ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

গুরু


 

 

  অচলায়তন
একদল বালক

    প্রথম। ওরে ভাই শুনেছিস?
    দ্বিতীয়। শুনেছি – কিন্তু চুপ কর।
    তৃতীয়। কেন বল দেখি?
    দ্বিতীয়। কী জানি বললে যদি অপরাধ হয়?
    প্রথম। কিন্তু উপাধ্যায়মশায় নিজে যে আমাকে বলেছেন।
    তৃতীয়। কী বলেছেন বল-না।
    প্রথম। গুরু আসছেন।
    সকলে। গুরু আসছেন!
    তৃতীয়। ভয় করছে না ভাই?
    দ্বিতীয়। ভয় করছে।
    প্রথম। আমার ভয় করছে না, মনে হচ্ছে মজা।
    তৃতীয়। কিন্তু ভাই গুরু কী?
    দ্বিতীয়। তা জানি নে।
    তৃতীয়। কে জানে?
    দ্বিতীয়। এখানে কেউ জানে না।
    প্রথম। শুনেছি গুরু খুব বড়ো, খুব মস্ত বড়ো।
    তৃতীয়। তাহলে এখানে কোথায় ধরবে?
    প্রথম। পঞ্চকদাদা বলেন অচলায়তনে তাঁকে কোথাও ধরবে না।
    তৃতীয়। কোথাও না?
    প্রথম। কোথাও না।
    তৃতীয়। তাহলে কী হবে?
    প্রথম। ভারি মজা হবে।

          পঞ্চকের প্রবেশ

    পঞ্চক।                 গান
                তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে কেউ তা জানে না।
                আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না॥
            ওরে ভাই, কে আছিস ভাই। কাকে ডেকে বলব, গুরু আসছেন।

                                            সঞ্জীবের প্রবেশ
    সঞ্জীব। তাই তো শুনেছি। কিন্তু কে এসে খবর দিলে বলো তো।
    পঞ্চক। কে দিলে তা তো কেউ বলে না।
    সঞ্জীব। কিন্তু গুরু আসছেন বলে তুমি তো তৈরি হচ্ছ না পঞ্চক?
    পঞ্চক। বাঃ, সেই জন্যেই তো পুঁথিপত্র সব ফেলে দিয়েছি।
    সঞ্জীব। সেই বুঝি তোমার তৈরি হওয়া?
    পঞ্চক। আরে, গুরু যখন না থাকেন তখনই পুঁথিপত্র। গুরু যখন আসবেন তখন ওই সব জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে সময় খোলসা করতে হবে। আমি সেই পুঁথি বন্ধ করবার কাজে ভয়ানক ব্যস্ত।
    সঞ্জীব। তাই তো দেখছি।
                                            [প্রস্থান
    পঞ্চক।             গান
                ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
                তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।

    ওহে জয়োত্তম, তুমি কাঁধে কিসের বোঝা নিয়ে চলেছ? বোঝা ফেলো। গুরু আসছেন যে।
    জয়োত্তম। আরে ছুঁয়ো না এ-সব মাঙ্গল্য। গুরুর জন্যে সিংহদ্বার সাজাতে চলেছি।
    পঞ্চক। গুরু কোন্‌ দ্বার দিয়ে ঢুকবেন তা জানবে কী করে?
    জয়োত্তম। তা তো বটেই। অচলায়তনে জানবার লোক কেবল তুমিই আছ।
    পঞ্চক। তোমরাও জান না আমিও জানি নে —তফাতটা এই যে, তোমরা বোঝা বয়ে মর, আমি হালকা হয়ে বসে আছি।
    জয়োত্তম। আচ্ছা, এখন পথ ছাড়ো, আমার সময় নেই।
                                                            [প্রস্থান
    পঞ্চক।             গান
                বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
                বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।

