ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
চোরাই ধন
[ছোটগল্প (গ্রন্থ), ১১ কার্তিক ১৩৪০
বঙ্গাব্দ।]
মহাকাব্যের যুগে স্ত্রীকে পেতে হত পৌরুষের জোরে ; যে অধিকারী সেই লাভ করত রমণীরত্ন । আমি লাভ করেছি কাপুরুষতা দিয়ে, সে কথা আমার স্ত্রীর জানতে বিলম্ব ঘটেছিল । কিন্তু, সাধনা করেছি বিবাহের পরে, যাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পেয়েছি তার মূল্য দিয়েছি দিনে দিনে ।
দাম্পত্যের স্বত্ব সাব্যস্ত করতে হয় প্রতিদিনই নতুন করে, অধিকাংশ পুরুষ ভুলে থাকে
এই কথাটা । তারা গোড়াতেই কাস্টম্ হৌসে মাল খালাস করে নিয়েছে সমাজের ছাড়চিঠি
দেখিয়ে, তার পর থেকে আছে বেপরোয়া । যেন পেয়েছে পাহারাওয়ালার সরকারি প্রতাপ
উপরওয়ালার দেওয়া তকমার জোরে ; উর্দিটা খুলে নিলেই অতি অভাজন তারা ।
বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান ; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার
প্রতিদিনের নব নব পর্যায়ে । এই কথাটা ভালোরকম করে বুঝেছি সুনেত্রার কাছ থেকেই । ওর
মধ্যে আছে ভালোবাসার ঐশ্বর্য, ফুরোতে চায় না তার সমারোহ ; দেউড়িতে চার-প্রহর বাজে
তার সাহানা রাগিণী । আপিস থেকে ফিরে এসে একদিন দেখি আমার জন্যে সাজানো আছে
বরফ-দেওয়া ফল্সার শরবত, রঙ দেখেই মনটা চমকে ওঠে ; তার পাশেই ছোটো রুপোর থালায় গোড়ে
মালা, ঘরে ঢোকবার আগেই গন্ধ আসে এগিয়ে । আবার কোনোদিন দেখি আইসক্রীমের যন্ত্রে
জমানো শাঁসে রসে মেশানো, তালশাঁস এক-পেয়ালা, আর পিরিচে একটিমাত্র সূর্যমুখী ।
ব্যাপারটা শুনতে বেশি কিছু নয় কিন্তু বোঝা যায়, দিনে দিনে নতুন করে সে অনুভব করেছে
আমার অস্তিত্ব । এই পুরোনোকে নতুন করে অনুভব করার শক্তি আর্টিস্টের । আর ইতরে জনাঃ
প্রতিদিন চলে দস্তুরের দাগা বুলিয়ে । ভালোবাসার প্রতিভা সুনেত্রার নবনবোন্মেষশালিনী
সেবা । আজ আমার মেয়ে অরুণার বয়স সতেরো, অর্থাৎ ঠিক যে বয়সে বিয়ে হয়েছিল সুনেত্রার ।
ওর নিজের বয়স আটত্রিশ, কিন্তু সযত্নে সাজসজ্জা করাটাকে ও জানে প্রতিদিন পুজোর
নৈবেদ্য-সাজানো, আপনাকে উৎসর্গ করবার আহ্নিক অনুষ্ঠান ।
সুনেত্রা ভালোবাসে শান্তিপুরে সাদা শাড়ি কালো পাড়ওয়ালা । খদ্দর-প্রচারকদের
ধিক্কারকে বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নিয়েছে; কিছুতেই স্বীকার করে নি খদ্দরকে । ও
বলে, ‘ দিশি তাঁতির হাত, দিশি তাঁতির তাঁত, এই আমার আদরের । তারা শিল্পী, তাদেরই
পছন্দে সুতো, আমার পছন্দ সমস্ত কাপড়টা নিয়ে । আসল কথা, সুনেত্রা বোঝে হালকা সাদা
রঙের শাড়িতে সকল রঙেরই ইশারা খাটে সহজে । ও সেই কাপড়ে নূতনত্ব দেয় নানা আভাসে, মনে
হয় না সেজেছে । ও বোঝে, আমার অবচেতন মনের দিগন্ত উদ্ভাসিত হয় ওর সাজে — আমি খুশি
হই, জানি নে কেন খুশি হয়েছি ।
