ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মুক্তির উপায়
[সাধনা পত্রিকার পৌষ ১২৯৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ]

ফকিরচাঁদ বাল্যকাল হইতেই গম্ভীরপ্রকৃতিবৃদ্ধসমাজে তাহাকে কখনোই বেমানান দেখাইত নাঠাণ্ডা জল, হিম, এবং হাস্যপরিহাস তাহার একেবারে সহ্য হইত নাএকে গম্ভীর, তাহাতে বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময়েই মুখমণ্ডলের চারি দিকে কালো পশমের গলাবন্ধ জড়াইয়া থাকাতে তাহাকে ভয়ংকর উঁচুদরের লোক বলিয়া বোধ হইতইহার উপরে, অতি অল্প বয়সেই তাহার ওষ্ঠাধর এবং গণ্ডস্থল প্রচুর গোঁফ-দাড়িতে আচ্ছন্ন হওয়াতে সমস্ত মুখের মধ্যে হাস্যবিকাশের স্থান আর তিলমাত্র অবশিষ্ট রহিল না

স্ত্রী হৈমবতীর বয়স অল্প এবং তাহার মন পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ নিবিষ্টসে বঙ্কিমবাবুর নভেল পড়িতে চায় এবং স্বামীকে ঠিক দেবতার ভাবে পূজা করিয়া তাহার তৃপ্তি হয় নাসে একটুখানি হাসিখুশি ভালোবাসে; এবং বিকচোন্মুখ পুষ্প যেমন বায়ুর আন্দোলন এবং প্রভাতের আলোকের জন্য ব্যাকুল হয় সেও তেমনি এই নবযৌবনের সময় স্বামীর নিকট হইতে আদর এবং হাস্যামোদ যথাপরিমাণে প্রত্যাশা করিয়া থাকেকিন্তু, স্বামী তাহাকে অবসর পাইলেই ভাগবত পড়ায়, সন্ধ্যাবেলায় ভগবদ্গীতা শুনায়, এবং তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশে মাঝে মাঝে শারীরিক শাসন করিতেও ত্রুটি করে নাযেদিন হৈমবতীর বালিশের নীচে হইতে কৃষ্ণকান্তের উইল বাহির হয় সেদিন উক্ত লঘুপ্রকৃতি যুবতীকে সমস্ত রাত্রি অশ্রুপাত করাইয়া তবে ফকির ক্ষান্ত হয়একে নভেল পাঠ, তাহাতে আবার পতিদেবকে প্রতারণাযাহা হউক, অবিশ্রান্ত আদেশ অনুদেশ উপদেশ ধর্মনীতি এবং দণ্ডনীতির দ্বারা অবশেষে হৈমবতীর মুখের হাসি, মনের সুখ এবং যৌবনের আবেগ একেবারে নিষ্কর্ষণ করিয়া ফেলিতে স্বামীদেবতা সম্পূর্ণ কৃতকার্য হইয়াছিলেন

কিন্তু, অনাসক্ত লোকের পক্ষে সংসারে বিস্তর বিঘ্ন পরে পরে ফকিরের এক ছেলে এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করিয়া সংসারবন্ধন বাড়িয়া গেলপিতার তাড়নায় এতবড়ো গম্ভীরপ্রকৃতির ফকিরকেও আপিসে আপিসে কর্মের উমেদারিতে বাহির হইতে হইল, কিন্তু কর্ম জুটিবার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না

তখন সে মনে করিল, বুদ্ধদেবের মতো আমি সংসার ত্যাগ করিব এই ভাবিয়া একদিন গভীর রাত্রে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল

মধ্যে আর-একটি ইতিহাস বলা আবশ্যক
নবগ্রামবাসী ষষ্ঠীচরণের এক ছেলে
নাম মাখনলালবিবাহের অনতিবিলম্বে সন্তানাদি না হওয়াতে পিতার অনুরোধে এবং নূতনত্বের প্রলোভনে আর-একটি বিবাহ করেএই বিবাহের পর হইতে যথাক্রমে তাহার উভয় স্ত্রীর গর্ভে সাতটি কন্যা এবং একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করিল

