ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


একটা আষাঢ়ে গল্প

[এই গল্পটি সাধনা পত্রিকার আষাঢ় ১২৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল]

দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপসেখানে কেবল তাসের সাহেব, তাসের বিবি, টেক্কা এবং গোলামের বাসদুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে
টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ- তাহাদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে
কিন্তু চমৎকার শৃঙ্খলাকাহার কত মূল্য এবং মর্যাদা তাহা বহুকাল হইতে স্থির হইয়া গেছে, তাহার রেখামাত্র ইতস্তত হইবার জো নাই সকলেই যথানির্দিষ্ট মতে আপন আপন কাজ করিয়া যায় বংশাবলিক্রমে কেবল পূর্ববর্তীদিগের উপর দাগা বুলাইয়া চলা
সে যে কী কাজ তাহা বিদেশীর পক্ষে বোঝা শক্তহঠাৎ খেলা বলিয়া ভ্রম হয়কেবল নিয়মে চলাফেরা, নিয়মে যাওয়া-আসা, নিয়মে ওঠাপড়াঅদৃশ্য হস্তে তাহাদিগকে চালনা করিতেছে এবং তাহারা চলিতেছে
তাহাদের মুখে কোনো ভাবের পরিবর্তন নাইচিরকাল একমাত্র ভাব ছাপ মারা রহিয়াছে যেন ফ্যাল্-ফ্যাল্ ছবির মতোমান্ধাতার আমল হইতে মাথার টুপি অবধি পায়ের জুতা পর্যন্ত অবিকল সমভাবে রহিয়াছে
কখনো কাহাকেও চিন্তা করিতে হয় না, বিবেচনা করিতে হয় না; সকলেই মৌন নির্জীবভাবে নিঃশব্দে পদচারণা করিয়া বেড়ায়; পতনের সময় নিঃশব্দে পড়িয়া যায় এবং অবিচলিত মুখশ্রী লইয়া চিৎ হইয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে
কাহারকোনো আশা নাই, অভিলাষ নাই, ভয় নাই, নূতন পথে চলিবার চেষ্টা নাই, হাসি নাই, কান্না নাই, সন্দেহ নাই, দ্বিধা নাইখাঁচার মধ্যে যেমন পাখি ঝট্‌পট্ করে, এই চিত্রিতবৎ মূর্তিগুলির অন্তরে সেরূপ কোনো-একটা জীবন্ত প্রাণীর অশান্ত আক্ষেপের লক্ষণ দেখা যায় না
অথচ এককালে এই খাঁচাগুলির মধ্যে জীবের বসতি ছিল— তখন খাঁচা দুলিত এবং ভিতর হইতে পাখার শব্দ এবং গান শুনা যাইত গভীর অরণ্য এবং বিস্তৃত আকাশের কথা মনে পড়িতএখন কেবল পিঞ্জরে সংকীর্ণতা এবং সুশৃঙ্খল শ্রেণী-বিন্যস্ত লৌহশলাকাগুলাই অনুভব করা যায়— পাখি উড়িয়াছে কি মরিয়াছে কি জীবন্মত হইয়া আছে, তাহা কে বলিতে পারে
আশ্চর্য স্তব্ধতা এবং শান্তিপরিপূর্ণ স্বস্তি এবং সন্তোষ পথে ঘাটে গৃহে সকলই সুসংহত, সুবিহিত— শব্দ নাই, দ্বন্দ্ব নাই, উৎসাহ নাই, আগ্রহ নাই—  কেবল নিত্য-নৈমিত্তিক ক্ষুদ্র কাজ এবং ক্ষুদ্র বিশ্রাম
সমুদ্র অবিশ্রাম একতানশব্দপূর্বক তটের উপর সহস্র ফেনশুভ্র কোমল করতলের আঘাত করিয়া সমস্ত দ্বীপকে নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে— পক্ষীমাতার দুই প্রসারিত নীলপক্ষের মতো আকাশ দিগ্‌দিগন্তের শান্তিরক্ষা করিতেছেঅতিদূর পরপারে গাঢ় নীল রেখার মতো বিদেশের আভাস দেখা যায়— সেখান হইতে রাগ-দ্বেষের দ্বন্দ্বকোলাহল সমুদ্র পার হইয়া আসিতে পারে না
সেই পরপারে, সেই বিদেশে এক দুয়ারানীর ছেলে এক রাজপুত্র বাস করেসে তাহার নির্বাসিত মাতার সহিত সমুদ্রতীরে আপনমনে বাল্যকাল যাপন করিতে থাকে