                        মহাপঞ্চকের প্রবেশ
    মহাপঞ্চক। গান! অচলায়তনে গান! মতিভ্রম হয়েছে!
    পঞ্চক। এবার দাদা স্বয়ং তোমাকেও গান ধরতে হবে। একধার থেকে মতিভ্রমের পালা আরম্ভ হল।
    মহাপঞ্চক। আমি মহাপঞ্চক গান ধরব! ঠাট্টা আমার সঙ্গে!
    পঞ্চক। ঠাট্টা নয়। অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে। এই বোবা পাথরগুলো থেকে সুর বেরোবে।
    মহাপঞ্চক। কেন বলো তো?
    পঞ্চক। গুরু আসছেন যে! তাই আমার কেবলই মন্তরে ভুল হচ্ছে!
    মহাপঞ্চক। গুরু এলে তোমার জন্যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
    পঞ্চক। তার জন্যে ভাবনা কী? নির্লজ্জ হয়ে একলা আমিই মুখ দেখাব।
    মহাপঞ্চক। মন্তরে ভুল হলে গুরু তোমাকে আয়তন থেকে দূর করে দেবেন।
    পঞ্চক। সেই ভরসাতেই তার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
    মহাপঞ্চক। অমিতায়ুর্ধারণী মন্ত্রটা –
    পঞ্চক। সেই মন্ত্রটা স্বয়ং গুরুর কাছ থেকে শিখব বলেই তো আগাগোড়া ভোলবার চেষ্টায় আছি। সেই জন্যেই গান ধরেছি দাদা।
    মহাপঞ্চক। ওই শঙ্খ বাজল। এখন আমার সপ্তকুমারিকা গাথা পাঠের সময়। কিন্তু বলে যাচ্ছি, সময় নষ্ট করো না। গুরু আসছেন।
    পঞ্চক।             গান
                আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,
                এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না॥
    ও কী ও। কান্না শুনি যে। এ নিশ্চয়ই সুভদ্র। আমাদের এই অচলায়তনে ঐ বালকের চোখের জল আর শুকোল না। ওর কান্না আমি সইতে পারি নে।
                                প্রস্থান ও বালক সুভদ্রকে লইয়া পুনঃ প্রবেশ
    পঞ্চক। তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল –কী হয়েছে বল।
    সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
    পঞ্চক। পাপ করেছিস? কী পাপ?
    সুভদ্র। সে আমি বলতে পারব না। ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে?
    পঞ্চক। তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল।
    সুভদ্র। আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের –
    পঞ্চক। উত্তর দিকের?
    সুভদ্র। হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে –

    পঞ্চক। জানলা খুলে কী করলি?
    সুভদ্র। বাইরেটা দেখে ফেলেছি।
    পঞ্চক। দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে।
    সুভদ্র। হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না —একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্‌ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
    পঞ্চক। ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে; —আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তাহলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত —আমি আসার পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।
বালকদলের প্রবেশ
    প্রথম। অ্যাঁ! সুভদ্র! তুমি বুঝি এখানে!
    দ্বিতীয়। জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে?
    পঞ্চক। চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র, কাঁদছিস কেন ভাই? প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তো করবি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে, প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিকতেই পারত না।
    প্রথম। (চুপিচুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা—
    পঞ্চক। আচ্ছা, আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অত সাহস আছে?
    দ্বিতীয়। আমাদের আয়তনের উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর!
    তৃতীয়। সেদিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তাহলে যে সে—
    পঞ্চক। তাহলে কী?
    তৃতীয়। সে যে ভয়ানক।
    পঞ্চক। কী ভয়ানক শুনিই-না।
    তৃতীয়। জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
    সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে?
    পঞ্চক। শোন বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে —কিন্তু যা-ই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।
    সুভদ্র। ভয় কর না?
    সকল ছেলে। ভয় কর না?
    পঞ্চক। না, আমি তো বলি, দেখিই-না কী হয়।
    সকলে। (কাছে ঘেঁষিয়া) আচ্ছা দাদা, তুমি বুঝি অনেক দেখেছ?
    পঞ্চক। দেখেছি বৈ কি। ও মাসে শনিবারে যেদিন মহাময়ূরী দেবীর পূজা পড়ল, সেদিন আমি কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে, তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিজে আঠারো বার ফুঁ দিয়েছি।
    সকলে। অ্যাঁ! কী ভয়ানক! আঠারো বার!

    সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, তোমার কী হল?
    পঞ্চক। তিন দিনের দিন যে সাপটা এসে আমাকে নিশ্চয় কামড়াবে কথা ছিল, সে আজ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে পারে নি।
    প্রথম। কিন্তু ভয়ানক পাপ করেছ তুমি।
    দ্বিতীয়। মহাময়ূরী দেবী ভয়ানক রাগ করেছেন।
    পঞ্চক। তার রাগটা কী রকম সেইটে দেখবার জন্যেই তো এ কাজ করেছি!
    সুভদ্র। কিন্তু পঞ্চকদাদা, যদি তোমাকে সাপে কামড়াত!
    পঞ্চক। তা হলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো সন্দেহ থাকত না— ভাই সুভদ্র, জানলা খুলে তুই কী দেখলি বল দেখি।
    দ্বিতীয়। না না, বলিস নে।
    তৃতীয়। না, সে আমরা শুনতে পারব না – কী ভয়ানক!
    প্রথম। আচ্ছা, একটু –খুব একটুখানি বল ভাই।
    সুভদ্র। আমি দেখলুম সেখানে পাহাড়, গোরু চরছে –
    বালকগণ। (কানে আঙুল দিয়া) ও বাবা, না না, আর শুনব না। আর বলো না সুভদ্র। ঐ যে উপাধ্যায়মশায় আসছেন। চল চল— আর না।
    পঞ্চক। কেন? এখন তোমাদের কী?
    প্রথম। বেশ, তাও জান না বুঝি? আজ যে পূর্বফাল্গুনী নক্ষত্র—
    পঞ্চক। তাতে কী?
    দ্বিতীয়। আজ কাকিনী সরোবরের নৈর্ঋত কোণে ঢোঁড়া সাপের খোলস খুঁজতে হবে না?
    পঞ্চক। কেন রে?
    প্রথম। তুমি কিছু জান না পঞ্চকদাদা। সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করতে হবে যে।
    দ্বিতীয়। আজ যে পিতৃপুরুষেরা সেই ধোঁয়া ঘ্রাণ করতে আসবেন।
    পঞ্চক। তাতে তাঁদের কষ্ট হবে না?
    প্রথম। পুণ্য হবে যে, ভয়ানক পুণ্য।
                                                    [সুভদ্র ব্যতীত বালকগণের প্রস্থান
                উপাধ্যায়ের প্রবেশ
    সুভদ্র। উপাধ্যায়মশায়!
    পঞ্চক। আরে পালা পালা। উপাধ্যায়মশায়ের কাছ থেকে একটু পরমার্থতত্ত্ব শুনতে হবে, এখন বিরক্ত করিস নে, একেবারে দৌড়ে পালা।
    উপাধ্যায়। কী সুভদ্র, তোমার বক্তব্য কী শীঘ্র বলে যাও।
    সুভদ্র। আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
    পঞ্চক। ভারি পণ্ডিত কিনা। পাপ করেছি! পালা বলছি।
    উপাধ্যায়। (উৎসাহিত হইয়া) পাপ করেছ? ওকে তাড়া দিচ্ছ কেন? সুভদ্র, শুনে যাও।
    পঞ্চক। আর রক্ষা নেই, পাপের এতটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতো ছোটে।
    উপাধ্যায়। কী বলছিলে?
    সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
    উপাধ্যায়। পাপ করেছ? আচ্ছা বেশ। তা হলে বোসো। শোনা যাক।
    সুভদ্র। আমি আয়তনের উত্তর দিকের –
    উপাধ্যায়। বলো, বলো, উত্তর দিকের দেয়ালে আঁক কেটেছ?
    সুভদ্র। না, আমি উত্তর দিকের জানলায় –
    উপাধ্যায়। বুঝেছি, কুনুই ঠেকিয়েছ। তা হলে তো সেদিকে আমাদের যতগুলি যজ্ঞের পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানলা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।
    পঞ্চক। এটা আপনি ভুল বলছেন। ক্রিয়াসংগ্রহে আছে ভূমিকূষমাণ্ডের বোঁটা দিয়ে একবার –
    উপাধ্যায়। তোমার তো স্পর্ধা কম দেখি নে। কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কি কোনদিন খুলে দেখা হয়েছে?
    পঞ্চক। (জনান্তিকে) সুভদ্র, যাও তুমি।– কিন্তু কুলদত্তকে তো আমি –
    উপাধ্যায়। কুলদত্তকে মান না? আচ্ছা, ভরদ্বাজ মিশ্রের প্রয়োগপ্রজ্ঞপ্তি তো মানতেই হবে— তাতে –
    সুভদ্র। উপাধ্যায় মশায়, আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
    পঞ্চক। আবার! সেই কথাই তো হচ্ছে। তুই চুপ কর।
    উপাধ্যায়। সুভদ্র, উত্তরের দেয়ালে যে আঁক কেটেছ সে চতুষ্কোণ, না গোলাকার?
    সুভদ্র। আঁক কাটি নি। আমি জানলা খুলে বাইরে চেয়েছিলুম।
    উপাধ্যায়। (বসিয়া পড়িয়া) আঃ সর্বনাশ! করেছিস কী? আজ তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর ওই জানলা কেউ খোলে নি তা জানিস?
    সুভদ্র। আমার কী হবে!
    পঞ্চক। (সুভদ্রকে আলিঙ্গন করিয়া) তোমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ। তোমার এই অসামান্য সাহস দেখে উপাধ্যায়মশায়ের মুখে আর কথা নেই। গুরু আসার পথ তুমিই প্রথম খোলসা করে দিলে।
                                                        [সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান
    উপাধ্যায়। জানি নে কী সর্বনাশ হবে। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী যে একজটা দেবী! বালকের দুই চক্ষু মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। যাই আচার্যদেবকে জানাই গে।
                                                         [প্রস্থান
                                            আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ
    আচার্য। এতকাল পরে আমাদের গুরু আসছেন।
    উপাচার্য। তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।
    আচার্য। প্রসন্ন হয়েছেন? তা হবে। হয়তো প্রসন্নই হয়েছেন। কিন্তু কেমন করে জানব?
    উপাচার্য। নইলে তিনি আসবেন কেন?
    আচার্য। এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে বলেই তিনি আসছেন।
