ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মধ্যবর্তিনী
[সাধনা পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩০০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল]

প্রথম পরিচ্ছেদ

নিবারণের সংসার নিতান্তই সচরাচর রকমের, তাহাতে কাব্যরসের কোনো নামগন্ধ ছিল নাজীবনে উক্ত রসের সে কোনো আবশ্যক আছে, এমন কথা তাহার মনে কখনো উদয় হয় নাইযেমন পরিচিত পুরাতন চটি-জোড়াটার মধ্যে পা দুটো দিব্য নিশ্চিন্তভাবে প্রবেশ করে, এই পুরাতন পৃথিবীটার মধ্যে নিবারণ সেইরূপ আপনার চিরাভ্যস্ত স্থানটি অধিকার করিয়া থাকে, সে সম্বন্ধে ভ্রমেও কোনোরূপ চিন্তা তর্ক বা তত্ত্বালোচনা করে না

নিবারণ প্রাতঃকালে উঠিয়া গলির ধারে গৃহদ্বারে খোলা গায়ে বসিয়া অত্যন্ত নিরুদ্‌বিগ্নভাবে হুঁকাটি লইয়া তামাক খাইতে থাকেপথ দিয়া লোকজন যাতায়াত করে, গাড়িঘোড়া চলে, বৈষ্ণব-ভিখারী গান গাহে, পুরাতন বোতল-সংগ্রহকারী হাঁকিয়া চলিয়া যায়; এই-সমস্ত চঞ্চল দৃশ্য মনকে লঘুভাবে ব্যাপৃত রাখে এবং যেদিন কাঁচা আম অথবা তপসি-মাছওয়ালা আসে, সেদিন অনেক দরদাম করিয়া কিঞ্চিৎ বিশেষরূপ রন্ধনের আয়োজন হয় তাহার পর যথাসময়ে তেল মাখিয়া স্নান করিয়া আহারান্তে দড়িতে ঝুলানো চাপকানটি পরিয়া এক ছিলিম তামাক পানের সহিত নিঃশেষপূর্বক আর-একটি পান মুখে পুরিয়া, আপিসে যাত্রা করেআপিস হইতে ফিরিয়া আসিয়া সন্ধ্যাবেলাটা প্রতিবেশী রামলোচন ঘোষের বাড়িতে প্রশান্ত গম্ভীর ভাবে সন্ধ্যাযাপন করিয়া আহারান্তে রাত্রে শয়নগৃহে স্ত্রী হরসুন্দরীর সহিত সাক্ষাৎ হয়

সেখানে মিত্রদের ছেলের বিবাহে আইবড়-ভাত পাঠানো, নবনিযুক্ত ঝির অবাধ্যতা, ছেঁচকিবিশেষে ফোঁড়নবিশেষের উপযোগিতা সম্বন্ধে যে-সমস্ত সংক্ষিপ্ত সমালোচনা চলে তাহা এপর্যন্ত কোনো কবি ছন্দোবদ্ধ করেন নাই, এবং সেজন্য নিবারণের মনে কখনো ক্ষোভের উদয় হয় নাই

ইতিমধ্যে ফাল্গুন মাসে হরসুন্দরীর সংকট পীড়া উপস্থিত হইলজ্বর আর কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না ডাক্তার যতই কুইনাইন দেয়, বাধাপ্রাপ্ত প্রবল স্রোতের ন্যায় জ্বরও তত ঊর্ধ্ব চড়িতে থাকেএমনি বিশ দিন, বাইশ দিন, চল্লিশ দিন পর্যন্ত ব্যাধি চলিল

নিবারণের আপিস বন্ধ; রামলোচনের বৈকালিক সভায় বহুকাল আর সে যায় না; কী যে করে তাহার ঠিক নাইএকবার শয়নগৃহে গিয়া রোগীর অবস্থা জানিয়া আসে, একবার বাহিরের বারান্দায় বসিয়া চিন্তিত মুখে তামাক টানিতে থাকে দুইবেলা ডাক্তার-বৈদ্য পরিবর্তন করে এবং যে যাহা বলে সেই সেই ঔষধ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চাহে

ভালোবাসার এইরূপ অব্যবস্থিত শুশ্রূষা সত্ত্বেও চল্লিশ দিনে হরসুন্দরী ব্যাধিমুক্ত হইলকিন্তু এমনি দুর্বল এবং শীর্ণ হইয়া গেল যে, শরীরটি যেন বহুদূর হইতে অতি ক্ষীণস্বরে ‘আছি’ বলিয়া সাড়া দিতেছে মাত্র

তখন বসন্তকালে দক্ষিণের হাওয়া দিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং উষ্ণ নিশীথের চন্দ্রালোকও সীমন্তিনীদের উন্মুক্ত শয়নকক্ষে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছে

হরসুন্দরীর ঘরের নীচেই প্রতিবেশীদের খিড়কির বাগানসেটা যে বিশেষ কিছু সুদৃশ্য রমণীয় স্থান তাহা বলিতে পারি নাএক সময় কে একজন শখ করিয়া গোটাকতক ক্রোটন রোপণ করিয়াছিল, তার পরে আর সেদিকে বড়ো একটা দৃকপাত করে নাইশুষ্ক ডালের মাচার উপর কুষ্মাণ্ডলতা উঠিয়াছে; বৃদ্ধ কুলগাছের তলায় বিষম জঙ্গল; রান্নাঘরের পাশে প্রাচীর ভাঙিয়া কতকগুলো ইট জড়ো হইয়া আছে এবং তাহারই সহিত দগ্ধাবশিষ্ট পাথুরে কয়লা এবং ছাই দিন দিন রাশীকৃত হইয়া উঠিতেছে

