১
মাধব দত্ত। মুশকিলে পড়ে গেছি। যখন ও ছিল না, তখন ছিলই না―
কোনো ভাবনাই ছিল না। এখন ও কোথা থেকে এসে আমার ঘর জুড়ে বসল; ও চলে গেলে আমার এ ঘর
যেন আর ঘরই থাকবে না। কবিরাজমশায়, আপনি কি মনে করেন ওকে―
কবিরাজ। ওর ভাগ্যে যদি আয়ু থাকে, তা হলে দীর্ঘকাল বাঁচতেও পারে; কিন্তু আয়ুর্বেদে
যেরকম লিখছে তাতে তো―
মাধব দত্ত।
বলেন কী!
কবিরাজ। শাস্ত্রে বলছেন, পৈত্তিকান্ সন্নিপাতজান্ কফবাতসমুদ্ভবান্―
মাধব দত্ত। থাক্ থাক্, আপনি আর ঐ শ্লোকগুলো আওড়াবেন না― ওতে আরো আমার ভয় বেড়ে যায়। এখন কী
করতে হবে সেইটে বলে দিন।
কবিরাজ।
(নস্য লইয়া) খুব সাবধানে রাখতে হবে।
মাধব দত্ত।
সে তো ঠিক কথা, কিন্তু কী বিষয়ে সাবধান হতে হবে সেইটে স্থির করে দিয়ে যান।
কবিরাজ।
আমি তো পূর্বেই বলেছি, ওকে বাইরে একেবারে যেতে দিতে পারবেন না।
মাধব দত্ত।
ছেলেমানুষ, ওকে দিনরাত ঘরের মধ্যে ধরে রাখা যে ভারি শক্ত।
কবিরাজ। তা কী করবেন বলেন। এই শরৎকালের রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ঐ বালকের পক্ষে বিষবৎ―
কারণ কিনা শাস্ত্রে বলছে, অপস্মারে জ্বরে কাশে কামলায়াং হলীমকে
―
মাধব দত্ত।
থাক্ থাক্, আপনার শাস্ত্র থাক্। তা হলে ওকে বন্ধ করেই রেখে দিতে হবে―
অন্য কোনো
উপায় নেই?
কবিরাজ। কিছু না, কারণ, পবনে তপনে চৈব―
মাধব দত্ত। আপনার ও চৈব নিয়ে আমার কী হবে বলেন তো। ও থাক্-না―
কী করতে হবে সেইটে বলে দিন। কিন্তু আপনার ব্যবস্থা বড়ো কঠোর। রোগের সমস্ত দুঃখ
ও-বেচারা চুপ করে সহ্য করে―
কিন্তু আপনার ওষুধ খাবার সময় ওর কষ্ট দেখে আমার বুক ফেটে যায়।
কবিরাজ। সেই কষ্ট যত প্রবল তার ফলও তত বেশি― তাই তো মহর্ষি চ্যবন বলেছেন, ভেষজং
হিতবাক্যঞ্চ তিক্তং আশুফলপ্রদং। আজ তবে উঠি দত্তমশায়!
[ প্রস্থান
ঠাকুরদার প্রবেশ
মাধব দত্ত।
ঐ রে ঠাকুরদা এসেছে! সর্বনাশ করলে!
ঠাকুরদা।
কেন? আমাকে তোমার ভয় কিসের?
মাধব দত্ত।
তুমি যে ছেলে খেপাবার সদ্দার।
ঠাকুরদা। তুমি তো ছেলেও নও, তোমার ঘরেও ছেলে নেই―
তোমার খেপবার বয়সও গেছে― তোমার ভাবনা
কী।
মাধব দত্ত।
ঘরে যে ছেলে একটি এনেছি।
ঠাকুরদা।
সে কী-রকম!
