া দিয়াছ কেন?
কোন্খানে?
গুরুজির কাছে।
কেন, আমাকে তোমাদের কিসের প্রয়োজন?
প্রয়োজন আমাদের কিছু নাই, কিন্তু তোমার তো প্রয়োজন আছে।
দামিনী জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, কিছু না, কিছু না!
শচীশ স্তম্ভিত হইয়া তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে
বলিল, দেখো, তোমার মন অশান্ত হইয়াছে, যদি শান্তি পাইতে চাও তবে—
তোমরা আমাকে শান্তি দিবে? দিনরাত্রি মনের মধ্যে কেবলই ঢেউ
তুলিয়া তুলিয়া পাগল হইয়া আছ, তোমাদের শান্তি কোথায়? জোড়হাত করি তোমাদের, রক্ষা করো
আমাকে—
আমি শান্তিতেই ছিলাম। আমি শান্তিতেই থাকিব।
শচীশ বলিল, উপরে ঢেউ দেখিতেছ বটে, কিন্তু ধৈর্য ধরিয়া ভিতরে
তলাইতে পারিলে দেখিবে সেখানে সমস্ত শান্ত।
দামিনী দুই হাত জোড় করিয়া বলিল, ওগো দোহাই তোমাদের, আমাকে আর
তলাইতে বলিয়ো না। আমার আশা তোমরা ছাড়িয়া দিলে তবেই আমি বাঁচিব।
২
নারীর হৃদয়ের রহস্য জানিবার মতো অভিজ্ঞতা আমার
হইল না। নিতান্তই উপর হইতে, বাহির হইতে, যেটুকু দেখিলাম তাহাতে আমার এই বিশ্বাস
জন্মিয়াছে যে, যেখানে মেয়েরা দুঃখ পাইবে সেইখানেই তারা হৃদয় দিতে প্রস্তুত। এমন
পশুর জন্য তারা আপনার বরণমালা গাঁথে যে লোক সেই মালা কামনার পাঁকে দলিয়া বীভৎস
করিতে পারে; আর তা যদি না হইল তবে এমন কারো দিকে তারা লক্ষ্য করে যার কণ্ঠে তাদের
মালা পৌঁছায় না, যে মানুষ ভাবের সূক্ষ্ণতায় এমনি মিলাইয়াছে যেন নাই বলিলেই হয়।
মেয়েরা স্বয়ম্বরা হইবার বেলায় তাদেরই বর্জন করে যারা আমাদের মতো মাঝারি মানুষ, যারা
স্থূলে সূক্ষ্ণে মিশাইয়া তৈরি—
নারীকে যারা নারী বলিয়াই জানে, অর্থাৎ, এটুকু জানে যে, তারা কাদায় তৈরী খেলার পুতুল
নয়, আবার সুরে তৈরি বীণার ঝংকারমাত্রও নহে। মেয়েরা আমাদের ত্যাগ করে, কেননা আমাদের
মধ্যে না আছে লুব্ধ লালসার দুর্দান্ত মোহ, না আছে বিভোর ভাবুকতার রঙিন মায়া; আমরা
প্রবৃত্তির কঠিন পীড়নে তাদের ভাঙিয়া ফেলিতেও পারি না, আবার ভাবের তাপে গলাইয়া আপন
কল্পনার ছাঁচে গড়িয়া তুলিতেও জানি না; তারা যা, আমরা তাদের ঠিক তাই বলিয়াই জানি—
এইজন্য তারা যদি-বা আমাদের পছন্দ
করে, ভালোবাসিতে পারে না। আমরাই তাদের সত্যকার আশ্রয়, আমাদেরই নিষ্ঠার উপর তারা
নির্ভর করিতে পারে, আমাদের আত্মোৎসর্গ এতই সহজ যে তার কোনো দাম আছে সে কথা তারা
ভুলিয়াই যায়। আমরা তাদের কাছে এইটুকুমাত্র বকশিশ পাই যে, তারা দরকার পড়িলেই নিজের
ব্যবহারে আমাদের লাগায়, এবং হয়তো-বা আমাদের শ্রদ্ধাও করে, কিন্তু—
যাক, এ-সব খুব সম্ভব ক্ষোভের কথা, খুব সম্ভব এ-সমস্ত সত্য নয়, খুব সম্ভব আমরা যে
কিছুই পাই না সেইখানেই আমাদের জিত—
অন্তত, সেই কথা বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিয়া থাকি।
দামিনী গুরুজির কাছে ঘেঁষে না তাঁর প্রতি তার একটা রাগ আছে
বলিয়া; দামিনী শচীশকে কেবলই এড়াইয়া চলে তার প্রতি তার মনের ভাব ঠিক উলটা রকমের
বলিয়া। কাছাকাছি আমিই একমাত্র মানুষ যাকে লইয়া রাগ বা অনুরাগের কোনো বালাই নাই।
সেইজন্য দামিনী আমার কাছে তার সেকালের কথা, একালের কথা, পাড়ায় কবে কী দেখিল কী হইল
সেই-সমস্ত সামান্য কথা, সুযোগ পাইলেই অনর্গল বকিয়া যায়। আমাদের দোতলার ঘরের সামনে
যে খানিকটা ঢাকা ছাদ আছে সেইখানে বসিয়া জাঁতি দিয়া সুপারি কাটিতে কাটিতে দামিনী
যাহা-তাহা বকে—
পৃথিবীর মধ্যে এই অতি সামান্য ঘটনাটা যে আজকাল শচীশের ভাবে-ভোলা চোখে এমন করিয়া
পড়িবে তাহা আমি মনে করিতে পারিতাম না। ঘটনাটা হয়তো সামান্য না হইতে পারে, কিন্তু
