২
দইওআলা। দই―
দই―
ভালো দই!
অমল। দইওআলা, দইওআলা, ও দইওআলা!
দইওআলা। ডাকছ কেন? দই কিনবে?
অমল। কেমন করে কিনব! আমার তো পয়সা নেই।
দইওআলা। কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?
অমল।
আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম।
দইওআলা।
আমার সঙ্গে!
অমল।
হাঁ। তুমি যে কত দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছ শুনে আমার মন কেমন করছে।
দইওআলা।
(দধির বাঁক নামাইয়া) , বাবা, তুমি এখানে বসে কী করছ?
অমল।
কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে, তাই আমি সারাদিন এইখেনেই বসে থাকি।
দইওআলা।
আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?
অমল।
আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়ি নি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওআলা, তুমি
কোথা থেকে আসছ?
দইওআলা।
আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।
অমল।
তোমাদের গ্রাম? অনে―ক দূরে তোমাদের গ্রাম?
দইওআলা।
আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।
অমল। পাঁচমুড়া পাহাড়―
শামলী নদী―
কী জানি,হয়তো তোমাদের গ্রাম দেখেছি―
কবে সে আমার
মনে পড়ে না।
দইওআলা।
তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?
অমল। না, কোনোদিন যাই নি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি। অনেক পুরোনোকালের খুব
বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম―
একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। না?
দইওআলা।
ঠিক বলেছ বাবা।
অমল।
সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।
দইওআলা।
কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বই কি, খুব চরে।
অমল। মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী করে নিয়ে যায়―
তাদের লাল শাড়ি পরা।
দইওআলা। বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে
যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয়―
কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে
বেড়াতে গিয়েছিলে!
অমল।
সত্যি বলছি দইওআলা, আমি একদিনও যাই নি। কবিরাজ যেদিন আমাকে বাইরে যেতে বলবে সেদিন
তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?
দইওআলা।
যাব বই কি বাবা, খুব নিয়ে যাব!
অমল। আমাকে তোমার মতো ঐরকম দই বেচতে শিখিয়ে দিয়ো। ঐরকম বাঁক কাঁধে নিয়ে―
ঐরকম খুব
দূরের রাস্তা দিয়ে।
দইওআলা।
মরে যাই! দই বেচতে যাবে কেন বাবা। এত এত পুঁথি পড়ে তুমি পণ্ডিত হয়ে উঠবে।
অমল। না, না, আমি কক্খনো পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের
বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে
বেড়াব। কী রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই―
ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।
দইওআলা।
হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!
অমল। না, না, ও আমার শুনতে খুব ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক
শুনলে মন উদাস হয়ে যায়―
তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে
হচ্ছিল―
কী জানি কী মনে হচ্ছিল!
দইওআলা।
বাবা, এক ভাঁড় দুই তুমি খাও।
অমল।
আমার তো পয়সা নেই।
দইওআলা। না না না না―
পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই একটু খেলে আমি কত খুশি হব।
অমল।
তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?
দইওআলা।
কিচ্ছু দেরি হন নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে
শিখে নিলুম।
[ প্রস্থান
অমল।
(সুর করিয়া) , দই, দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে
গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলায় গোরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়,
সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই। দই, দই, দই―ই, ভালো দই! এই-যে রাস্তায়
প্রহরী পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
প্রহরী, প্রহরী, একটিবার শুনে যাও-না প্রহরী!
প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী।
অমন করে ডাকাডাকি করছ কেন? আমাকে ভয় কর না তুমি?
অমল।
কেন, তোমাকে কেন ভয় করব?
প্রহরী।
যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যাই।
অমল।
কোথায় ধরে নিয়ে যাবে? অনেক দূরে? ঐ পাহাড় পেরিয়ে?
