ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
পাত্র ও পাত্রী
[সবুজপত্র পত্রিকার পৌষ
১৩২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
ইতিপূর্বে প্রজাপতি কখনো আমার কপালে বসেন নি বটে, কিন্তু একবার আমার মানসপদ্মে বসেছিলেন। তখন আমার বয়স ষোলো। তার পরে, কাঁচা ঘুমে চমক লাগিয়ে দিলে যেমন ঘুম আর আসতে চায় না, আমার সেই দশা হল। আমার বন্ধুবান্ধবরা কেউ কেউ দারপরিগ্রহ ব্যাপারে দ্বিতীয় এমন-কি, তৃতীয় পক্ষে প্রোমোশন পেলেন; আমি কৌমার্যের লাস্ট বেঞ্চিতে বসে শূন্য সংসারের কড়িকাঠ গণনা করে কাটিয়ে দিলুম।
আমি চোদ্দ বছর বয়সে এন্ট্রেন্স পাস করেছিলুম। তখন বিবাহ কিংবা এন্ট্রেন্স
পরীক্ষায় বয়সবিচার ছিল না। আমি কোনোদিন পড়ার বই গিলি নি, সেইজন্যে শারীরিক বা
মানসিক অজীর্ণ রোগে আমাকে ভুগতে হয় নি। ইঁদুর যেমন দাঁত বসাবার জিনিস পেলেই সেটাকে
কেটে-কুটে ফেলে, তা সেটা খাদ্যই হোক আর অখাদ্যই হোক, শিশুকাল থেকেই তেমনি ছাপার বই
দেখলেই সেটা পড়ে ফেলা আমার স্বভাব ছিল। সংসারে পড়ার বইয়ের চেয়ে না-পড়ার বইয়ের
সংখ্যা ঢের বেশি, এইজন্য আমার পুঁথির সৌরজগতে স্কুল-পাঠ্য পৃথিবীর চেয়ে
বেস্কুল-পাঠ্য সূর্য চোদ্দ লক্ষগুণে বড়ো ছিল। তবু, আমার সংস্কৃত-পণ্ডিতমশায়ের
নিদারুণ ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, আমি পরীক্ষায় পাস করেছিলুম।
আমার বাবা ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তখন আমরা ছিলেম সাতক্ষীরায় কিম্বা
জাহানাবাদে কিম্বা ঐরকম কোনো-একটা জায়গায়। গোড়াতেই ব’লে রাখা ভালো, দেশ কাল এবং
পাত্র সম্বন্ধে আমার এই ইতিহাসে যে-কোনো স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে তার সবগুলোই সুস্পষ্ট
মিথ্যা, যাঁদের রসবোধের চেয়ে কৌতূহল বেশি তাঁদের ঠকতে হবে। বাবা তখন তদন্তে
বেরিয়েছিলেন। মায়ের ছিল কী একটা ব্রত; দক্ষিণা এবং ভোজনব্যবস্থার জন্য ব্রাহ্মণ
তাঁর দরকার। এইরকম পারমার্থিক প্রয়োজনে আমাদের পণ্ডিতমশায় ছিলেন মায়ের প্রধান সহায়।
এইজন্য মা তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন, যদিচ বাবার মনের ভাব ছিল ঠিক তার উলটো।
আজ আহারান্তে দানদক্ষিণার যে ব্যবস্থা হল তার মধ্যে আমিও তালিকাভুক্ত হলুম। সে
পক্ষে যে-আলোচনা হয়েছিল তার মর্মটা এই— আমার তো কলকাতায় কলেজ যাবার সময় হল। এমন
অবস্থায় পুত্রবিচ্ছেদদুঃখ দূর করবার জন্যে একটা সদুপায় অবলম্বন করা কর্তব্য। যদি
একটি শিশুবধূ মায়ের কোলের কাছে থাকে তবে তাকে মানুষ করে, যত্ন করে তাঁর দিন কাটতে
পারে। পণ্ডিতমশায়ের মেয়ে কাশীশ্বরী এই কাজের পক্ষে উপযুক্ত— কারণ, সে শিশুও বটে,
সুশীলাও বটে, আর কুলশাসেত্রর গণিতে তার সঙ্গে আমার অঙ্কে অঙ্কে মিল। তা ছাড়া
ব্রাহ্মণের কন্যাদায়মোচনের পারমার্থিক ফলও লোভের সামগ্রী।
মায়ের মন বিচলিত হল। মেয়েটিকে একবার দেখা কর্তব্য এমন আভাস দেবামাত্র পণ্ডিতমশায়
বললেন, তাঁর ‘পরিবার’ কাল রাত্রেই মেয়েটিকে নিয়ে বাসায় এসে পৌঁচেছেন। মায়ের পছন্দ
হতে দেরী হল না; কেননা, রুচির সঙ্গে পুণ্যের বাটখারার যোগ হওয়াতে সহজেই ওজন ভারী
হল। মা বললেন, মেয়েটি সুলক্ষণা— অর্থাৎ, যথেষ্টপরিমাণ সুন্দরী না হলেও সান্ত্বনার
কারণ আছে।
কথাটা পরম্পরায় আমার কানে উঠল। যে-পণ্ডিতমশায়ের ধাতুরূপকে বরাবর ভয় করে এসেছি তাঁরই
কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহের সম্বন্ধ— এরই বিসদৃশতা আমার মনকে প্রথমেই প্রবল বেগে
আকর্ষণ করলে। রূপকথার গল্পের মতো হঠাৎ সুবন্তপ্রকরণ যেন তার সমস্ত অনুস্বার বিসর্গ
ঝেড়ে ফেলে একবারে রাজকন্যা হয়ে উঠল।
একদিন বিকেলে মা তাঁর ঘরে আমাকে ডাকিয়ে বললেন, “সনু,পণ্ডিতমশায়ের বাসা থেকে আম আর
মিষ্টি এসেছে, খেয়ে দেখ্।”
মা জানতেন,
আমাকে পঁচিশটা আম খেতে দিলে আর-পঁচিশটার দ্বারা তার পাদপূরণ করলে তবে আমার ছন্দ
মেলে। তাই তিনি রসনার সরস পথ দিয়ে আমার হৃদয়কে আহ্বান করলেন। কাশীশ্বরী তাঁর কোলে
বসেছিল। সমৃতি অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, কিন্তু মনে আছে— রাংতা দিয়ে তার খোঁপা
মোড়া, আর গায়ে কলকাতার দোকানের এক সাটিনের জ্যাকেট— সেটা নীল এবং লাল এবং লেস্ এবং
ফিতের একটা প্রত্যক্ষ প্রলাপ। যতটা মনে পড়ছে— রঙ শাম্লা; ভুরু-জোড়া খুব ঘন; এবং
চোখদুটো পোষা প্রাণীর মতো, বিনা সংকোচে তাকিয়ে আছে। মুখের বাকি অংশ কিছুই মনে পড়ে
না— বোধ হয় বিধাতার কারখানায় তার গড়ন তখনো সারা হয় নি, কেবল একমেটে করে রাখা হয়েছে।
আর যাই হোক, তাকে দেখতে নেহাত ভালোমানুষের মতো।
আমার বুকের ভিতরটা ফুলে উঠল। মনে মনে বুঝলুম, ঐ রাংতা-জড়ানো বেণীওয়ালা জ্যাকেট-মোড়া
সামগ্রীটি ষোলো-আনা আমার— আমি ওর প্রভু, আমি ওর দেবতা। অন্য সমস্ত দুর্লভ সামগ্রীর
জন্যেই সাধনা করতে হয়, কেবল এই একটি জিনিসের জন্য নয়; আমি কড়ে আঙুল নড়ালেই হয়;
বিধাতা এই বর দেবার জন্যে আমাকে সেধে বেড়াচ্ছেন। মা’কে যে আমি বরাবর দেখে আসছি,
স্ত্রী বলতে কী বোঝায় তা আমার ঐ সূত্রে জানা ছিল। দেখেছি, বাবা অন্য সমস্ত ব্রতের
উপর চটা ছিলেন কিন্তু সাবিত্রীব্রতের বেলায় তিনি মুখে যাই বলুন, মনে মনে বেশ একটু
