ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
১
অচলায়তন
একদল বালক
প্রথম। ওরে ভাই শুনেছিস?
দ্বিতীয়। শুনেছি – কিন্তু চুপ কর।
তৃতীয়। কেন বল দেখি?
দ্বিতীয়। কী জানি বললে যদি অপরাধ হয়?
প্রথম। কিন্তু উপাধ্যায়মশায় নিজে যে আমাকে বলেছেন।
তৃতীয়। কী বলেছেন বল-না।
প্রথম। গুরু আসছেন।
সকলে। গুরু আসছেন!
তৃতীয়। ভয় করছে না ভাই?
দ্বিতীয়। ভয় করছে।
প্রথম। আমার ভয় করছে না, মনে হচ্ছে মজা।
তৃতীয়। কিন্তু ভাই গুরু কী?
দ্বিতীয়। তা জানি নে।
তৃতীয়। কে জানে?
দ্বিতীয়। এখানে কেউ জানে না।
প্রথম। শুনেছি গুরু খুব বড়ো, খুব মস্ত বড়ো।
তৃতীয়। তাহলে এখানে কোথায় ধরবে?
প্রথম। পঞ্চকদাদা বলেন অচলায়তনে তাঁকে কোথাও ধরবে না।
তৃতীয়। কোথাও না?
প্রথম। কোথাও না।
তৃতীয়। তাহলে কী হবে?
প্রথম। ভারি মজা হবে।
পঞ্চকের প্রবেশ
পঞ্চক।
গান
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না।
আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না॥
ওরে ভাই, কে
আছিস ভাই। কাকে ডেকে বলব, গুরু আসছেন।
সঞ্জীবের প্রবেশ
সঞ্জীব। তাই তো শুনেছি। কিন্তু কে এসে খবর দিলে বলো তো।
পঞ্চক। কে দিলে তা তো কেউ বলে না।
সঞ্জীব। কিন্তু গুরু আসছেন বলে তুমি তো তৈরি হচ্ছ না পঞ্চক?
পঞ্চক। বাঃ, সেই জন্যেই তো পুঁথিপত্র সব ফেলে দিয়েছি।
সঞ্জীব। সেই বুঝি তোমার তৈরি হওয়া?
পঞ্চক। আরে, গুরু যখন না থাকেন তখনই পুঁথিপত্র। গুরু যখন আসবেন
তখন ওই সব জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে সময় খোলসা করতে হবে। আমি সেই পুঁথি বন্ধ করবার কাজে
ভয়ানক ব্যস্ত।
সঞ্জীব। তাই তো দেখছি।
[প্রস্থান
পঞ্চক।
গান
ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।
ওহে জয়োত্তম, তুমি কাঁধে কিসের বোঝা নিয়ে চলেছ? বোঝা ফেলো। গুরু
আসছেন যে।
জয়োত্তম। আরে ছুঁয়ো না এ-সব মাঙ্গল্য। গুরুর জন্যে সিংহদ্বার
সাজাতে চলেছি।
পঞ্চক। গুরু কোন্ দ্বার দিয়ে ঢুকবেন তা জানবে কী করে?
জয়োত্তম। তা তো বটেই। অচলায়তনে জানবার লোক কেবল তুমিই আছ।
পঞ্চক। তোমরাও জান না আমিও জানি নে —তফাতটা এই যে, তোমরা বোঝা
বয়ে মর, আমি হালকা হয়ে বসে আছি।
জয়োত্তম। আচ্ছা, এখন পথ ছাড়ো, আমার সময় নেই।
[প্রস্থান
পঞ্চক।
গান
বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
মহাপঞ্চক। গান! অচলায়তনে গান! মতিভ্রম হয়েছে!
পঞ্চক। এবার দাদা স্বয়ং তোমাকেও গান ধরতে হবে। একধার থেকে
মতিভ্রমের পালা আরম্ভ হল।
মহাপঞ্চক। আমি মহাপঞ্চক গান ধরব! ঠাট্টা আমার সঙ্গে!
পঞ্চক। ঠাট্টা নয়। অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে। এই
বোবা পাথরগুলো থেকে সুর বেরোবে।
মহাপঞ্চক। কেন বলো তো?
পঞ্চক। গুরু আসছেন যে! তাই আমার কেবলই মন্তরে ভুল হচ্ছে!