আমি জানিতাম, শচীশ যে মুল্লুকে বাস করে সেখানে ঘটনা বলিয়া কোনো উপসর্গই নাই; সেখানে
হ্লাদিনী ও সন্ধিনী ও যোগমায়া যাহা ঘটাইতেছে সে একটা নিত্যলীলা, সুতরাং তাহা
ঐতিহাসিক নহে—
সেখানকার চিরযমুনাতীরের চিরধীর সমীরের বাঁশি যারা শুনিতেছে তারা যে আশপাশের অনিত্য
ব্যাপার চোখে কিছু দেখে বা কানে কিছু শোনে হঠাৎ তাহা মনে হয় না। অন্তত গুহা হইতে
ফিরিয়া আসার পূর্বে শচীশের চোখ-কান ইহা অপেক্ষা অনেকটা বোজা ছিল।
আমারও একটু ত্রুটি ঘটিতেছিল। আমি মাঝে মাঝে আমাদের রসালোচনার
আসরে গরহাজির হইতে শুরু করিয়াছিলাম। সেই ফাঁক শচীশের কাছে ধরা পড়িতে লাগিল। একদিন
সে আসিয়া দেখিল, গোয়ালাবাড়ি হইতে এক ভাঁড় দুধ কিনিয়া আনিয়া দামিনীর পোষা বেজিকে
খাওয়াইবার জন্য তার পিছনে ছুটিতেছি। কৈফিয়তের হিসাবে এ কাজটা নিতান্তই অচল, সভাভঙ্গ
পর্যন্ত এটা মুলতবি রাখিলে লোকসান ছিল না, এমন-কি বেজির ক্ষুধানিবৃত্তির ভার স্বয়ং
বেজির 'পরে রাখিলে জীবে দয়ার অত্যন্ত ব্যত্যয় হইত না অথচ নামে রুচির পরিচয় দিতে
পারিতাম। তাই হঠাৎ শচীশকে দেখিয়া অপ্রস্তুত হইতে হইল। ভাঁড়টা সেইখানে রাখিয়া
আত্মমর্যাদা-উদ্ধারের পন্থায় সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিলাম।
কিন্তু, আশ্চর্য দামিনীর ব্যবহার। সে একটুও কুণ্ঠিত হইল না;
বলিল, কোথায় যান শ্রীবিলাসবাবু?
আমি মাথা চুলকাইয়া বলিলাম, একবার—
দামিনী বলিল, উহাদের গান এতক্ষণে শেষ হইয়া গেছে। আপনি বসুন-না।
শচীশের সামনে দামিনীর এইপ্রকার অনুরোধে আমার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ
করিতে লাগিল।
দামিনী কহিল, বেজিটাকে লইয়া মুশকিল হইয়াছে—
কাল রাত্রে পাড়ার মুসলমানদের বাড়ি হইতে ও একটা মুরগি চুরি করিয়া খাইয়াছে। উহাকে
ছাড়া রাখিলে চলিবে না। শ্রীবিলাসবাবুকে বলিয়াছি একটা বড়ো দেখিয়া ঝুড়ি কিনিয়া আনিতে,
উহাকে চাপা দিয়া রাখিতে হইবে।
বেজিকে দুধ খাওয়ানো, বেজির ঝুড়ি কিনিয়া আনা প্রভৃতি উপলক্ষে
শ্রীবিলাসবাবুর আনুগত্যটা শচীশের কাছে দামিনী যেন একটু উৎসাহ করিয়াই প্রচার করিল।
যেদিন গুরুজি আমার সামনে শচীশকে তামাক সাজিতে বলিয়াছিলেন সেই দিনের কথাটা মনে পড়িল।
জিনিসটা একই।
শচীশ কোনো কথা না বলিয়া কিছু দ্রুত চলিয়া গেল। দামিনীর মুখের
দিকে চাহিয়া দেখি, শচীশ যে দিকে চলিয়া গেল সেই দিকে তাকাইয়া তার চোখ দিয়া বিদ্যুৎ
ঠিকরিয়া পড়িল—
সে মনে মনে কঠিন হাসি হাসিল।
কী যে সে বুঝিল তা সেই জানে কিন্তু ফল হইল এই, নিতান্ত সামান্য
ছুতা করিয়া দামিনী আমাকে তলব করিতে লাগিল। আবার, এক-একদিন নিজের হাতে কোনো-একটা
মিষ্টান্ন তৈরি করিয়া বিশেষ করিয়া আমাকেই সে খাওয়াইতে বসিল। আমি বলিলাম, শচীশদাকে—
দামিনী বলিল, তাঁকে খাইতে ডাকিলে বিরক্ত করা হইবে।
শচীশ মাঝে মাঝে দেখিয়া গেল আমি খাইতে বসিয়াছি।
তিনজনের মধ্যে আমার দশাটাই সব চেয়ে মন্দ। এই নাট্যের মুখ্য
পাত্র যে দুটি তাদের অভিনয়ের আগাগোড়াই আত্মগত—
আমি আছি প্রকাশ্যে, তার একমাত্র কারণ, আমি নিতান্তই গৌণ। তাহাতে এক-একবার নিজের
ভাগ্যের উপরে রাগও হয়, অথচ উপলক্ষ সাজিয়া যেটুকু নগদ বিদায় জোটে সেটুকুর লোভও
সামলাইতে পারি না। এমন মুশকিলেও পড়িয়াছি!
৩
কিছুদিন শচীশ পূর্বের চেয়ে আরো অনেক বেশি জোরের
সঙ্গে করতাল বাজাইয়া নাচিয়া নাচিয়া কীর্তন করিয়া বেড়াইল। তার পরে একদিন সে আসিয়া
আমাকে বলিল, দামিনীকে আমাদের মধ্যে রাখা চলিবে না।
আমি বলিলাম, কেন?