কিন্তু বাতায়নতলে শয়ন করিয়া এই বাগানের দিকে চাহিয়া হরসুন্দরী প্রতিমুহুর্তে যে একটি আনন্দরস পান করিতে লাগিল, তাহার অকিঞ্চিৎকর জীবনে এমন সে আর কখনো করে নাইগ্রীষ্মকালে স্রোতোবেগ মন্দ হইয়া ক্ষুদ্র গ্রাম্যনদীটি যখন বালুশয্যার উপরে শীর্ণ হইয়া আসে তখন সে যেমন অত্যন্ত স্বচ্ছতা লাভ করে; তখন যেমন প্রভাতের সূর্যালোক তাহার তলদেশ পর্যন্ত কম্পিত হইতে থাকে, বায়ুস্পর্শ তাহার সর্বাঙ্গ পুলকিত করিয়া তোলে, এবং আকাশের তারা তাহার স্ফটিকদর্পণের উপর সুখস্মৃতির ন্যায় অতি সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়, তেমনি হরসুন্দরীর ক্ষীণ জীবনতন্তুর উপর আনন্দময়ী প্রকৃতির প্রত্যেক অঙ্গুলি যেন স্পর্শ করিতে লাগিল এবং অন্তরের মধ্যে যে একটি সংগীত উঠিতে লাগিল তাহার ঠিক ভাবটি সে সস্পূর্ণ বুঝিতে পারিল না

এমন সময় তাহার স্বামী যখন পাশে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিত ‘কেমন আছ’, তখন তাহার চোখে যেন জল উছলিয়া উঠিতরোগশীর্ণ মুখে তাহার চোখ দুটি অত্যন্ত বড়ো দেখায়, সেই বড়ো বড়ো প্রেমার্দ্র সকৃতজ্ঞ চোখ স্বামীর মুখের দিকে তুলিয়া শীর্ণহস্তে স্বামীর হস্ত ধরিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিত, স্বামীর অন্তরেও যেন কোথা হইতে একটা নূতন অপরিচিত আনন্দরশ্মি প্রবেশলাভ করিত

এইভাবে কিছুদিন যায়একদিন রাত্রে ভাঙা প্রাচীরের উপরিবর্তী খর্ব অশথগাছের কম্পমান শাখান্তরাল হইতে একখানি বৃহৎ চাঁদ উঠিতেছে এবং সন্ধ্যাবেলাকার গুমট ভাঙিয়া হঠাৎ একটা নিশাচর বাতাস জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, এমন সময় নিবারণের চুলের মধ্যে অঙ্গুলি বুলাইতে বুলাইতে হরসুন্দরী কহিল, “আমাদের তো ছেলেপুলে কিছুই হইল না, তুমি আর-একটি বিবাহ করো

হরসুন্দরী কিছুদিন হইতে এই কথা ভাবিতেছিলমনে যখন একটা প্রবল আনন্দ, একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে আমি সব করিতে পারিতখন হঠাৎ একটা আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবতী হইয়া উঠেস্রোতের উচ্ছ্বাস যেমন কঠিন তটের উপর আপনাকে সবেগে মূর্ছিত করে, তেমনি প্রেমের আবেগ, আনন্দের উচ্ছ্বাস একটা মহৎ ত্যাগ একটা বৃহৎ দুঃখের উপর আপনাকে যেন নিক্ষেপ করিতে চাহে

সেইরূপ অবস্থায় অত্যন্ত পুলকিত চিত্তে একদিন হরসুন্দরী স্থির করিল, আমার স্বামীর জন্য আমি খুব বড়ো একটা কিছু করিবকিন্তু হায়, যতখানি সাধ ততখানি সাধ্য কাহার আছেহাতের কাছে কী আছে, কী দেওয়া যায় ঐশ্বর্য নাই, বুদ্ধি নাই, ক্ষমতা নাই, শুধু একটা প্রাণ আছে, সেটাও যদি কোথাও দিবার থাকে এখনই দিয়া ফেলি, কিন্তু তাহারই বা মূল্য কী

আর, স্বামীকে যদি দুগ্ধফেনের মতো শুভ্র, নবনীর মতো কোমল, শিশুকন্দর্পের মতো সুন্দর একটি স্নেহের পুত্তলি সন্তান দিতে পারিতাম! কিন্তু প্রাণপণে ইচ্ছা করিয়া মরিয়া গেলেও তো সে হইবে নাতখন মনে হইল,স্বামীর একটি বিবাহ দিতে হইবেভাবিল, স্ত্রীরা ইহাতে এত কাতর হয় কেন, এ কাজ তো কিছুই কঠিন নহেস্বামীকে যে ভালোবাসে, সপত্নীকে ভালোবাসা তাহার পক্ষে কী এমন অসাধ্যমনে করিয়া বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল

প্রস্তাবটা প্রথম যখন শুনিল, নিবারণ হাসিয়া উড়াইয়া দিল, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বারও কর্ণপাত করিল নাস্বামীর এই অসম্মতি, এই অনিচ্ছা দেখিয়া হরসুন্দরীর বিশ্বাস এবং সুখ যতই বাড়িয়া উঠিল তাহার প্রতিজ্ঞাও ততই দৃঢ় হইতে লাগিল

এদিকে নিবারণ যত বারংবার এই অনুরোধ শুনিল, ততই ইহার অসম্ভাব্যতা তাহার মন হইতে দূর হইল এবং গৃহদ্বারে বসিয়া তামাক খাইতে খাইতে সন্তানপরিবৃত গৃহের সুখময় চিত্র তাহার মনে উজ্জ্বল হইয়া উইতে লাগিল

একদিন নিজেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া কহিল, “বুড়াবয়সে একটি কচি খুকিকে বিবাহ করিয়া আমি মানুষ করিতে পারিব না