মাখন লোকটা নিতান্ত শৌখিন এবং চপলপ্রকৃতি, কোনো প্রকার গুরুতর কর্তব্যের দ্বারা আবদ্ধ হইতে নিতান্ত নারাজএকে তো ছেলেপুলের ভার, তাহার পরে যখন দুই কর্ণধার দুই কর্ণে ঝিঁকা মারিতে লাগিল, তখন নিতান্ত অসহ্য হইয়া সেও একদিন গভীর রাত্রে ডুব মারিল

বহুকাল তাহার আর সাক্ষাৎ নাইকখনো কখনো শুনা যায়, এক বিবাহে কিরূপ সুখ তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে কাশীতে গিয়া গোপনে আর-একটি বিবাহ করিয়াছে ; শুনা যায়, হতভাগ্য কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করিয়াছে কেবল দেশের কাছাকাছি আসিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার মন উতলা হয়, ধরা পড়িবার ভয়ে আসিতে পারে না

কিছুদিন ঘুরিতে ঘুরিতে উদাসীন ফকিরচাঁদ নবগ্রামে আসিয়া উপস্থিতপথ-পার্শ্ববর্তী এক বটবৃক্ষ-তলে বসিয়া নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, আহা, বৈরাগ্যমেবাভয়দারাপুত্র ধনজন কেউ কারো নয় কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ বলিয়া এক গান জুড়িয়া দিল—

শোন্ রে শোন্, অবোধ মন
শোন্ সাধুর উক্তি—
কিসে মুক্তি
সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ

ভবের শুক্তি ভেঙে মুক্তি-মুক্তা কর্ অন্বেষণ
ওরে ও ভোলা মন, ভোলা মন রে

সহসা গান বন্ধ হইয়া গেলও কে ও! বাবা দেখছি! সন্ধান পেয়েছেন বুঝি! তবে তো সর্বনাশআবার তো সংসারের অন্ধকূপে টেনে নিয়ে যাবেনপালাতে হল

ফকির তাড়াতাড়ি নিকটবর্তী এক গৃহে প্রবেশ করিলবৃদ্ধ গৃহস্বামী চুপচাপ বসিয়া তামাক টানিতেছিলফকিরকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে হে তুমি
ফকির
বাবা, আমি সন্ন্যাসী
বৃদ্ধসন্ন্যাসী! দেখি দেখি বাবা, আলোতে এসো দেখি

এই বলিয়া আলোতে টানিয়া লইয়া ফকিরের মুখের পরে ঝুঁকিয়া বুড়ামানুষ বহু কষ্টে যেমন করিয়া পুঁথি পড়ে তেমনি করিয়া ফকিরের মুখ নিরীক্ষণ করিয়া বিড়বিড় করিয়া বকিতে লাগিল-এই তো আমার সেই মাখনলাল দেখছি সেই নাক, সেই চোখ, কেবল কপালটা বদলেছে, আর সেই চাঁদমুখ গোঁফে দাড়িতে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে
বলিয়া বৃদ্ধ স্নেহে ফকিরের শ্মশ্রুল মুখে দুই-একবার হাত বুলাইয়া লইল এবং প্রকাশ্যে কহিল, বাবা মাখন!
বলা বাহুল্য বৃদ্ধের নাম ষষ্ঠীচরণ
ফকির (সবিস্ময়ে) মাখন! আমার নাম তো মাখন নয়পূর্বে আমার নাম যাই থাক্, এখন আমার নাম চিদানন্দস্বামী ইচ্ছা হয় তো পরমানন্দও বলতে পার