সে একা বসিয়া বসিয়া মনে মনে এক অত্যন্ত বৃহৎ অভিলাষের জাল বুনিতেছেসেই জাল দিগ্‌দিগন্তরে নিক্ষেপ করিয়া কল্পনায় বিশ্বজগতের নব নব রহস্যরাশি সংগ্রহ করিয়া আপনার দ্বারের কাছে টানিয়া তুলিতেছে তাহার অশান্ত চিত্ত সমুদ্রের তীরে আকাশের সীমায় ঐ দিগন্তরোধী নীল গিরিমালার পরপারে সর্বদা সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছে— খুঁজিতে চায় কোথায় পক্ষীরাজ ঘোড়া, সাপের মাথার মানিক, পারিজাত পুষ্প, সোনার কাঠি, রুপার কাঠি পাওয়া যায়, কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে দুর্গম দৈত্যভবনে স্বপ্নসম্ভবা অলোকসুন্দরী রাজকুমারী ঘুমাইয়া রহিয়াছেন

রাজপুত্র পাঠশালে পড়িতে যায়, সেখানে পাঠান্তে সদাগরের পুত্রের কাছে দেশ-বিদেশের কথা এবং কোটালের পুত্রের কাছে তাল-বেতালের কাহিনী শোনে

ঝুপ্‌ ঝুপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়ে, মেঘে অন্ধকার হইয়া থাকে— গৃহদ্বারে মায়ের কাছে বসিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিয়া রাজপুত্র বলে, মা, একটা খুব দূর দেশের গল্প বলোমা অনেকক্ষণ ধরিয়া তাঁহার বাল্যশ্রুত এক অপূর্ব দেশের অপূর্ব গল্প বলিতেন বৃষ্টির ঝর্‌-ঝর্ শব্দের মধ্যে সেই গল্প শুনিয়া রাজপুত্রের হৃদয় উদাস হইয়া যাইত

একদিন সদাগরের পুত্র আসিয়া রাজপুত্রকে কহিল, সাঙাত, পড়াশুনা তো সাঙ্গ করিয়াছি, এখন একবার দেশভ্রমণে বাহির হইব তাই বিদায় লইতে আসিলাম
রাজার পুত্র কহিল, আমিও তোমার সঙ্গে যাইবকোটালের পুত্র কহিল, আমাকে কি একা ফেলিয়া যাইবে; আমিও তোমাদের সঙ্গী
রাজপুত্র দুঃখিনী মাকে গিয়া বলিল, মা, আমি ভ্রমণে বাহির হইতেছি— এবার তোমার দুঃখমোচনের উপায় করিয়া আসিব
তিন বন্ধুতে বাহির হইয়া পড়িল 

সমুদ্রে সদাগরের দ্বাদশতরী প্রস্তুত ছিল তিন বন্ধু চড়িয়া বসিলদক্ষিণের বাতাসে পাল ভরিয়া উঠিল— নৌকাগুলা রাজপুত্রের হৃদয়বাসনার মতো ছুটিয়া চলিল
শঙ্খদ্বীপে গিয়া একনৌকা শঙ্খ, চন্দনদ্বীপে গিয়া একনৌকা চন্দন, প্রবালদ্বীপে গিয়া একনৌকা প্রবাল বোঝাই হইল
তাহার পর আর চারি বৎসরে গজদন্ত মৃগনাভি লবঙ্গ জায়ফলে যখন আরচারিটি নৌকা পূর্ণ হইল তখন সহসা একটা বিপর্যয় ঝড় আসিল
সব-কটা নৌকা ডুবিল, কেবল একটি নৌকা তিন বন্ধুকে একটা দ্বীপে আছাড়িয়া ফেলিয়া খান্‌ খান্ হইয়া গেল
এই দ্বীপে তাসের টেক্কা, তাসের সাহেব, তাসের বিবি, তাসের গোলাম যথানিয়মে বাস করে এবং দহলা-নহলাগুলাও তাহাদের পদানুবর্তী হইয়া যথানিয়মে কাল কাটায়