হরসুন্দরী কহিল, “সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে নামানুষ করিবার ভার আমার উপর রহিল” বলিতে বলিতে এই সন্তানহীনা রমণীর মনে একটি কিশোর-বয়স্কা, সুকুমারী, লজ্জাশীলা, মাতৃক্রোড় হইতে সদ্যোবিচ্যুতা নববধূর মুখচ্ছবি উদয় হইল এবং হৃদয় স্নেহে বিগলিত হইয়া গেল

নিবারণ কহিল, “আমার আপিস আছে, কাজ আছে, তুমি আছ, কচি মেয়ের আবদার শুনিবার অবসর আমি পাইব না

হরসুন্দরী বারবার করিয়া কহিল, তাহার জন্য কিছুমাত্র সময় নষ্ট করিতে হইবে নাএবং অবশেষে পরিহাস করিয়া কহিল, “আচ্ছা গো, তখন দেখিব কোথায় বা তোমার কাজ থাকে, কোথায় বা আমি থাকি, আর কোথায় বা তুমি থাক

নিবারণ সে কথার উত্তরমাত্র দেওয়া আবশ্যক মনে করিল না, শাস্তির স্বরূপ হরসুন্দরীর কপোলে তর্জনী আঘাত করিলএই তো গেল ভুমিকা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

একটি নোলকপরা অশ্রুভরা ছোটোখাটো মেয়ের সহিত নিবারণের বিবাহ হইল, তাহার নাম শৈলবালা

নিবারণ ভাবিল, নামটি বড়ো মিষ্ট এবং মুখখানিও বেশ ঢলোঢলোতাহার ভাবখানা, তাহার চেহারাখানি, তাহার চলাফেরা একটু বিশেষ মনোযোগ করিয়া চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে আর কিছুতেই হইয়া উঠে নাউল্‌টিয়া এমন ভাব দেখাইতে হয় যে, ঐ তো একফোঁটা মেয়ে, উহাকে লইয়া তো বিষম বিপদে পড়িলাম, কোনোমতে পাশ কাটাইয়া আমার বয়সোচিত কর্তব্যক্ষেত্রের মধ্যে গিয়া পড়িলে যেন পরিত্রাণ পাওয়া যায়

হরসুন্দরী নিবারণের এই বিষম বিপদগ্রস্থ ভাব দেখিয়া মনে মনে বড়ো আমোদ বোধ করিতএক-একদিন হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিত, “আহা, পালাও কোথায়ঐটুকু মেয়ে, ও তো আর তোমাকে খাইয়া ফেলিবে না

নিবারণ দ্বিগুণ শশব্যস্ত ভাব ধারণ করিয়া বলিত, “আরে রোসো রোসো, আমার একটু বিশেষ কাজ আছে” বলিয়া যেন পালাইবার পথ পাইত নাহরসুন্দরী হাসিয়া দ্বার আটক করিয়া বলিত, আজ ফাঁকি দিতে পারিবে নাঅবশেষে নিবারণ নিতান্তই নিরুপায় হইয়া কাতরভাবে বসিয়া পড়িত

হরসুন্দরী তাহার কানের কাছে বলিত, “আহা, পরের মেয়েকে ঘরে আনিয়া অমন হতশ্রদ্ধা করিতে নাই

এই বলিয়া শৈলবালাকে ধরিয়া নিবারণের বাম পাশে বসাইয়া দিত এবং জোর করিয়া ঘোমটা খুলিয়া ও চিবুক ধরিয়া তাহার আনত মুখ তুলিয়া নিবারণেকে বলিত, “আহা, কেমন চাঁদের মতো মুখখানি দেখো দেখি

কোনোদিন বা উভয়কে ঘরে বসাইয়া কাজ আছে বলিয়া যাইত এবং বাহির হইতে ঝনাৎ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিতনিবারণ নিশ্চয় জানিত দুটি কৌতূহলী চক্ষু কোনো-না-কোনো ছিদ্রে সংলগ্ন হইয়া আছে— অতিশয় উদাসীনভাবে পাশ ফিরিয়া নিদ্রার উপক্রম করিত, শৈলবালা ঘোমটা টানিয়া গুটিসুটি মারিয়া মুখ ফিরাইয়া একটা কোণের মধ্যে মিলাইয়া থাকিত

অবশেষে হরসুন্দরী নিতান্ত না পারিয়া হাল ছাড়িয়া দিল, কিন্তু খুব বেশি দুঃখিত হইল না

হরসুন্দরী যখন হাল ছাড়িল, তখন স্বয়ং নিবারণ হাল ধরিলএ বড়ো কৌতুহল, এ বড়ো রহস্য! এক টুকরা হীরক পাইলে তাহাকে নানা ভাবে নানা দিকে ফিরাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, আর এ একটি ক্ষুদ্র সুন্দর মানুষের মন— বড়ো অপূর্ব! ইহাকে কতরকম করিয়া স্পর্শ করিয়া, সোহাগ করিয়া, অন্তরাল হইতে, সম্মুখ হইতে, পার্শ্ব হইতে দেখিতে হয়কখনো একবার কানের দুলে দোল দিয়া, কখনো ঘোমটা একটুখানি টানিয়া তুলিয়া, কখনো বিদ্যুতের মতো সহসা সচকিতে, কখনো নক্ষত্রের মতো দীর্ঘকাল একদৃষ্টে নব নব সৌন্দর্যের সীমা আবিস্কার করিতে হয়