সে বলিল, প্রকৃতির সংসর্গ আমাদের একেবারে ছাড়িতে হইবে।
আমি বলিলাম, তা যদি হয় তবে বুঝিব আমাদের সাধনার মধ্যে মস্ত একটা
ভুল আছে।
শচীশ আমার মুখের দিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিল।
আমি বলিলাম, তুমি যাহাকে প্রকৃতি বলিতেছ সেটা তো একটা প্রকৃত
জিনিস; তুমি তাকে বাদ দিতে গেলেও সংসার হইতে সে তো বাদ পড়ে না। অতএব, সে যেন নাই
এমন ভাবে যদি সাধনা করিতে থাক তবে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া হইবে; একদিন সে ফাঁকি এমন ধরা
পড়িবে তখন পালাইবার পথ পাইবে না।
শচীশ কহিল, ন্যায়ের তর্ক রাখো। আমি বলিতেছি কাজের কথা। স্পষ্টই
দেখা যাইতেছে মেয়েরা প্রকৃতির চর, প্রকৃতির হুকুম তামিল করিবার জন্যই নানা সাজে
সাজিয়া তারা মনকে ভোলাইতে চেষ্টা করিতেছে। চৈতন্যকে আবিষ্ট করিতে না পারিলে তারা
মনিবের কাজ হাসিল করিতে পারে না। সেইজন্য চৈতন্যকে খোলসা রাখিতে হইলে প্রকৃতির
এই-সমস্ত দূতীগুলিকে যেমন করিয়া পারি এড়াইয়া চলা চাই।
আমি কী-একটা বলিতে যাইতেছিলাম, আমাকে বাধা দিয়া শচীশ বলিল, ভাই
বিশ্রী, প্রকৃতির মায়া দেখিতে পাইতেছ না, কেননা সেই মায়ার ফাঁদে আপনাকে জড়াইয়াছ। যে
সুন্দর রূপ দেখাইয়া আজ তোমাকে সে ভুলাইয়াছে, প্রয়োজনের দিন ফুরাইয়া গেলেই সেই রূপের
মুখোশ সে খসাইয়া ফেলিবে; যে তৃষ্ণার চশমায় ঐ রূপকে তুমি বিশ্বের সমস্তের চেয়ে বড়ো
করিয়া দেখিতেছ সময় গেলেই সেই তৃষ্ণাকে সুদ্ধ একেবারে লোপ করিয়া দিবে। যেখানে
মিথ্যার ফাঁদ এমন স্পষ্ট করিয়া পাতা, দরকার কী সেখানে বাহাদুরি করিতে যাওয়া?
আমি বলিলাম, তোমার কথা সবই মানিতেছি ভাই, কিন্তু আমি এই বলি,
প্রকৃতির বিশ্বজোড়া ফাঁদ আমি নিজের হাতে পাতি নাই এবং সেটাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটাইয়া
চলি এমন জায়গা আমি জানি না। ইহাকে বেকবুল করা যখন আমাদের হাতে নাই তখন সাধনা
তাহাকেই বলি, যাহাতে প্রকৃতিকে মানিয়া প্রকৃতির উপরে উঠিতে পারা যায়। যাই বল ভাই,
আমরা সে রাস্তায় চলিতেছি না, তাই সত্যকে আধখানা ছাঁটিয়া ফেলিবার জন্য এত বেশি
ছট্ফট্ করিয়া মরি।
শচীশ বলিল, তুমি কী রকম সাধনা চালাইতে চাও আর-একটু স্পষ্ট করিয়া
বলো শুনি।
আমি বলিলাম, প্রকৃতির স্রোতের ভিতর দিয়াই আমাদিগকে জীবনতরী
বাহিয়া চলিতে হইবে। আমাদের সমস্যা এ নয় যে, স্রোতটাকে কী করিয়া বাদ দিব; সমস্যা এই
যে, তরী কী হইলে ডুবিবে না, চলিবে। সেইজন্যই হালের দরকার।
শচীশ বলিল, তোমরা গুরু মান না বলিয়াই জান না যে, গুরুই আমাদের
সেই হাল। সাধনাকে নিজের খেয়ালমত গড়িতে চাও? শেষকালে মরিবে।
এই কথা বলিয়া শচীশ গুরুর ঘরে গেল এবং তাঁর পায়ের কাছে বসিয়া পা
টিপিতে শুরু করিয়া দিল। সেইদিন শচীশ গুরুর জন্য তামাক সাজিয়া দিয়া তাঁর কাছে
প্রকৃতির নামে নালিশ রুজু করিল।
একদিনের তামাকে কথাটা শেষ হইল না। অনেক দিন ধরিয়া গুরু অনেক
চিন্তা করিলেন। দামিনীকে লইয়া তিনি বিস্তর ভুগিয়াছেন। এখন দেখিতেছেন, এই একটিমাত্র
মেয়ে তাঁর ভক্তদের একটানা ভক্তিস্রোতের মাঝখানে বেশ একটি ঘূর্ণির সৃষ্টি করিয়া
তুলিয়াছে। কিন্তু, শিবতোষ বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি-সমেত দামিনীকে তাঁর হাতে এমন করিয়া
সঁপিয়া গেছে যে, তাকে কোথায় সরাইবেন তা ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। তার চেয়ে কঠিন এই যে,
গুরু দামিনীকে ভয় করেন।
এ দিকে শচীশ উৎসাহের মাত্রা দ্বিগুণ চৌগুণ চড়াইয়া এবং ঘন ঘন
গুরুর পা টিপিয়া, তামাক সাজিয়া, কিছুতেই এ কথা ভুলিতে পারিল না যে, প্রকৃতি তার
সাধনার রাস্তায় দিব্য করিয়া আড্ডা গাড়িয়া বসিয়াছে।
একদিন পাড়ায় গোবিন্দজির মন্দিরে একদল নামজাদা বিদেশী
কীর্তনওয়ালার কীর্তন চলিতেছিল। পালা শেষ হইতে অনেক রাত হইবে। আমি গোড়ার দিকেই ফস্
করিয়া উঠিয়া আসিলাম; আমি যে নাই তা সেই ভিড়ের মধ্যে কারো কাছে ধরা পড়িবে মনে করি
নাই।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় দামিনীর মন খুলিয়া গিয়াছিল। যে-সব কথা ইচ্ছা
করিলেও বলিয়া ওঠা যায় না, বাধিয়া যায়, তাও সেদিন বড়ো সহজে এবং সুন্দর করিয়া তার মুখ
দিয়া বাহির হইল। বলিতে বলিতে সে যেন নিজের মনের অনেক অজানা অন্ধকার কুঠরি দেখিতে
পাইল। সেদিন নিজের সঙ্গে মুখামুখি করিয়া দাঁড়াইবার একটা সুযোগ দৈবাৎ তার জুটিয়াছিল।
এমন সময়ে কখন যে শচীশ পিছন দিক হইতে আসিয়া দাঁড়াইল, আমরা