তাসের রাজ্যে এতদিন কোনো উপদ্রব ছিল নাএই প্রথম গোলযোগের সূত্রপাত হইল
এতদিন পরে প্রথম এই একটা তর্ক উঠিল— এই যে তিনটে লোক হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্র হইতে উঠিয়া আসিল
, ইহাদিগকে কোন্ শ্রেণীতে ফেলা যাইবে
প্রথমত, ইহারা কোন্ জাতি— টেক্কা, সাহেব, গোলাম, না দহলা-নহলা ?
দ্বিতীয়ত, ইহারা কোন্ গোত্র— ইস্কাবন, চিড়েতন, হরতন, অথবা রুহিতন ?
এ-সমস্ত স্থির না হইলে ইহাদের সহিত কোনোরূপ ব্যবহার করাই কঠিনইহারা কাহার অন্ন খাইবে, কাহার সহিত বাস করিবে, ইহাদের মধ্যে অধিকারভেদে কেই বা বায়ুকোণে, কেই বা নৈর্ঋতকোণে, কেই বা ঈশানকোণে মাথা রাখিয়া এবং কেই বা দণ্ডায়মান হইয়া নিদ্রা দিবে তাহার কিছুই স্থির হয় না
এ রাজ্যে এত বড়ো বিষম দুশ্চিন্তার কারণ ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটে নাই

কিন্তু ক্ষুধাকাতর বিদেশী বন্ধু তিনটির এ-সকল গুরুতর বিষয়ে তিলমাত্র চিন্তা নাইতাহারা কোনো গতিকে আহার পাইলে বাঁচে যখন দেখিল তাহাদের আহারাদি দিতে সকলে ইতস্তত করিতে লাগিল এবং বিধান খুঁজিবার জন্য টেক্কারা বিরাট সভা আহ্বান করিল, তখন তাহারা যে যেখানে যে-খাদ্য পাইল খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল
এই ব্যবহারে দুরি তিরি পর্যন্ত অবাকতিরি কহিল, ভাই দুরি, ইহাদের বাচবিচার কিছুই নাইদুরি কহিল, ভাই তিরি, বেশ দেখিতেছি, ইহারা আমাদের অপেক্ষাও নীচজাতীয়

আহারাদি করিয়া ঠাণ্ডা হইয়া তিন বন্ধু দেখিল, এখানকার মানুষগুলা কিছু নূতন রকমের যেন জগতে ইহাদের কোথাও মূল নাইযেন ইহাদের টিকি ধরিয়া কে উৎপাটন করিয়া লইয়াছে, ইহারা একপ্রকার হতবুদ্ধিভাবে সংসারের স্পর্শ পরিত্যাগ করিয়া দুলিয়া দুলিয়া বেড়াইতেছে যাহা-কিছু করিতেছে তাহা যেন আর-একজন কে করাইতেছেঠিক যেন পুৎলাবজির দোদুল্যমান পুতুলগুলির মতোতাই কাহারও মুখে ভাব নাই, ভাবনা নাই, সকলেই নিরতিশয় গম্ভীর চালে যথানিয়মে চলাফেরা করিতেছেঅথচ সবসুদ্ধ ভারি অদ্ভুত দেখাইতেছে