ষষ্ঠীবাবা, তা এখন আপনাকে চিঁড়েই বল্ আর পরমান্নই বল্, তুই যে আমার মাখন, বাবা, সে তো আমি ভুলতে পারব না—বাবা, তুই কোন্ দুঃখে সংসার ছেড়ে গেলিতোর কিসের অভাবদুই স্ত্রী— বড়োটিকে না ভালোবাসিস ছোটোটি আছে ছেলেপিলের দুঃখও নেইশত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সাতটি কন্যে, একটি ছেলেআর, আমি বুড়ো বাপ, কদিনই বা বাঁচব— তোর সংসার তোরই থাকবে
ফকির একেবারে আঁতকিয়া উঠিয়া কহিল, কী সর্বনাশ শুনলেও যে ভয় হয়
এতক্ষণে প্রকৃত ব্যাপারটা বোধগম্য হইলভাবিল, মন্দ কী, দিন-দুই বৃদ্ধের পুত্রভাবেই এখানে লুকাইয়া থাকা যাক, তাহার পরে সন্ধানে অকৃতকার্য হইয়া বাপ চলিয়া গেলেই এখান হইতে পলায়ন করিব
ফকিরকে নিরুত্তর দেখিয়া বৃদ্ধের মনে আর সংশয় রহিল নাকেষ্টা চাকরকে ডাকিয়া বলিল, ওরে ও কেষ্টা, তুই সকলকে খবর দিয়ে আয় গে, আমার মাখন ফিরে এসেছে

দেখিতে দেখিতে লোকে লোকারণ্যপাড়ার লোকে অধিকাংশই বলিল, সেই বটেকেহ বা সন্দেহ প্রকাশ করিল কিন্তু, বিশ্বাস করিবার জন্যই লোকে এত ব্যগ্র যে সন্দিগ্ধ লোকদের উপরে সকলে হাড়ে চটিয়া গেলযেন তাহারা ইচ্ছাপূর্বক কেবল রসভঙ্গ করিতে আসিয়াছে; যেন তাহারা পাড়ার চৌদ্দ অক্ষরের পয়ারকে সতেরো অক্ষর করিয়া বসিয়া আছে, কোনোমতে তাহাদিগকে সংক্ষেপ করিতে পারিলেই তবে পাড়াসুদ্ধ লোক আরাম পায়তাহারা ভূতও বিশ্বাস করে না, ওঝাও বিশ্বাস করে না ; আশ্চর্য গল্প শুনিয়া যখন সকলের তাক লাগিয়া গিয়াছে তখন তাহারা প্রশ্ন উত্থাপন করেএকপ্রকার নাস্তিক বলিলেই হয় কিন্তু, ভূত অবিশ্বাস করিলে ততটা ক্ষতি নাই, তাই বলিয়া বুড়া বাপের হারা ছেলেকে অবিশ্বাস করা যে নিতান্ত হৃদয়হীনতার কাজযাহা হউক, সকলের নিকট হইতে তাড়না খাইয়া সংশয়ীর দল থামিয়া গেল

ফকিরের অতিভীষণ অটল গাম্ভীর্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া পাড়ার লোকেরা তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল, আরে আরে, আমাদের সেই মাখন আজ ঋষি হয়েছেন, তপিস্বী হয়েছেন, চিরটা কাল ইয়ার্কি দিয়ে কাটালে, আজ হঠাৎ মহামুনি জামদগ্নি হয়ে বসেছেন

কথাটা উন্নতচেতা ফকিরের অত্যন্ত খারাপ লাগিল, কিন্তু নিরুপায়ে সহ্য করিতে হইলএকজন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, ওরে মাখন, তুই কুচ্‌কুচে কালো ছিলি, রঙটা এমন ফরসা করলি কী করে
ফকির উত্তর দিল, যোগ অভ্যাস করে
সকলেই বলিল, যোগের কী আশ্চর্য প্রভাব
একজন উত্তর করিল, আশ্চর্য আর কী শাস্ত্রে আছে, ভীম যখন হনুমানের লেজ ধরে তুলতে গেলেন কিছুতেই তুলতে পারলেন নাসে কী করে হল সে তো যোগ-বলে
এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইল
হেনকালে ষষ্ঠীচরণ আসিয়া ফকিরকে বলিল, বাবা, একবার বাড়ির ভিতরে যেতে হচ্ছে
এ সম্ভাবনাটা ফকিরের মাথায় উদয় হয় নাই— হঠাৎ বজ্রাঘাতের মতো মস্তিষ্কে প্রবেশ করিলঅনেকক্ষণ চুপ করিয়া, পাড়ার লোকের বিস্তর অন্যায় পরিহাস পরিপাক করিয়া অবশেষে বলিল, বাবা, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, আমি অন্তঃপুরে ঢুকতে পারব না
ষষ্ঠীচরণ পাড়ার লোকদের সম্বোধন করিয়া বলিল, তা হলে আপনাদের একবার গা তুলতে হচ্ছেবউমাদের এইখানেই নিয়ে আসি তাঁরা বড়ো ব্যাকুল হয়ে আছেন
সকলে উঠিয়া গেলফকির ভাবিল, এইবেলা এখান হইতে এক দৌড় মারি কিন্তু রাস্তায় বাহির হইলেই পাড়ার লোক কুক্কুরের মতো তাহার পশ্চাতে ছুটিবে, ইহাই কল্পনা করিয়া তাহাকে নিস্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিতে হইল
যেমনি মাখনলালের দুই স্ত্রী প্রবেশ করিল, ফকির অমনি নতশিরে তাহাদিগকে প্রণাম করিয়া কহিল, মা, আমি তোমাদের সন্তান
অমনি ফকিরের নাকের সম্মুখে একটা বালা-পরা হাত খড়্‌গের মতো খেলিয়া গেল এবং একটি কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে বাজিয়া উঠিল, ওরে ও পোড়াকপালে মিন্‌সে, তুই মা বললি কাকে!
অমনি আর-একটি কণ্ঠ আরো দুই সুর উচ্চে পাড়া কাঁপাইয়া ঝংকার দিয়া উঠিল, চোখের মাথা খেয়ে বসেছিস! তোর মরণ হয় না!