জানিতেও পাই নাই। তখন দামিনীর চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। অথচ, কথাটা বিশেষ কিছুই নয়।
কিন্তু সেদিন তার সকল কথাই একটা চোখের জলের গভীরতার ভিতর দিয়া বহিয়া আসিতেছিল।
শচীশ যখন আসিল তখনো নিশ্চয়ই কীর্তনের পালা শেষ হইতে অনেক দেরি
ছিল। বুঝিলাম, ভিতরে এতক্ষণ তাকে কেবলই ঠেলা দিয়াছে। দামিনী শচীশকে হঠাৎ সামনে
দেখিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া উঠিয়া পাশের ঘরের দিকে চলিল। শচীশ কাঁপা গলায় কহিল,
শোনো দামিনী, একটা কথা আছে।
দামিনী আস্তে আস্তে আবার বসিল। আমি চলিয়া যাইবার জন্য উস্খুস্
করিতেই সে এমন করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল যে, আমি আর নড়িতে পারিলাম না।
শচীশ কহিল, আমরা যে প্রয়োজনে গুরুজির কাছে আসিয়াছি তুমি তো সে
প্রয়োজনে আস নাই।
দামিনী কহিল, না।
শচীশ কহিল, তবে কেন তুমি এই ভক্তদের মধ্যে আছ?
দামিনীর দুই চোখ যেন দপ্ করিয়া জ্বলিল; সে কহিল, কেন আছি! আমি
কি সাধ করিয়া আছি! তোমাদের ভক্তরা যে এই ভক্তিহীনাকে ভক্তির গারদে পায়ে বেড়ি দিয়া
রাখিয়াছে। তোমরা কি আমার আর-কোনো রাস্তা রাখিয়াছ?
শচীশ বলিল, আমরা ঠিক করিয়াছি, তুমি যদি কোনো আত্মীয়ার কাছে গিয়া
থাক তবে আমরা খরচপত্রের বন্দোবস্ত করিয়া দিব।
তোমরা ঠিক করিয়াছ?
হাঁ।
আমি ঠিক করি নাই।
কেন, ইহাতে তোমার অসুবিধাটা কী?
তোমাদের কোনো ভক্ত-বা এক মতলবে এক বন্দোবস্ত করিবেন, কোনো ভক্ত-বা আর-এক মতলবে
আর-এক বন্দোবস্ত করিবেন—
মাঝখানে আমি কি তোমাদের দশ পঁচিশের ঘুঁটি?
শচীশ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।
দামিনী কহিল, আমাকে তোমাদের ভালো লাগিবে বলিয়া নিজের ইচ্ছায়
তোমাদের মধ্যে আমি আসি নাই। আমাকে তোমাদের ভালো লাগিতেছে না বলিয়া তোমাদের ইচ্ছায়
আমি নড়িব না।
বলিতে বলিতে মুখের উপর দুই হাত দিয়া তার আঁচল চাপিয়া সে কাঁদিয়া
উঠিল, এবং তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
সেদিন শচীশ আর কীর্তন শুনিতে গেল না। সেই ছাদে মাটির উপরে চুপ
করিয়া বসিয়া রহিল। সেদিন দক্ষিণহাওয়ায় দূর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ পৃথিবীর বুকের
ভিতরকার একটা কান্নার মতো নক্ষত্রলোকের দিকে উঠিতে লাগিল। আমি বাহির হইয়া গিয়া
অন্ধকারে গ্রামের নির্জন রাস্তার মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।
৪
গুরুজি আমাদের দুজনকে যে রসের স্বর্গলোকে বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলেন, আজ মাটির
পৃথিবী তাহাকে ভাঙিবার জন্য কোমর বাঁধিয়া লাগিল। এতদিন তিনি রূপকের পাত্রে ভাবের মদ
কেবলই আমাদিগকে ভরিয়া ভরিয়া পান করাইয়াছেন, এখন রূপের সঙ্গে রূপকের ঠোকাঠুকি হইয়া
পাত্রটা মাটির উপরে কাত হইয়া পড়িবার জো হইয়াছে। আসন্ন বিপদের লক্ষণ তাঁর অগোচর রহিল
না।
শচীশ আজকাল কেমন-এক-রকম হইয়া গেছে। যে ঘুড়ির লখ ছিঁড়িয়া গেছে
তারই মতো এখনো হাওয়ায় ভাসিতেছে বটে, কিন্তু পাক খাইয়া পড়িল বলিয়া, আর দেরি নাই। জপে
তপে অর্চনায় আলোচনায় বাহিরের দিকে শচীশের কামাই নাই, কিন্তু চোখ দেখিলে বোঝা যায়
ভিতরে ভিতরে তার পা টলিতেছে।
আর, দামিনী আমার সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করিবার রাস্তা রাখে নাই।
সে যতই বুঝিল গুরুজি মনে মনে ভয় এবং শচীশ মনে মনে ব্যথা পাইতেছে ততই সে আমাকে লইয়া
আরো বেশি টানাটানি করিতে লাগিল। এমন হইল যে, হয়তো আমি শচীশ এবং গুরুজি বসিয়া কথা
বলিতেছি, এমন সময় দরজার কাছে আসিয়া দামিনী ডাক দিয়া গেল, শ্রীবিলাসবাবু, একবার আসুন
তো। শ্রীবিলাসবাবুকে কী যে তার দরকার তাও বলে না। গুরুজি আমার মুখের দিকে চান, শচীশ
আমার মুখের দিকে চায়, আমি উঠি কি না উঠি করিতে করিতে দরজার দিকে তাকাইয়া ধাঁ করিয়া
উঠিয়া বাহির হইয়া যাই। আমি চলিয়া গেলেও খানিকক্ষণ কথাটা চালাইবার একটু চেষ্টা চলে,
কিন্তু চেষ্টাটা কথাটার চেয়ে বেশি হইয়া উঠে, তার পরে কথাটা বন্ধ হইয়া যায়। এমনি
করিয়া ভারি একটা ভাঙাচোরা এলোমেলো কাণ্ড হইতে লাগিল, কিছুতেই কিছু আর আঁট বাঁধিতে
চাহিল না।
আমরা দুজনেই গুরুজির দলের দুই প্রধান বাহন, ঐরাবত এবং
উচ্চৈঃশ্রবা বলিলেই হয়—
কাজেই আমাদের আশা তিনি সহজে
ছাড়িতে পারেন না। তিনি আসিয়া দামিনীকে বলিলেন, মা দামিনী, এবার কিছু দূর ও দুর্গম
জায়গায় যাইব। এখান হইতেই তোমাকে ফিরিয়া যাইতে হইবে।
কোথায় যাইব?