ম্যাক্‌মোরান্ কোম্পানির আপিসের হেডবাবু শ্রীযুক্ত নিবারণচন্দ্রের অদৃষ্টে এমন অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয় নাইসে যখন প্রথম বিবাহ করিয়াছিল তখন বালক ছিল, যখন যৌবন লাভ করিল তখন স্ত্রী তাহার নিকট চিরপরিচিত, বিবাহিত জীবন চিরাভ্যস্তহরসুন্দরীকে অবশ্যই সে ভালোবাসিত, কিন্তু কখনোই তাহার মনে ক্রমে ক্রমে প্রেমের সচেতন সঞ্চার হয় নাই

একেবারে পাকা আম্রের মধ্যেই যে পতঙ্গ জন্মলাভ করিয়াছে, যাহাকে কোনো কালে রস অন্বেষণ করিতে হয় নাই, অল্পে অল্পে রসাস্বাদ করিতে হয় নাই, তাহাকে একবার বসন্তকালের বিকশিত পুষ্পবনের মধ্যে ছাড়িয়া দেওয়া হউক দেখি— বিকচোন্মুখ গোলাপের আধখোলা মুখটির কাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার কী আগ্রহএকটুকু যে সৌরভ পায়, একটুকু যে মধুর আস্বাদ লাভ করে তাহাতে তাহার কী নেশা

নিবারণ প্রথমটা কখনো বা একটা গাউনপরা কাঁচের পুতুল, কখনো বা এক শিশি এসেণ্স, কখনো বা কিছু মিষ্টদ্রব্য কিনিয়া আনিয়া শৈলবালাকে গোপনে দিয়া যাইতএমনি করিয়া একটুখানি ঘনিষ্ঠতার সুত্রপাত হয়অবশেষে কখন একদিন হরসুন্দরী গৃহকার্যের অবকাশে আসিয়া দ্বারের ছিদ্র দিয়া দেখিল, নিবারণ এবং শৈলবালা বসিয়া কড়ি লইয়া দশ-পঁচিশ খেলিতেছে

বুড়োবয়সে এই খেলা বটে! নিবারণ সকালে আহারাদি করিয়া যেন আপিসে বাহির হইল কিন্তু আপিসে না গিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছেএ প্রবঞ্চনার কী আবশ্যক ছিল হঠাৎ একটা জ্বলন্ত বজ্রশলাকা দিয়া কে যেন হরসুন্দরীর চোখ খুলিয়া দিল, সেই তীব্রতাপে চোখের জল বাষ্প হইয়া শুকাইয়া গেল

হরসুন্দরী মনে মনে কহিল, আমিই তো উহাকে ঘরে আনিলাম, আমিই তো মিলন করাইয়া দিলাম, তবে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন— যেন আমি উহাদের সুখের কাঁটা

হরসুন্দরী শৈলবালাকে গৃহকার্য শিখাইতএকদিন নিবারণ মুখ ফুটিয়া বলিল, “ছেলে-মানুষ, উহাকে তুমি বড়ো বেশি পরিশ্রম করাইতেছ, উহার শরীর তেমন সবল নহে

বড়ো একটা তীব্র উত্তর হরসুন্দরীর মুখের কাছে আসিয়াছিল; কিন্তু কিছু বলিল না, চুপ করিয়া গেল

সেই অবধি বউকে কোনো গৃহকার্যে হাত দিতে দিত না; রাঁধাবাড়া দেখাশুনা সমস্ত কাজ নিজে করিতএমন হইল, শৈলবালা আর নড়িয়া বসিতে পারে না, হরসুন্দরী দাসীর মতো তাহার সেবা করে এবং স্বামী বিদূষকের মতো তাহার মনোরঞ্জন করেসংসারের কাজ করা, পরের দিকে তাকানো, যে জীবনের কর্তব্য এ শিক্ষাই তাহার হইল না

হরসুন্দরী যে নীরবে দাসীর মতো কাজ করিতে লাগিল তাহার মধ্যে ভারি একটা গর্ব আছেতাহার মধ্যে ন্যূনতা এবং দীনতা নাই সে কহিল, তোমরা দুই শিশুতে মিলিয়া খেলা করো, সংসারের সমস্ত ভার আমি লইলাম

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

হায়, আজ কোথায় সে বল, যে বলে হরসুন্দরী মনে করিয়াছিল স্বামীর জন্য চিরজীবনকাল সে আপনার প্রেমের দাবির অর্ধেক অংশ অকাতরে ছাড়িয়া দিতে পারিবেহঠাৎ একদিন পূর্ণিমার রাত্রে জীবনে যখন জোয়ার আসে, তখন দুই কূল প্লাবিত করিয়া মানুষ মনে করে, আমার কোথাও সীমা নাই তখন যে একটা বৃহৎ প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে, জীবনের সুদীর্ঘ ভাঁটার সময় সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে তাহার সমস্ত প্রাণে টান পড়ে হঠাৎ ঐশ্বর্যের দিনে লেখনীর এক আঁচড়ে যে দানপত্র লিখিয়া দেয়, চিরদারিদ্যের দিনে পলে পলে তিল তিল করিয়া তাহা শোধ করিতে হয় তখন বুঝা যায় মানুষ বড়ো দীন, হৃদয় বড়ো দুর্বল, তাহার ক্ষমতা অতি যৎসামান্য

দীর্ঘ রোগাবসানে ক্ষীণ, রক্তহীন, পাণ্ডু কলেবরে হরসুন্দরী সেদিন শুক্ল দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো একটি শীর্ণ রেখামাত্র ছিল; সংসারে নিতান্ত লঘু হইয়া ভাসিতেছিলমনে হইয়াছিল, আমার যেন কিছুই না হইলেও চলেক্রমে শরীর বলী হইয়া উঠিল, রক্তের তেজ বাড়িতে লাগিল, তখন হরসুন্দরীর মনে কোথা হইতে একদল শরিক আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহারা উচ্চৈঃশ্বরে কহিল, তুমি তো ত্যাগপত্র লিখিয়া বসিয়া আছ কিন্তু আমাদের দাবি আমরা ছাড়িব না