আনন্দ বোধ করতেন। মা তাঁকে ভালোবাসতেন তা জানি, কিন্তু কিসে বাবা রাগ করবেন, কিসে
তাঁর বিরক্তি হবে, এইটেকে মা যে একান্ত মনে ভয় করতেন, এরই রসটুকু বাবা তাঁর সমস্ত
পৌরুষ দিয়ে সব চেয়ে উপভোগ করতেন। পূজাতে দেবতার বোধ হয় বড়ো-একটা-কিছু আসে যায় না,
কেননা সেটা তাঁদের বৈধ বরাদ্দ। কিন্তু মানুষের নাকি ওটা অবৈধ পাওনা, এইজন্যে ঐটের
লোভে তাদের অসামাল করে। সেই বালিকার রূপগুণের টান সেদিন আমার উপরে পৌঁছয় নি, কিন্তু
আমি যে পূজনীয় সে কথাটা সেই চোদ্দ বছর বয়সে আমার পুরুষের রক্তে গাঁজিয়ে উঠল। সেদিন
খুব গৌরবের সঙ্গেই আমগুলো খেলুম, এমন-কি, সগর্বে তিনটে আম পাতে বাকি রাখলুম,যা আমার
জীবনে কখনো ঘটে নি; এবং তার জন্যে সমস্ত অপরাহ্নকালটা অনুশোচনায় গেল।
সেদিন কাশীশ্বরী খবর পায় নি আমার সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কোন্ শ্রেণীর— কিন্তু বাড়ি
গিয়েই বোধ হয় জানতে পেরেছিল। তার পরে যখনই তার সঙ্গে দেখা হত সে শশব্যস্ত হয়ে
লুকোবার জায়গা পেত না। আমাকে দেখে তার এই ত্রস্ততা আমার দেখে খুব ভালো লাগত। আমার
আবির্ভাব বিশ্বের কোনো-একটা জায়গায় কোনো-একটা আকারে খুব একটা প্রবল প্রভাব সঞ্চার
করে, এই জৈব-রাসায়নিক তথ্যটা আমার কাছে বড়ো মনোরম ছিল। আমাকে দেখেও যে কেউ ভয় করে
বা লজ্জা করে, বা কোনো একটা-কিছু করে, সেটা বড়ো অপূর্ব। কাশীশ্বরী তার পালানোর
দ্বারাই আমাকে জানিয়ে যেত, জগতের মধ্যে সে বিশেষভাবে সম্পূর্ণভাবে এবং নিগূঢ়ভাবে
আমারই ।
এতকালের অকিঞ্চিৎকরতা থেকে হঠাৎ এক মুহূর্তে এমন একান্ত গৌরবের পদ লাভ করে কিছুদিন
আমার মাথার মধ্যে রক্ত ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। বাবা যেরকম মাকে কর্তব্যের বা রন্ধনের বা
ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে সর্বদা ব্যাকুল করে তুলেছেন, আমিও মনে মনে তারই ছবির উপরে
দাগা বুলোতে লাগলুম। বাবার অনভিপ্রেত কোনো-একটা লক্ষ্য সাধন করবার সময় মা যেরকম
সাবধানে নানাপ্রকার মনোহর কৌশলে কাজ উদ্ধার করতেন, আমি কল্পনার কাশীশ্বরীকেও সেই
পথে প্রবৃত্ত হতে দেখলুম। মাঝে মাঝে মনে মনে তাকে অকাতরে এবং অকস্মাৎ মোটা অঙ্কের
ব্যাঙ্ক্নোট থেকে আরম্ভ ক’রে হীরের গয়না পর্যন্ত দান করতে আরম্ভ করলুম। এক-একদিন
ভাত খেতে বসে তার খাওয়াই হল না এবং জানলার ধারে বসে আঁচলের খুঁট দিয়ে সে চোখের জল
মুচছে, এই করুণ দৃশ্যও আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলুম এবং এটা যে আমার কাছে অত্যন্ত
শোচনীয় বোধ হল তা বলতে পারি নে। ছোটো ছেলেদের আত্মনির্ভরতার সম্বন্ধে বাবা অত্যন্ত
বেশি সতর্ক ছিলেন। নিজের ঘর ঠিক করা, নিজের কাপড়চোপড় রাখা সমস্তই আমাকে নিজের হাতে
করত হত। কিন্তু আমার মনের মধ্যে গার্হস্থ্যের যে-চিত্রগুলি স্পষ্ট রেখায় জেগে উঠল,
তার মধ্যে একটি নীচে লিখে রাখছি। বলা বাহুল্য, আমার পৈতৃক ইতিহাসে ঠিক এইরকম ঘটনাই
পূর্বে একদিন ঘটেছিল; এই কল্পনার মধ্যে আমার ওরিজিন্যালিটি কিছুই নেই। চিত্রটি এই—
রবিবারে মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি খাটের উপর বালিশে ঠেসান দিয়ে পা-ছড়িয়ে আধ-শোওয়া
অবস্থার খবরের কাগজ পড়ছি। হাতে গুড়গুড়ির নল। ঈষৎ তন্দ্রাবেশে নলটা নীচে পড়ে গেল।
বারান্দায় বসে কাশীশ্বরী ধোবাকে কাপড় দিচ্ছিল, আমি তাকে ডাক দিলুম; সে তাড়াতাড়ি
ছুটে এসে আমার হাতে তুলে দিলে। আমি তাকে বললুম, ‘দেখো, আমার বসবার ঘরের বাঁদিকের
আলমারির তিনের থাকে একটা নীল রঙের মলাট-দেওয়া মোটা ইংরাজি বই আছে, সেইটে নিয়ে এসো
তো।’ কাশী একটা নীল রঙের বই এনে দিলে; আমি বললুম, ‘আঃ, এটা নয়; সে এর চেয়ে মোটা, আর
তার পিঠের দিকে সোনালি অক্ষরে নাম লেখা।’ এবারে সে একটা সবুজ রঙের বই আনলে— সেটা
আমি ধপাস্ করে মেঝের উপর ফেলে দিয়ে রেগে উঠে পড়লুম। তখন কাশীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল
এবং তার চোখ ছল্ছল্ করে উঠল। আমি গিয়ে দেখলুম, তিনের শেল্ফে বইটা নেই, সেটা আছে
পাঁচের শেল্ফে। বইটা হাতে করে নিয়ে এসে নিঃশব্দে বিছানায় শুলুম
কিন্তু কাশীকে ভুলের কথা কিছু বললুম না। সে মাথা হেঁট করে বিমর্ষ হয়ে ধোবাকে কাপড়
দিতে লাগল এবং নির্বুদ্ধিতার দোষে স্বামীর বিশ্রামে ব্যাঘাত করেছে, এই অপরাধ
কিছুতেই ভুলতে পারলে না।
বাবা ডাকাতি তদন্ত করছেন, আর আমার এইভাবে দিন যাচ্ছে। এ দিকে আমার সম্বন্ধে
পণ্ডিতমশায়ের ব্যবহার আর ভাষা এক মুহূর্তে কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে এসে পৌঁছল এবং
সেটা নিরতিশয় সদ্ভাববাচ্য।
এমন সময় ডাকাতি তদন্ত শেষ হয়ে গেল, বাবা ঘরে ফিরে এলেন। আমি জানি, মা আস্তে আস্তে
সময় নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাবার বিশেষ প্রিয় তরকারি-রান্নার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু
করে সইয়ে সইয়ে কথাটাকে পাড়বেন বলে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। বাবা পণ্ডিতমশায়কে অর্থলুব্ধ
বলে ঘৃণা করতেন; মা নিশ্চয়ই প্রথমে পণ্ডিতমশায়ের মৃদুরকম নিন্দা অথচ তাঁর স্ত্রী ও
