ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রীতিমত নভেল
[সাধনা পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ]

প্রথম পরিচ্ছেদ

আলা হো আকবর শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে একদিকে তিনলক্ষ যবনসেনা, অন্য দিকে তিনসহস্র আর্যসৈন্য বন্যার মধ্যে একাকী অশ্বত্থবৃক্ষের মতো হিন্দুবীরগণ সমস্ত রাত্রি এবং সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া অটল দাঁড়াইয়া ছিল, কিন্তু এইবার ভাঙিয়া পড়িবে, তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে এবং সেইসঙ্গে ভারতের জয়ধ্বজা ভূমিসাৎ হইবে এবং আজিকার এই অস্তাচলবর্তী সহস্ররশ্মির সহিত হিন্দুস্থানের গৌরবসূর্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইবে

হর হর বোম্ বোম্!পাঠক, বলিতে পার, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশজন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত হইল? বলিতে পার কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল? —কাহার বজ্রমন্দ্রিত হর হর বোম্ বোম্শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছকণ্ঠের আলা হো আকবর ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল? কাহার উদ্যত অসির সম্মুখে ব্যাঘ্র-আক্রান্ত মেষযূথের ন্যায় শত্রুসৈন্য মুহূর্তের মধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়নপর হইল? বলিতে পার, সেদিনকার আর্যস্থানের সূর্যদেব সহস্ররক্তকরস্পর্শে কাহার রক্তাক্ত তরবারিকে আশীর্বাদ করিয়া অস্তাচলে বিশ্রাম করিতে গেলেন? বলিতে পার কি পাঠক

ইনিই সেই ললিতসিংহকাঞ্চীর সেনাপতিভারত-ইতিহাসের ধ্রুবনক্ষত্র 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আজ কাঞ্চীনগরে কিসের এত উৎসবপাঠক, জান কিহর্ম্যশিখরে জয়ধ্বজা কেন এত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেকেবল কি বায়ুভরে না আনন্দভরে দ্বারে দ্বারে কদলীতরু ও মঙ্গলঘট, গৃহে গৃহে শঙ্খধ্বনিপথে পথে দীপমালাপুরপ্রাচীরের উপর লোকে লোকারণ্য নগরের লোক কাহার জন্য এমন উৎসুক হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছেসহসা পুরুষকণ্ঠের জয়ধ্বনি এবং বামাকণ্ঠের হুলুধ্বনি একত্র মিশ্রিত হইয়া অভ্রভেদ করিয়া নির্নিমেষ নক্ষত্রলোকের দিকে উত্থিত হইলনক্ষত্রশ্রেণী বায়ুব্যাহত দীপমালার ন্যায় কাঁপিতে লাগিল

ঐ-যে প্রমত্ত তুরঙ্গমের উপর আরোহণ করিয়া বীরবর পুরদ্বারে প্রবেশ করিতেছেন, উঁহাকে চিনিয়াছ কিউনিই আমাদের সেই পূর্বপরিচিত ললিতসিংহ, কাঞ্চীর সেনাপতিশত্রু নিধন করিয়া স্বীয় প্রভু কাঞ্চীরাজ-পদতলে শত্রুরক্তাঙ্কিত খড়্গ উপহার দিতে আসিয়াছেনতাই এত উৎসব

কিন্তু এত-যে জয়ধ্বনি, সেনাপতির সেদিকে কর্ণপাত নাইগবাক্ষ হইতে পুরললনাগণ এত যে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন, সে দিকে তাঁহার দৃক্‌পাত নাইঅরণ্যপথ দিয়া যখন তৃষ্ণাতুর পথিক সরোবরের দিকে ধাবিত হয় তখন শুষ্ক পত্ররাশি তাঁহার মাথার উপর ঝরিতে থাকিলে তিনি কি ভ্রূক্ষেপ করেনঅধীরচিত্ত ললিতসিংহের নিকট এই অজস্র সম্মান সেই শুষ্ক পত্রের ন্যায় নীরস, লঘু ও অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল

অবশেষে অশ্ব যখন অন্তঃপুরপ্রাসাদের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল, তখন মুহূর্তের জন্য সেনাপতি তাঁহার বল্গা আকর্ষণ করিলেন; অশ্ব মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইল, মুহূর্তের জন্য ললিতসিংহ একবার প্রাসাদবাতায়নে তৃষিত দৃষ্টি নিপে করিলেন, মুহূর্তের জন্য দেখিতে পাইলেন দুইটি লজ্জানত নেত্র একবার চকিতের মতো তাঁহার মুখের উপর পড়িল এবং দুইটি অনিন্দিত বাহু হইতে একটি পুষ্পমালা খসিয়া তাঁহার সম্মুখে ভূতলে পতিত হইলতৎক্ষণাৎ অশ্ব হইতে নামিয়া সেই মালা কিরীটচূড়ায় তুলিয়া লইলেন এবং আর-একবার কৃতার্থ দৃষ্টিতে ঊর্ধ্বে চাহিলেন তখন দ্বার রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, দীপ নির্বাপিত