তোমার মাসির ওখানে।
সে আমি পারিব না।
কেন?
প্রথম, তিনি আমার আপন মাসি নন; তার পরে, তাঁর কিসের দায় যে তিনি
আমাকে তাঁর ঘরে রাখিবেন?
যাতে তোমার খরচ তাঁর না লাগে আমরা তার—
দায় কি কেবল খরচের? তিনি যে আমার দেখাশোনা খবরদারি করিবেন সে
ভার তাঁর উপরে নাই।
আমি কি চিরদিনই সমস্তক্ষণ তোমাকে আমার সঙ্গে রাখিব?
সে জবাব কি আমার দিবার?
যদি আমি মরি তুমি কোথায় যাইবে?
সে কথা ভাবিবার ভার আমার উপর কেহ দেয় নাই। আমি ইহাই খুব করিয়া
বুঝিয়াছি, আমার মাসি নাই, বাপ নাই, ভাই নাই; আমার বাড়ি নাই, কড়ি নাই, কিছুই নাই।
সেইজন্যই আমার ভার বড়ো বেশি; সে ভার আপনি সাধ করিয়াই লইয়াছেন; এ আপনি অন্যের ঘাড়ে
নামাইতে পারিবেন না।
এই বলিয়া দামিনী সেখান হইতে চলিয়া গেল। গুরুজি দীর্ঘনিশ্বাস
ছাড়িয়া বলিলেন, মধুসূদন!
একদিন আমার প্রতি দামিনীর হুকুম হইল, তার জন্য ভালো বাংলা বই
কিছু আনাইয়া দিতে। বলা বাহুল্য, ভালো বই বলিতে দামিনী ভক্তিরত্নাকর বুঝিত না, এবং
আমার 'পরে তার কোনোরকম দাবি করিতে কিছুমাত্র বাধিত না। সে একরকম করিয়া বুঝিয়া
লইয়াছিল যে দাবি করাই আমার প্রতি সব চেয়ে অনুগ্রহ করা। কোনো কোনো গাছ আছে যাদের
ডালপালা ছাঁটিয়া দিলেই থাকে ভালো—
দামিনীর সম্বন্ধে আমি সেই জাতের মানুষ।
আমি যে লেখকের বই আনাইয়া দিলাম সে লোকটা একেবারে নির্জলা
আধুনিক। তার লেখায় মনুর চেয়ে মানবের প্রভাব অনেক বেশি প্রবল। বইয়ের প্যাকেটটা
গুরুজির হাতে আসিয়া পড়িল। তিনি ভুরু তুলিয়া বলিলেন, কী হে শ্রীবিলাস, এ-সব বই কিসের
জন্য?
আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
গুরুজি দুই-চারিটি পাতা উলটাইয়া বলিলেন, এর মধ্যে সাত্ত্বিকতার
গন্ধ তো বড়ো পাই না। লেখকটিকে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না।
আমি ফস্ করিয়া বলিয়া ফেলিলাম, একটু যদি মনোযোগ করিয়া দেখেন তো
সত্যের গন্ধ পাইবেন।
আসল কথা, ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহ জমিতেছিল। ভাবের নেশার অবসাদে আমি
একেবারে জর্জরিত। মানুষকে ঠেলিয়া ফেলিয়া সুদ্ধমাত্র মানুষের হৃদয়বৃত্তিগুলাকে লইয়া
দিনরাত্রি এমন করিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করিতে আমার যতদূর অরুচি হইবার তা হইয়াছে।
গুরুজি আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, তার পরে
বলিলেন, আচ্ছা, তবে একবার মনোযোগ করিয়া দেখা যাক। বলিয়া বইগুলা তাঁর বালিশের নীচে
রাখিলেন। বুঝিলাম, এ তিনি ফিরাইয়া দিতে চান না।
নিশ্চয় দামিনী আড়াল হইতে ব্যাপারখানার আভাস পাইয়াছিল। দরজার
কাছে আসিয়া সে আমাকে বলিল, আপনাকে যে বইগুলা আনাইয়া দিতে বলিয়াছিলাম সে কি এখনো আসে
নাই?
আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
গুরুজি বলিলেন, মা, সে বইগুলি তো তোমার পড়িবার যোগ্য নয়।
দামিনী কহিল, আপনি বুঝিবেন কী করিয়া?
গুরুজি ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, তুমিই বা বুঝিবে কী করিয়া?
আমি পূর্বেই পড়িয়াছি, আপনি বোধ হয় পড়েন নাই।
তবে আর প্রয়োজন কী?