হরসুন্দরী যেদিন প্রথম পরিষ্কাররূপে আপন অবস্থা বুঝিতে পারিল, সেদিন নিবারণ ও শৈলবালাকে আপন শয়নগৃহ ছাড়িয়া দিয়া ভিন্ন গৃহে একাকিনী গিয়া শয়ন করিল

আট বৎসর বয়সে বাসররাত্রে যে-শয্যায় প্রথম শয়ন করিয়াছিল, আজ সাতাশ বৎসর পরে সেই শয্যা ত্যাগ করিলপ্রদীপ নিভাইয়া দিয়া এই সধবা রমণী যখন অসহ্য হৃদয়ভার লইয়া তাহার নূতন বৈধব্যশয্যার উপরে আসিয়া পড়িল, তখন গলির অপর প্রান্তে একজন শৌখিন যুবা বেহাগ রাগিণীতে মালিনীর গান গাইতেছিল; আর একজন বাঁয়া-তবলায় সংগত করিতেছিল এবং শ্রোতৃবন্ধুগণ সমের কাছে হাঃ-হাঃ-হাঃ করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছিল

তাহার সেই গান সেই নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নারাত্রে পার্শ্বের ঘরে মন্দ শুনাইতেছিল নাতখন বালিকা শৈলবালার ঘুমে চোখ ঢুলিয়া পড়িতেছিল, আর নিবারণ তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া ধীরে ধীরে ডাকিতেছিল, সই

লোকটা ইতিমধ্যে বঙ্কিমবাবুর চন্দ্রশেখর পড়িয়া ফেলিয়াছে এবং দুই-একজন আধুনিক কবির কাব্যও শৈলবালাকে পড়িয়া শুনাইয়াছে

নিবারণের জীবনের নিম্নস্তরে যে একটি যৌবন-উৎস বরাবর চাপা পড়িয়া ছিল, আঘাত পাইয়া হঠাৎ বড়ো অসময়ে তাহা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলকেহই সেজন্য প্রস্তুত ছিল না, এই হেতু অকস্মাৎ তাহার বুদ্ধিশুদ্ধি এবং সংসারের সমস্ত বন্দোবস্ত উলটাপালটা হইয়া গেল সে বেচারা কোনোকালে জানিত না মানুষের ভিতরে এমন-সকল উপদ্রবজনক পদার্থ থাকে, এমন সকল দুর্দাম দুরন্ত শক্তি, যাহা সমস্ত হিসাবকিতাব শৃঙ্খলা-সামঞ্জস্য একেবারে নয়ছয় করিয়া দেয়

কেবল নিবারণ নহে, হরসুন্দরীও একটা নূতন বেদনার পরিচয় পাইলএ কিসের আকাঙ্ক্ষা, এ কিসের দুঃসহ যন্ত্রণামন এখন যাহা চায়, কখনো তো তাহা চাহেও নাই, কখনো তো তাহা পায়ও নাইযখন ভদ্রভাবে নিবারণ নিয়মিত আপিসে যাইত, যখন নিদ্রার পূর্বে কিয়ৎকালের জন্য গয়লার হিসাব, দ্রব্যের মহার্ঘতা এবং লৌকিকতার কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা চলিত, তখন তো এই অন্তর্বিপ্লবের কোনো সূত্রপাতমাত্র ছিল নাভালোবাসিত বটে, কিন্তু তাহার তো কোনো উজ্জ্বলতা, কোনো উত্তাপ ছিল নাসে ভালোবাসা অপ্রজ্বলিত ইন্ধনের মতো ছিল মাত্র

আজ তাহার মনে হইল, জীবনের সফলতা হইতে যেন চিরকাল কে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া আসিয়াছেতাহার হৃদয় যেন চিরদিন উপবাসী হইয়া আছেতাহার এই নারীজীবন বড়ো দারিদ্যেই কাটিয়াছেসে কেবল হাটবাজার পানমসলা তরিতরকারির ঝঞ্চাট লইয়াই সাতাশটা অমূল্য বৎসর দাসীবৃত্তি করিয়া কাটাইল, আর আজ জীবনের মধ্যপথে আসিয়া দেখিল তাহারই শয়নকক্ষের পার্শ্বে এক গোপন মহামহৈশ্বর্যভাণ্ডারের কুলুপ খুলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা একেবারে রাজরাজেশ্বরী হইয়া বসিল নারী দাসী বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে নারী রানীও বটেকিন্তু ভাগাভাগি করিয়া একজন নারী হইল দাসী, আর একজন নারী হইল রানী; তাহাতে দাসীর গৌরব গেল, রানীর সুখ রহিল না

কারণ, শৈলবালাও নারী-জীবনের যথার্থ সুখের স্বাদ পাইল নাএত অবিশ্রাম আদর পাইল যে, ভালোবাসিবার আর মুহুর্ত অবসর রহিল নাসমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হইয়া, সমুদ্রের মধ্যে আত্মবিসর্জন করিয়া বোধ করি নদীর একটি মহৎ চরিতার্থতা আছে, কিন্তু সমুদ্র যদি জোয়ারের টানে আকৃষ্ট হইয়া ক্রমাগতই নদীর উন্মুখীন হইয়া রহে, তবে নদী কেবল নিজের মধ্যেই নিজে স্ফীত হইতে থাকেসংসার তাহার সমস্ত আদর সোহাগ লইয়া দিবারাত্রি শৈলবালার দিকে অগ্রসর হইয়া রহিল, তাহাতে শৈলবালার আত্মাদর অতিশয় উত্তুঙ্গ হইয়া উঠিতে লাগিল, সংসারের প্রতি তাহার ভালোবাসা পড়িতে পাইল না সে জানিল, আমার জন্যই সমস্ত এবং আমি কাহার জন্যও নহিএ অবস্থায় যথেষ্ট অহংকার আছে কিন্তু পরিতৃপ্তি কিছুই নাই