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

সহস্র শত্রুর নিকট যে অবিচলিত, দুইটি চকিত হরিণনেত্রের নিকট সে পরাভূত সেনাপতি বহুকাল ধৈর্যকে পাষাণদুর্গের মতো হৃদয়ে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন, গতকল্য সন্ধ্যাকালে দুটি কালো চোখের সলজ্জ সসম্ভ্রম দৃষ্টি সেই দুর্গের ভিত্তিতে গিয়া আঘাত করিয়াছে এবং এতকালের ধৈর্য মুহূর্তে ভূমিসাৎ হইয়া গেছেকিন্তু, ছি ছি সেনাপতি, তাই বলিয়া কি সন্ধ্যার অন্ধকারে চোরের মতো রাজান্তঃপুরের উদ্যানপ্রাচীর লঙঘন করিতে হয়তুমিই না ভুবনবিজয়ী বীরপুরুষ?

কিন্তু যে উপন্যাস লেখে তাহার কোথাও বাধা নাই; দ্বারীরাও দ্বাররোধ করে না, অসূর্যম্পশ্যরূপা রমণীরাও আপত্তি প্রকাশ করে না, অতএব এই সুরম্য বসন্তসন্ধ্যায় দক্ষিণবায়ুবীজিত রাজান্তঃপুরের নিভৃত উদ্যানে একবার প্রবেশ করা যাকহে পাঠিকা, তোমরাও আইস এবং পাঠকগণ, ইচ্ছা করিলে তোমরাও অনুবর্তী হইতে পার— আমি অভয়দান করিতেছি

একবার চাহিয়া দেখো, বকুলতলের তৃণশয্যায় সন্ধ্যাতারার প্রতিমার মতো ঐ রমণী কেহে পাঠক, হে পাঠিকা, তোমরা উঁহাকে জান কিঅমন রূপ কোথাও দেখিয়াছ? রূপের কি কখনো বর্ণনা করা যায় ভাষা কি কখনো কোনো মন্ত্রবলে এমন জীবন, যৌবন এবং লাবণ্যে ভরিয়া উঠিতে পারে হে পাঠক, তোমার যদি দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ হয় তবে স্ত্রীর মুখ স্মরণ করোহে রূপসী পাঠিকা, যে যুবতীকে দেখিয়া তুমি সঙ্গিনীকে বলিয়াছ ইহাকে কী এমন ভালো দেখিতে, ভাইহউক সুন্দরী, কিন্তু ভাই, তেমন শ্রী নাই।’ -তাহার মুখ মনে করো, ঐ তরুতলবর্তিনী রাজকুমারীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য উপলব্ধি করিবেপাঠক এবং পাঠিকা, এবার চিনিলে কিউনিই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা

রাজকুমারী কোলের উপর ফুল রাখিয়া নতমুখে মালা গাঁথিতেছেন, সহচরী কেহই নাইগাঁথিতে গাঁথিতে এক-একবার অঙ্গুলি আপনার সুকুমার কার্যে শৈথিল্য করিতেছে, উদাসীন দৃষ্টি কোন্-এক অতিদূরবর্তী চিন্তারাজ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছেরাজকুমারী কী ভাবিতেছেন

কিন্তু হে পাঠক, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিব নাকুমারীর নিভৃত হৃদয়মন্দিরের মধ্যে আজি এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কোন মর্ত্যদেবতার আরতি হইতেছে, অপবিত্র কৌতূহল লইয়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারিব নাঐ দেখো, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পূজার সুগন্ধি ধূপধূমের ন্যায় সন্ধ্যার বাতাসে মিশাইয়া গেল এবং দুইফোঁটা অশ্রুজল দুটি সুকোমল কুসুমকোরকের মতো অজ্ঞাত দেবতার চরণের উদ্দেশে খসিয়া পড়িলএমন সময় পশ্চাৎ হইতে একটি পুরুষের কণ্ঠ গভীর আবেগভরে কম্পিত রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, রাজকুমারী!