আপনার কোনো প্রয়োজনে তো কোথাও বাধে না, আমারই কিছুতে বুঝি
প্রয়োজন নাই?
আমি সন্ন্যাসী, তা তুমি জান।
আমি সন্ন্যাসিনী নই তা আপনি জানেন, আমার ও বইগুলি পড়িতে ভালো
লাগে। আপনি দিন।
গুরুজি বালিশের নীচে হইতে বইগুলি বাহির করিয়া আমার হাতের কাছে
ছুঁড়িয়া ফেলিলেন,আমি দামিনীকে দিলাম।
ব্যাপারটি যে ঘটিল তার ফল হইল, দামিনী যে-সব বই আপনার ঘরে বসিয়া
একলা পড়িত তাহা আমাকে ডাকিয়া পড়িয়া শুনাইতে বলে। বারান্দায় বসিয়া আমাদের পড়া হয়,
আলোচনা চলে। শচীশ সমুখ দিয়া বার বার আসে আর যায়, মনে করে 'বসিয়া পড়ি', অনাহূত বসিতে
পারে না।
একদিন বইয়ের মধ্যে ভারি একটা মজার কথা ছিল, শুনিয়া দামিনী
খিল্খিল করিয়া হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল। আমরা জানিতাম সেদিন মন্দিরে মেলা, শচীশ
সেইখানে গিয়াছে। হঠাৎ দেখি পিছনের ঘরের দরজা খুলিয়া শচীশ বাহির হইয়া আসিল এবং
আমাদের সঙ্গেই বসিয়া গেল।
সেই মুহূর্তেই দামিনীর হাসি একেবারে বন্ধ, আমিও থতমত খাইয়া
গেলাম। ভাবিলাম, শচীশের সঙ্গে যা হয় একটা কিছু কথা বলি, কিন্তু কোনো কথাই ভাবিয়া
পাইলাম না, বইয়ের পাতা কেবলই নিঃশব্দে উলটাইতে লাগিলাম। শচীশ যেমন হঠাৎ আসিয়া
বসিয়াছিল তেমনি হঠাৎ উঠিয়া চলিয়া গেল। তার পরে সেদিন আমাদের আর পড়া হইল না। শচীশ
বোধ করি বুঝিল না যে, দামিনী ও আমার মাঝখানে যে আড়ালটা নাই বলিয়া সে আমাকে ঈর্ষা
করিতেছে সেই আড়ালটা আছে বলিয়াই আমি তাকে ঈর্ষা করি।
সেইদিনই শচীশ গুরুজিকে গিয়া বলিল, প্রভু, কিছুদিনের জন্য একলা
সমুদ্রের ধারে বেড়াইয়া আসিতে চাই। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ফিরিয়া আসিব।
গুরুজি উৎসাহের সঙ্গে বলিলেন, খুব ভালো কথা, তুমি যাও।
শচীশ চলিয়া গেল। দামিনী আমাকে আর পড়িতেও ডাকিল না, আমাকে তার
অন্য কোনো প্রয়োজনও হইল না। তাকে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করিতে যাইতেও দেখি না।
ঘরেই থাকে, সে ঘরের দরজা বন্ধ।
কিছুদিন যায়। একদিন গুরুজি দুপুরবেলা ঘুমাইতেছেন, আমি ছাদের
বারান্দায় বসিয়া চিঠি লিখিতেছি, এমন সময়ে শচীশ হঠাৎ আসিয়া আমার দিকে দৃক্পাত না
করিয়া দামিনীর বন্ধ দরজায় ঘা মারিয়া বলিল, দামিনী! দামিনী!
দামিনী তখনই দরজা খুলিয়া বাহির হইল। শচীশের এ কী চেহারা!
প্রচণ্ড ঝড়ের-ঝাপ্টা-খাওয়া ছেঁড়া-পাল ভাঙা-মাস্তুল জাহাজের মতো ভাবখানা; চোখ দুটো
কেমনতরো, চুল উষ্কোখুষ্কো, কাপড় ময়লা।
শচীশ বলিল, দামিনী, তোমাকে চলিয়া যাইতে বলিয়াছিলাম—
আমার ভুল হইয়াছিল, আমাকে মাপ
করো।
দামিনী হাত জোড় করিয়া বলিল, ও কী কথা আপনি বলিতেছেন?