চারি দিকে এই জীবন্ত নির্জীবতার পরমগম্ভীর রকমসকম দেখিয়া রাজপুত্র আকাশে মুখ তুলিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলএই আন্তরিক কৌতুকের উচ্চ হাস্যধ্বনি তাসরাজ্যের কলরবহীন রাজপথে ভারি বিচিত্র শুনাইলএখানে সকলই এমনি একান্ত যথাযথ, এমনি পরিপাটি, এমনি প্রাচীন, এমনি সুগম্ভীর যে কৌতুক আপনার অকস্মাৎ-উচ্ছ্বসিত উচ্ছৃঙ্খল শব্দে আপনি চকিত হইয়া ্লান হইয়া নির্বাপিত হইয়া গেল- চারি দিকের লোকপ্রবাহ পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ স্তব্ধ গম্ভীর অনুভূত হইল
কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্র ব্যাকুল হইয়া রাজপুত্রকে কহিল, ভাই সাঙাত, এই নিরানন্দ ভূমিতে আর একদণ্ড নয় এখানে আর দুই দিন থাকিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে হইবে জীবিত আছি কি না
রাজপুত্র কহিল, না ভাই, আমার কৌতূহল হইতেছেইহারা মানুষের মতো দেখিতে— ইহাদের মধ্যে এক ফোঁটা জীবন্ত পদার্থ আছে কি না একবার নাড়া দিয়া দেখিতে হইবে

এমনি তো কিছুকাল যায়কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয় নাযেখানে যখন ওঠা, বসা, মুখ ফেরানো, উপুড় হওয়া, চিৎ হওয়া, মাথা নাড়া, ডিগ্‌বাজি খাওয়া উচিত, ইহারা তাহার কিছুই করে না  বরং সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে এবং হাসেএই-সমস্ত যথাবিহিত অশেষ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে একটি দিগ্‌গজ গাম্ভীর্য আছে ইহারা তদ্দ্বারা অভিভূত হয় না
একদিন টেক্কা সাহেব গোলাম আসিয়া রাজপুত্র কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্রকে হাঁড়ির মতো গলা করিয়া অবিচলিত গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা বিধানমতে চলিতেছ না কেন
তিন বন্ধু উত্তর করিল, আমাদের ইচ্ছা
হাঁড়ির মতো গলা করিয়া তাসরাজ্যের তিন অধিনায়ক স্বপ্নাভিভূতের মতো বলিল, ইচ্ছা ? সে বেটা কে
ইচ্ছা কী সেদিন বুঝিল না কিন্তু ক্রমে ক্রমে বুঝিলপ্রতিদিন দেখিতে লাগিল এমন করিয়া না চলিয়া অমন করিয়া চলাও সম্ভব, যেমন এদিক আছে তেমনি ওদিকও আছে— বিদেশ হইতে তিনটে জীবন্ত দৃষ্টান্ত আসিয়া জানাইয়া দিল বিধানের মধ্যেই মানবের সমস্ত স্বাধীনতার সীমা নহেএমনি করিয়া তাহারা ইচ্ছানামক একটা রাজশক্তির প্রভাব অস্পষ্টভাবে অনুভব করিতে লাগিল

ঐ সেটি যেমনি অনুভব করা অমনি তাসরাজ্যের আগাগোড়া অল্প অল্প করিয়া আন্দোলিত হইতে আরম্ভ হইল— গতনিদ্র প্রকাণ্ড অজগরসর্পের অনেকগুলা কুণ্ডলীর মধ্যে জাগরণ যেমন অত্যন্ত মন্দগতিতে সঞ্চলন করিতে থাকে সেইরূপ 

নির্বিকারমূর্তি বিবি এতদিন কাহারদিকে দৃষ্টিপাত করে নাই, নির্বাক্ নিরুদ্‌বিগ্নভাবে আপনার কাজ করিয়া গেছেএখন একদিন বসন্তের অপরাহ্নে ইহাদের মধ্যে একজন চকিতের মতো ঘনকৃষ্ণ পক্ষ র্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করিয়া রাজপুত্রের দিকে মুগ্ধনত্রেকটাক্ষপাত করিল রাজপুত্র চমকিয়া উঠিয়া কহিল, এ কী সর্বনাশ! আমি জানিতাম, ইহারা এক-একটা মূর্তিবৎ— তাহা তো নহে, দেখিতেছি এ যে নারী