কন্যার প্রচুর রকমের প্রশংসা করে কথাটার গোড়াপত্তন করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে
পণ্ডিতমশায়ের আনন্দিত প্রগল্ভতায় কথাটা চারি দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিবাহ যে পাকা,
দিনক্ষণ দেখা চলছে, এ কথা তিনি কাউকে জানাতে বাকি রাখেন নি। এমন-কি, বিবাহকালে
সেরেস্তাদার বাবুর পাকা দালানটি কয়দিনের জন্যে তাঁর প্রয়োজন হবে, যথাস্থানে সে
আলোচনাও তিনি সেরে রেখেছেন। শুভকর্মে সকলেই তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে সম্মত
হয়েছে। বাবার আদালতের উকিলের দল চাঁদা করে বিবাহের ব্যয় বহন করতেও রাজি। স্থানীয়
এন্ট্রেন্স-স্কুলের সেক্রেটারি বীরেশ্বরবাবুর তৃতীয় ছেলে তৃতীয় ক্লাসে পড়ে, সে
চাঁদ ও কুমুদের রূপক অবলম্বন করে এরই মধ্যে বিবাহসম্বন্ধে ত্রিপদীছন্দে একটা কবিতা
লিখেছে। সেক্রেটারিবাবু সেই কবিতাটা নিয়ে রাস্তায় ঘাটে যাকে পেয়েছেন তাকে ধরে ধরে
শুনিয়েছেন। ছেলেটির সম্বন্ধে গ্রামের লোক খুব আশান্বিত হয়ে উঠেছে।
সুতরাং ফিরে এসেই বাইরে থেকেই বাবা শুভসংবাদ শুনতে পেলেন। তার পরে মায়ের কান্না এবং
অনাহার, বাড়ির সকলের ভীতিবিহ্বলতা, চাকরদের অকারণ জরিমানা, এজ্লাসে প্রবলবেগে
মামলা ডিস্মিস্ এবং প্রচণ্ড তেজে শাস্তিদান, পণ্ডিতমশায়ের পদচ্যুতি এবং
রাংতা-জড়ানো বেণী-সহ কাশীশ্বরীকে নিয়ে তাঁর অন্তর্ধান; এবং ছুটি ফুরোবার পূর্বেই
মাতৃসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে সবলে কলকাতায় নির্বাসন। আমার মনটা ফাটা ফুটবলের
মতো চুপসে গেল— আকাশে আকাশে, হাওয়ার উপরে তার লাফালাফি একেবারে বন্ধ হল।
২
আমার পরিণয়ের পথে গোড়াতেই এই বিঘ্ন— তার পরে আমার প্রতি বারেবারেই প্রজাপতির
ব্যর্থ-পক্ষপাত ঘটেছে। তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে ইচ্ছা করি নে— আমার এই বিফলতার
ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত নোট দুটো-একটা রেখে যাব। বিশ বছর বয়সের পূর্বেই আমি পুরা দমে
এম. এ. পরীক্ষা পাস করে চোখে চশমা পরে এবং গোঁফের রেখাটাকে তা দেবার যোগ্য করে
বেরিয়ে এসেছি। বাবা তখন রামপুরহাট কিম্বা নোয়াখালি কিংবা বারাসাত কিম্বা ঐরকম
কোনো-একটা জায়গায়। এতদিন তো শব্দসাগর মন্থন করে ডিগ্রিরত্ন পাওয়া গেল, এবার
অর্থসাগর-মন্থনের পালা। বাবা তাঁর বড়ো বড়ো পেট্রন সাহেবদের স্মরণ করতে গিয়ে দেখলেন,
তাঁর সব চেয়ে বড়ো সহায় যিনি তিনি পরলোকে, তাঁর চেয়ে যিনি কিছু কম তিনি পেনশন নিয়ে
বিলেতে, যিনি আরো কমজোরী তিনি পাঞ্জাবে বদলি হয়েছেন, আর যিনি বাংলাদেশে বাকি আছেন
তিনি অধিকাংশ উমেদারকেই উপক্রমণিকায় আশ্বাস দেন কিন্তু উপসংহারে সেটা সংহরণ করেন।
আমার পিতামহ যখন ডেপুটি ছিলেন তখন মুরুব্বির বাজার এমন কষা ছিল না তাই তখন চাকরি
থেকে পেনশন এবং পেনশন থেকে চাকরি একই বংশে খেয়া-পারাপারের মতো চলত। এখন দিন খারাপ,
তাই বাবা যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছিলেন যে, তাঁর বংশধর গভর্মেণ্ট আপিসের উচ্চ খাঁচা
থেকে সওদাগিরি আপিসের নিম্ন দাঁড়ে অবতরণ করবে কি না, এমন সময় এক ধনী ব্রাহ্মণের
একমাত্র কন্যা তাঁর নোটিশে এল। ব্রাহ্মণটি কন্ট্র্যাক্টর, তাঁর অর্থাগমের পথটি
প্রকাশ্য ভূতলের চেয়ে অদৃশ্য রসাতলের দিক দিয়েই প্রশস্ত ছিল। তিনি সে সময়ে বড়োদিন
উপলক্ষে কমলা লেবু ও অন্যান্য উপহারসামগ্রী যথাযোগ্য পাত্রে বিতরণ করতে ব্যস্ত
ছিলেন, এমন সময়ে তাঁর পাড়ায় আমার অভ্যুদয় হল। বাবার বাসা ছিল তাঁর বাড়ির সামনেই,
মাঝে ছিল এক রাস্তা। বলা বাহুল্য, ডেপুটির এম. এ. পাস-করা ছেলে কন্যাদায়িকের পক্ষে
খুব ‘প্রাংশুলভ্য ফল’। এইজন্যে কন্ট্র্যাক্টর বাবু আমার প্রতি ‘উদ্বাহু’ হয়ে
উঠেছিলেন। তাঁর বাহু আধূলিলম্বিত ছিল সে পরিচয় পূর্বেই দিয়েছি— অন্তত সে বাহু
ডেপুটিবাবুর হৃদয় পর্যন্ত অতি অনায়াসে পৌঁছল। কিন্তু, আমার হৃদয়টা তখন আরো অনেক
উপরে ছিল।
কারণ, আমার বয়স তখন কুড়ি পেরোয়-পেরোয়; তখন খাঁটি স্ত্রীরত্ন ছাড়া অন্য কোনো রত্নের
প্রতি আমার লোভ ছিল না। শুধু তাই নয়, তখনো ভাবুকতার দীপ্তি আমার মনে উজ্জ্বল।
অর্থাৎ, সহধর্মিণী শব্দের যে-অর্থ আমার মনে ছিল সে-অর্থটা বাজারে চলতি ছিল না।
বর্তমান কালে আমাদের দেশে সংসারটা চার দিকেই সংকুচিত; মননসাধনের বেলায় মনকে জ্ঞান ও
ভাবের উদার ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত করে রাখা আর ব্যবহারের বেলায় তাকে সেই সংসারের অতি
ছোটো মাপে কৃশ করে আনা, এ আমি মনে মনেও সহ্য করতে পারতুম না। যে-স্ত্রীকে আইডিয়ালের
পথে সঙ্গিনী করতে চাই সেই স্ত্রী ঘরকন্নার গারদে পায়ের বেড়ি হয়ে থাকবে এবং প্রত্যেক
চলাফেরায় ঝংকার দিয়ে পিছনে টেনে রাখবে, এমন দুর্গ্রহ আমি স্বীকার করে নিতে নারাজ
ছিলুম। আসল কথা, আমাদের দেশের প্রহসনে যাদের আধুনিক ব’লে বিদ্রূপ করে কলেজ থেকে
টাটকা বেরিয়ে আমি সেইরকম নিরবচ্ছিন্ন আধুনিক হয়ে উঠেছিলুম। আমাদের কালে সেই
আধুনিকের দল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আশ্চর্য এই যে, তারা সত্যই বিশ্বাস করত যে,
সমাজকে মেনে চলাই দুর্গতি এবং তাকে টেনে চলাই উন্নতি।