না, আমাকে মাপ করো। আমাদেরই সাধনার সুবিধার জন্য তোমাকে ইচ্ছামত
ছাড়িতে বা রাখিতে পারি এত বড়ো অপরাধের কথা আমি কখনো আর মনেও আনিব না। কিন্তু তোমার
কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে, সে তোমাকে রাখিতেই হইবে।
দামিনী তখনই নত হইয়া শচীশের দুই পা ছুঁইয়া বলিল, আমাকে হুকুম
করো তুমি।
শচীশ বলিল, আমাদের সঙ্গে তুমি যোগ দাও, অমন করিয়া তফাত হইয়া
থাকিয়ো না।
দামিনী কহিল, তাই যোগ দিব, আমি কোনো অপরাধ করিব না। এই বলিয়া সে
আবার নত হইয়া পা ছুঁইয়া শচীশকে প্রণাম করিল, এবং আবার বলিল, আমি কোনো অপরাধ করিব
না।
৫
পাথর আবার গলিল। দামিনীর যে অসহ্য দীপ্তি ছিল তার আলোটুকু রহিল, তাপ রহিল না। পূজায়
অর্চনায় সেবায় মাধুর্যের ফুল ফুটিয়া উঠিল। যখন কীর্তনের আসর জমিত, গুরুজি আমাদের
লইয়া যখন আলোচনায় বসিতেন, যখন তিনি গীতা বা ভাগবত ব্যাখ্যা করিতেন, দামিনী কখনো
একদিনের জন্য অনুপস্থিত থাকিত না। তার সাজসজ্জারও বদল হইয়া গেল। আবার সে তার তসরের
কাপড়খানি পরিল; দিনের মধ্যে যখনই তাকে দেখা গেল মনে হইল সে যেন এইমাত্র স্নান করিয়া
আসিয়াছে।
গুরুজির সঙ্গে ব্যবহারেই তার সকলের চেয়ে কঠিন পরীক্ষা। সেখানে
সে যখন নত হইত তখন তার চোখের কোণে আমি একটা রুদ্র তেজের ঝলক দেখিতে পাইতাম। আমি বেশ
জানি, গুরুজির কোনো হুকুম সে মনের মধ্যে একটুও সহিতে পারে না, কিন্তু তাঁর সব কথা
সে এতদূর একান্ত করিয়া মানিয়া লইল যে একদিন তিনি তাকে বাংলার সেই বিষম আধুনিক
লেখকের দুর্বিসহ রচনার বিরুদ্ধে সাহস করিয়া আপত্তি জানাইতে পারিলেন। পরের দিন
দেখিলেন, তাঁর দিনে বিশ্রাম করিবার বিছানার কাছে কতকগুলা ফুল রহিয়াছে, ফুলগুলি সেই
লোকটার বইয়ের ছেঁড়া পাতার উপরে সাজানো।
অনেকবার দেখিয়াছি গুরুজি শচীশকে যখন নিজের সেবায় ডাকিতেন সেইটেই
দামিনীর কাছে সব চেয়ে অসহ্য ঠেকিত। সে কোনোমতে ঠেলিয়া-ঠুলিয়া শচীশের কাজ নিজে করিয়া
দিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু সব সময়ে তাহা সম্ভব হইত না। তাই শচীশ যখন গুরুজির কলিকায়
ফুঁ দিতে থাকিত তখন দামিনী প্রাণপণে মনে মনে জপিত, অপরাধ করিব না, অপরাধ করিব না।
কিন্তু শচীশ যাহা ভাবিয়াছিল তার কিছুই হইল না। আর-একবার দামিনী
যখন এমনি করিয়াই নত হইয়াছিল তখন শচীশ তার মধ্যে কেবল মাধুর্যকেই দেখিয়াছিল, মধুরকে
দেখে নাই। এবারে স্বয়ং দামিনী তার কাছে এমনি সত্য হইয়া উঠিয়াছে যে গানের পদ,
তত্ত্বের উপদেশ সমস্তকে ঠেলিয়া সে দেখা দেয়, কিছুতেই তাকে চাপা দেওয়া চলে না। শচীশ
তাকে এতই স্পষ্ট দেখিতে পায় যে তার ভাবের ঘোর ভাঙিয়া যায়। এখন সে তাকে কোনোমতেই
একটা ভাবরসের রূপকমাত্র বলিয়া মনে করিতে পারে না। এখন দামিনী গানগুলিকে সাজায় না,
গানগুলিই দামিনীকে সাজাইয়া তোলে।
এখানে এই সামান্য কথাটুকু বলিয়া রাখি, এখন আমাকে দামিনীর আর
কোনো প্রয়োজন নাই। আমার 'পরে তার সমস্ত ফর্মাশ হঠাৎ একেবারে বন্ধ। আমার যে কয়েকটি
সহযোগী ছিল তার মধ্যে চিলটা মরিয়াছে, বেজিটা পালাইয়াছে, কুকুরছানাটার অনাচারে
গুরুজি বিরক্ত বলিয়া সেটাকে দামিনী বিলাইয়া দিয়াছে। এইরূপে আমি বেকার ও সঙ্গহীন
হইয়া পড়াতে পুনশ্চ গুরুজির দরবারে পূর্বের মতো ভর্তি হইলাম, যদিচ সেখানকার সমস্ত
কথাবার্তা গানবাজনা আমার কাছে একেবারে বিশ্রী রকমের বিস্বাদ হইয়া গিয়াছিল।
৬
একদিন শচীশ কল্পনার খোলা-ভাঁটিতে পূর্ব ও পশ্চিমের, অতীতের ও বর্তমানের সমস্ত দর্শন
ও বিজ্ঞান, রস ও তত্ত্ব একত্র চোলাইয়া একটা অপূর্ব আরক বানাইতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ
দামিনী ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ওগো, তোমরা একবার শীঘ্র এসো।
আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলিলাম, কী হইয়াছে?
দামিনী কহিল, নবীনের স্ত্রী বোধ হয় বিষ খাইয়াছে।
নবীন আমাদের গুরুজির একজন চেলার আত্মীয়—
আমাদের প্রতিবেশী, সে আমাদের
কীর্তনের দলের একজন গায়ক। গিয়া দেখিলাম, তার স্ত্রী তখন মরিয়া গেছে। খবর লইয়া
জানিলাম, নবীনের স্ত্রী তার মাতৃহীনা বোনকে নিজের কাছে আনিয়া রাখিয়াছিল। ইহারা
কুলীন, উপযুক্ত পাত্র পাওয়া দায়। মেয়েটিকে দেখিতে ভালো। নবীনের ছোটো ভাই তাকে বিবাহ
করিবে বলিয়া পছন্দ করিয়াছে। সে কলিকাতায় কালেজে পড়ে, আর কয়েক মাস পরে পরীক্ষা দিয়া
আগামী আষাঢ় মাসে সে বিবাহ করিবে এইরকম কথা। এমন সময়ে নবীনের স্ত্রীর কাছে ধরা পড়িল
যে তার স্বামীর ও তার বোনের পরস্পর আসক্তি জন্মিয়াছে। তখন তার বোনকে বিবাহ করিবার
জন্য সে স্বামীকে অনুরোধ করিল। খুব বেশি পীড়াপীড়ি করিতে হইল না। বিবাহ চুকিয়া গেলে
পর নবীনের প্রথমা স্ত্রী বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করিয়াছে।
তখন আর কিছু করিবার ছিল না। আমরা ফিরিয়া আসিলাম। গুরুজির কাছে
অনেক শিষ্য জুটিল,তাঁরা তাঁকে কীর্তন শুনাইতে লাগিল—
তিনি কীর্তনে যোগ দিয়া নাচিতে
লাগিলেন।
প্রথম রাত্রে তখন চাঁদ উঠিয়াছে। ছাদের যে কোণটার দিকে একটা
চালতা গাছ ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে সেইখানটার ছায়া-আলোর সংগমে দামিনী চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।
শচীশ তার পিছন দিকের ঢাকা বারান্দার উপরে আস্তে আস্তে পায়চারি করিতেছে। আমার ডায়ারি
লেখা রোগ, ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া লিখিতেছি।
সেদিন কোকিলের আর ঘুম ছিল না। দক্ষিনে হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো
যেন কথা বলিয়া উঠিতে চায়, আর তার উপরে চাঁদের আলো ঝিল্মিল করিয়া উঠে। হঠাৎ এক সময়ে
শচীশের কী মনে হইল, সে দামিনীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল। দামিনী চমকিয়া মাথায় কাপড় দিয়া
একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল। শচীশ ডাকিল, দামিনী!