কোটালের পুত্র ও সদাগরের পুত্রকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া রাজকুমার কহিল, ভাই, ইহার মধ্যে বড়ো মাধুর্য আছেতাহার সেই নবভাবোদ্দীপ্ত কৃষ্ণনেত্রের প্রথম কটাক্ষপাতে আমার মনে হইল যেন আমি এক নূতনসৃষ্ট জগতের প্রথম উষার প্রথম উদয় দেখিতে পাইলামএতদিন যে ধৈর্য ধরিয়া অবস্থান করিতেছি আজ তাহা সার্থক হইল
দুই বন্ধু পরম কৌতূহলের সহিত সহাস্যে কহিল, সত্য নাকি সাঙাত

সেই হতভাগিনী হরতনের বিবিটি আজ হইতে প্রতিদিন নিয়ম ভুলিতে লাগিলতাহার যখন যেখানে হাজির হওয়া বিধান, মুহুর্মুহু তাহার ব্যতিক্রম হইতে আরম্ভ হইলমনে করো, যখন তাহাকে গোলামের পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইতে হইবে তখন সে হঠাৎ রাজপুত্রের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ায় গোলাম অবিচলিত ভাবে সুগম্ভীর কণ্ঠে বলে, বিবি, তোমার ভুল হইলশুনিয়া হরতনের বিবির স্বভাবত-রক্তকপোল অধিকতর রক্তবর্ণ হইয়া উঠে, তাহার নির্নিমেষ প্রশান্ত দৃষ্টি নত হইয়া যায়রাজপুত্র উত্তর দেয়, কিছু ভুল হয় নাই, আজ হইতে আমিই গোলাম

নবপ্রস্ফুটিত রমণীহৃদয় হইতে এ কী অভূতপূর্ব শোভা, এ কী অভাবনীয় লাবণ্য বিস্ফুরিত হইতে লাগিল তাহার গতিতে এ কী সুমধুর চাঞ্চল্য, তাহার দৃষ্টিপাতে এ কী হৃদয়ের হিল্লো, তাহার সমস্ত অস্তিত্ব হইতে এ কী একটি সুগন্ধি আরতি-উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে

এই নব অপরাধিনীর ভ্রমসংশোধনে সাতিশয় মনোযোগ করিতে গিয়া আজকাল সকলেরই ভ্রম হইতে লাগিলটেক্কা আপনার চিরন্তন মর্যাদারক্ষার কথা বিস্মৃত হইল, সাহেবে গোলামে আর প্রভেদ থাকে না, দহলা-নহলাগুলা পর্যন্ত কেমন হইয়া গেল

এই পুরাতন দ্বীপে বসন্তের কোকিল অনেকবার ডাকিয়াছে কিন্তু সেইবার যেমন ডাকিল এমন আর-কখনো ডাকে নাইসমুদ্র চিরদিন একতান কলধ্বনিতে গান করিয়া আসিতেছে, কিন্তু এতদিন সে সনাতন বিধানের অলঙ্ঘ্য মহিমা এক সুরে ঘোষণা করিয়া আসিয়াছে— আজ সহসা দক্ষিণবায়ুচঞ্চল বিশ্বব্যাপী দুরন্ত যৌবন-তরঙ্গরাশির মতো আলোতে ছায়াতে ভঙ্গিতে ভাষাতে আপনার অগাধ আকুলতা ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল

এই কি সেই টেক্কা, সেই সাহেব, সেই গোলামকোথায় গেল সেই পরিতুষ্ট পরিপুষ্ট সুগোল মুখচ্ছবিকেহ বা আকাশের দিকে চায়, কেহ বা সমুদ্রের ধারে বসিয়া থাকে, কাহারবা রাত্রে নিদ্রা হয় না, কাহারবা আহারে মন নাই
মুখে কাহারঈর্ষা, কাহারঅনুরাগ, কাহারব্যাকুলতা, কাহারসংশয়কোথাও হাসি, কোথাও রোদন, কোথাও সঙ্গীতসকলেরই নিজের নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি দৃষ্টি পড়িয়াছেসকলেই আপনার সহিত অন্যের তুলনা করিতেছে
টেক্কা ভাবিতেছে, সাহেব ছোকরাটাকে দেখিতে নেহাত মন্দ না হউক কিন্তু উহার শ্রী নাই- আমার চালচলনের মধ্যে এমন একটা মাহাত্ম্য আছে যে, কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টি আমার দিকে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না
সাহেব ভাবিতেছে, টেক্কা সর্বদা ভারি টক্‌টক্ রিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বেড়াইতেছে, মনে করিতেছে, উহাকে দেখিয়া বিবিগুলা বুক ফাটিয়া মারা গেল বলিয়া ঈষৎ বক্র হাসিয়া দর্পণে মুখ দেখিতেছে