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

একদিন ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছেএমনি অন্ধকার করিয়াছে যে, ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করা অসাধ্যবাহিরে ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে কুলগাছের তলায় লতাগুল্মের জঙ্গল জলে প্রায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এবং প্রাচীরের পার্শ্ববর্তী নালা দিয়া ঘোলা জলস্রোত কলকল শব্দে বহিয়া চলিয়াছেহরসুন্দরী আপনার নূতন শয়নগৃহের নির্জন অন্ধকারে জানলার কাছে চুপ করিয়া বসিয়া আছে

এমন সময় নিবারণ চোরের মতো ধীরে ধীরে দ্বারের কাছে প্রবেশ করিল, ফিরিয়া যাইবে কি অগ্রসর হইবে ভাবিয়া পাইল নাহরসুন্দরী তাহা লক্ষ্য করিল কিন্তু একটি কথাও কহিল না

তখন নিবারণ হঠাৎ একেবারে তীরের মতো হরসুন্দরীর পার্শ্বে গিয়া এক নিশ্বাসে বলিয়া ফেলিল, “গোটাকতক গহনার আবশ্যক হইয়াছেজান তো অনেকগুলো দেনা হইয়া পড়িয়াছে, পাওনাদার বড়োই অপমান করিতেছে— কিছু বন্ধক রাখিতে হইবে— শীঘ্রই ছাড়াইয়া লইতে পারিব

হরসুন্দরী কোনো উত্তর দিল না, নিবারণ চোরের মতো দাঁড়াইয়া রহিলঅবশেষে পুনশ্চ কহিল, “তবে কি আজ হইবে না
হরসুন্দরী কহিল, “না

ঘরে প্রবেশ করাও যেমন শক্ত, ঘর হইতে অবিলম্বে বাহির হওয়াও তেমনি কঠিন
নিবারণ একটু এদিকে ওদিকে চাহিয়া ইতস্তত করিয়া বলিল, “তবে অন্যত্র চেষ্টা দেখি গে যাই”, বলিয়া প্রস্থান করিল

ঋণ কোথায় এবং কোথায় গহনা বন্ধক দিতে হইবে হরসুন্দরী তাহা সমস্তই বুঝিলবুঝিল, নববধূ পূর্বরাত্রে তাহার এই হতবুদ্ধি পোষা পুরুষটিকে অত্যন্ত ঝংকার দিয়া বলিয়াছিল, “দিদির সিন্দুকভরা গহনা, আর আমি বুঝি একখানি পরিতে পারি না

নিবারণ চলিয়া গেলে ধীরে ধীরে উঠিয়া লোহার সিন্দুক খুলিয়া একে একে সমস্ত গহনা বাহির করিলশৈলবালাকে ডাকিয়া প্রথমে আপনার বিবাহের বেনারসি শাড়িখানি পরাইল, তাহার পর তাহার আপাদমস্তক এক-একখানি করিয়া গহনায় ভরিয়া দিলভালো করিয়া চুল বাঁধিয়া দিয়া প্রদীপ জ্বালিয়া দেখিল, বালিকার মুখখানি বড়ো সুমিষ্ট, একটি সদ্যঃপক্ক সুগন্ধ ফলের মতো নিটোল রসপূর্ণশৈলবালা যখন ঝমঝম শব্দ করিয়া চলিয়া গেল, সেই শব্দ বহুক্ষণ ধরিয়া হরসুন্দরীর শিরার রক্তের মধ্যে ঝিমঝিম করিয়া বাজিতে লাগিলমনে মনে কহিল, আজ আর কী লইয়া তোতে আমাতে তুলনা হইবেকিন্তু এক সময়ে আমারও তো ঐ বয়স ছিল, আমিও তো অমনি যৌবনের শেষরেখা পর্যন্ত ভরিয়া উঠিয়াছিলাম, তবে আমাকে সে কথা কেহ জানায় নাই কেনকখন সেদিন আসিল এবং কখন সেদিন গেল তাহা একবার সংবাদও পাইলাম নাকিন্তু কী গর্বে, কী গৌরবে, তরঙ্গ তুলিয়া শৈলবালা চলিয়াছে

হরসুন্দরী যখন কেবলমাত্র ঘরকন্নাই জানিত তখন এই গহনাগুলি তাহার কাছে কত দামি ছিলতখন কি নির্বোধের মতো এ-সমস্ত এমন করিয়া একমুহূর্তে হাতছাড়া করিতে পারিতএখন ঘরকন্না ছাড়া আর একটা বড়ো কিসের পরিচয় পাইয়াছে, এখন গহনার দাম, ভবিষ্যতের হিসাব সমস্ত তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে

আর শৈলবালা সোনামানিক ঝকমক করিয়া শয়নগৃহে চলিয়া গেল, একবার মুহূর্তের তরে ভাবিলও না হরসুন্দরী তাহাকে কতখানি দিলসে জানিল, চতুর্দিক হইতে সমস্ত সেবা, সমস্ত সস্পদ, সমস্ত সৌভাগ্য স্বাভাবিক নিয়মে তাহার মধ্যে আসিয়া পরিসমাপ্ত হইবে, কারণ সে হইল শৈলবালা, সে হইল সই