দামিনী থমকিয়া দাঁড়াইল। জোড়হাত করিয়া কহিল, প্রভু, আমার একটা
কথা শোনো।
শচীশ চুপ করিয়া তার মুখের দিকে চাহিল। দামিনী কহিল, আমাকে
বুঝাইয়া দাও, তোমরা দিনরাত যা লইয়া আছ তাহাতে পৃথিবীর কী প্রয়োজন? তোমরা কাকে
বাঁচাইতে পারিলে?
আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। দামিনী
কহিল, তোমরা দিনরাত রস রস করিতেছ, ও ছাড়া আর কথা নাই। রস যে কী সে তো আজ দেখিলে?
তার না আছে ধর্ম, না আছে কর্ম, না আছে ভাই, না আছে স্ত্রী, না আছে কুলমান; তার দয়া
নাই, বিশ্বাস নাই, লজ্জা নাই, শরম নাই। এই নির্লজ্জ নিষ্ঠুর সর্বনেশে রসের রসাতল
হইতে মানুষকে রক্ষা করিবার কী উপায় তোমরা করিয়াছ?
আমি থাকিতে পারিলাম না; বলিয়া উঠিলাম, আমরা স্ত্রীলোককে আমাদের
চতুঃসীমানা হইতে দূরে খেদাইয়া রাখিয়া নিরাপদে রসের চর্চা করিবার ফন্দি করিয়াছি।
আমার কথায় একেবারেই কান না দিয়া দামিনী শচীশকে কহিল, আমি তোমার
গুরুর কাছ হইতে কিছুই পাই নাই। তিনি আমার উতলা মনকে এক মুহূর্ত শান্ত করিতে পারেন
নাই। আগুন দিয়া আগুন নেবানো যায় না। তোমার গুরু যে পথে সবাইকে চালাইতেছেন সে-পথে
ধৈর্য নাই, বীর্য নাই, শান্তি নাই। ঐ যে মেয়েটা মরিল, রসের পথে রসের রাক্ষসীই তো
তার বুকের রক্ত খাইয়া তাকে মারিল। কী তার কুৎসিত চেহারা সে তো দেখিলে! প্রভু,
জোড়হাত করিয়া বলি, ঐ রাক্ষসীর কাছে আমাকে বলি দিয়ো না। আমাকে বাঁচাও। যদি কেউ আমাকে
বাঁচাইতে পারে তো সে তুমি।
ক্ষণকালের জন্য আমরা তিন জনেই চুপ করিয়া রহিলাম। চারি দিক এমনি
স্তব্ধ হইয়া উঠিল যে আমার মনে হইল, যেন ঝিল্লির শব্দে পাণ্ডুবর্ণ আকাশটার সমস্ত গান
ঝিম্ ঝিম্ করিয়া আসিতেছে।
শচীশ বলিল, বলো আমি তোমার কী করিতে পারি?
দামিনী বলিল, তুমিই আমার গুরু হও। আমি আর কাহাকেও মানিব না।
তুমি আমাকে এমন-কিছু মন্ত্র দাও যা এ-সমস্তের চেয়ে অনেক উপরের জিনিস—
যাহাতে আমি বাঁচিয়া যাইতে পারি। আমার দেবতাকেও তুমি আমার সঙ্গে মজাইয়ো না।
শচীশ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তাই হইবে।
দামিনী শচীশের পায়ের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া
প্রণাম করিল। গুন্ গুন্ করিয়া বলিতে লাগিল, তুমি আমার গুরু, তুমি আমার গুরু! আমাকে
সকল অপরাধ হইতে বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও।
পরিশিষ্ট
আবার একদিন কানাকানি এবং কাগজে কাগজে গালাগালি
চলিল যে, ফের শচীশের মতের বদল হইয়াছে। একদিন অতি উচ্চৈঃস্বরে সে না মানিত জাত, না
মানিত ধর্ম; তার পরে আর-একদিন অতি উচ্চৈঃস্বরে সে খাওয়া-ছোঁওয়া স্নান-তর্পণ যোগযাগ
দেবদেবী কিছুই মানিতে বাকি রাখিল না; তার পরে আর-একদিন এই-সমস্তই মানিয়া-লওয়ার ঝুড়ি
ঝুড়ি বোঝা ফেলিয়া দিয়া সে নীরবে শান্ত হইয়া বসিল—
কী মানিল আর কী না মানিল তাহা
বোঝা গেল না। কেবল ইহাই দেখা গেল আগেকার মতো আবার সে কাজে লাগিয়া গেছে, কিন্তু তার
মধ্যে ঝগড়াবিবাদের ঝাঁজ নাই।
আর-একটা কথা লইয়া কাগজে বিস্তর বিদ্রূপ ও কটূক্তি হইয়া গেছে।
আমার সঙ্গে দামিনীর বিবাহ হইয়াছে—
এই বিবাহের রহস্য কী তা সকলে বুঝিবে না, বোঝার প্রয়োজনও নাই।