এ-হেন আমি শ্রীযুক্ত সনৎকুমার, একটি ধনশালী কন্যাদায়িকের টাকার থলির হাঁ-করা মুখের
সামনে এসে পড়লুম। বাবা বললেন, শুভস্য শীঘ্রং। আমি চুপ করে রইলুম; মনে মনে ভাবলুম,
একটু দেখে-শুনে বুঝে-পড়ে নিই। চোখ কান খুলে রাখলুম— কিছু পরিমাণ দেখা এবং অনেকটা
পরিমাণ শোনা গেল। মেয়েটি পুতুলের মতো ছোটো এবং সুন্দর— সে যে স্বভাবের নিয়মে তৈরি
হয়েছে তা তাকে দেখে মনে হয় না— কে যেন তার প্রত্যেক চুলটি পাট ক’রে, তার ভুরুটি
এঁকে, তাকে হাতে করে গড়ে তুলেছে। সে সংস্কৃতভাষায় গঙ্গার স্তব আবৃত্তি করে পড়তে
পারে। তার মা পাথুরে কয়লা পর্যন্ত গঙ্গার জলে ধুয়ে তবে রাঁধেন; জীবধাত্রী বসুন্ধরা
নানা জাতিকে ধারণ করেন বলে পৃথিবীর সংস্পর্শ সম্বন্ধে তিনি সর্বদাই সংকুচিত; তাঁর
অধিকাংশ ব্যবহার জলেরই সঙ্গে, কারণ জলচর মৎস্যরা মুসলমান-বংশীয় নয় এবং জলে পেঁয়াজ
উৎপন্ন হয় না। তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান কাজ আপনার দেহকে গৃহকে কাপড়চোপড় হাঁড়িকুঁড়ি
খাটপালঙ বাসনকোসনকে শোধন এবং মার্জন করা। তাঁর সমস্ত কৃত্য সমাপন করতে বেলা আড়াইটে
হয়ে যায়। তাঁর মেয়েটিকে তিনি স্বহস্তে সর্বাংশে এমনি পরিশুদ্ধ করে তুলেছেন যে, তার
নিজের মত বা নিজের ইচ্ছা বলে কোনো উৎপাত ছিল না। কোনো ব্যবস্থায় যত অসুবিধাই হোক,
সেটা পালন করা তার পক্ষে সহজ হয় যদি তার কোনো সংগত কারণ তাকে বুঝিয়ে না দেওয়া যায়।
সে খাবার সময় ভালো কাপড় পরে না পাছে সকড়ি হয়; সে ছায়া সম্বন্ধেও বিচার করিতে
শিখেছে। সে যেমন পালকির ভিতরে বসেই গঙ্গাসনান করে, তেমনি অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে
আবৃত থেকে সংসারে চলে ফেরে। বিধি-বিধানের ’পরে আমারও মায়ের যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল
কিন্তু তাঁর চেয়ে আরো বেশি শ্রদ্ধা যে আর-কারো থাকবে এবং তাই নিয়ে সে মনে মনে গুমর
করবে, এটা তিনি সইতে পারতেন না। এইজন্যে আমি যখন তাঁকে বললুম “মা, এ মেয়ের
যোগ্যপাত্র আমি নই” , তিনি হেসে বললেন, “না, কলিযুগে তেমন পাত্র মেলা ভার! ”
আমি বললুম, “তা
হলে আমি বিদায় নিই।”
মা বললেন, “সে কি সুনু, তোর পছন্দ হল না? কেন, মেয়েটিকে তো দেখতে ভালো।”
আমি বললুম, “মা, স্ত্রী তো কেবল চেয়ে চেয়ে দেখবার জন্যে নয়, তার বুদ্ধি থাকাও চাই।”
মা বললেন, “শোনো একবার। এরই মধ্যে তুই তার কম বুদ্ধির পরিচয় কী পেলি।”
আমি বললুম, “বুদ্ধি থাকলে মানুষ দিনরাত এই-সব অনর্থক অকাজের মধ্যে বাঁচতেই পারে না।
হাঁপিয়ে মরে যায়।”
মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি জানেন, এই বিবাহ সম্বন্ধে বাবা অপর পক্ষে প্রায় পাকা
কথা দিয়েছেন। তিনি আরো জানেন যে, বাবা এটা প্রায়ই ভুলে যান যে, অন্য মানুষেরও ইচ্ছে
বলে একটা বালাই থাকতে পারে। বস্তুত, বাবা যদি অত্যন্ত বেশি রাগারাগি জবরদস্তি না
করতেন তা হলে হয়তো কালক্রমে ঐ পৌরাণিক পুতুলকে বিবাহ করে আমিও একদিন প্রবল রোখে
স্নান আহ্নিক এবং ব্রত-উপবাস করতে করতে গঙ্গাতীরে সদ্গতি লাভ করতে পারতুম। অর্থাৎ,
মায়ের উপর যদি এই বিবাহ দেবার ভার থাকত তা হলে তিনি সময় নিয়ে, অতি ধীর মন্দ সুযোগে
ক্ষণে ক্ষণে কানে মন্ত্র দিয়ে, ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুপাত করে কাজ উদ্ধার করে নিতে
পারতেন। বাবা যখন কেবলই তর্জন গর্জন করতে লাগলেন আমি তাঁকে মরিয়া হয়ে বললুম,
‘ছেলেবেলা থেকে খেতে-শুতে চলতে-ফিরতে আমাকে আত্মনির্ভরতার উপদেশ দিয়েছেন, কেবল
বিবাহের বেলাতেই কি আত্মনির্ভর চলবে না।’ কলেজে লজিকে পাস করবার বেলায় ছাড়া
ন্যায়শাস্ত্রের জোরে কেউ কোনোদিন সফলতা লাভ করেছে, এ আমি দেখি নি। সংগত যুক্তি
কুতর্কের আগুনে কখনো জলের মতো কাজ করে না, বরঞ্চ তেলের মতোই কাজ করে থাকে। বাবা
ভেবে রেখেছেন তিনি অন্য পক্ষকে কথা দিয়েছেন, বিবাহের ঔচিত্য সম্বন্ধে এর চেয়ে বড়ো
প্রমাণ আর কিছুই নেই। অথচ আমি যদি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতুম যে, পণ্ডিতমশায়কে মাও
একদিন কথা দিয়েছিলেন তবু সে কথায় শুধু যে আমার বিবাহ ফেঁসে গেল তা নয়, পণ্ডিতমশায়ের
জীবিকাও তার সঙ্গে সহমরণে গেল— তা হলে এই উপলক্ষে একটা ফৌজদারি বাধত। বুদ্ধি বিচার
এবং রুচির চেয়ে শুচিতা মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম যে ঢের ভালো, তার কবিত্ব যে সুগভীর
ও সুন্দর, তার নিষ্ঠা যে অতি মহৎ, তার ফল যে অতি উত্তম, সিম্বলিজ্ম্টাই যে
আইডিয়ালিজ্ম্, এ কথা বাবা আজকাল আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সময়ে অসময়ে আলোচনা করেছেন।
আমি রসনাকে থামিয়ে রেখেছি কিন্তু মনকে তো চুপ করিয়ে রাখতে পারি নি। যে-কথাটা মুখের
আগার কাছে এসে ফিরে যেত সেটা হচ্ছে এই যে, ‘এ-সব যদি আপনি মানেন তবে পালবার বেলায়
মুরগি পালেন কেন।’ আরো একটা কথা মনে আসত; বাবাই একদিন দিনক্ষণ পালপার্বণ বিধিনিষেধ
দানদক্ষিণা নিয়ে তাঁর অসুবিধা বা ক্ষতি ঘটলে মাকে কঠোর ভাষায় এ-সব অনুষ্ঠানের
পণ্ডতা নিয়ে তাড়না করেছেন। মা তখন দীনতা স্বীকার করে অবলাজাতি স্বভাবতই অবুঝ বলে
মাথা হেঁটে করে বিরক্তির ধাক্কাটা কাটিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণভোজনের বিস্তারিত আয়োজনে