মহাপঞ্চক। গুরু এলে তোমার জন্যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
পঞ্চক। তার জন্যে ভাবনা কী? নির্লজ্জ হয়ে একলা আমিই মুখ দেখাব।
মহাপঞ্চক। মন্তরে ভুল হলে গুরু তোমাকে আয়তন থেকে দূর করে দেবেন।
পঞ্চক। সেই ভরসাতেই তার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
মহাপঞ্চক। অমিতায়ুর্ধারণী মন্ত্রটা –
পঞ্চক। সেই মন্ত্রটা স্বয়ং গুরুর কাছ থেকে শিখব বলেই তো আগাগোড়া
ভোলবার চেষ্টায় আছি। সেই জন্যেই গান ধরেছি দাদা।
মহাপঞ্চক। ওই শঙ্খ বাজল। এখন আমার সপ্তকুমারিকা গাথা পাঠের সময়।
কিন্তু বলে যাচ্ছি, সময় নষ্ট করো না। গুরু আসছেন।
পঞ্চক।
গান
আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না॥
ও কী ও। কান্না শুনি যে। এ নিশ্চয়ই সুভদ্র। আমাদের এই অচলায়তনে
ঐ বালকের চোখের জল আর শুকোল না। ওর কান্না আমি সইতে পারি নে।
প্রস্থান ও বালক সুভদ্রকে লইয়া পুনঃ প্রবেশ
পঞ্চক। তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল –কী
হয়েছে বল।
সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক। পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র। সে আমি বলতে পারব না। ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে?
পঞ্চক। তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল।
সুভদ্র। আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের –
পঞ্চক। উত্তর দিকের?
সুভদ্র। হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে –
পঞ্চক। জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র। বাইরেটা দেখে ফেলেছি।
পঞ্চক। দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে।
সুভদ্র। হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না —একবার দেখেই তখনই
বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
পঞ্চক। ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে;
—আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তাহলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত —আমি আসার
পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।
বালকদলের প্রবেশ
প্রথম। অ্যাঁ! সুভদ্র! তুমি বুঝি এখানে!
দ্বিতীয়। জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে?
পঞ্চক। চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র, কাঁদছিস কেন ভাই? প্রায়শ্চিত্ত
করতে হয় তো করবি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে,
প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিকতেই পারত না।
প্রথম। (চুপিচুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা—
পঞ্চক। আচ্ছা, আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অত সাহস আছে?
দ্বিতীয়। আমাদের আয়তনের উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর!
তৃতীয়। সেদিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তাহলে যে
সে—
পঞ্চক। তাহলে কী?
তৃতীয়। সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক। কী ভয়ানক শুনিই-না।
তৃতীয়। জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী
হবে?
পঞ্চক। শোন বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে
—কিন্তু যা-ই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।
সুভদ্র। ভয় কর না?
সকল ছেলে। ভয় কর না?
পঞ্চক। না, আমি তো বলি, দেখিই-না কী হয়।
সকলে। (কাছে ঘেঁষিয়া) আচ্ছা দাদা, তুমি বুঝি অনেক দেখেছ?
পঞ্চক। দেখেছি বৈ কি। ও মাসে শনিবারে যেদিন মহাময়ূরী দেবীর পূজা
পড়ল, সেদিন আমি কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে, তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার
পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিজে আঠারো বার ফুঁ দিয়েছি।
সকলে। অ্যাঁ! কী ভয়ানক! আঠারো বার!
সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, তোমার
কী হল?
পঞ্চক। তিন দিনের দিন যে সাপটা এসে আমাকে নিশ্চয় কামড়াবে কথা
ছিল, সে আজ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে পারে নি।
প্রথম। কিন্তু ভয়ানক পাপ করেছ তুমি।
দ্বিতীয়। মহাময়ূরী দেবী ভয়ানক রাগ করেছেন।
পঞ্চক। তার রাগটা কী রকম সেইটে দেখবার জন্যেই তো এ কাজ করেছি!
সুভদ্র। কিন্তু পঞ্চকদাদা, যদি তোমাকে সাপে কামড়াত!
পঞ্চক। তা হলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো সন্দেহ থাকত না—
ভাই সুভদ্র, জানলা খুলে তুই কী দেখলি বল দেখি।
দ্বিতীয়। না না, বলিস নে।
তৃতীয়। না, সে আমরা শুনতে পারব না – কী ভয়ানক!