নিজের স্ত্রীর নিকট হইতে এরূপ চলিত বাংলা শোনা অভ্যাস ছিল না, সুতরাং একান্ত কাতর হইয়া ফকির জোড়হস্তে কহিল, আপনারা ভুল বুঝছেন আমি এই আলোতে দাঁড়াচ্ছি, আমাকে একটু ঠাউরে দেখুন
প্রথমা ও দ্বিতীয়া পরে পরে কহিল, ঢের দেখেছি দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছেতুমি কচি খোকা নও, আজ নতুন জন্মাও নিতোমার দুধের দাঁত অনেক দিন ভেঙেছে তোমার কি বয়সের গাছ-পাথর আছেতোমায় যম ভুলেছে বলে কি আমরা ভুলব
এরূপ এক-তরফা দাম্পত্য আলাপ কতক্ষণ চলিত বলা যায় না— কারণ, ফকির একেবারে বাক্‌শক্তিরহিত হইয়া নতশিরে দাঁড়াইয়া ছিলএমন সময় অত্যন্ত কোলাহল শুনিয়া এবং পথে লোক জমিতে দেখিয়া ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিলবলিল, এতদিন আমার ঘর নিস্তব্ধ ছিল, একেবারে টুঁশব্দ ছিল নাআজ মনে হচ্ছে বটে, আমার মাখন ফিরে এসেছে

ফকির করজোড়ে কহিল, মশায়, আপনার পুত্রবধূদের হাত থেকে আমাকে রক্ষে করুন
ষষ্ঠীবাবা, অনেক দিন পরে এসেছ, তাই প্রথমটা একটু অসহ্য বোধ হচ্ছে তা, মা, তোমরা এখন যাওবাবা মাখন তো এখন এখানেই রইলেন, ওঁকে আর কিছুতেই যেতে দিচ্ছি নে
ললনাদ্বয় বিদায় হইলে ফকির ষষ্ঠীচরণকে বলিল, মশায়, আপনার পুত্র কেন যে সংসার ত্যাগ করে গেছেন তা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছি মশায়, আমার প্রণাম জানবেন, আমি চললেম
বৃদ্ধ এমনি উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন উত্থাপন করিল যে, পাড়ার লোক মনে করিল মাখন তাহার বাপকে মারিয়াছে তাহারা হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল সকলে আসিয়া ফকিরকে জানাইয়া দিল, এমন ভণ্ডতপস্বীগিরি এখানে খাটিবে না ভালোমানুষের ছেলের মতো কাল কাটাইতে হইবে একজন বলিল, ইনি তো পরমহংস নন, পরম বক

গাম্ভীর্য গোঁফদাড়ি এবং গলাবন্ধের জোরে ফকিরকে এমন-সকল কুৎসিত কথা কখনো শুনিতে হয় নাইযাহা হউক, লোকটা পাছে আবার পালায় পাড়ার লোকেরা অত্যন্ত সতর্ক রহিল স্বয়ং জমিদার ষষ্ঠীচরণের পক্ষ অবলম্বন করিলেন