দেশে যতগুলি বিবি ছিলেন সকলেই প্রাণপণে সাজসজ্জা করেন আর পরস্পরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন, আ মরিয়া যাইগর্বিণীর এত সাজের-ধুম কিসের জন্য গো বাপুউহার রকমসকম দেখিয়া লজ্জা করে! বলিয়া দ্বিগুণ প্রযত্নে হাবভাব বিস্তার করিতে থাকেন
আবার কোথাও দুই সখায় কোথাও দুই সখীতে গলা ধরিয়া নিভৃতে বসিয়া গোপন কথাবার্তা হইতে থাকেকখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো রাগ করে, কখনো মান-অভিমান চলে, কখনো সাধাসাধি হয়

যুবকগুলা পথের ধারে বনের ছায়ায় তরুমূলে পৃষ্ঠ রাখিয়া, শুষ্কপত্ররাশির উপর পা ছড়াইয়া অলসভাবে বসিয়া থাকেবালা সুনীল বসন পরিয়া সেই ছায়াপথ দিয়া আপনমনে চলিতে চলিতে সেইখানে আসিয়া মুখ নত করিয়া চোখ ফিরাইয়া লয়, যেন কাহাকেও দেখিতে পায় নাই, যেন কাহাকেও দেখা দিতে আসে নাই এমনি ভাব করিয়া চলিয়া যায়

তাই দেখিয়া কোনো কোনো খপা যুবক দুঃসাহসে ভর করিয়া তাড়াতাড়ি কাছে অগ্রসর হয়, কিন্তু মনের মতো একটাও কথা জোগায় না, অপ্রতিভ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে, অনুকূল অবসর চলিয়া যায় এবং রমণীও অতীত মুহূর্তের মতো ক্রমে ক্রমে দূরে বিলীন হইয়া যায়

মাথার উপরে পাখি ডাকিতে থাকে, বাতাস অঞ্চল ও অলক উড়াইয়া হূহকরিয়া বহিয়া যায়, তরুপল্লঝর্‌ঝর্ ম্‌মর্ করে এবং সমুদ্রের অবিশ্রাম উচ্ছ্বসিত ধ্বনি হৃদয়ের অব্যক্ত বাসনাকে দ্বিগুণ দোদুল্যমান করিয়া তোলে
একটা বসন্তে তিনটে বিদেশী যুবক আসিয়া মরা গাঙে এমনি একটা ভরা তুফান তুলিয়া দিল 

রাজপুত্র দেখিলেন, জোয়ারভাঁটার মাঝখানে সমস্ত দেশটা থম্‌থকরিতেছে— কথা নাই, কেবল মুখ-চাওয়াচাওয়ি; কেবল এক পা এগোনো, দুই পা পিছনো; কেবল আপনার মনের বাসনা স্তূপাকার করিয়া বালির ঘর গড়া এবং বালির ঘর ভাঙাসকলেই যেন ঘরের কোণে বসিয়া আপনার অগ্নিতে আপনাকে আহুতি দিতেছে, এবং প্রতিদিন কৃশ ও বাক্যহীন হইয়া যাইতেছে কেবল চোখ-দুটা জ্বলিতেছে, এবং অন্তর্নিহিত বাণীর আন্দোলনে ওষ্ঠাধর বায়ুকম্পিত পল্লবের মতো স্পন্দিত হইতেছে