মাধব দত্ত।
আমার স্ত্রী যে পোষ্যপুত্র নেবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিল।
ঠাকুরদা।
সে তো অনেকদিন থেকে শুনছি, কিন্তু তুমি যে নিতে চাও না।
মাধব দত্ত। জান তো ভাই, অনেক কষ্টে টাকা করেছি, কোথা থেকে পরের ছেলে এসে আমার বহু
পরিশ্রমের ধন বিনা পরিশ্রমে ক্ষয় করতে থাকবে, সে কথা মনে করলেও আমার খারাপ লাগত।
কিন্তু এই ছেলেটিকে আমার যে কিরকম লেগে গিয়েছে
―
ঠাকুরদা।
তাই এর জন্যে টাকা যতই খরচ করছ, ততই মনে করছ, সে যেন টাকার পরম ভাগ্য।
মাধব দত্ত। আগে টাকা রোজগার করতুম, সে কেবল একটা নেশার মতো ছিল― না করে কোনোমতে থাকতে পারতুম
না। কিন্তু এখন যা টাকা করছি, সবই ঐ ছেলে পাবে জেনে উপার্জনে ভারি একটা আনন্দ
পাচ্ছি।
ঠাকুরদা।
বেশ, বেশ ভাই, ছেলেটি কোথায় পেলে বলো দেখি।
মাধব দত্ত।
আমার স্ত্রীর গ্রামসম্পর্কে ভাইপো। ছোটোবেলা থেকে বেচারার মা নেই। আবার সেদিন তার
বাপও মারা গেছে।
ঠাকুরদা।
আহা! তবে তো আমাকে তার দরকার আছে।
মাধব দত্ত। কবিরাজ বলছে তার ঐটুকু শরীরে একসঙ্গে বাত পিত্ত শ্লেষ্মা যে-রকম
প্রকুপিত হয়ে উঠেছে, তাতে তার আর বড়ো আশা নেই। এখন একমাত্র উপায় তাকে কোনোরকমে এই
শরতের রৌদ্র আর বাতাস থেকে বাঁচিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখা। ছেলেগুলোকে ঘরের বার করাই
তোমার এই বুড়োবয়সের খেলা― তাই তোমাকে ভয় করি।
ঠাকুরদা। মিছে বল নি― একেবারে ভয়ানক হয়ে উঠেছি আমি, শরতের রৌদ্র আর হাওয়ারই মতো। কিন্তু
ভাই, ঘরে ধরে রাখবার মতো খেলাও আমি কিছু জানি। আমার কাজকর্ম একটু সেরে আসি, তার পরে
ঐ ছেলেটির সঙ্গে ভাব করে নেব।
[ প্রস্থান
অমল গুপ্তের প্রবেশ
অমল।
পিসেমশায়!
মাধব দত্ত।
কী অমল?
অমল।
আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?
মাধব দত্ত।
না বাবা!
অমল। ঐ যেখানটাতে পিসিমা জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙেন। ঐ দেখো-না, যেখানে ভাঙা ডালের
খুদগুলি দুই হাতে তুলে নিয়ে লেজের উপর ভর দিয়ে বসে কাঠবিড়ালি কুটুস কুটুস করে
খাচ্ছে―
ওখানে আমি যেতে পারব না?
মাধব দত্ত।
না বাবা!
অমল।
আমি যদি কাঠবিড়ালি হতুম তবে বেশ হত। কিন্তু পিসেমশায়, আমাকে কেন বেরোতে দেবে না?
মাধব দত্ত।
কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে।
অমল।
কবিরাজ কেমন করে জানলে?
মাধব দত্ত।
বল কী অমল! কবিরাজ জানবে না! সে যে এত বড়ো বড়ো পুঁথি পড়ে ফেলেছে!
অমল।
পুঁথি পড়লেই কি সমস্ত জানতে পারে?
মাধব দত্ত।
বেশ! তাও বুঝি জান না!
অমল। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) আমি যে পুঁথি কিছুই পড়ি নি― তাই জানি নে।
মাধব দত্ত। দেখো, বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা সব তোমারই মতো― তারা ঘর থেকে তো বেরোয় না।
অমল।
বেরোয় না?
মাধব দত্ত। না, কখন বেরোবে বলো। তারা বসে বসে কেবল পুঁথি পড়ে―
আর-কোনো দিকেই তাদের চোখ নেই। অমলবাবু, তুমিও বড়ো হলে পণ্ডিত হবে―
বসে বসে এই এত বড়ো বড়ো সব পুথিঁ পড়বে― সবাই
দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে।
অমল। না, না পিসেমশায়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমি পণ্ডিত হব না― পিসেমশায়, আমি পণ্ডিত
হব না।
মাধব দত্ত।
সে কী কথা অমল! যদি পণ্ডিত হতে পারতুম, তা হলে আমি তো বেঁচে যেতুম।
অমল। আমি, যা আছে সব দেখব― কেবলি দেখে বেড়াব।
মাধব দত্ত।
শোনো একবার! দেখবে কী? দেখবার এত আছেই বা কী?
অমল। আমাদের জানলার কাছে বসে সেই-যে দূরে পাহাড় দেখা যায়― আমার ভারি ইচ্ছে করে ঐ
পাহাড়টার পার হয়ে চলে যাই।
মাধব দত্ত। কী পাগলের মতো কথা! কাজ নেই কর্ম নেই, খামকা পাহাড়টা পার হয়ে চলে যাই!
কী যে বলে তার ঠিক নেই। পাহাড়টা যখন মস্ত বেড়ার মতো উঁচু হয়ে আছে তখন তো বুঝতে হবে
ওটা পেরিয়ে যাওয়া বারণ― নইলে এত বড়ো বড়ো পাথর জড়ো করে এতবড়ো একটা কাণ্ড করার দরকার কী ছিল!