প্রত্যেক মানুষেই আছে একজন আমি, সেই অপরিমেয় রহস্যের অসীম মূল্য জোগায় ভালোবাসায় ।
অহংকারের মেকি পয়সা তুচ্ছ হয়ে যায় এর কাছে । সুনেত্রা আপন মনপ্রাণ দিয়ে এই পরম
মূল্য দিয়ে এসেছে আমাকে, আজ একুশ বছর ধরে । ওর শুভ্র ললাটে কুঙ্কুমবিন্দুর মধ্যে
প্রতিদিন লেখা হয় অক্লান্ত বিস্ময়ের বাণী । ওর নিখিল জগতের মর্মস্থান অধিকার করে
আছি আমি, সেজন্যে আমাকে আর-কিছু হতে হয় নি সাধারণ জগতের যে-কেউ হওয়া ছাড়া ।
সাধারণকেই অসাধারণ করে আবিষ্কার করে ভালোবাসা । শাস্ত্রে বলে, আপনাকে জানো । আনন্দে
আপনাকেই জানি আর-একজন যখন প্রেমে জেনেছে আমার আপনকে ।
২
বাবা ছিলেন, কোনো নামজাদা ব্যাঙ্কের অন্যতম অধিনায়ক, তারই একজন অংশিদার হলেম আমি ।
যাকে বলে ঘুমিয়ে-পড়া অংশিদার একেবারেই তা নয় । আষ্টেপৃষ্ঠে লাগাম দিয়ে জুতে দিলে
আমাকে আপিসের কাজে । আমার শরীর-মনের সঙ্গে এই কাজটা মানানসই নয় । ইচ্ছা ছিল,
ফরেস্ট্ বিভাগে কোথাও পরিদর্শকের পদ দখল করে বসি, খোলা হাওয়ায় দৌড়ধাপ করি, শিকারের
শখ নিই মিটিয়ে । বাবা তাকালেন প্রতিপত্তির দিকে ; বললেন, ‘ যে কাজ পাচ্ছ সেটা সহজে
জোটে না বাঙালির ভাগ্যে । হার মানতে হল । তা ছাড়া মনে হয়, পুরুষের প্রতিপত্তি
জিনিসটা মেয়েদের কাছে দামী । সুনেত্রার ভগ্নীপতি অধ্যাপক ; ইম্পীরিএল সার্ভিস তার,
সেটাতে ওদের মেয়েমহলের মাথা উপরে তুলে রাখে । যদি জংলি ‘ নিস্পেকেট্টর সাহেব ' হয়ে
সোলার হ্যাট প ' রে বাঘ-ভালুকের চামড়ায় মেঝে দিতুম ঢেকে, তাতে আমার দেহের গুরুত্ব
কমিয়ে রাখত, সেই সঙ্গে কমাত আমার পদের গৌরব আর-পাঁচজন পদস্থ প্রতিবেশীর তুলনায় । কী
জানি এই লাঘবতায় মেয়েদের আত্মাভিমান বুঝি কিছু ক্ষুণ্ন করে ।
এ দিকে ডেস্কে-বাঁধা স্থাবরত্বের চাপে দেখতে দেখতে আমার যৌবনের ধারা আসছে ভোঁতা হয়ে
। অন্য কোনো পুরুষ হলে সে কথাটা নিশ্চিন্ত মনে ভুলে গিয়ে পেটের পরিধিবিস্তারকে
দুর্বিপাক বলে গণ্য করত না । আমি তা পারি নে । আমি জানি, সুনেত্রা মুগ্ধ হয়েছিল
শুধু আমার গুণে নয়, আমার দেহসৌষ্ঠবে । বিধাতার স্বরচিত যে বরমাল্য অঙ্গে নিয়ে একদিন
তাকে বরণ করেছি নিশ্চিত তার প্রয়োজন আছে প্রতিদিনের অভ্যর্থনায় । আশ্চর্য এই যে,
সুনেত্রার যৌবন আজও রইল অক্ষুণ্ন, দেখতে দেখতে আমিই চলেছি ভাঁটার মুখে — শুধু
ব্যাঙ্কে জমছে টাকা ।
আমাদের মিলনের প্রথম অভ্যুদয়কে আর-একবার প্রত্যক্ষ চোখের সামনে আনল আমার মেয়ে অরুণা
। আমাদের জীবনের সেই উষারুণরাগ দেখা দিয়েছে ওদের তারুণ্যের নবপ্রভাতে । দেখে পুলকিত
হয়ে ওঠে আমার সমস্ত মন । শৈলেনের দিকে চেয়ে দেখি, আমার সেদিনকার বয়স ওর দেহে
আবির্ভূত । যৌবনের সেই ক্ষিপ্রশক্তি, সেই অজস্র প্রফুল্লতা, আবার ক্ষণে ক্ষণে
প্রতিহত দুরাশায় ম্লানায়মান উৎসাহের উৎকণ্ঠা । সেই দিন আমি যে পথে চলতেম সেই পথ ওরও
সামনে, তেমনি করেই অরুণার মায়ের মন বশ করবার নানা উপলক্ষ ও সৃষ্টি করছে, কেবল