প্রহরী।
একেবারে রাজার কাছে যদি নিয়ে যাই।
অমল। রাজার কাছে? নিয়ে যাও-না আমাকে! কিন্তু আমাকে যে করিরাজ বাইরে যেতে বারণ
করেছে। আমাকে কেউ কোত্থাও ধরে নিয়ে যেতে পারবে না―
আমাকে কেবল দিনরাত্রি এখানেই বসে
থাকতে হবে।
প্রহরী। কবিরাজ বারণ করেছে? আহা, তাই বটে―
তোমার মুখ যেন সাদা হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালি
পড়েছে। তোমার হাত দুখানিতে শিরগুলি দেখা যাচ্ছে।
অমল।
তুমি ঘণ্টা বাজাবে না প্রহরী?
প্রহরী।
এখনো সময় হয় নি।
অমল।
কেউ বলে 'সময় বয়ে যাচ্ছে', কেউ বলে 'সময় হয় নি'। আচ্ছা, তুমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই তো
সময় হবে?
প্রহরী।
সে কি হয়! সময় হলে তবে আমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিই।
অমল।
বেশ লাগে তোমার ঘণ্টা―
আমার শুনতে ভারি ভালো লাগে―
দুপুরবেলা আমাদের বাড়িতে যখন সকলেরই খাওয়া হয়ে যায়―
পিসেমশায় কোথায় কাজ করতে বেরিয়ে যান, পিসিমা রামায়ণ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন, আমাদের
খুদে কুকুরটা উঠোনে ঐ কোণের ছায়ায় লেজের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমোতে থাকে―
তখন তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে―
ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং। তোমার ঘণ্টা কেন
বাজে?
প্রহরী।
ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।
অমল।
কোথায় চলে যাচ্ছে? কোন্ দেশে?
প্রহরী।
সে কথা কেউ জানে না।
অমল। সে দেশ বুঝি কেউ দেখে আসে নি? আমার ভারি ইচ্ছে করছে ঐ সময়ের সঙ্গে চলে যাই―
যে
দেশের কথা কেউ জানে না সেই অনেক দূরে।
প্রহরী।
সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!
অমল।
আমাকেও যেতে হবে?
প্রহরী।
হবে বই কি!
অমল।
কিন্তু কবিরাজ যে আমাকে বাইরে যেতে বারণ করেছে।
প্রহরী।
কোন্দিন কবিরাজই হয়তো স্বয়ং হাতে ধরে নিয়ে যাবেন!
অমল।
না না, তুমি তাকে জান না, সে কেবলই ধরে রেখে দেয়।
প্রহরী।
তার চেয়ে ভালো কবিরাজ যিনি আছেন, তিনি এসে ছেড়ে দিয়ে যান।
অমল।
আমার সেই ভালো কবিরাজ কবে আসবেন? আমার যে আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
প্রহরী।
অমন কথা বলতে নেই বাবা!
অমল। না―
আমি তো বসেই আছি―
যেখানে আমাকে বসিয়ে রেখেছে সেখান থেকে আমি তো বেরোই নে―
কিন্তু তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং―
আর আমার মন-কেমন করে। আচ্ছা প্রহরী!
প্রহরী।
কী বাবা?
অমল। আচ্ছা, ঐ-যে রাস্তার ওপারের বড়ো বাড়িতে নিশেন উড়িয়ে দিয়েছে, আর ওখানে সব লোকজন
কেবলই আসছে যাচ্ছে―
ওখানে কী হয়েছে?
প্রহরী।
ওখানে নতুন ডাকঘর বসেছে।
অমল।
ডাকঘর? কার ডাকঘর?
প্রহরী।
ডাকঘর আর কার হবে? রাজার ডাকঘর।
―এ ছেলেটি ভারি মজার।
অমল।
রাজার ডাকঘরে রাজার কাছ থেকে সব চিঠি আসে?
প্রহরী।
আসে বৈকি। দেখো একদিন তোমার নামেও চিঠি আসবে।
অমল।
আমার নামেও চিঠি আসবে? আমি যে ছেলেমানুষ।
প্রহরী।
ছেলেমানুষকে রাজা এতটুকুটুকু ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লেখেন।
অমল।
বেশ হবে। আমি কবে চিঠি পাব? আমাকেও তিনি চিঠি লিখবেন তুমি কেমন করে জানলে?