রাজপুত্র সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, বাঁশি আনো, রীভেরী বাজাও, সকলে আনন্দধ্বনি করো, হরতনের বিবি স্বয়ম্বরা হইবেন
তৎক্ষণাৎ দহলা-নহলা বাঁশিতে ফুঁ দিতে লাগিল, দুরি তিরি তরীভেরী লইয়া পড়িল হঠাৎ এই তুমুল আনন্দতরঙ্গে সেই কানাকানি চাওয়াচাওয়ি ভাঙিয়া গেল
উৎসবে নরনারী একত্র মিলিত হইয়া কত কথা, কত হাসি, কত পরিহাসকত রহস্যচ্ছলে মনের কথা বলা, কত ছল করিয়া অবিশ্বাস দেখানো, কত উচ্চহাস্যে তচ্ছ আলাপ ঘন অরণ্যে বাতাস উঠিলে যেমন শাখায় শাখায় পাতায় পাতায় লতায় বৃক্ষে নানা ভঙ্গিতে হেলাদোলা মেলামেলি হইতে থাকে, ইহাদের মধ্যে তেমনি হইতে লাগিল

এমনি কলরব আনন্দোৎসবের মধ্যে বাঁশিতে সকাল হইতে বড়ো মধুর স্বরে সাহানা বাজিতে লাগিলআনন্দের মধ্যে গভীরতা, মিলনের মধ্যে ব্যাকুলতা, বিশ্বদৃশ্যের মধ্যে সৌন্দর্য, হৃদয়ে হৃদয়ে প্রীতির বেদনা সঞ্চার করিল যাহারা ভালো করিয়া ভালোবাসে নাই তাহারা ভালোবাসিল, যাহারা ভালোবাসিয়াছিল তাহারা আনন্দে উদাস হইয়া গেল

হরতনের বিবি রাঙা বসন পরিয়া সমস্ত দিন একটা গোপন ছায়াকুঞ্জে বসিয়া ছিলতাহার কানেও দূর হইতে সাহানার তান প্রবেশ করিতেছিল এবং তাহার দুটি চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিয়াছিল; হঠাৎ এক সময়ে চক্ষু মেলিয়া দেখিল, সম্মুখে রাজপুত্র বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে; সে অমনি কম্পিতদেহে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ভূমিতে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িল

রাজপুত্র সমস্ত দিন একাকী সমুদ্রতীরে পদচারণা করিতে করিতে সেই সন্ত্রস্ত নেত্রক্ষেপ এবং সলজ্জ লুণ্ঠন মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন

রাত্রে শতসহস্র দীপের আলোকে, মালার সুগন্ধে, বাঁশির সঙ্গীতে, অলংকৃত সুসজ্জিত সহাস্য শ্রেণীবদ্ধ যুবকদের সভায় একটি বালিকা ধীরে ধীরে কম্পিত চরণে মালা হাতে করিয়া রাজপুত্রের সম্মুখে আসিয়া নতশিরে দাঁড়াইলঅভিলষিত কণ্ঠে মালাও উঠিল না, অভিলষিত মুখে চোখও তুলিতে পারিল নারাজপুত্র তখন আপনি শির নত করিলেন এবং মাল্য স্খলিত হইয়া তাঁহার কণ্ঠে পড়িয়া গেলচিত্রবৎ নিস্তব্ধ সভা সহসা আনন্দোচ্ছ্বাসে আলোড়িত হইয়া উঠিল

সকলে বরকন্যাকে সমাদর করিয়া সিংহাসনে লইয়া বসাইলরাজপুত্রকে সকলে মিলিয়া রাজ্যে অভিষেক করিল

১০

সমুদ্রপারের দুঃখিনী দুয়ারানী সোনার তরীতে চড়িয়া পুত্রের নবরাজ্যে আগমন করিলেন
ছবির দল হঠাৎ মানুষ হইয়া উঠিয়াছেএখন আর পূর্বের মতো সেই অবিচ্ছিন্ন শান্তি এবং অপরিবর্তনীয় গাম্ভীর্য নাইসংসারপ্রবাহ আপনার সুখদুঃখ রাগদ্বেষ বিপদসম্পদ লইয়া এই নবীন রাজার নবরাজ্যকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিলএখন কেহ ভালো, কেহ মন্দ, কাহারআনন্দ, কাহারবিষাদ—এখন সকলে মানুষএখন সকলে অলঙ্ঘ্য বিধানমতে নিরীহ না হইয়া নিজের ইচ্ছামতে সাধু এবং অসাধু

আষাঢ়  ১২৯৯