যথেষ্ট লক্ষগোচর নই আমিই । অপর পক্ষে অরুণা জানে মনে মনে, তার বাবা বোঝে মেয়ের দরদ
। এক-একদিন কী জানি কেন দুই চক্ষে অদৃশ্য অশ্রুর করুণা নিয়ে চুপ ক ' রে এসে বসে
আমার পায়ের কাছের মোড়ায় । ওর মা নিষ্ঠুর হতে পারে, আমি পারি নে ।
অরুণার মনের কথা ওর মা যে বোঝে না তা নয় ; কিন্তু তার বিশ্বাস, এ-সমস্তই ‘ প্রভাতে
মেঘডম্বরম্ ', বেলা হলেই যাবে মিলিয়ে । ঐখানেই সুনেত্রার সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য ।
খিদে মিটতে না দিয়ে খিদে মেরে দেওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাত পড়বে
তখন হৃদয়ের রসনায় নবীন ভালোবাসার স্বাদ যাবে মরে । মধ্যাহ্নে ভোরের সুর লাগাতে গেলে
আর লাগে না । অভিভাবক বলেন, বিবেচনা করবার বয়েস হোক আগে, তার পরে, ইত্যাদি । হায়
রে, বিবেচনা করবার বয়েস ভালোবাসার বয়েসের উলটো পিঠে ।
কয়েকদিন আগেই এসেছিল ‘ ভরা বাদর মাহ ভাদর ' । ঘনবর্ষণের আড়ালে কলকাতার ইটকাঠের
বাড়িগুলো এল মোলায়েম হয়ে, শহরের প্রখর মুখরতা অশ্রুগদ্গদ কণ্ঠস্বরের মতো হল
বাষ্পাকুল । ওর মা জানত অরুণা আমার লাইব্রেরি ঘরে পরীক্ষার পড়ায় প্রবৃত্ত । একখানা
বই আনতে গিয়ে দেখি, মেঘাচ্ছন্ন দিনান্তের সজল ছায়ায় জানলার সামনে সে চুপ করে বসে;
তখনো চুল বাঁধে নি, পুবে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার এলোচুলে ।
সুনেত্রাকে কিছু বললেম না । তখনি শৈলেনকে লিখে দিলেম চায়ের নিমন্ত্রণ-চিঠি । পাঠিয়ে
দিলেম আমার মোটরগাড়ি ওদের বাড়িতে । শৈলেন এল, তার অকস্মাৎ আবির্ভাব সুনেত্রার পছন্দ
নয়, সেটা বোঝা কঠিন ছিল না । আমি শৈলেনকে বললেম, “ গণিতে আমার যেটুকু দখল তাতে হাল
আমলের ফিজিক্সের তল পাই নে, তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো ; কোয়ান্টম থিওরিটা যথাসাধ্য
বুঝে নিতে চাই, আমার সেকেলে বিদ্যেসাধ্যি অত্যন্ত বেশি অথর্ব হয়ে পড়েছে ।”
বলা বাহুল্য, বিদ্যাচর্চা বেশিদূর এগোয় নি । আমার নিশ্চিত বিশ্বাস অরুণা তার বাবার
চাতুরি স্পষ্টই ধরেছে আর মনে মনে বলেছে, এমন আদর্শ বাবা অন্য কোনো পরিবারে আজ
পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় নি ।
কোয়ান্টম থিওরির ঠিক শুরুতেই বাজল টেলিফোনের ঘন্টা — ধড়ফড়িয়ে উঠে বললেম, “ জরুরি
কাজের ডাক । তোমরা এক কাজ করো, ততক্ষণ পার্লার টেনিস খেলো, ছুটি পেলেই আবার আসব
ফিরে । ”
টেলিফোনে আওয়াজ এল, “ হ্যালো, এটা কি বারোশো অমুক নম্বর । ”
আমি বললেম, “ না, এখানকার নম্বর সাতশো অমুক । ”
পরক্ষণেই নিচের ঘরে গিয়ে একখানা বাসি খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেম,
অন্ধকার হয়ে এল, দিলেম বাতি জ্বেলে ।
সুনেত্রা এল ঘরে । অত্যন্ত গম্ভীর মুখ । আমি হেসে বললেম, “ মিটিয়রলজিস্ট্ তোমার