প্রহরী।
তা নইলে তিনি ঠিক তোমার এই খোলা জানলাটার সামনেই অতবড়ো একটা সোনালি রঙের নিশেন
উড়িয়ে ডাকঘর খুলতে যাবেন কেন?
―ছেলেটাকে আমার বেশ লাগছে।
অমল।
আচ্ছা, রাজার কাছ থেকে আমার চিঠি এলে আমাকে কে এনে দেবে?
প্রহরী। রাজার যে অনেক ডাক-হরকরা আছে―
দেখ নি বুকে গোল গোল সোনার তকমা প'রে তারা ঘুরে
বেড়ায়।
অমল।
আচ্ছা, কোথায় তারা ঘোরে?
প্রহরী।
ঘরে ঘরে, দেশে দেশে।
―এর প্রশ্ন শুনলে হাসি পায়।
অমল।
বড়ো হলে আমি রাজার ডাক-হরকরা হব।
প্রহরী। হা হা হা হা! ডাক-হরকরা! সে ভারি মস্ত কাজ! রোদ নেই বৃষ্টি নেই, গরিব নেই
বড়োমানুষ নেই, সকলের ঘরে ঘরে চিঠি বিলি করে বেড়ানো―
সে খুব জবর কাজ!
অমল। তুমি হাসছ কেন! আমার ঐ কাজটাই সকলের চেয়ে ভালো লাগছে। না না তোমার কাজও খুব
ভালো―
দুপুরবেলা যখন রোদ্দুর ঝাঁঝাঁ করে, তখন ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং―
আবার এক-এক দিন
রাত্রে হঠাৎ বিছানায় জেগে উঠে দেখি ঘরের প্রদীপ নিবে গেছে, বাইরের কোন্ অন্ধকারের
ভিতর দিয়ে ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং।
প্রহরী। ঐ যে মোড়ল আসছে―
আমি এবার পালাই। ও যদি দেখতে পায় তোমার সঙ্গে গল্প করছি, তা হলেই
মুশকিল বাধাবে।
অমল।
কই মোড়ল, কই,কই?
প্রহরী।
ঐ যে, অনেক দূরে। মাথায় একটা মস্ত গোলপাতার ছাতি।
অমল।
ওকে বুঝি রাজা মোড়ল করে দিয়েছে?
প্রহরী।
আরে না। ও আপনি মোড়লি করে। যে ওকে না মানতে চায় ও তার সঙ্গে দিনরাত এমনি লাগে যে
ওকে সকলেই ভয় করে। কেবল সকলের সঙ্গে শত্রুতা করেই ও আপনার ব্যবসা চালায়। আজ তবে
যাই, আমার কাজ কামাই যাচ্ছে। আমি আবার কাল সকালে এসে তোমাকে সমস্ত শহরের খবর শুনিয়ে
যাব।
[ প্রস্থান
অমল। রাজার কাছ থেকে রোজ একটা করে চিঠি যদি পাই তা হলে বেশ হয়―
এই জানলার কাছে বসে বসে পড়ি। কিন্তু আমি তো পড়তে পারি নে! কে পড়ে দেবে? পিসিমা তো
রামায়ণ পড়ে। পিসিমা কি রাজার লেখা পড়তে পারে? কেউ যদি পড়তে না পারে জমিয়ে রেখে দেব,
আমি বড়ো হলে পড়ব। কিন্তু ডাক-হরকরা যদি আমাকে না চেনে! মোড়লমশায়, ও মোড়লমশায়―
একটা কথা শুনে যাও।
মোড়লের প্রবেশ
মোড়ল।
কে রে! রাস্তার মধ্যে আমাকে ডাকাডাকি করে! কোথাকার বাঁদর এটা!