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এক-একজন লোক স্বপ্নাবস্থায় নির্ভীকভাবে অত্যন্ত সংকটের পথ দিয়া চলিয়া যায়, মুহূর্তমাত্র চিন্তা করে নাঅনেক জাগ্রত মানুষেরও তেমনি চিরস্বপ্নাবস্থা উপস্থিত হয়, কিছুমাত্র জ্ঞান থাকে না, বিপদের সংকীর্ণ পথ দিয়া নিশ্চিন্তমনে অগ্রসর হইতে থাকে, অবশেষে নিদারুণ সর্বনাশের মধ্যে গিয়া জাগ্রত হইয়া উঠে

আমাদের ম্যাক্‌মোরান কোম্পানির হেডবাবুটিরও সেই দশাশৈলবালা তাহার জীবনের মাঝখানে একটা প্রবল আবর্তের মতো ঘুরিতে লাগিল এবং বহুদূর হইতে বিবিধ মহার্ঘ পদার্থ আকৃষ্ট হইয়া তাহার মধ্যে বিলুপ্ত হইতে লাগিলকেবল যে নিবারণের মনুষ্যত্ব এবং মাসিক বেতন, হরসুন্দরীর সুখসৌভাগ্য এবং বসনভূষণ, তাহা নহে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্‌মোরান কোম্পানির ক্যাশ তহবিলেও গোপনে টান পড়িলতাহার মধ্য হইতেও দুটা-একটা করিয়া তোড়া অদৃশ্য হইতে লাগিলনিবারণ স্থির করিত, আগামী মাসের বেতন হইতে আস্তে আস্তে শোধ করিয়া রাখিবকিন্তু আগামী মাসের বেতনটি হাতে আসিবামাত্র সেই আবর্ত হইতে টান পড়ে এবং শেষ দু-আনিটি পর্যন্ত চকিতের মতো চিকমিক করিয়া বিদ্যুদ্‌বেগে অন্তর্হিত হয়

শেষে একদিন ধরা পড়িলপুরুষানুক্রমের চাকুরি সাহেব বড়ো ভালোবাসে, তহবিল পূরণ করিয়া দিবার জন্য দুইদিনমাত্র সময় দিল

কেমন করিয়া সে ক্রমে ক্রমে আড়াই হাজার টাকার তহবিল ভাঙিয়াছে তাহা নিবারণ নিজেই বুঝিতে পারিল নাএকেবারে পাগলের মতো হইয়া হরসুন্দরীর কাছে গেল, বলিল, “ সর্বনাশ হইয়াছে

হরসুন্দরী সমস্ত শুনিয়া একেবারে পাংশুবর্ণ হইয়া গেল
নিবারণ কহিল, “শীঘ্র গহনাগুলো বাহির করো
” হরসুন্দরী কহিল, “সে তো আমি সমস্ত ছোটোবউকে দিয়াছি
নিবারণ নিতান্ত শিশুর মতো অধীর হইয়া বলিতে লাগিল, “কেন দিলে ছোটো বউকে
কেন দিলেকে তোমাকে দিতে বলিল
হরসুন্দরী তাহার প্রকৃত উত্তর না দিয়া কহিল, “তাহাতে ক্ষতি কী হইয়াছে
সে তো আর জলে পড়ে নাই
ভীরু নিবারণ কাতরস্বরে কহিল, “তবে যদি তুমি কোনো ছুতা করিয়া তাহার কাছ হইতে বাহির করিতে পার
কিন্তু আমার মাথা খাও, বলিয়ো না যে আমি চাহিতেছি কিংবা কী জন্য চাহিতেছি

তখন হরসুন্দরী মর্মান্তিক বিরক্তি ও ঘৃণা-ভরে বলিয়া উঠিল, “এই কি তোমার ছলছুতা করিবার, সোহাগ দেখাইবার সময়চলো” বলিয়া স্বামীকে লইয়া ছোটোবউয়ের ঘরে প্রবেশ করিল
ছোটোবউ কিছু বুঝিল না
সে সকল কথাতেই বলিল, “সে আমি কী জানি

সংসারের কোনো চিন্তা যে তাহাকে কখনো ভাবিতে হইবে এমন কথা কি তাহার সহিত ছিল সকলে আপনার ভাবনা ভাবিবে এবং সকলে মিলিয়া শৈলবালার আরাম চিন্তা করিবে— অকস্মাৎ ইহার ব্যতিক্রম হয়, এ কী ভয়ানক অন্যায়!

তখন নিবারণ শৈলবালার পায়ে ধরিয়া কাঁদিয়া পড়িলশৈলবালা কেবলই বলিল, “সে আমি জানি না আমার জিনিস আমি কেন দিব

নিবারণ দেখিল ঐ দুর্বল ক্ষুদ্র সুন্দর সুকুমারী বালিকাটি লোহার সিন্দুকের অপেক্ষাও কঠিনহরসুন্দরী সংকটের সময় স্বামীর দুর্বলতা দেখিয়া ঘৃণায় জর্জরিত হইয়া উঠিলশৈলবালার চাবি বলপূর্বক কাড়িয়া লইতে গেলশৈলবালা তৎক্ষণাৎ চাবির গোছা প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া পুষ্করিণীর মধ্যে ফেলিয়া দিল

হরসুন্দরী হতবুদ্ধি স্বামীকে কহিল, “তালা ভাঙ্গিয়া ফেলো-না
শৈলবালা প্রশান্তমুখে বলিল, “তাহা হইলে আমি গলায় দড়ি দিয়া মরিব

নিবারণ কহিল, “আমি আর-একটা চেষ্টা দেখিতেছি,” বলিয়া এলোথেলো বেশে বাহির হইয়া গেল

নিবারণ দুই ঘণ্টার মধ্যেই পৈতৃক বাড়ি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়া আসিল