রাজকন্যা সহসা ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেনচারি দিক হইতে প্রহরী ছুটিয়া আসিয়া অপরাধীকে বন্দী করিলরাজকন্যা তখন পুনরায় সসংজ্ঞ হইয়া দেখিলেন, সেনাপতি বন্দী হইয়াছেন

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এ অপরাধে প্রাণদণ্ডই বিধানকিন্তু পূর্বোপকার স্মরণ করিয়া রাজা তাঁহাকে নির্বাসিত করিয়া দিলেনসেনাপতি মনে মনে কহিলেন, দেবী, তোমার নেত্রও যখন প্রতারণা করিতে পারে, তখন সত্য পৃথিবীতে কোথাও নাই আজ হইতে আমি মানবের শত্রু একটি বৃহৎ দস্যুদলের অধিপতি হইয়া ললিতসিংহ অরণ্যে বাস করিতে লাগিলেন

হে পাঠক, তোমার আমার মতো লোক এইরূপ ঘটনায় কী করিতনিশ্চয় যেখানে নির্বাসিত হইত সেখানে আর-একটা চাকরির চেষ্টা দেখিত, কিংবা একটা নূতন খবরের কাগজ বাহির করিতকিছু কষ্ট হইত সন্দেহ নাই - সে অন্নাভাবেকিন্তু, সেনাপতির মতো মহৎ লোক, যাহারা উপন্যাসে সুলভ এবং পৃথিবীতে দুর্লভ, তাহারা চাকরিও করে না, খবরের কাগজও চালায় নাতাহারা যখন সুখে থাকে তখন একনিশ্বাসে নিখিলজগতের উপকার করে এবং মনোবাঞ্ছা তিলমাত্র ব্যর্থ হইলেই আরক্তলোচনে বলে, রাক্ষসী পৃথিবী, পিশাচ সমাজ, তোদের বুকে পা দিয়া আমি ইহার প্রতিশোধ লইববলিয়া তৎক্ষণাৎ দস্যুব্যবসায় আরম্ভ করেএইরূপ ইংরাজি কাব্যে পড়া যায় এবং অবশ্যই এ প্রথা রাজপুতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল

দস্যুর উপদ্রবে দেশের লোক ত্রস্ত হইয়া উঠিলকিন্তু এই অসামান্য দস্যুরা অনাথের সহায়, দরিদ্রের বন্ধু, দুর্বলের আশ্রয়, কেবল, ধনী উচ্চকুলজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং রাজকর্মচারীদের পক্ষে কালান্তক যম

ঘোর অরণ্য, সূর্য অস্তপ্রায়কিন্তু, বনচ্ছায়ায় অকালরাত্রির আবির্ভাব হইয়াছেতরুণ যুবক অপরিচিত পথে একাকী চলিতেছে! সুকুমার শরীর পথশ্রমে ক্লান্ত, কিন্তু তথাপি অধ্যবসায়ের বিরাম নাই কটিদেশে যে তরবারি বদ্ধ রহিয়াছে, তাহারই ভার দুঃসহ বোধ হইতেছেঅরণ্যে লেশমাত্র শব্দ হইলেই ভয়প্রবণ হৃদয় হরিণের মতো চকিত হইয়া উঠিতেছেকিন্তু তথাপি এই আসন্ন রাত্রি এবং অজ্ঞাত অরণ্যের মধ্যে দৃঢ় সংকল্পের সহিত অগ্রসর হইতেছে

দস্যুরা আসিয়া দস্যুপতিকে সংবাদ দিল, মহারাজ, বৃহৎ শিকার মিলিয়াছেমাথায় মুকুট, রাজবেশ, কটিদেশে তরবারি
দস্যুপতি কহিলেন
, তবে এ শিকার আমার তোরা এখানেই থাক
পথিক চলিতে চলিতে সহসা একবার শুষ্ক পত্রের খস্‌খস্ শব্দ শুনিতে পাইলউৎকণ্ঠিত হইয়া চারি দিকে চাহিয়া দেখিল
সহসা বুকের মাঝখানে তীর আসিয়া বিঁধিল, পান্থ মাবলিয়া ভূতলে পড়িয়া গেল
দস্যুপতি নিকটে আসিয়া জানু পাতিয়া নত হইয়া আহতের মুখের দিকে নিরীক্ষণ করিলেনভূতলশায়ী পথিক দস্যুর হাত ধরিয়া কেবল একবার মৃদুস্বরে কহিল, “ললিত!
মুহূর্তে দস্যুর হৃদয় যেন সহস্র খণ্ডে ভাঙিয়া এক চীৎকারশব্দ বাহির হইল, রাজকুমারী!
দস্যুরা আসিয়া দেখিল শিকার এবং শিকারী উভয়েই অন্তিম আলিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া মৃত পড়িয়া আছে

রাজকুমারী একদিন সন্ধ্যাকালে তাঁহার অন্তঃপুরের উদ্যানে অজ্ঞানে ললিতের উপর রাজদণ্ড নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, ললিত আর-একদিন সন্ধ্যাকালে অরণ্যের মধ্যে অজ্ঞান রাজকন্যার প্রতি শর নিক্ষেপ করিলসংসারের বাহিরে যদি কোথাও মিলন হইয়া থাকে তো আজ উভয়ের অপরাধ উভয়ে বোধ করি মার্জনা করিয়াছে 

ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