মুখ দেখলে ঝড়ের সিগ্ নাল দিত।”
ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে সুনেত্রা বললে, “ কেন তুমি শৈলেনকে অমন করে প্রশ্রয় দাও বারে
বারে । ”
আমি বললেম, “ প্রশ্রয় দেবার লোক অদৃশ্যে আছে ওর অন্তরাত্মায় । ”
“ওদের দেখাশোনাটা কিছুদিন বন্ধ রাখতে পারলে এই ছেলেমানুষিটা কেটে যেত আপনা হতেই । ”
“ছেলেমানুষির কসাইগিরি করতে যাবই বা কেন । দিন যাবে, বয়স বাড়বে, এমন ছেলেমানুষি আর
তো ফিরে পাবে না কোনো কালে।”
“তুমি গ্রহনক্ষত্র মান ' না, আমি মানি । ওরা মিলতে পারে না । ”
“গ্রহনক্ষত্র কোথায় কী ভাবে মিলেছে চোখে পড়ে না, কিন্তু ওরা দুজনে যে মিলেছে অন্তরে
অন্তরে সেটা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্ট করেই । ”
“তুমি বুঝবে না আমার কথা । যখনি আমরা জন্মাই তখনি আমাদের যথার্থ দোসর ঠিক হয়ে থাকে
। মোহের ছলনায় আর-কাউকে যদি স্বীকার করে নিই তবে তাতেই ঘটে অজ্ঞাত অসতীত্ব । নানা
দুঃখে বিপদে তার শাস্তি । ”
“যথার্থ দোসর চিনব কী করে । ”
“নক্ষত্রের স্বহস্তে স্বাক্ষর-করা দলিল আছে । ”
৩
আর লুকোনো চলল না ।
আমার শ্বশুর অজিতকুমার ভট্টাচার্য । বনেদি পণ্ডিত-বংশে তাঁর জন্ম । বাল্যকাল কেটেছে
চতুষ্পাঠীর আবহাওয়ায় । পরে কলকাতায় এসে কলেজে নিয়েছেন এম. এ. ডিগ্রি গণিতে । ফলিত
জ্যোতিষে তাঁর যেমন বিশ্বাস ছিল তেমনি ব্যুৎপত্তি । তাঁর বাবা ছিলেন পাকা নৈয়ায়িক,
ঈশ্বর তাঁর মতে অসিদ্ধ ; আমার শ্বশুরও দেবদেবী কিছুই মানতেন না তার প্রমাণ পেয়েছি ।
তাঁর সমস্ত বেকার বিশ্বাস ভিড় করে এসে পড়েছিল গ্রহনক্ষত্রের উপর, একরকম গোঁড়ামি
বললেই হয় । এই ঘরে জন্মেছে সুনেত্রা ; বাল্যকাল থেকে তার চার দিকে গ্রহনক্ষত্রের
কড়া পাহারা ।
আমি ছিলুম অধ্যাপকের প্রিয় ছাত্র, সুনেত্রাকেও
তার পিতা দিতেন শিক্ষা । পরস্পর মেলবার সুযোগ হয়েছিল বার বার । সুযোগটা যে ব্যর্থ
হয় নি সে খবরটা বেতার বিদ্যুদ্বার্তায় আমার কাছে ব্যক্ত হয়েছে । আমার শাশুড়ির নাম
বিভাবতী । সাবেক কালের আওতার মধ্যে তাঁর জন্ম বটে, কিন্তু স্বামীর সংসর্গে তাঁর মন
ছিল সংস্কারমুক্ত, স্বচ্ছ । স্বামীর সঙ্গে প্রভেদ এই, গ্রহনক্ষত্র তিনি একেবারেই
মানতেন না, মানতেন আপন ইষ্টদেবতাকে । এ নিয়ে স্বামী একদিন ঠাট্টা করাতে বলেছিলেন, “
ভয়ে ভয়ে তুমি পেয়েদাগুলোর কাছে সেলাম ঠুকে বেড়াও, আমি মানি স্বয়ং রাজাকে । ”
স্বামী বললেন, “ ঠকবে । রাজা থাকলেও যা না থাকলেও তা, লাঠি-ঘাড়ে নিশ্চিত আছে
পেয়াদার দল । ”
শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, “ ঠকব সেও ভালো । তাই বলে দেউড়ির দরবারে গিয়ে নাগরা জুতোর
কাছে মাথা হেঁট করতে পারব না । ”
আমার শাশুড়ি আমাকে বড়ো স্নেহ করতেন । তাঁর কাছে
আমার মনের কথা ছিল অবারিত । অবকাশ বুঝে একদিন তাঁকে বললেম, “ মা, তোমার নেই ছেলে