অমল।
পিসেমশায়, তোমার কি মনে হয় ও বারণ করছে? আমার ঠিক বোধ হয় পৃথিবীটা কথা কইতে পারে
না, তাই অমনি করে নীল আকাশে হাত তুলে ডাকছে। অনেক দূরের যারা ঘরের মধ্যে বসে থাকে
তারাও দুপুরবেলা একলা জানলার ধারে বসে ঐ ডাক শুনতে পায়। পণ্ডিতরা বুঝি শুনতে পায়
না?
মাধব দত্ত। তারা তো তোমার মতো খেপা নয়― তারা শুনতে চায়ও না।
অমল।
আমার মতো খেপা আমি কালকে একজনকে দেখেছিলুম।
মাধব দত্ত।
সত্যি নাকি? কী রকম শুনি।
অমল।
তার কাঁধে এক বাঁশের লাঠি। লাঠির আগায় একটা পুঁটুলি বাঁধা। তার বাঁ হাতে একটা ঘটি।
পুরানো একজোড়া নাগরাজুতো পরে সে এই মাঠের পথ দিয়ে ঐ পাহাড়ের দিকেই যাচ্ছিল। আমি
তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বললে, কী জানি, যেখানে হয়। আমি
জিজ্ঞাসা করলুম, কেন যাচ্ছ? সে বললে, কাজ খুঁজতে যাচ্ছি। আচ্ছা পিসেমশায়, কাজ কি
খুঁজতে হয়?
মাধব দত্ত।
হয় বৈকি। কত লোক কাজ খুঁজে বেড়ায়।
অমল।
বেশ তো। আমিও তাদের মতো কাজ খুঁজে বেড়াব।
মাধব দত্ত।
খুঁজে যদি না পাও।
অমল। খুঁজে যদি না পাই তো আবার খুঁজব। তার পরে সেই নাগরাজুতো পরা লোকটা চলে গেল―
আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম। সেই যেখানে ডুমুরগাছের তলা দিয়ে ঝরনা
বয়ে যাচ্ছে, সেইখানে সে লাঠি নামিয়ে রেখে ঝরনার জলে আস্তে আস্তে পা ধুয়ে নিলে―
তার পরে পুঁটুলি খুলে ছাতু বের করে জল দিয়ে মেখে নিয়ে খেতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে
আবার পুঁটুলি বেঁধে ঘাড়ে করে নিলে― পায়ের কাপড় গুটিয়ে নিয়ে সেই ঝরনার ভিতর নেমে জল
কেটে কেটে কেমন পার হয়ে চলে গেল। পিসিমাকে বলে রেখেছি ঐ ঝরনার ধারে গিয়ে একদিন আমি
ছাতু খাব।
মাধব দত্ত।
পিসিমা কী বললে?
অমল।
পিসিমা বললেন, তুমি ভালো হও, তার পর তোমাকে ঐ ঝরনার ধারে নিয়ে গিয়ে ছাতু খাইয়ে আনব।
কবে আমি ভালো হব?
মাধব দত্ত।
আর তো দেরি নেই বাবা!
অমল।
দেরি নেই? ভালো হলেই কিন্তু আমি চলে যাব।
মাধব দত্ত।
কোথায় যাবে?
অমল। কত বাঁকা বাঁকা ঝরনার জলে আমি পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পার হতে হতে চলে যাব― দুপুরবেলায়
সবাই যখন ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে, তখন আমি কোথায় কতদূরে কেবল কাজ খুঁজে খুঁজে
বেড়াতে বেড়াতে চলে যাব।
মাধব দত্ত। আচ্ছা বেশ, আগে তুমি ভালো হও, তার পরে তুমি―
অমল।
তার পরে আমাকে পণ্ডিত হতে বোলো না পিসেমশায়!
মাধব দত্ত।
তুমি কী হতে চাও বলো।
অমল। এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না― আচ্ছা আমি ভেবে বলব।
মাধব দত্ত।
কিন্তু তুমি অমন করে যে-সে বিদেশী লোককে ডেকে ডেকে কথা বোলো না।
অমল।
বিদেশী লোক আমার ভারি ভালো লাগে।
মাধব দত্ত।
যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যেত?
অমল। তা হলে তো সে বেশ হত। কিন্তু আমাকে তো কেউ ধরে নিয়ে যায় না― সব্বাই কেবল বসিয়ে
রেখে দেয়।
মাধব দত্ত। আমার কাজ আছে আমি চললুম― কিন্তু বাবা দেখো, বাইরে যেন বেরিয়ে যেয়ো না।
অমল।
যাব না। কিন্তু পিসেমশায়, রাস্তার ধারের এই ঘরটিতে আমি বসে থাকব।