ফকির দেখিল এমনি কড়া পাহারা যে, মৃত্যু না হইলে ইহারা ঘরের বাহির করিবে না একাকী ঘরে বসিয়া গান গাহিতে লাগিল—

শোন্ সাধুর উক্তি, কিসে মুক্তি
সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ

বলা বাহুল্য, গানটার আধ্যাত্মিক অর্থ অনেকটা ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে
এমন করিয়াও কোনোমতে দিন কাটিতকিন্তু মাখনের আগমনসংবাদ পাইয়া দুই স্ত্রীর সম্পর্কের একঝাঁক শ্যালা ও শ্যালী আসিয়া উপস্থিত হইল
তাহারা আসিয়াই প্রথমত ফকিরের গোঁফদাড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল— তাহারা বলিল, এ তো সত্যকার গোঁফদাড়ি নয়, ছদ্মবেশ করিবার জন্য আঠা দিয়া জুড়িয়া আসিয়াছে
নাসিকার নিম্নবর্তী গুম্ফ ধরিয়া টানাটানি করিলে ফকিরের ন্যায় অত্যন্ত মহৎ লোকেরও মাহাত্ম্য রক্ষা করা দুষ্কর হইয়া উঠে ইহা ছাড়া কানের উপর উপদ্রবও ছিল— প্রথমত মলিয়া, দ্বিতীয়ত এমন-সকল ভাষা প্রয়োগ করিয়া যাহাতে কান না মলিলেও কান লাল হইয়া উঠে

ইহার পর ফকিরকে তাহারা এমন-সকল গান ফরমাশ করিতে লাগিল আধুনিক বড়ো বড়ো নূতন পণ্ডিতেরা যাহার কোনোরূপ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করিতে হার মানেনআবার, নিদ্রাকালে তাহারা ফকিরের স্বল্পাবশিষ্ট গণ্ডস্থলে চুনকালি মাখাইয়া দিল; আহারকালে কেসুরের পরিবর্তে কচু, ডাবের জলের পরিবর্তে হুঁকার জল, দুধের পরিবর্তে পিঠালি-গোলার আয়োজন করিল ; পিঁড়ার নীচে সুপারি রাখিয়া তাহাকে আছাড় খাওয়াইল, লেজ বানাইল এবং সহস্র প্রচলিত উপায়ে ফকিরের অভ্রভেদী গাম্ভীর্য ভূমিসাৎ করিয়া দিল

ফকির রাগিয়া ফুলিয়া-ফাঁপিয়া ঝাঁকিয়া-হাঁকিয়া কিছুতেই উপদ্রবকারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করিতে পারিল নাকেবল সর্বসাধারণের নিকট অধিকতর হাস্যাস্পদ হইতে লাগিলইহার উপরে আবার অন্তরাল হইতে একটি মিষ্ট কণ্ঠের উচ্চহাস্য মাঝে মাঝে কর্ণগোচর হইত ; সেটা যেন পরিচিত বলিয়া ঠেকিত এবং মন দ্বিগুণ অধৈর্য হইয়া উঠিত

পরিচিত কণ্ঠ পাঠকের অপরিচিত নহেএইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ষষ্ঠীচরণ কোনো-এক সম্পর্কে হৈমবতীর মামাবিবাহের পর শাশুড়ির দ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পিতৃমাতৃহীনা হৈমবতী মাঝে মাঝে কোনো-না কোনো কুটুম্ববাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করিতঅনেক দিন পরে সে মামার বাড়ি আসিয়া নেপথ্য হইতে এক পরমকৌতুকাবহ অভিনয় নিরীক্ষণ করিতেছেতৎকালে হৈমবতীর স্বাভাবিক রঙ্গপ্রিয়তার সঙ্গে প্রতিহিংসাপ্রবৃত্তির উদ্রেক হইয়াছিল কিনা চরিত্রতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা স্থির করিবেন, আমরা বলিতে অক্ষম