আমার নেই মা । মেয়ে দিয়ে আমাকে দাও তোমার ছেলের জায়গাটি । তোমার সম্মতি পেলে তার
পরে পায়ে ধরব অধ্যাপকের । ”
তিনি বললেন, “ অধ্যাপকের কথা পরে হবে বাছা, আগে তোমার ঠিকুজি এনে দাও আমার কাছে । ”
দিলেম এনে । তিনি বললেন, “ হবার নয় । অধ্যাপকের মত হবে না । অধ্যাপকের মেয়েটিও তার
বাপেরই শিষ্যা । ”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “ মেয়ের মা ? ”
বললেন, “ আমার কথা বোলো না । আমি তোমাকে জানি, আমার মেয়ের মনও জানি, তার বেশি
জানবার জন্যে নক্ষত্রলোকে ছোটবার শখ নেই আমার । ”
আমার মন উঠল বিদ্রোহী হয়ে । বললেম, এমনতরো অবাস্তব বাধা মানাই অন্যায় । কিন্তু, যা
অবাস্তব তার গায়ে ঘা বসে না । তার সঙ্গে লড়াই করব কী দিয়ে ।
এ দিকে মেয়ের সম্বন্ধের কথা আসতে লাগল নানা দিক থেকে । গ্রহতারকার অসম্মতি নেই এমন
প্রস্তাবও ছিল তার মধ্যে। মেয়ে জিদ করে বলে বসল, সে চিরকাল কুমারী থাকবে, বিদ্যার
সাধনাতেই যাবে তার দিন ।
বাপ মানে বুঝলেন না, তাঁর মনে পড়ল লীলাবতীর কথা । মা বুঝলেন, গোপনে জল পড়তে লাগল
তাঁর চোখ দিয়ে । অবশেষে একদিন মা আমার হাতে একখানি কাগজ দিয়ে বললেন, “ সুনেত্রার
ঠিকুজি । এই দেখিয়ে তোমার জন্মপত্রী সংশোধন করিয়ে নিয়ে এসো । আমার মেয়ের অকারণ দুঃখ
সইতে পারব না । ”
পরে কী হল বলতে হবে না । ঠিকুজির অঙ্কজাল থেকে সুনেত্রাকে উদ্ধার করে আনলেম । চোখের
জল মুছতে মুছতে মা বললেন, “পুণ্যকর্ম করেছ, বাছা। ” তার পরে গেছে একুশ বছর কেটে ।
৪
হাওয়ার বেগ বাড়তে চলল, বৃষ্টির বিরাম নেই । সুনেত্রাকে বললেম, “ আলোটা লাগছে চোখে,
নিবিয়ে দিই । ” নিবিয়ে দিলেম ।
বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পের ঝাপসা আভা এল অন্ধকার ঘরে । সোফার উপরে
সুনেত্রাকে বসালেম আমার পাশে। বললেম, “ সুনি, আমাকে তোমার যথার্থ দোসর বলে মান তুমি
? ”
“ এ আবার কী প্রশ্ন হল তোমার । উত্তর দিতে হবে নাকি । ”
“ তোমার গ্রহতারা যদি না মানে ? ”
“ নিশ্চয় মানে, আমি বুঝি জানি নে ? ”
“ এতদিন তো একত্রে কাটল আমাদের, কোনো সংশয় কি কোনোদিন উঠেছে তোমার মনে । ”
“ অমন সব বাজে কথা জিজ্ঞাসা কর যদি রাগ করব । ”
“ সুনি, দুজনে মিলে দুঃখ পেয়েছি অনেকবার । আমাদের প্রথম ছেলেটি মারা গেছে আট-মাসে ।
টাইফয়েডে আমি যখন মরণাপন্ন, বাবার হল মৃত্যু । শেষে দেখি উইল জাল করে দাদা নিয়েছেন
সমস্ত সম্পত্তি । আজ চাকরিই আমার একমাত্র ভরসা । তোমার মায়ের স্নেহ ছিল আমার জীবনের
ধ্রুবতারা । পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পথে নৌকোডুবি হয়ে স্বামীর সঙ্গে মারা গেলেন
মেঘনা নদীর গর্ভে । দেখলেন, বিষয়বুদ্ধিহীন অধ্যাপক ঋণ রেখে গেছেন মোটা অঙ্কের ; সেই
ঋণ স্বীকার করে নিলেম । কেমন করে জানব এই-সমস্ত বিপত্তি ঘটায় নি আমারই দুষ্টগ্রহ ?