প্রবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকর্মা লজিকের পাকা ছাঁচে ঢালাই করে জীব সৃজন করেন নি।
অতএব কোনো মানুষের কথায় বা কাজে সংগতি নেই এ কথা বলে তাকে বাগিয়ে নেওয়া যায় না,
রাগিয়ে দেওয়া হয় মাত্র। ন্যায়শাস্ত্রের দোহাই পাড়লে অন্যায়ের প্রচণ্ডতা বেড়ে ওঠে—
যারা পোলিটিকাল বা গার্হসথ্য অ্যাজিটেশনে শ্রদ্ধাবান তাদের এ কথাটা মনে রাখা উচিত।
ঘোড়া যখন তার পিছনের গাড়িটাকে অন্যায় মনে করে তার উপরে লাথি চালায় তখন অন্যায়টা তো
থেকেই যায়, মাঝের থেকে তার পাকেও জখম করে। যৌবনের আবেগে অল্প একটুখানি তর্ক করতে
গিয়ে আমার সেই দশা হল। পৌরাণিকী মেয়েটির হাত রক্ষা পাওয়া গেল বটে, কিন্তু বাবার
আধুনিক যুগের তহবিলের আশ্রয়ও খোওয়ালুম। বাবা বললেন, “যাও, তুমি আত্মনির্ভর করো গে।”
আমি প্রণাম করে বললুম, “যে আজ্ঞে।”
মা বসে বসে কাঁদতে লাগলেন।
বাবার দক্ষিণ হস্ত বিমুখ হল বটে কিন্তু মাঝখানে মা থাকাতে ক্ষণে ক্ষণে
মানি-অর্ডারের পেয়াদার দেখা পাওয়া যেত। মেঘ বর্ষণ বন্ধ করে দিলে, কিন্তু গোপনে
স্নিগ্ধ রাত্রে শিশিরের অভিষেক চলতে লাগল। তারই জোরে ব্যাবসা শুরু করে দিলুম। ঠিক
ঊনআশি টাকা দিয়ে গোড়াপত্তন হল; আজ সেই কারবারে যে-মূলধন খাটছে তা ঈর্ষাকাতর
জনশ্রুতির চেয়ে অনেক কম হলেও, বিশ লক্ষ টাকার চেয়ে কম নয়।
প্রজাপতির পেয়াদারা আমার পিছন পিছন ফিরতে লাগল। আগে যে-সব দ্বার বন্ধ ছিল এখন তার
আর আগল রইল না। মনে আছে, একদিন যৌবনের দুর্নিবার দুরাশায় একটি ষোড়শীর প্রতি (বয়সের
অঙ্কটা এখনকার নিষ্ঠাবান পাঠকদের ভয়ে কিছু সহনীয় করে বললুম) আমার হৃদয়কে উন্মুখ
করেছিলুম কিন্তু খবর পেয়েছিলুম, কন্যার মাতৃপক্ষ লক্ষ্য করে আছেন সিবিলিয়ানের
প্রতি— অন্তত ব্যারিস্টারের নীচে তাঁর দৃষ্টি পৌঁছয় না। আমি তাঁর মনোযোগ-মীটরের
জিরো-পয়েণ্টের নীচে ছিলুম। কিন্তু, পরে সেই ঘরেই অন্য একদিন শুধু চা নয়, লাঞ্চ
খেয়েছি, রাত্রে ডিনারের পর মেয়েদের সঙ্গে হুটস্ট্ খেলেছি, তাদের মুখে বিলেতের
একেবারে খাস মহলের ইংরেজি ভাষার কথাবার্তা শুনেছি। আমার মুশকিল এই যে, র্যাসেলস,
ডেজার্টেড ভিলেজ এবং অ্যাডিসন্ স্টীল প’ড়ে আমি ইংরিজি পাকিয়েছি, এই মেয়েদের সঙ্গে
পাল্লা দেওয়া আমার কর্ম নয়। O
my, O dear O dear
প্রভৃতি উদ্ভাষণগুলো আমার মুখ দিয়ে ঠিক সুরে রেরোতেই চায় না। আমার যতটুকু বিদ্যা
তাতে আমি অত্যন্ত হাল ইংরেজি ভাষায় বড়োজোর হাটে-বাজারে কেনা-বেচা করতে পারি, কিন্তু
বিংশ শতাব্দীর ইংরেজিতে প্রেমালাপ করার কথা মনে করলে আমার প্রেমই দৌড় মারে। অথচ
এদের মুখে বাংলাভাষার যেরকম দুর্ভিক্ষ তাতে এদের সঙ্গে খাঁটি বঙ্কিমি সুরে মধুরালাপ
করতে গেলে ঠকতে হবে। তাতে মজুরি পোষাবে না। তা যাই হোক, এই-সব বিলিতি গিল্টি-করা
মেয়ে একদিন আমার পক্ষে সুলভ হয়েছিল। কিন্তু রুদ্ধ দরজার ফাঁকের থেকে যে মায়াপুরী
দেখেছিলুম দরজা যখন খুলল তখন আর তার ঠিকানা পেলুম না। তখন আমার কেবল মনে হতে লাগল,
সেই যে আমার ব্রতচারিণী নিরর্থক নিয়মের নিরন্তর পুনরাবৃত্তির পাকে অহোরাত্র ঘুরে
ঘুরে আপনার জড়বুদ্ধিকে তৃপ্ত করত, এই মেয়েরাও ঠিক সেই বুদ্ধি নিয়েই বিলিতি চালচলন
আদবকায়দার সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপসর্গগুলিকে প্রদক্ষিণ করে দিনের পর দিন, বৎসরের পর
বৎসর, অনায়াসে অক্লান্তচিত্তে কাটিয়ে দিচ্ছে। তারাও যেমন ছোঁয়া ও নাওয়ার লেশমাত্র
স্খলন দেখলে অশ্রদ্ধায় কণ্টকিত হয়ে উঠত, এরাও তেমনি এক্সেন্টের একটু খুঁত কিম্বা
কাঁটা-চাম্চের অল্প বিপর্যয় দেখলে ঠিক তেমনি করেই অপরাধীর মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে
সন্দিহান হয়ে ওঠে। তারা দিশি পুতুল, এরা বিলিতি পুতুল। মনের গতিবেগে এরা চলে
না,অভ্যাসের দম-দেওয়া কলে এদের চালায়। ফল হল এই যে, মেয়েজাতের উপরেই আমার মনে মনে
অশ্রদ্ধা জন্মাল; আমি ঠিক করলুম, ওদের বুদ্ধি যখন কম তখন স্নান-আচমন-উপবাসের
অকর্ম-কাণ্ড প্রকাণ্ড না হলে ওরা বাঁচে কী করে। বইয়ে পড়েছি, একরকম জীবাণু আছে সে
ক্রমাগতই ঘোরে। কিন্তু, মানুষ ঘোরে না, মানুষ চলে। সেই জীবাণুর পরিবর্ধিত সংস্করণের
সঙ্গেই কি বিধাতা হতভাগ্য পুরুষমানুষের বিবাহের সম্বন্ধ পাতিয়েছেন।
এ দিকে বয়স যত বাড়তে চলল বিবাহ সম্বন্ধে দ্বিধাও তত বেড়ে উঠল। মানুষের একটা বয়স আছে
যখন সে চিন্তা না করেও বিবাহ করতে পারে। সে বয়সে পেরোলে বিবাহ করতে দুঃসাহসিকতার
দরকার হয়। আমি সেই বেপরোয়া দলের লোক নই। তা ছাড়া কোনো প্রকৃতিস্থ মেয়ে বিনা কারণে
এক নিশ্বাসে আমাকে কেন যে বিয়ে করে ফেলবে আমি তা কিছুতেই ভেবে পাই নে। শুনেছি,
ভালোবাসা অন্ধ, কিন্তু এখানে সেই অন্ধের উপর তো কোনো ভার নেই। সংসারবুদ্ধির দুটো
চোখের চেয়ে আরো বেশি চোখ আছে— সেই চক্ষু যখন বিনা নেশায় আমার দিকে তাকিয়ে দেখে তখন
আমার মধ্যে কী দেখতে পায় আমি তাই ভাবি। আমার গুণ নিশ্চয়ই অনেক আছে, কিন্তু সেগুলো
তো ধরা পড়তে দেরি লাগে, এক চাহনিতেই বোঝা যায় না। আমার নাসার মধ্যে যে খর্বতা আছে
বুদ্ধির উন্নতি তা পূরণ করেছে জানি, কিন্তু নাসাটাই থাকে প্রত্যক্ষ হয়ে, আর ভগবান