    উপাচার্য। না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না। আমরা কঠোর নিয়ম সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি —কোনো ত্রুটি ঘটে নি।
    আচার্য। কঠোর নিয়ম? হাঁ, সমস্তই পালিত হয়েছে।
    উপাচার্য। বজ্রশুদ্ধিব্রত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতাত্তর বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয়!
    আচার্য। না, আর কোথাও হতে পারে না।
    উপাচার্য। কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন?
    আচার্য। সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ?
    উপাচার্য। আমার তো একমুহূর্তের জন্যে অশান্তি নেই।
    আচার্য। অশান্তি নেই?
    উপাচার্য। কিছুমাত্র না। আমার অহোরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা। এর চেয়ে আর শান্তি কী হতে পারে?
    আচার্য। ঠিক, ঠিক –ঠিক বলেছ সূতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায় তার অন্ত পাব? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত – এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায় –তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি!
    উপাচার্য। আচার্যদেব, আপনাকে এমন বিচলিত হতে কখনো দেখি নি।
    আচার্য। কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারি দিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত। তুমি এটা অনুভব করতে পারছ না সূতসোম?
    উপাচার্য। কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না। আমাদের সমস্ত শিক্ষা কোন্‌ কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত। ঐ-যে পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয়? এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল! ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল আপনাকেই মানে। আপনি ওকে একটু ভর্ৎসনা করে দেবেন।
    আচার্য। আচ্ছা তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে দেখি।
                                                    [উপাচার্যের প্রস্থান
            পঞ্চকের প্রবেশ
    আচার্য। (পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস পঞ্চক!
    পঞ্চক। করলেন কী! আমাকে ছুঁলেন?
    আচার্য। কেন, বাধা কী আছে?
    পঞ্চক। আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি।
    আচার্য। কেন পার নি বৎস?
    পঞ্চক। প্রভু, কেন, তা আমি বলতে পারি নে। আমার পারবার উপায় নেই।
    আচার্য। সৌম্য, তুমি তো জান, এখানকার যে নিয়ম সেই নিয়মকে আশ্রয় করে হাজার বছর হাজার হাজার লোক নিশ্চিন্ত আছে। আমরা যে খুশি তাকে কি ভাঙতে পারি?
    পঞ্চক। আচার্যদেব, যে-নিয়ম সত্য তাকে ভাঙতে না দিলে তার যে পরীক্ষা হয় না। তাই কি ঠিক নয়?
    আচার্য। যাও বৎস, তোমার পথে তুমি যাও। আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করো না।
    পঞ্চক। আচার্যদেব, আপনি জানেন না কিন্তু আপনিই আমাকে নিয়মের চাকার নিচে থেকে টেনে নিয়েছেন।
    আচার্য। কেমন করে বৎস?
    পঞ্চক। তা জানি নে, কিন্তু আপনি আমাকে এমন একটা-কিছু দিয়েছেন যা আচারের চেয়ে, নিয়মের চেয়ে অনেক বেশি।
    আচার্য। তুমি কী কর না-কর আমি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করি নে, কিন্তু আজ একটি কথা জিজ্ঞাসা করব। তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে যূনক জাতির সঙ্গে মেশ?
    পঞ্চক। আপনি কি এর উত্তর শুনতে চান?
    আচার্য। না না থাক্, বলো না। কিন্তু যূনকেরা যে অত্যন্ত ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি –
    পঞ্চক। তাদের সম্বন্ধে আপনার কি কোনো বিশেষ আদেশ আছে?
    আচার্য। না না, আদেশ আমার কিছুই নেই। যদি ভুল করতে হয় তবে ভুল করো গে –তুমি ভুল করো গে—আমাদের কথা শুনো না।
    পঞ্চক। ওই উপাচার্য আসছেন –বোধ করি কাজের কথা আছে—বিদায় হই।
                                                                        [প্রস্থান
                উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ
    উপাচার্য। (উপাধ্যায়ের প্রতি) আচার্যদেবকে তো বলতেই হবে। উনি নিতান্ত উদ্‌বিগ্ন হবেন— কিন্তু দায়িত্ব যে ওঁরই।
    আচার্য। উপাধ্যায়, কোনো সংবাদ আছে নাকি?
    উপাধ্যায়। অত্যন্ত মন্দ সংবাদ।
    আচার্য। অতএব সেটা সত্বর বলা উচিত।
    উপাধ্যায়। আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।
    আচার্য। উত্তর দিকটা তো একজটা দেবীর।
    উপাধ্যায়। সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসকে সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।
    উপাচার্য। এখন কথা হচ্ছে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী।
    আচার্য। আমার তো স্মরণ হয় না। উপাধ্যায় বোধ করি -
    উপাধ্যায়। না, আমিও তো মনে আনতে পারি নে। আজ তিনশো বছর এ প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয় নি— সবাই ভুলেই