আগে থাকতে যদি জানতে আমাকে তো বিয়ে করতে না ? ”
সুনেত্রা কোনো উত্তর না করে আমাকে জড়িয়ে ধরলে ।
আমি বললেম, “ সব দুঃখ-দুর্লক্ষণের চেয়ে ভালোবাসাই যে বড়ো, আমাদের জীবনে তার কী
প্রমাণ হয় নি । ”
“ নিশ্চয়, নিশ্চয় হয়েছে । ”
“ মনে করো, যদি গ্রহের অনুগ্রহে তোমার আগেই আমার মৃত্যু হয়, সেই ক্ষতি কি বেঁচে
থাকতেই আমি পূরণ করতে পারি নি । ”
“ থাক্ থাক্, আর বলতে হবে না । ”
“ সাবিত্রীর কাছে সত্যবানের সঙ্গে একদিনের মিলনও যে চিরবিচ্ছেদের চেয়ে বড়ো ছিল,
তিনি তো ভয় করেন নি মৃত্যুগ্রহকে । ”
চুপ করে রইল সুনেত্রা । আমি বললেম, “ তোমার অরুণা ভালোবেসেছে শৈলেনকে, এইটুকু জানা
যথেষ্ট ; বাকি সমস্তই থাক্ অজানা, কী বল, সুনি । ”
সুনেত্রা কোনো উত্তর করলে না ।
“তোমাকে যখন প্রথম ভালোবেসেছিলুম, বাধা পেয়েছি । আমি সংসারে দ্বিতীয়বার সেই নিষ্ঠুর
দুঃখ আসতে দেব না কোনো গ্রহেরই মন্ত্রণায় । ওদের দুজনের ঠিকুজির অঙ্ক মিলিয়ে সংশয়
ঘটতে দেব না কিছুতেই । ”
ঠিক সেই সময়েই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল । শৈলেন নেমে চলে যাচ্ছে । সুনেত্রা
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বললে, “ কী বাবা শৈলেন। এখুনি তুমি যাচ্ছ না কি। ”
শৈলেন ভয়ে ভয়ে বললে, “ কিছু দেরি হয়েই গেছে, ঘড়ি ছিল না, বুঝতে পারি নি । ”
সুনেত্রা বললে, “ না, কিছু দেরি হয় নি । আজ রাত্রে তোমাকে এখানেই খেয়ে যেতে হবে । ”
একেই তো বলে প্রশ্রয় ।
সেই রাত্রে আমার ঠিকুজি-সংশোধনের সমস্ত বিবরণ সুনেত্রাকে শোনালেম । সে বলে উঠল, “
না বললেই ভালো করতে ।”
“কেন। ”
“এখন থেকে কেবলই ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে । ”
“কিসের ভয় । বৈধব্যযোগের ? ”
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সুনি । তার পরে বললে, “ না, করব না ভয় । আমি যদি তোমাকে ফেলে
আগে চলে যাই তা হলে আমার মৃত্যু হবে দ্বিগুণ মৃত্যু।”
কার্তিক ১৩৪০