বুদ্ধিকে নিরাকার করে রেখে দিলেন। যাই হোক, যখন দেখি, কোনো সাবালক মেয়ে অত্যল্প
কালের নোটিশেই আমাকে বিয়ে করতে অত্যল্পমাত্র আপত্তি করে না, তখন মেয়েদের প্রতি আমার
শ্রদ্ধা আরো কমে। আমি যদি মেয়ে হতুম তা হলে শ্রীযুৎ সনৎকুমারের নিজের খর্ব নাসার
দীর্ঘনিশ্বাসে তার আশা এবং অহংকার ধূলিসাৎ হতে থাকত।
এমনি করে আমার বিবাহের বোঝাই-হীন নৌকাটা মাঝে মাঝে চড়ায় ঠেকেছে কিন্তু ঘাটে এসে
পৌঁছয় নি। স্ত্রী ছাড়া সংসারের অন্যান্য উপকরণ ব্যাবসার উন্নতির সঙ্গে বেড়ে চলতে
লাগল। একটা কথা ভুলে ছিলুম, বয়সও বাড়ছে। হঠাৎ একটা ঘটনায় সে কথা মনে করিয়ে দিলে।
অভ্রের খনির তদন্তে ছোটোনাগপুরের এক শহরে গিয়ে দেখি, পণ্ডিতমশায় সেখানে শালবনের
ছায়ায় ছোট্ট একটি নদীর ধারে দিব্যি বাসা বেঁধে বসে আছেন। তাঁর ছেলে সেখানে কাজ করে।
সেই শালবনের প্রান্তে আমার তাঁবু পড়েছিল। এখন দেশ জুড়ে আমার ধনের খ্যাতি।
পণ্ডিতমশায় বললেন, কালে আমি যে অসামান্য হয়ে উঠব, এ তিনি পূর্বেই জানতেন। তা হবে,
কিন্তু আশ্চর্যরকম গোপন করে রেখেছিলেন। তা ছাড়া কোন্ লক্ষণের দ্বারা জেনেছিলেন আমি
তো তা বলতে পারি নে। বোধ করি অসামান্য লোকদের ছাত্র-অবস্থায় ষত্বণত্ব জ্ঞান থাকে
না। কাশীশ্বরী শ্বশুরবাড়িতে ছিল, তাই বিনা বাধায় আমি পণ্ডিতমশায়ের ঘরের লোক হয়ে
উঠলুম। কয়েক বৎসর পূর্বে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে— কিন্তু তিনি নাতনিতে পরিবৃত।
সবগুলি তাঁর স্বকীয়া নয়, তাঁর মধ্যে দুটি ছিল তাঁর পরলোকগত দাদার। বৃদ্ধ এদের নিয়ে
আপনার বার্ধক্যের অপরাহ্নকে নানা রঙে রঙিন করে তুলেছেন। তাঁর অমরুশতক আর্যাসপ্তশতী
হংসদূত পদাঙ্কদূতের শ্লোকের ধারা নুড়িগুলির চার দিকে গিরিনদীর ফেনোচ্ছল প্রবাহের
মতো এই মেয়েগুলিকে ঘিরে ঘিরে সহাস্যে ধ্বনিত হয়ে উঠছে।
আমি হেসে বললুম, “পণ্ডিতমশায়, ব্যাপারখানা কী! ”
তিনি বললেন, “বাবা, তোমাদের ইংরাজি শাস্ত্রে বলে যে, শনিগ্রহ চাঁদের মালা পরে
থাকেন— এই আমার সেই চাঁদের মালা।”
সেই দরিদ্র ঘরের এই দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, আমি একা। বুঝতে পারলুম,
আমি নিজের ভারে নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পণ্ডিতমশায় জানেন না যে তাঁর বয়স হয়েছে,
কিন্তু আমার যে হয়েছে সে আমি স্পষ্ট জানলুম। বয়স হয়েছে বলতে এইটে বোঝায়, নিজের চারি
দিককে ছাড়িয়ে এসেছি— চার পাশে ঢিলে হয়ে ফাঁক হয়ে গেছে। সে ফাঁক টাকা দিয়ে, খ্যাতি
দিয়ে, বোজানো যায় না। পৃথিবী থেকে রস পাচ্ছি নে কেবল বস্তু সংগ্রহ করছি, এর
ব্যর্থতা অভ্যাসবশত ভুলে থাকা যায়। কিন্তু, পণ্ডিতমশায়ের ঘর দেখলুম তখন বুঝলুম,
আমার দিক শুষ্ক, আমার রাত্রি শূন্য। পণ্ডিতমশায় নিশ্চয় ঠিক করে বসে আছেন যে, আমি
তাঁর চেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ— এই কথা মনে করে আমার হাসি এল। এই বস্তুজগৎকে ঘিরে একটি
অদৃশ্য আনন্দলোক আছে। সেই আনন্দলোকের সঙ্গে আমাদের জীবনের যোগসূত্র না থাকলে আমরা
ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে থাকি। পণ্ডিতমশায়ের সেই যোগ আছে, আমার নেই, এই তফাত। আমি
আরাম-কেদারার দুই হাতায় দুই পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগলুম পুরুষের
জীবনের চার আশ্রমের চার অধিদেবতা। বাল্যে মা; যৌবনে স্ত্রী; প্রৌঢ়ে কন্যা;
পুত্রবধূ; বার্ধক্যে নাতনি, নাতবউ। এমনি করে মেয়েদের মধ্য দিয়ে পুরুষ আপনার পূর্ণতা
পায়। এই তত্ত্বটা মর্মরিত শালবনে আমাকে আবিষ্ট করে ধরল। মনের সামনে আমার ভাবী
বৃদ্ধবয়সের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তাকিয়ে দেখলুম— দেখে তার নিরতিশয় নীরসতায় হৃদয়টা
হাহাকার করে উঠল। ঐ মরুপথের মধ্য দিয়ে মুনফার বোঝা ঘাড়ে করে নিয়ে কোথায় গিয়ে মুখ
থুবড়ে পড়ে মরতে হবে! আর দেরি করলে তো চলবে না। সম্প্রতি চল্লিশ পেরিয়েছি— যৌবনের
শেষ থলিটি ঝেড়ে নেবার জন্যে পঞ্চাশ রাস্তার ধারে বসে আছে, তার লাঠির ডগাটা এইখান
থেকে দেখা যাচ্ছে। এখন পকেটের কথাটা বন্ধ রেখে জীবনের কথা একটুখানি ভেবে দেখা যাক।
কিন্তু, জীবনের যে-অংশে মুলতবি পড়েছে সে-অংশে আর তো ফিরে যাওয়া চলবে না। তবু তার
ছিন্নতায় তালি লাগাবার সময় এখনো সম্পূর্ণ যায় নি।
এখান থেকে কাজের গতিকে পশ্চিমের এক শহরে যেতে হল। সেখানে বিশ্বপতিবাবু ধনী বাঙালি
মহাজন। তাঁকে নিয়ে আমার কাজের কথা ছিল। লোকটি খুব হুঁশিয়ার, সুতরাং তাঁর সঙ্গে কোনো
কথা পাকা করতে বিস্তর সময় লাগে। একদিন বিরক্ত হয়ে যখন ভাবছি ‘একে নিয়ে আমার কাজের
সুবিধা হবে না’, এমন-কি, চাকরকে আমার জিনিসপত্র প্যাক করতে বলে দিয়েছি, হেনকালে
বিশ্বপতিবাবু সন্ধ্যার সময় এসে আমাকে বললেন, “আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেকরকম লোকের
আলাপ আছে, আপনি একটু মনোযোগ করলে একটি বিধবা বেঁচে যায়।”
ঘটনাটি এই।–
নন্দকৃষ্ণবাবু বেরেলিতে প্রথমে আসেন একটি বাঙালি-ইংরাজি স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে।
কাজ করেছিলেন খুব ভালো। সকলেই আশ্চর্য হয়েছিল— এমন সুযোগ্য সুশিক্ষিত লোক দেশ ছেড়ে,