গেছে। ঐ-যে মহাপঞ্চক আসছে – যদি কারও জানা থাকে তো সে ওর।
                    মহাপঞ্চকের প্রবেশ
    উপাধ্যায়। মহাপঞ্চক, সব শুনেছ বোধ করি।
    মহাপঞ্চক। সেইজন্যেই তো এলুম; আমরা এখন সকলেই অশুচি, বাহিরের হাওয়া আমাদের আয়তনে প্রবেশ করেছে।
    উপাচার্য। এর প্রায়শ্চিত্ত কী, আমাদের কারও স্মরণ নেই। তুমিই হয়তো বলতে পার।
    মহাপঞ্চক। ক্রিয়াকল্পতরুতে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না –একমাত্র ভগবান জ্বলনানন্তকৃত আধিকর্মিক বর্ষায়ণে লিখছে, অপরাধীকে ছয় মাস মহাতামস সাধন করতে হবে।
    উপাচার্য। মহাতামস?
    মহাপঞ্চক। হাঁ, ওকে অন্ধকারে রেখে দিতে হবে, আলোকের এক রশ্মিমাত্রও দেখতে পাবে না। কেননা আলোকের দ্বারা যে-অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন।
    উপাচার্য। তা হলে, মহাপঞ্চক, সমস্ত ভার তোমার উপর রইল।
    উপাধ্যায়। চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। ততক্ষণ সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করিয়ে আনি গে।
                                                        [সকলের গমনোদ্যম
    আচার্য। শোনো, প্রয়োজন নেই।
    উপাধ্যায়। কিসের প্রয়োজন নেই?
    আচার্য। প্রায়শ্চিত্তের।
    মহাপঞ্চক। প্রয়োজন নেই বলছেন! আধিকর্মিক বর্ষায়ণ খুলে আমি এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি –
    আচার্য। দরকার নেই —সুভদ্রকে কোনো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমি আশীর্বাদ করে তার –
    মহাপঞ্চক। এও কি কখনো সম্ভব হয়? যা কোনো শাস্ত্রে নেই আপনি কি তাই –
    আচার্য। না, হতে দেব না, যদি কোনো অপরাধ ঘটে সে আমার। তোমাদের ভয় নেই।
    উপাধ্যায়। এ রকম দুর্বলতা তো আপনার কোনো দিন দেখি নি। এই তো সেবার অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসে তৃতীয় রাত্রে বালক কুশলশীল জল জল করে পিপাসায় প্রাণত্যাগ করলে কিন্তু তবু তার মুখে যখন এক বিন্দু জল দেওয়া গেল না, তখন তো আপনি নীরব হয়ে ছিলেন। তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তো চিরকালের।
                                            সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের প্রবেশ
    পঞ্চক। ভয় নেই সুভদ্র, তোর কোনো ভয় নেই– এই শিশুটিকে অভয় দাও প্রভু।
    আচার্য। বৎস, তুমি কোনো পাপ কর নি। যারা বিনা অপরাধে তোমাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে মুখ বিকৃত করে ভয় দেখাচ্ছে পাপ তাদেরই। এসো পঞ্চক।
                                            [সুভদ্রকে কোলে লইয়া পঞ্চকের সঙ্গে প্রস্থান
    উপাধ্যায়। এ কী হল উপাচার্যমশায়?
                                            [উপাচার্যের প্রস্থান
    মহাপঞ্চক। আমরা অশুচি হয়ে রইলুম, আমাদের যাগযজ্ঞ ব্রত-উপবাসে সকলই পণ্ড হতে থাকল, এ তো সহ্য করা শক্ত।
    উপাধ্যায়। এ সহ্য করা চলবেই না। আচার্য কি শেষে আমাদের ম্লেচ্ছের সঙ্গে সমান করে দিতে চান?
    মহাপঞ্চক। উনি আজ সুভদ্রকে বাঁচাতে গিয়ে সনাতন ধর্মকে বিনাশ করবেন! এ কী রকম বুদ্ধিবিকার ওঁর ঘটল? এ অবস্থায় ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না।
    সঞ্জীব, বিশ্বম্ভর, জয়োত্তমের প্রবেশ
    সঞ্জীব। এতদিন এখানে সব ঠিক চলছিল। যেই গুরু আসবেন রব উঠল অমনি কেন এই-সব অনাচার ঘটতে লাগল?