অমল।
তুমি মোড়লমশায়, তোমাকে তো সবাই মানে।
মোড়ল।
(খুশি হইয়া) হাঁ, হাঁ, মানে বৈকি। খুব মানে।
অমল।
রাজার ডাক-হরকরা তোমার কথা শোনে?
মোড়ল।
না শুনে তার প্রাণ বাঁচে? বাস রে, সাধ্য কী!
অমল। তুমি ডাক-হরকরাকে বলে দেবে আমারই নাম অমল―
আমি এই জানলার কাছটাতে বসে থাকি।
মোড়ল।
কেন বলো দেখি।
অমল। আমার নামে যদি চিঠি আসে―
মোড়ল।
তোমার নামে চিঠি! তোমাকে কে চিঠি লিখবে?
অমল। রাজা যদি চিঠি লেখে তা হলে―
মোড়ল।
হা হা হা হা! এ ছেলেটা তো কম নয়। হা হা হা হা! রাজা তোমাকে চিঠি লিখবে! তা লিখবে
বৈকি! তুমি যে তাঁর পরম বন্ধু! কদিন তোমার সঙ্গে দেখা না হয়ে রাজা শুকিয়ে যাচ্ছে,
খবর পেয়েছি। আর বেশি দেরি নেই, চিঠি হয়তো আজই আসে কি কালই আসে।
অমল।
মোড়লমশায়, তুমি অমন করে কথা কচ্ছ কেন! তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?
মোড়ল।
বাস রে। তোমার উপর রাগ করব! এত সাহস আমার! রাজার সঙ্গে তোমার চিঠি চলে!
―মাধব
দত্তের বড়ো বাড় হয়েছে দেখছি। দু-পয়সা জমিয়েছে কিনা, এখন তার ঘরে রাজা-বাদশার কথা
ছাড়া আর কথা নেই। রোসো-না ওকে মজা দেখাচ্ছি। ওরে ছোঁড়া, বেশ, শীঘ্রই যাতে রাজার
চিঠি তোদের বাড়িতে আসে, আমি তার বন্দোবস্ত করছি।
অমল।
না, না, তোমাকে কিছু করতে হবে না।
মোড়ল। কেন রে? তোর খবর আমি রাজাকে জানিয়ে দেব―
তিনি তা হলে আর দেরি করতে পারবেন না―
তোমাদের খবর নেওয়ার জন্যে এখনই পাইক পাঠিয়ে দেবেন!
―না, মাধব দত্তর ভারি আস্পর্ধা
―রাজার কানে একবার উঠলে দুরস্ত হয়ে যাবে
[ প্রস্থান
অমল। কে তুমি মল ঝম্ ঝম্ করতে করতে চলেছ― একটু দাঁড়াও-না ভাই।
বালিকার প্রবেশ
বালিকা।
আমার কি দাঁড়াবার জো আছে! বেলা বয়ে যায় যে।
অমল।
তোমার দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না―
আমারও এখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করে না।
বালিকা।
তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে যেন সকালবেলাকার তারা―
তোমার কী হয়েছে বলো তো।
অমল।
জানি নে কী হয়েছে, কবিরাজ আমাকে বেরোতে বারণ করেছে।
বালিকা। আহা, তবে বেরিয়ো না―
কবিরাজের কথা মেনে চলতে হয়―
দুরন্তপনা করতে নেই, তা হলে
লোকে দুষ্টু বলবে। বাইরের দিকে তাকিয়ে তোমার মন ছটফট করছে, আমি বরঞ্চ তোমার এই
আধখানা দরজা বন্ধ করে দিই।
অমল। না, না, বন্ধ কোরা না―
এখানে আমার আর-সব বন্ধ কেবল এইটুকু খোলা। তুমি কে বলো-না―
আমি তো তোমাকে চিনি নে!
বালিকা।
আমি সুধা।
অমল।
সুধা?
সুধা।
জান না? আমি এখানকার মালিনীর মেয়ে।
অমল।
তুমি কী কর?