এত দূরে সামান্য বেতনে চাকরি করতে এলেন কী কারণে। কেবল যে পরীক্ষা পাস করাতে তাঁর
খ্যাতি ছিল তা নয়, সকল ভালো কাজেই তিনি হাত দিয়েছিলেন। এমন সময় কেমন করে বেরিয়ে
পড়ল, তাঁর স্ত্রীর রূপ ছিল বটে কিন্তু কুল ছিল না; সামান্য কোন্ জাতের মেয়ে,
এমন-কি, তাঁর ছোঁওয়া লাগলে পানীয় জলের পানীয়তা এবং অন্যান্য নিগূঢ় সাত্ত্বিক গুণ
নষ্ট হয়ে যায়। তাঁকে যখন সবাই চেপে ধরলে তিনি বললেন, হাঁ, জাতে ছোটো বটে, কিন্তু
তবু সে তাঁর স্ত্রী। তখন প্রশ্ন উঠল, এমন বিবাহ বৈধ হয় কী করে। যিনি প্রশ্ন
করেছিলেন নন্দকৃষ্ণবাবু তাঁকে বললেন, “আপনি তো শালগ্রাম সাক্ষী করে পরে পরে দুটি
স্ত্রী বিবাহ করেছেন, এবং দ্বিবচনেও সন্তুষ্ট নেই তার বহু প্রমাণ দিয়েছেন।
শালগ্রামের কথা বলতে পারি নে কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, আমার বিবাহ আপনার চেয়ে বৈধ,
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বৈধ— এর চেয়ে বেশি কথা আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই
নে।”
যাকে নন্দকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন তিনি খুশি হন নি। তার উপরে লোকের অনিষ্ট করবার
ক্ষমতাও তাঁর অসামান্য ছিল। সুতরাং সেই উপদ্রবে নন্দকৃষ্ণ বেরিলি ত্যাগ করে এই
বর্তমান শহরে এসে ওকালতি শুরু করলেন। লোকটা অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন— উপবাসী থাকলেও
অন্যায় মকদ্দমা তিনি কিছুতেই নিতেন না। প্রথমটা তাতে তাঁর যত অসুবিধা হোক, শেষকালে
উন্নতি হতে লাগল। কেননা, হাকিমরা তাঁকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। একখানি বাড়ি করে
একটু জমিয়ে বসেছেন এমন সময় দেশে মন্বন্তর এল। দেশ উজাড় হয়ে যায়। যাদের উপর সাহায্য
বিতরণের ভার ছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ চুরি করছিল বলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতেই
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, “সাধুলোক পাই কোথায়?
তিনি বললেন, “আমাকে যদি বিশ্বাস করেন আমি এ কাজের ভার নিতে পারি।”
তিনি ভার পেলেন এবং এই ভার বহন করতে করতেই একদিন মধ্যাহ্নে মাঠের মধ্যে এক গাছতলায়
মারা যান। ডাক্তার
বললে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে।
গল্পের এতটা পর্যন্ত আমার পূর্বেই জানা ছিল। কেমন একটা উচ্চ ভাবের মেজাজে এঁরই কথা
তুলে আমাদের ক্লাবে আমি বলেছিলুম, “এই নন্দকৃষ্ণের মতো লোক যারা সংসার ফেল করে
শুকিয়ে মরে গেছে— না রেখেছে নাম, না রেখেছে টাকা— তারাই ভগবানের সহযোগী হয়ে
সংসারটাকে উপরের দিকে— ”
এইটুকু মাত্র বলতেই ভরা পালের নৌকা হঠাৎ চড়ায় ঠেকে যাওয়ার মতো, আমার কথা মাঝখানে
বন্ধ হয়ে গেল। কারণ,আমাদের মধ্যে খুব একজন সম্পত্তি ও প্রতিপত্তিশালী লোক খবরের
কাগজ পড়ছিলেন— তিনি তাঁর চশমার উপর থেকে আমার প্রতি দৃষ্টি হেনে বলে উঠলেন, “হিয়ার
হিয়ার!”
যাক গে। শোনা গেল, নন্দকৃষ্ণর বিধবা স্ত্রী তাঁর একটি মেয়েকে নিয়ে এই পাড়াতেই
থাকেন। দেয়ালির রাত্রে মেয়েটির জন্ম হয়েছিল বলে বাপ তার নাম দিয়েছিলেন দীপালি।
বিধবা কোনো সমাজে স্থান পান না বলে সম্পূর্ণ একলা থেকে এই মেয়েটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে
মানুষ করেছেন। এখন মেয়েটির বয়স পঁচিশের উপর হবে। মায়ের শরীর রুগ্ণ এবং বয়সও কম নয়—
কোন্দিন তিনি মারা যাবেন, তখন এই মেয়েটির কোথাও কোনো গতি হবে না। বিশ্বপতি আমাকে
বিশেষ অনুনয় করে বললেন, “যদি এর পাত্র জুটিয়ে দিতে পারেন তো সেটা একটা পুণ্যকর্ম
হবে।”
আমি বিশ্বপতিকে শুকনো স্বার্থপর নিরেট কাজের লোক বলে মনে মনে একটু অবজ্ঞা করেছিলুম।
বিধবার অনাথা মেয়েটির জন্য তাঁর এই আগ্রহ দেখে আমার মন গলে গেল। ভাবলুম, প্রাচীন
পৃথিবীর মৃত ম্যামথের পাকযন্ত্রের মধ্যে থেকে খাদ্যবীজ বের করে পুঁতে দেখা গেছে,
তার থেকে অঙ্কুর বেরিয়েছে— তেমনি মানুষের মনুষ্যত্ব বিপুল মৃতস্তূপের মধ্যে থেকেও
সম্পূর্ণ মরতে চায় না।
আমি বিশ্বপতিকে বললুম, “পাত্র আমার জানা আছে, কোনো বাধা হবে না। আপনারা কথা এবং দিন
ঠিক করুন।”
“কিন্তু মেয়ে না দেখেই তো আর— ”
“না দেখেই হবে।”
“কিন্তু, পাত্র যদি সম্পত্তির লোভ করে সে বড়ো বেশি নেই। মা মরে গেলে কেবল ঐ
বাড়িখানি পাবে, আর সামান্য যদি কিছু পায়।”
“পাত্রের নিজের সম্পত্তি আছে, সেজন্যে ভাবতে হবে না।”
“তার নাম বিবরণ প্রভৃতি— ”
“সে এখন বলব না, তা হলে জানাজানি হয়ে বিবাহ ফেঁসে যেতে পারে।”
“মেয়ের মাকে তো তার একটা বর্ণনা দিতে হবে।”
“বলবেন, লোকটা অন্য সাধারণ মানুষের মতো দোষে গুণে জড়িত। দোষ এত বেশি নেই যে ভাবনা
হতে পারে; গুণও এত বেশি নেই যে লোভ করে চলে। আমি যতদূর জানি তাতে কন্যার পিতামাতারা
তাকে বিশেষ পছন্দ করে, স্বয়ং কন্যাদের মনের কথা ঠিক জানা যায় নি।”
বিশ্বপতিবাবু এই ব্যাপারে যখন অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হলেন তখন তাঁর উপরে আমার ভক্তি বেড়ে
গেল। যে-কারবারে ইতিপূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার দরে বনছিল না, সেটাতে লোকসান দিয়েও