    বিশ্বম্ভর। আচার্য অদীনপুণ্য যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন, তবে তিনি যেমন আছেন থাকুন কিন্তু আমরা তাঁর কোনো অনুশাসন মানব না।
    জয়োত্তম। তিনি বলেন, তাঁর গুরু তাঁকে যে আসনে বসিয়েছেন তাঁর গুরুই তাঁকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দেবেন, সেইজন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন।
অধ্যেতার প্রবেশ
    উপাধ্যায়। কী গো অধ্যেতা, ব্যাপার কী?
    অধ্যেতা। সুভদ্রকে মহাতামসে বসায় কার সাধ্য?
    মহাপঞ্চক। কেন কী বিঘ্ন ঘটেছে?
    অধ্যেতা। মূর্তিমান বিঘ্ন রয়েছে তোমার ভাই!
    মহাপঞ্চক। পঞ্চক?
    অধ্যেতা। হাঁ। আমি ডাকতেই সুভদ্র ছুটে এল কিন্তু পঞ্চক তাকে কেড়ে নিয়ে গেল।
    মহাপঞ্চক। না, এই নরাধমকে নিয়ে আর চলল না। অনেক সহ্য করেছি। এবার ওকে নির্বাসন দেওয়াই স্থির। কিন্তু অধ্যেতা, তুমি এটা সহ্য করলে?
    অধ্যেতা। আমি কি তোমার পঞ্চককে ভয় করি? স্বয়ং আচার্য অদীনপুণ্য এসে তাকে আদেশ করলেন, তাই তো সে সাহস পেলে।
    সঞ্জীব। স্বয়ং আমাদের আচার্য!
    বিশ্বম্ভর। ক্রমে এ-সব হচ্ছে কী! এতদিন এই আয়তনে আছি, কখনো তো এমন অনাচারের কথা শুনি নি। আর স্বয়ং আমাদের আচার্যের এই কীর্তি!
    জয়োত্তম। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক-না।
    বিশ্বম্ভর। না না, আচার্যকে আমরা –
    মহাপঞ্চক। কী করবে আচার্যকে, বলেই ফেলো।
    বিশ্বম্ভর। তাই তো ভাবছি কী করা যায়। তাকে না হয় –আপনি বলে দিন-না কী করতে হবে।
    মহাপঞ্চক। আমি বলছি তাঁকে সংযত করে রাখতে হবে।
    সঞ্জীব। কেমন করে?
    মহাপঞ্চক। কেমন করে আবার কী! মত্ত হস্তীকে যেমন করে সংযত করতে হয় তেমনি করে।
    জয়োত্তম। আমাদের আচার্যদেবকে কি তা হলে –
    মহাপঞ্চক। হাঁ, তাঁকে বন্ধ করে রাখতে হবে। চুপ করে রইলে যে! পারবে না?
                                                                আচার্যের প্রবেশ
    আচার্য। বৎস, এতদিন তোমরা আমাকে আচার্য বলে মেনেছ, আজ তোমাদের সামনে আমার বিচারের দিন এসেছে। আমি স্বীকার করছি অপরাধের অন্ত নেই, অন্ত নেই, তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।
    সঞ্জীব। তবে আর দেরি করেন কেন? এ দিকে যে আমাদের সর্বনাশ হয়।
    আচার্য। গুরু চলে গেলেন, আমরা তাঁর জায়গায় পুঁথি নিয়ে বসলুম; সেই জীর্ণ পুঁথির ভাণ্ডারে প্রতিদিন তোমরা দলে দলে আমার কাছে তোমাদের তরুণ হৃদয়টি মেলে ধরে কী চাইতে এসেছিলে? অমৃতবাণী? কিন্তু আমার তালু যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! রসনায় যে রসের লেশমাত্র নেই! এবার নিয়ে এস সেই বাণী, গুরু, নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী! প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও!
    পঞ্চক। (ছুটিয়া প্রবেশ করিয়া) তোমার নববর্ষার সজল হাওয়ায় উড়ে যাক সব শুকনো পাতা —আয় রে নবীন কিশলয় —তোরা ছুটে আয়, তোরা ফুটে বেরো। ভাই জয়োত্তম, শুনছ না, আকাশের ঘন নীল মেঘের মধ্যে মুক্তির ডাক উঠেছে —আজ নৃত্য কর রে নৃত্য কর।
                                    গান
                ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে,
                          তারে আজ থামায় কে রে।
                সে যে আকাশ পানে হাত পেতেছে,
                          তারে আজ নামায় কে রে।
          প্রথমে জয়োত্তমের, পরে বিশ্বম্ভরের, পরে সঞ্জীবের নৃত্যগীতে যোগ