ঠাট্টার সম্পর্কীয় লোকেরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম করিত, কিন্তু স্নেহের সম্পর্কীয় লোকদের হাত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিনসাত মেয়ে এবং এক ছেলে তাঁহাকে এক দণ্ড ছাড়ে নাবাপের স্নেহে অধিকার করিবার জন্য তাহাদের মা তাহাদিগকে অনুক্ষণ নিযুক্ত রাখিয়াছিলেনদুই মাতার মধ্যে আবার রেষারেষি ছিল, উভয়েরই চেষ্টা যাহাতে নিজের সন্তানই অধিক আদর পায়উভয়েই নিজ নিজ সন্তানদিগকে সর্বদাই উত্তেজিত করিতে লাগিল— দুই দলে মিলিয়া পিতার গলা জড়াইয়া ধরা, কোলে বসা, মুখচুম্বন করা প্রভৃতি প্রবল স্নেহব্যক্তিকার্যে পরস্পরকে জিতিবার চেষ্টা করিতে লাগিল

বলা বাহুল্য ফকির লোকটা অত্যন্ত নির্লিপ্তস্বভাব, নহিলে নিজের সন্তানদের অকাতরে ফেলিয়া আসিতে পারিত নাশিশুরা ভক্তি করিতে জানে না, তাহারা সাধুত্বের নিকট অভিভূত হইতে শিখে নাই, এইজন্য ফকির শিশুজাতির প্রতি তিলমাত্র অনুরক্ত ছিলেন না তাহাদিগকে তিনি কীট-পতঙ্গের ন্যায় দেহ হইতে দূরে রাখিতে ইচ্ছা করিতেনসম্প্রতি তিনি অহরহ শিশু-পঙ্গপালে আচ্ছন্ন হইয়া বর্জইস অক্ষরের ছোটো বড়ো নোটের দ্বারা আদ্যোপান্ত সমাকীর্ণ ঐতিহাসিক প্রবন্ধের ন্যায় শোভমান হইলেনতাহাদের মধ্যে বয়সের বিস্তর তারতম্য ছিল এবং তাহারা সকলেই কিছু তাঁহার সহিত বয়ঃপ্রাপ্ত সভ্যজনোচিত ব্যবহার করিত না ; শুদ্ধশুচি ফকিরের চক্ষে অনেক সময় অশ্রুর সঞ্চার হইত এবং তাহা আনন্দাশ্রু নহে

পরের ছেলেরা যখন নানা সুরে তাঁহাকে বাবা’ ‘বাবা করিয়া ডাকিয়া আদর করিত তখন তাঁহার সাংঘাতিক পাশব শক্তি প্রয়োগ করিবার একান্ত ইচ্ছা হইত, কিন্তু ভয়ে পারিতেন নামুখ চক্ষু বিকৃত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন
অবশেষে ফকির মহা চেঁচামেচি করিয়া বলিতে লাগিল, আমি যাবই, দেখি আমাকে কে আটক করিতে পারে
তখন গ্রামের লোক এক উকিল আনিয়া উপস্থিত করিলউকিল আসিয়া কহিল, জানেন আপনার দুই স্ত্রী?
ফকিরআজ্ঞে, এখানে এসে প্রথম জানলুম
উকিলআর, আপনার সাত মেয়ে, এক ছেলে, তার মধ্যে দুটি মেয়ে বিবাহযোগ্য
ফকিরআজ্ঞে, আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন, দেখতে পাচ্ছি
উকিলআপনার এই বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণের ভার আপনি যদি না নেন, তবে আপনার অনাথিনী দুই স্ত্রী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করবেন, পূর্বে হতে বলে রাখলুম