সুধা।
সাজি ভরে ফুল তুলে নিয়ে এসে মালা গাঁথি। এখন ফুল তুলতে চলেছি।
অমল। ফুল তুলতে চলেছ? তাই তোমার পা দুটি অমন খুশি হয়ে উঠেছে―
যতই চলেছ, মল বাজছে ঝম্
ঝম্ ঝম্। আমি যদি তোমার সঙ্গে যেতে পারতুম তা হলে উঁচু ডালে যেখানে দেখা যায় না
সেইখান থেকে আমি তোমাকে ফুল পেড়ে দিতুম।
সুধা।
তাই বই কি! ফুলের খবর আমার চেয়ে তুমি নাকি বেশি জান!
অমল।
জানি, আমি খুব জানি। আমি সাত ভাই চম্পার খবর জানি। আমার মনে হয় আমাকে যদি সবাই ছেড়ে
দেয় তা হলে আমি চলে যেতে পারি খুব ঘন বনের মধ্যে যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সরু ডালের সব-আগায় যেখানে মনুয়া পাখি বসে বসে দোলা খায় সেইখানে আমি চাঁপা হয়ে ফুটতে
পারি। তুমি আমার পারুলদিদি হবে?
সুধা। কী বুদ্ধি তোমার! পারুলদিদি আমি কী করে হব! আমি যে সুধা―
আমি শশী মালিনীর মেয়ে।
আমাকে রোজ এত এত মালা গাঁথতে হয়। আমি যদি তোমার মতো এইখানে বসে থাকতে পারতুম তা হলে
কেমন মজা হত!
অমল।
তা হলে সমস্ত দিন কী করতে?
সুধা। আমার বেনে-বউ পুতুল আছে, তার বিয়ে দিতুম। আমার পুষি মেনি আছে, তাকে নিয়ে―
যাই,
বেলা বয়ে যাচ্ছে, দেরি হলে ফুল আর থাকবে না।
অমল।
আমার সঙ্গে আর-একটু গল্প করো-না, আমার খুব ভালো লাগছে।
সুধা।
আচ্ছা বেশ, তুমি দুষ্টুমি কোরো না, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে এইখানে স্থির হয়ে বসে থাকো,
আমি ফুল তুলে ফেরবার পথে তোমার সঙ্গে গল্প করে যাব।
অমল।
আর আমাকে একটি ফুল দিয়ে যাবে?
সুধা।
ফুল অমনি কেমন করে দেব? দাম দিতে হবে যে।
অমল।
আমি যখন বড়ো হব তখন তোমাকে দাম দেব। আমি কাজ খুঁজতে চলে যাব ঐ ঝরনা পার হয়ে, তখন
তোমাকে দাম দিয়ে যাব।
সুধা।
আচ্ছা বেশ।
অমল।
তুমি তা হলে ফুল তুলে আসবে?
সুধা।
আসব।
অমল।
আসবে?
সুধা।
আসব।
অমল।
আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার?
সুধা।
না, ভুলব না। দেখো, মনে থাকবে।
[ প্রস্থান
ছেলের দলের প্রবেশ
অমল।
ভাই, তোমরা সব কোথায় যাচ্ছ ভাই? একবার একটুখানি এইখানে দাঁড়াও-না।
ছেলেরা।
আমরা খেলতে চলেছি।
অমল।
কী খেলবে তোমরা ভাই?
ছেলেরা।
আমরা চাষ-খেলা খেলব।
প্রথম।
(লাঠি দেখাইয়া) এই যে আমাদের লাঙল।
দ্বিতীয়।
আমরা দুজনে দুই গোরু হব।
অমল।
সমস্ত দিন খেলবে?
ছেলেরা। হাঁ, সমস্ত দি―
ন।
অমল।
তার পরে সন্ধ্যায় সময় নদীর ধার দিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে?