    মহাপঞ্চক। পঞ্চক, নির্লজ্জ বানর কোথাকার, থাম বলছি, থাম!

    পঞ্চক।                       গান

                        ওরে আমার মন মেতেছে,
                              আমারে থামায় কে রে।
    মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, আমি তোমাকে বলি নি একজটা দেবীর শাপ আরম্ভ হয়েছে? দেখছ, কী করে তিনি আমাদের সকলের বুদ্ধিকে বিচলিত করে তুলছেন —ক্রমে দেখবে অচলায়তনের একটি পাথরও আর থাকবে না।
    পঞ্চক। না, থাকবে না, থাকবে না, পাথরগুলো সব পাগল হয়ে যাবে; তারা কে কোথায় ছুটে বেরিয়ে পড়বে, তারা গান ধরবে –
                          ওরে ভাই, নাচ রে, ও ভাই, নাচ রে,—
                                আজ ছাড়া পেয়ে বাঁচ রে, —
                            লাজভয় ঘুচিয়ে দে রে;
                            তোরে আজ থামায় কে রে!
    মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী! সর্বনাশ শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছ না! ওরে সব ছন্নমতি মূর্খ, অভিশপ্ত বর্বর, আজ তোদের নাচবার দিন?     পঞ্চক। সর্বনাশের বাজনা বাজলেই নাচ শুরু হয় দাদা।
    মহাপঞ্চক। চুপ কর্ লক্ষ্মীছাড়া! ছাত্রগণ, তোমরা আত্মবিস্মৃত হোয়ো না। ঘোর বিপদ আসন্ন, সে কথা স্মরণ রেখো।
    বিশ্বম্ভর। আচার্যদেব, পায়ে ধরি, সুভদ্রকে আমাদের হাতে দিন, তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত থেকে নিরস্ত করবেন না।
    আচার্য। না বৎস, এমন অনুরোধ কোরো না।
    সঞ্জীব। ভেবে দেখুন, সুভদ্রের কতবড়ো ভাগ্য। মহাতামস ক-জন লোকে পারে। ও-যে ধরাতলে দেবত্ব লাভ করবে!
    আচার্য। গায়ের জোড়ে দেবতা গড়বার পাপে আমাকে লিপ্ত কোরো না। সে মানুষ, সে শিশু, সেই জন্যেই সে দেবতাদের প্রিয়।
    জয়োত্তম। দেখুন, আপনি আমাদের আচার্য, আমাদের প্রণম্য, কিন্তু যে অন্যায় কাজ করছেন, তাতে আমরা বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হব।
    আচার্য। করো, বলপ্রয়োগ করো, আমাকে মেনো না, আমাকে মারো, আমি অপমানেরই যোগ্য, তোমাদের হাত দিয়ে আমার যে শাস্তি আরম্ভ হল, তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সেই জন্যেই বলছি শাস্তির কারণ আর বাড়তে দেব না। সুভদ্রকে তোমাদের হাতে দিতে পারব না।
    বিশ্বম্ভর। পারবেন না?
    আচার্য। না।
    মহাপঞ্চক। তা হলে আর দ্বিধা করা নয়। বিশ্বম্ভর, এখন তোমাদের উচিত ওঁকে জোর করে ধরে নিয়ে ঘরে বন্ধ করা। ভীরু, কেউ সাহস করছ না? আমাকেই তবে এ কাজ করতে হবে?
    জয়োত্তম। খবরদার —আচার্যদেবের গায়ে হাত দিতে পারবে না।
    বিশ্বম্ভর। না না, মহাপঞ্চক, ওঁকে অপমান করলে আমরা সইতে পারব না।
    সঞ্জীব। আমরা সকলে মিলে পায়ে ধরে ওঁকে রাজি করাব। একা সুভদ্রের প্রতি দয়া করে উনি কি আমাদের সকলের অমঙ্গল ঘটাবেন?
    বিশ্বম্ভর। এই অচলায়তনের এমন কত শিশু উপবাসে প্রাণত্যাগ করেছে —তাতে ক্ষতি কী হয়েছে!