ফকির সব চেয়ে আদালতকে ভয় করিততাহার জানা ছিল, উকিলেরা জেরা করিবার সময় মহাপুরুষদিগের মানমর্যাদা গাম্ভীর্যকে খাতির করে না প্রকাশ্যে অপমান করে এবং খবরের কাগজে তাহার রিপোর্ট বাহির হয়ফকির অশ্রুসিক্তলোচনে উকিলকে বিস্তারিত আত্মপরিচয় দিতে চেষ্টা করিল; উকিল তাহার চাতুরীর, তাহার উপস্থিতবুদ্ধির, তাহার মিথ্যা গল্প রচনার অসাধারণ ক্ষমতার ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতে লাগিলশুনিয়া ফকিরের আপন হস্তপদ দংশন করিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল
ষষ্ঠীচরণ ফকিরকে পুনশ্চ পলায়নোদ্যত দেখিয়া শোকে অধীর হইয়া পড়িলপাড়ার লোকে তাহাকে চারি দিকে ঘিরিয়া অজস্র গালি দিল এবং উকিল তাহাকে এমন শাসাইল যে তাহার মুখে আর কথা রহিল না
ইহার উপর যখন আটজন বালক বালিকা গাঢ় স্নেহে তাহাকে চারি দিকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া তাহার শ্বাসরোধ করিবার উপক্রম করিল, তখন অন্তরালস্থিত হৈমবতী হাসিবে কি কাঁদিবে ভাবিয়া পাইল না

ফকির অন্য উপায় না দেখিয়া ইতিমধ্যে নিজের পিতাকে একখানা চিঠি লিখিয়া সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিয়াছিলসেই পত্র পাইয়া ফকিরের পিতা হরিচরণবাবু আসিয়া উপস্থিতপাড়ার লোক, জমিদার এবং উকিল কিছুতেই দখল ছাড়ে না

এ লোকটি যে ফকির নহে, মাখন, তাহারা তাহার সহস্র অকাট্য প্রমাণ প্রয়োগ করিল— এমন-কি, যে ধাত্রী মাখনকে মানুষ করিয়াছিল সেই বুড়িকে আনিয়া হাজির করিলসে কম্পিত হস্তে ফকিরের চিবুক তুলিয়া ধরিয়া মুখ নিরীক্ষণ করিয়া তাহার দাড়ির উপরে দরবিগলিত ধারায় অশ্রুপাত করিতে লাগিল

যখন দেখিল, তাহাতেও ফকির রাশ মানে না, তখন ঘোমটা টানিয়া দুই স্ত্রী আসিয়া উপস্থিত হইলপাড়ার লোকেরা শশব্যস্ত হইয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেলকেবল দুই বাপ, ফকির এবং শিশুরা ঘরে রহিল
দুই স্ত্রী হাত নাড়িয়া নাড়িয়া ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিল, কোন্ চুলোয়, যমের কোন্ দুয়োরে যাবার ইচ্ছে হয়েছে

ফকির তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, সুতরাং নিরুত্তর হইয়া রহিলকিন্তু, ভাবে যেরূপ প্রকাশ পাইল তাহাতে যমের কোনো বিশেষ দ্বারের প্রতি তাহার যে বিশেষ পক্ষপাত আছে এরূপ বোধ হইল না; আপাতত যে-কোনো একটা দ্বার পাইলেই সে বাঁচে, কেবল একবার বাহির হইতে পারিলেই হয়

তখন আর-একটি রমণীমূর্তি গৃহে প্রবেশ করিয়া ফকিরকে প্রণাম করিল
ফকির প্রথমে অবাক, তাহার পরে আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া বলিল, এ যে হৈমবতী!
নিজের অথবা পরের স্ত্রীকে দেখিয়া এত প্রেম তাহার চক্ষে ইতিপূর্বে কখনো প্রকাশ পায় নাইমনে হইল মূর্তিমতী মুক্তি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত

আর-একটি লোক মুখের উপর শাল মুড়ি দিয়া অন্তরাল হইতে দেখিতেছিলতাহার নাম মাখনলালএকটি অপরিচিত নিরীহ ব্যক্তিকে নিজপদে অভিষিক্ত দেখিয়া সে এতক্ষণ পরম সুখানুভব করিতেছিল; অবশেষে হৈমবতীকে উপস্থিত দেখিয়া বুঝিতে পারিল, উক্ত নিরপরাধ ব্যক্তি তাহার নিজের ভগ্নীপতি ; তখন দয়াপরতন্ত্র হইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, না, আপনার লোককে এমন বিপদে ফেলা মহাপাতকদুই স্ত্রীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিল, এ আমারই দড়ি, আমারই কলসী
মাখনলালের এই অসাধারণ মহত্ত্ব ও বীরত্বে পাড়ার লোক আশ্চর্য হইয়া গেল

চৈত্র ১২৯৮