ছেলেরা।
হাঁ, সন্ধ্যার সময় ফিরব।
অমল।
আমার এই ঘরের সামনে দিয়েই ফিরো ভাই।
ছেলেরা।
তুমি বেরিয়ে এসো-না, খেলবে চলো।
অমল।
কবিরাজ আমাকে বেরিয়ে যেতে মানা করেছে।
ছেলেরা।
কবিরাজ! কবিরাজের মানা তুমি শোন বুঝি! চল্ ভাই চল্ আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অমল। না ভাই, তোমরা আমার এই জানলার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু খেলা করো―
আমি একটু
দেখি।
ছেলেরা।
এখেনে কী নিয়ে খেলব?
অমল। এই যে আমার সব খেলনা পড়ে রয়েছে―
এ-সব তোমরাই নাও ভাই―
ঘরের ভিতরে একলা খেলতে ভালো
লাগে না
―
এ-সব ধুলোয় ছড়ানো পড়েই থাকে―
এ আমার কোনো কাজে লাগে না।
ছেলেরা।
বা, বা, বা, কী চমৎকার খেলনা! এ যে জাহাজ! এ যে জটাইবুড়ি! দেখছিস ভাই? কেমন সুন্দর
সেপাই!
―এ-সব তুমি আমাদের দিয়ে দিলে? তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
অমল।
না, কিছু কষ্ট হচ্ছে না, সব তোমাদের দিলুম।
ছেলেরা।
আর কিন্তু ফিরিয়ে দেব না।
অমল।
না, ফিরিয়ে দিতে হবে না।
ছেলেরা।
কেউ তো বকবে না?
অমল।
কেউ না, কেউ না। কিন্তু রোজ সকালে তোমরা এই খেলনাগুলো নিয়ে আমার এই দরজার সামনে
খানিকক্ষণ ধরে খেলো। আবার এগুলো যখন পুরোনো হয়ে যাবে আমি নতুন খেলনা আনিয়ে দেব।
ছেলেরা। বেশ ভাই, আমরা রোজ এখানে খেলে যাব। ও ভাই, সেপাইগুলোকে এখানে সব সাজা―
আমরা লড়াই-লড়াই খেলি। বন্দুক কোথায় পাই? ঐ-যে একটা মস্ত শরকাঠি পড়ে আছে―
ঐটেকে ভেঙে
ভেঙে নিয়ে আমরা বন্দুক বানাই। কিন্তু ভাই তুমি যে ঘুমিয়ে পড়ছ!
অমল। হাঁ, আমার ভারি ঘুম পেয়ে আসছে। জানি নে কেন আমার থেকে থেকে ঘুম পায়। অনেকক্ষণ
বসে আছি আমি, আর বসে থাকতে পারছি নে―
আমার পিঠ ব্যথা করছে।
ছেলেরা। এখন যে সবে এক প্রহর বেলা―
এখনই তোমার ঘুম পায় কেন? ঐ শোনো এক প্রহরের ঘণ্টা
বাজছে।
অমল। হাঁ, ঐ যে বাজছে ঢং ঢং ঢং―
আমাকে ঘুমোতে যেতে ডাকছে।
ছেলেরা।
তবে আমরা এখন যাই, আবার কাল সকালে আসব।
অমল।
যাবার আগে তোমাদের একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি ভাই। তোমরা তো বাইরে থাক, তোমরা ঐ
রাজার ডাকঘরের ডাক-হরকরাদের চেন?
ছেলেরা।
হাঁ চিনি বৈকি, খুব চিনি।
অমল।
কে তারা, নাম কী?
ছেলেরা। একজন আছে বাদল হরকরা, একজন আছে শরৎ―
আরো কত আছে।
অমল।
আচ্ছা, আমার নামে যদি চিঠি আসে তারা কি আমাকে চিনতে পারবে?
ছেলেরা।
কেন পারবে না? চিঠিতে তোমার নাম থাকলেই তারা তোমাকে ঠিক চিনে নেবে।
অমল।
কাল সকালে যখন আসবে তাদের একজনকে ডেকে এনে আমাকে চিনিয়ে দিয়ো না।
ছেলেরা।
আচ্ছা দেব।