রেজিস্ট্রী দলিল সই করবার জন্যে আমার উৎসাহ হল। তিনি যাবার সময় বলে গেলেন,
“পাত্রটিকে বলবেন, অন্য সব বিষয়ে যাই হোক, এমন গুণবতী মেয়ে কোথাও পাবেন না।”
যে-মেয়ে সমাজের আশ্রয় থেকে এবং শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত তাকে যদি হৃদয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত
করা যায় তা হলে সে মেয়ে কি আপনাকে উৎসর্গ করতে কিছুমাত্র কৃপণতা করবে। যে মেয়ের বড়ো
রকমের আশা আছে তারই আশার অন্ত থাকে না। কিন্তু, এই দীপালির দীপটি মাটির, তাই আমার
মতো মেটে ঘরের কোণে তার শিখাটির অমর্যাদা হবে না।
সন্ধ্যার সময় আলো জ্বেলে বিলিতি কাগজ পড়ছি, এমন সময় খবর এল, একটি মেয়ে আমার সঙ্গে
দেখা করতে এসেছে। বাড়িতে স্ত্রীলোক কেউ নেই, তাই ব্যস্ত হয়ে পড়লুম। কোনো ভদ্র উপায়
উদ্ভাবনের পূর্বেই মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকে প্রণাম করলে। বাইরে থেকে কেউ বিশ্বাস
করবে না, কিন্তু আমি অত্যন্ত লাজুক মানুষ। আমি না তার মুখের দিকে চাইলুম, না তাকে
কোনো কথা বললুম। সে বললে, “আমার নাম দীপালি।”
গলাটি ভারি মিষ্টি। সাহস করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম, সে মুখ বুদ্ধিতে কোমলতা
মাখানো। মাথার ঘোমটা নেই— সাদা দিশি কাপড়, এখনকার ফ্যাশানে পরা। কী বলি ভাবছি, এমন
সময় সে বললে, “আমাকে বিবাহ দেবার জন্যে আপনি কোনো চেষ্টা করবেন না।”
আর যাই হোক, দীপালির মুখে এমন আপত্তি আমি প্রত্যাশাই করি নি। আমি ভেবে রেখেছিলুম,
বিবাহের প্রস্তাবে তার দেহ মন প্রাণ কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছে।
জিজ্ঞাসা করলুম, “জানা অজানা কোনো পাত্রকেই তুমি বিবাহ করবে না ? ”
সে বললে, “না, কোনো পাত্রকেই না।”
যদিচ মনস্তত্ত্বের চেয়ে বস্তুতত্ত্বেই আমার অভিজ্ঞতা বেশি— বিশেষত নারীচিত্ত আমার
কাছে বাংলা বানানের চেয়ে কঠিন, তবু কথাটার সাদা অর্থ আমার কাছে সত্য অর্থ ব’লে মনে
হল না। আমি বললুম, “যে-পাত্র আমি তোমার জন্যে বেছেছি সে অবজ্ঞা করবার যোগ্য নয়।”
দীপালি বললে, “আমি তাঁকে অবজ্ঞা করি নে, কিন্তু আমি বিবাহ করব না।”
আমি বললুম, “সে লোকটিও তোমাকে মনের সঙ্গে শ্রদ্ধা করে।”
“কিন্তু, না, আমাকে বিবাহ করতে বলবেন না।”
“আচ্ছা, বলব না, কিন্তু আমি কি তোমাদের কোনো কাজে লাগতে পারি নে।”
“আমাকে যদি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে পড়াবার কাজ জুটিয়ে দিয়ে এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে যান
তা হলে ভারি উপকার হয়।”
বললুম, “কাজ আছে, জুটিয়ে দিতে পারব।”
এটা সম্পূর্ণ সত্য কথা নয়। মেয়ে-ইস্কুলের খবর আমি কী জানি। কিন্তু, মেয়ে-ইস্কুল
স্থাপন করতে তো দোষ নেই।
দীপালি বললে, “আপনি আমাদের বাড়ি গিয়ে একবার মায়ের সঙ্গে এ কথার আলোচনা করে দেখবেন?
”
আমি বললুম, “আমি কাল সকালেই যাব।”
দীপালি চলে গেল। কাগজ-পড়া আমার বন্ধ হল। ছাতের উপর বেরিয়ে এসে চৌকিতে বসলুম।
তারাগুলোকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কোটি কোটি যোজন দূরে থেকে তোমরা কি সত্যই মানুষের
জীবনের সমস্ত কর্মসূত্র ও সম্বদ্ধসূত্র নিঃশব্দে বসে বসে বুনছ।’
এমন সময়ে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ বিশ্বপতির মেজো ছেলে শ্রীপতি ছাতে এসে উপস্থিত। তার
সঙ্গে যে-আলোচনাটা হল, তার মর্ম এই—
শ্রীপতি দীপালিকে বিবাহ করবার আগ্রহে সমাজ ত্যাগ করতে প্রস্তুত। বাপ বলেন, এমন
দুষ্কার্য করলে তিনি তাকে ত্যাগ করবেন। দীপালি বলে, তার জন্যে এত বড়ো দুঃখ অপমান ও
ত্যাগ স্বীকার কেউ করবে, এমন যোগ্যতা তার নেই। তা ছাড়া
শ্রীপতি শিশুকাল থেকে ধনীগৃহে লালিত; দীপালির মতে, সে সমাজচ্যুত এবং নিরাশ্রয় হয়ে
দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। এই নিয়ে তর্ক চলছে, কিছুতে তার মীমাংসা হচ্ছে
না। ঠিক এই সংকটের সময় আমি মাঝখানে পড়ে এদের মধ্যে আর-একটা পাত্রকে খাড়া করে
সমস্যার জটিলতা অত্যন্ত বাড়িয়ে তুলেছি। এইজন্যে শ্রীপতি আমাকে এই নাটকের থেকে
প্রুফশিটের কাটা অংশের মতো বেরিয়ে যেতে বলছে।
আমি বললুম,
“যখন এসে পড়েছি তখন বেরোচ্ছি নে। আর, যদি বেরোই তা হলে গ্রন্থি কেটে তবে বেড়িয়ে
পড়ব।”
বিবাহের দিনপরিবর্তন হল না। কেবলমাত্র পাত্রপরিবর্তন হল। বিশ্বপতির অনুনয় রক্ষা
করেছি কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন নি। দীপালির অনুনয় রক্ষা করি নি কিন্তু ভাবে
বোধ হল, সে সন্তুষ্ট হয়েছে। ইস্কুলে কাজ খালি ছিল কি না জানি নে কিন্তু আমার ঘরে
কন্যার স্থান শূন্য ছিল, সেটা পূর্ণ হল। আমার মতো বাজে লোক যে নিরর্থক নয় আমার
অর্থই সেটা শ্রীপতির কাছে প্রমাণ করে দিলে। তার গৃহদীপ আমার কলকাতার বাড়িতেই জ্বলল।
ভেবেছিলুম, সময়মত বিবাহ না সেরে রাখার মুলতবি অসময়ে বিবাহ করে পূরণ করতে হবে,
কিন্তু দেখলুম, উপরওয়ালা প্রসন্ন হলে দুটো-একটা ক্লাস ডিঙিয়েও প্রোমোশন পাওয়া যায়।
আজ পঞ্চান্ন বছর বয়সে আমার ঘর নাতনিতে ভরে গেছে, উপরন্তু একটি নাতিও জুটেছে,
কিন্তু, বিশ্বপতিবাবুর সঙ্গে আমার কারবার বন্ধ হয়ে গেছে—কারণ, তিনি পাত্রটিকে পছন্দ
করেন নি।
পৌষ ১৩২৪