বহুকষ্টে হাতে বেড়িটা বাঁচিল, কিন্তু চাকরি গেলস্থাবর-জঙ্গমের মধ্যে রহিল কেবল দুটিমাত্র স্ত্রীতাহার মধ্যে ক্লেশকাতর বালিকা স্ত্রীটি গর্ভবতী হইয়া নিতান্ত স্থাবর হইয়াই পড়িলগলির মধ্যে একটি ছোটো স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে এই ক্ষুদ্র পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করিল

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ছোটোবউয়ের অসন্তোষ এবং অসুখের আর শেষ নাইসে কিছুতেই বুঝিতে চায় না তাহার স্বামীর ক্ষমতা নাইক্ষমতা নাই যদি তো বিবাহ করিল কেন
উপরের তলায় কেবল দুটিমাত্র ঘর
একটি ঘরে নিবারণ ও শৈলবালার শয়নগৃহ আর-একটি ঘরে হরসুন্দরী থাকেশৈলবালা খুঁতখুঁত করিয়া বলে, “আমি দিনরাত্রি শোবার ঘরে কাটাইতে পারি না
নিবারণ মিথ্যা আশ্বাস দিয়া বলিত, “আমি আর-একটা ভালো বাড়ির সন্ধানে আছি, শীঘ্র বাড়ি বদল করিব

শৈলবালা বলিত, “কেন, ঐ তো পাশে আর-একটা ঘর আছে

শৈলবালা তাহার পূর্ব-প্রতিবেশিনীদের দিকে কখনো মুখ তুলিয়া চাহে নাইনিবারণের বর্তমান দুরবস্থায় ব্যথিত হইয়া তাহারা একদিন দেখা করিতে আসিল; শৈলবালা ঘরে খিল দিয়া বসিয়া রহিল, কিছুতেই দ্বার খুলিল নাতাহারা চলিয়া গেলে রাগিয়া, কাঁদিয়া, উপবাসী থাকিয়া, হিস্টিরিয়া করিয়া পাড়া মাথায় করিলএমনতরো উৎপাত প্রায় ঘটিতে লাগিল
অবশেষে শৈলবালার শারীরিক সংকটের অবস্থায় গুরুতর পীড়া হইল, এমন-কি, গর্ভপাত হইবার উপক্রম হইল
নিবারণ হরসুন্দরীর দুই হাত ধরিয়া বলিল, “তুমি শৈলকে বাঁচাও
হরসুন্দরী দিন নাই রাত্রি নাই শৈলবালার সেবা করিতে লাগিল
তিলমাত্র ত্রুটি হইলে শৈল তাহাকে দুর্বাক্য বলিত, সে একটি উত্তর মাত্র করিত না

শৈল কিছুতেই সাগু খাইতে চাহিত না, বাটিসুদ্ধ ছুঁড়িয়া ফেলিত, জ্বরের সময় কাঁচা আমের অম্বল দিয়া ভাত খাইতে চাহিতনা পাইলে রাগিয়া কাঁদিয়া অনর্থপাত করিতহরসুন্দরী তাহাকে “লক্ষ্মী আমার,” “বোন আমার,” “দিদি আমার” বলিয়া শিশুর মতো ভুলাইতে চেষ্টা করিত

কিন্তু শৈলবালা বাঁচিল নাসংসারের সমস্ত সোহাগ আদর লইয়া পরম অসুখ ও অসন্তোষে বালিকার ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণ ব্যর্থ জীবন নষ্ট হইয়া গেল

সপ্তম পরিচ্ছেদ

নিবারণের প্রথমে খুব একটা আঘাত লাগিল, পরক্ষণেরই দেখিল তাহার একটা মস্ত বাঁধন ছিঁড়িয়া গিয়াছেশোকের মধ্যে হঠাৎ তাহার একটা মুক্তির আনন্দ বোধ হইলহঠাৎ মনে হইল এতদিন তাহার বুকের উপর একটা দুঃস্বপ্ন চাপিয়া ছিলচৈতন্য হইয়া মুহূর্তের মধ্যে জীবন নিরতিশয় লঘু হইয়া গেলমাধবীলতাটির মতো এই যে কোমল জীবনপাশ ছিঁড়িয়া গেল, এই কি তাহার আদরের শৈলবালাহঠাৎ নিশ্বাস টানিয়া দেখিল, না, সে তাহার উদ্‌বন্ধনরজ্জু

আর তাহার চিরজীবনের সঙ্গিনী হরসুন্দরী? দেখিল, সেই তো তাহার সমস্ত সংসার একাকিনী অধিকার করিয়া তাহার জীবনের সমস্ত সুখদুঃখের স্মৃতিমন্দিরের মাঝখানে বসিয়া আছে— কিন্তু তবু মধ্যে একটা বিচ্ছেদঠিক যেন একটি ক্ষুদ্র উজ্জ্বল সুন্দর নিষ্ঠুর ছুরি আসিয়া একটি হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ এবং বাম অংশের মাঝখানে বেদনাপূর্ণ বিদারণরেখা টানিয়া দিয়া গেছে

একদিন গভীর রাত্রে সমস্ত শহর যখন নিদ্রিত, নিবারণ ধীরে ধীরে হরসুন্দরীর নিভৃত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলনীরবে সেই পুরাতন নিয়মমত সেই পুরাতন শয্যার দক্ষিণ অংশ গ্রহণ করিয়া শয়ন করিলকিন্তু এবার তাহার সেই চির অধিকারের মধ্যে চোরের মতো প্রবেশ করিল

হরসুন্দরীও একটি কথা বলিল না, নিবারণও একটি কথা বলিল নাউহারা পূর্বে যেরূপ পাশাপাশি শয়ন করিত এখনো সেইরূপ পাশাপাশি শুইল, কিন্তু ঠিক মাঝখানে একটি মৃত বালিকা শুইয়া রহিল, তাহাকে কেহ লঙ্ঘন করিতে পারিল না

জ্যৈষ্ঠ ১৩০০