                                            সুভদ্রের প্রবেশ
    সুভদ্র। আমাকে মহাতামস ব্রত করাও।
    পঞ্চক। সর্বনাশ করলে! ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আমি এখানে এসেছিলুম কখন জেগে উঠে চলে এসেছে।
    আচার্য। বৎস সুভদ্র, এস আমার কোলে। যাকে পাপ বলে ভয় করছ সে পাপ আমার —আমিই প্রায়শ্চিত্ত করব।
    বিশ্বম্ভর। না না, আয় রে আয় সুভদ্র, তুই মানুষ না, তুই দেবতা।
    সঞ্জীব। তুই ধন্য।
    বিশ্বম্ভর। তোর বয়সে মহাতামস করা আর কারো ভাগ্যে ঘটে নি। সার্থক তোর মা তোকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন।
    উপাধ্যায়। আহা সুভদ্র, তুই আমাদের অচলায়তনেরই বালক বটে।
    মহাপঞ্চক। আচার্য, এখনো কি তুমি জোর করে এই বালককে এই মহাপূণ্য থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ?
    আচার্য। হায় হায়, এই দেখেই তো আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি ওকে কাঁদিয়ে আমার হাত থেকে ছিঁড়ে কেড়ে নিয়ে যেতে তা হলেও আমার এত বেদনা হত না। কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর মুষ্টি অতটুকু শিশুর মনকেও চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে! কখন সময় পেল সে? সে কি গর্ভের মধ্যেও কাজ করে?
    পঞ্চক। সুভদ্র, আয় ভাই, প্রায়শ্চিত্ত করতে যাই –আমিও যাব তোর সঙ্গে।
    আচার্য। বৎস, আমিও যাব।
    সুভদ্র। না না, আমাকে যে একলা থাকতে হবে –লোক থাকলে যে পাপ হবে।
    মহাপঞ্চক। ধন্য শিশু, তুমি তোমার ওই প্রাচীন আচার্যকে আজ শিক্ষা দিলে! এস তুমি আমার সঙ্গে।
    আচার্য। না, আমি যতক্ষণ তোমাদের আচার্য আছি ততক্ষণ আমার আদেশ ব্যতীত কোনো ব্রত আরম্ভ বা শেষ হতেই পারে না। আমি নিষেধ করছি। সুভদ্র, আচার্যের কথা অমান্য করো না —এস পঞ্চক, ওকে কোলে করে নিয়ে এস।
                        [সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের ও আচার্যের এবং উপাধ্যায়ের প্রস্থান
    মহাপঞ্চক। ধিক! তোমাদের মতো ভীরুদের দুর্গতি হতে রক্ষা করে এমন সাধ্য কারও নেই। তোমরা নিজেও মরবে, অন্য সকলকেও মারবে।
                        পদাতিকের প্রবেশ
    পদাতিক। স্থবিরপত্তনের রাজা আসছেন।
    মহাপঞ্চক। ব্যাপারখানা কী! এ-যে আমাদের রাজা মন্থরগুপ্ত!
                        রাজার প্রবেশ
    রাজা। নরদেবগণ, তোমাদের সকলকে নমস্কার।
    সকলে। জয়োস্তু রাজন্‌।
    মহাপঞ্চক। কুশল তো?
    রাজা। অত্যন্ত মন্দ সংবাদ। প্রত্যন্তদেশের দূতেরা এসে খবর দিল যে, দাদাঠাকুরের দল এসে আমাদের রাজ্যসীমার কাছে বাসা বেঁধেছে।
    মহাপঞ্চক। দাদাঠাকুরের দল কারা?
    রাজা। ঐ-যে যূনকরা।
    মহাপঞ্চক। যূনকরা যদি একবার আমাদের প্রাচীর ভাঙে তা হলে যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দেবে!
    রাজা। সেই জন্যেই তো ছুটে এলুম। চণ্ডক বলে একজন যূনক আমাদের স্থবিরক সম্প্রদায়ের মন্ত্র পাবার জন্যে গোপনে তপস্যা করছিল। আমি সংবাদ পেয়েই তার শিরশ্ছেদ করেছি।
    মহাপঞ্চক। ভালোই করেছেন। কিন্তু এদিকে আমাদের অচলায়তনের মধ্যেই যে পাপ প্রবেশ করেছে তার কী করলেন? আমাদের পরাভবের আর দেরি কী?
    রাজা। সে কী কথা!
    সঞ্জীব। আয়তনে একজটা দেবীর শাপ লেগেছে।
    রাজা। একজটা দেবীর শাপ! সর্বনাশ! কেন তাঁর শাপ?
    মহাপঞ্চক। যে উত্তর দিকে তাঁর অধিষ্ঠান এখানে একদিন সেই দিককার জানালা খোলা হয়েছে।
    রাজা। (বসিয়া পড়িয়া) তবে তো আর আশা নেই।
    মহাপঞ্চক। আচার্য অদীনপুণ্য এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিচ্ছেন না।
    বিশ্বম্ভর। তিনি জোর করে আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন।
    রাজা। দাও, দাও, অদীনপূণ্যকে এখনই নির্বাসিত করে দাও!
    মহাপঞ্চক। আগামী অমাবস্যায় –
    রাজা। না না, এখন তিথিনক্ষত্র দেখবার সময় নেই। বিপদ আসন্ন। সংকটের সময় আমি আমার রাজঅধিকার খাটাতে পারি– শাস্ত্রে তার বিধান আছে।
    মহাপঞ্চক। হাঁ আছে। কিন্তু আচার্য কে হবে?
    রাজা। তুমি, তুমি। এখনই আমি তোমাকে আচার্যের পদে প্রতিষ্ঠিত করে দিলুম। দিক্‌পালগণ সাক্ষী, এই ব্রহ্মচারীগণ সাক্ষী।
    মহাপঞ্চক। অদীনপুণ্যকে কোথায় নির্বাসিত করতে চান?
    রাজা। আয়তনের বাহিরে নয়। কী জানি যদি যূনকদের সঙ্গে যোগ দেন। আয়তনের প্রান্তে যে দর্ভক পাড়া আছে সেইখানে তাঁকে বদ্ধ করে রেখো।
    জয়োত্তম। আচার্য অদীনপুণ্যকে দর্ভকদের পাড়ায়! তারা যে অন্ত্যজজাতি –অশুচি পতিত!
    মহাপঞ্চক। যিনি স্পর্ধাপূর্বক আচার লঙ্ঘন করেন, অনাচারীদের মধ্যে নির্বাসনই তাঁর উচিত দণ্ড। মনে কোরো না আমার ভাই বলে পঞ্চককে ক্ষমা করব। তারও সেই দর্ভকপাড়ায় গতি।
                                                দূতের প্রবেশ
    দূত। শুনলুম গুরু খুব কাছে এসেছেন।
    রাজা। কে বললে?
    দূত। চারি দিকেই কথা উঠেছে।
    রাজা। তা হলে তো তাঁর অভ্যর্থনার আয়োজন করতে হবে। মহাপঞ্চক, অচলায়তনের সমস্ত জানলা বন্ধ করে শুদ্ধিমন্ত্র পাঠ করাতে থাকো।
    মহাপঞ্চক। জানলা বন্ধ সম্বন্ধে ভাববেন না। মন্ত্রের ভার আমি নিচ্ছি।
                                                    [রাজার প্রস্থান
    পঞ্চক কোথায়?
    জয়োত্তম। শুনলুম সে প্রাচীর ডিঙিয়ে যূনকদের কাছে গেছে।
    মহাপঞ্চক। পাষণ্ড! আর যেন সে আয়তনে ফিরে না আসে। গুরু আসবার আগেই এখানকার সমস্ত উপদ্রব দূর করা চাই। ওহে ব্রহ্মচারীগণ, মন্ত্র পড়বার জন্যে স্নান করে প্রস্তুত হয়ে এসো।