প্রথম। আচ্ছা, একটু –খুব একটুখানি বল ভাই।
সুভদ্র। আমি দেখলুম সেখানে পাহাড়, গোরু চরছে –
বালকগণ। (কানে আঙুল দিয়া) ও বাবা, না না, আর শুনব না। আর বলো না
সুভদ্র। ঐ যে উপাধ্যায়মশায় আসছেন। চল চল— আর না।
পঞ্চক। কেন? এখন তোমাদের কী?
প্রথম। বেশ, তাও জান না বুঝি? আজ যে পূর্বফাল্গুনী নক্ষত্র—
পঞ্চক। তাতে কী?
দ্বিতীয়। আজ কাকিনী সরোবরের নৈর্ঋত কোণে ঢোঁড়া সাপের খোলস
খুঁজতে হবে না?
পঞ্চক। কেন রে?
প্রথম। তুমি কিছু জান না পঞ্চকদাদা। সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার
লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করতে হবে যে।
দ্বিতীয়। আজ যে পিতৃপুরুষেরা সেই ধোঁয়া ঘ্রাণ করতে আসবেন।
পঞ্চক। তাতে তাঁদের কষ্ট হবে না?
প্রথম। পুণ্য হবে যে, ভয়ানক পুণ্য।
[সুভদ্র ব্যতীত বালকগণের প্রস্থান
উপাধ্যায়ের প্রবেশ
সুভদ্র। উপাধ্যায়মশায়!
পঞ্চক। আরে পালা পালা। উপাধ্যায়মশায়ের কাছ থেকে একটু
পরমার্থতত্ত্ব শুনতে হবে, এখন বিরক্ত করিস নে, একেবারে দৌড়ে পালা।
উপাধ্যায়। কী সুভদ্র, তোমার বক্তব্য কী শীঘ্র বলে যাও।
সুভদ্র। আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক। ভারি পণ্ডিত কিনা। পাপ করেছি! পালা বলছি।
উপাধ্যায়। (উৎসাহিত হইয়া) পাপ করেছ? ওকে তাড়া দিচ্ছ কেন?
সুভদ্র, শুনে যাও।
পঞ্চক। আর রক্ষা নেই, পাপের এতটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতো
ছোটে।
উপাধ্যায়। কী বলছিলে?
সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
উপাধ্যায়। পাপ করেছ? আচ্ছা বেশ। তা হলে বোসো। শোনা যাক।
সুভদ্র। আমি আয়তনের উত্তর দিকের –
উপাধ্যায়। বলো, বলো, উত্তর দিকের দেয়ালে আঁক কেটেছ?
সুভদ্র। না, আমি উত্তর দিকের জানলায় –
উপাধ্যায়। বুঝেছি, কুনুই ঠেকিয়েছ। তা হলে তো সেদিকে আমাদের
যতগুলি যজ্ঞের পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানলা না
চাটাতে পারলে শোধন হবে না।
পঞ্চক। এটা আপনি ভুল বলছেন। ক্রিয়াসংগ্রহে আছে ভূমিকূষমাণ্ডের
বোঁটা দিয়ে একবার –
উপাধ্যায়। তোমার তো স্পর্ধা কম দেখি নে। কুলদত্তের
ক্রিয়াসংগ্রহের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কি কোনদিন খুলে দেখা হয়েছে?
পঞ্চক। (জনান্তিকে) সুভদ্র, যাও তুমি।– কিন্তু কুলদত্তকে তো আমি
–
উপাধ্যায়। কুলদত্তকে মান না? আচ্ছা, ভরদ্বাজ মিশ্রের
প্রয়োগপ্রজ্ঞপ্তি তো মানতেই হবে— তাতে –
সুভদ্র। উপাধ্যায় মশায়, আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক। আবার! সেই কথাই তো হচ্ছে। তুই চুপ কর।
উপাধ্যায়। সুভদ্র, উত্তরের দেয়ালে যে আঁক কেটেছ সে চতুষ্কোণ, না
গোলাকার?
সুভদ্র। আঁক কাটি নি। আমি জানলা খুলে বাইরে চেয়েছিলুম।
উপাধ্যায়। (বসিয়া পড়িয়া) আঃ সর্বনাশ! করেছিস কী? আজ তিনশো
পঁয়তাল্লিশ বছর ওই জানলা কেউ খোলে নি তা জানিস?
সুভদ্র। আমার কী হবে!
পঞ্চক। (সুভদ্রকে আলিঙ্গন করিয়া) তোমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র।
তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ। তোমার এই অসামান্য সাহস দেখে
উপাধ্যায়মশায়ের মুখে আর কথা নেই। গুরু আসার পথ তুমিই প্রথম খোলসা করে দিলে।
[সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান
উপাধ্যায়। জানি নে কী সর্বনাশ হবে। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী যে
একজটা দেবী! বালকের দুই চক্ষু মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। যাই
আচার্যদেবকে জানাই গে।
[প্রস্থান
আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ
আচার্য। এতকাল পরে আমাদের গুরু আসছেন।
উপাচার্য। তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।
আচার্য। প্রসন্ন হয়েছেন? তা হবে। হয়তো প্রসন্নই হয়েছেন। কিন্তু
কেমন করে জানব?
উপাচার্য। নইলে তিনি আসবেন কেন?
আচার্য। এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ
হয়েছে বলেই তিনি আসছেন।
উপাচার্য। না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না। আমরা কঠোর নিয়ম
সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি —কোনো ত্রুটি ঘটে নি।
আচার্য। কঠোর নিয়ম? হাঁ, সমস্তই পালিত হয়েছে।
উপাচার্য। বজ্রশুদ্ধিব্রত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতাত্তর
বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয়!
আচার্য। না, আর কোথাও হতে পারে না।
উপাচার্য। কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন?
আচার্য। সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ?
উপাচার্য। আমার তো একমুহূর্তের জন্যে অশান্তি নেই।
আচার্য। অশান্তি নেই?
উপাচার্য। কিছুমাত্র না। আমার অহোরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা। এর
চেয়ে আর শান্তি কী হতে পারে?
আচার্য। ঠিক, ঠিক –ঠিক বলেছ সূতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায়
তার অন্ত পাব? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত – এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর
এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায় –তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার
হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি!
উপাচার্য। আচার্যদেব, আপনাকে এমন বিচলিত হতে কখনো দেখি নি।
আচার্য। কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারি
দিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক
পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত। তুমি এটা অনুভব করতে পারছ না সূতসোম?
উপাচার্য। কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র
বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না। আমাদের সমস্ত শিক্ষা
কোন্ কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত। ঐ-যে
পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয়? এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল! ঐ
আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল আপনাকেই মানে। আপনি ওকে একটু ভর্ৎসনা করে
দেবেন।
আচার্য। আচ্ছা তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে
দেখি।
[উপাচার্যের প্রস্থান
পঞ্চকের
প্রবেশ
আচার্য। (পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস পঞ্চক!
পঞ্চক। করলেন কী! আমাকে ছুঁলেন?
আচার্য। কেন, বাধা কী আছে?
পঞ্চক। আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি।
আচার্য। কেন পার নি বৎস?
পঞ্চক। প্রভু, কেন, তা আমি বলতে পারি নে। আমার পারবার উপায় নেই।
আচার্য। সৌম্য, তুমি তো জান, এখানকার যে নিয়ম সেই নিয়মকে আশ্রয়
করে হাজার বছর হাজার হাজার লোক নিশ্চিন্ত আছে। আমরা যে খুশি তাকে কি ভাঙতে পারি?
পঞ্চক। আচার্যদেব, যে-নিয়ম সত্য তাকে ভাঙতে না দিলে তার যে
পরীক্ষা হয় না। তাই কি ঠিক নয়?
আচার্য। যাও বৎস, তোমার পথে তুমি যাও। আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা
করো না।
পঞ্চক। আচার্যদেব, আপনি জানেন না কিন্তু আপনিই আমাকে নিয়মের
চাকার নিচে থেকে টেনে নিয়েছেন।
আচার্য। কেমন করে বৎস?
পঞ্চক। তা জানি নে, কিন্তু আপনি আমাকে এমন একটা-কিছু দিয়েছেন যা
আচারের চেয়ে, নিয়মের চেয়ে অনেক বেশি।
আচার্য। তুমি কী কর না-কর আমি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করি নে, কিন্তু
আজ একটি কথা জিজ্ঞাসা করব। তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে যূনক জাতির সঙ্গে মেশ?
পঞ্চক। আপনি কি এর উত্তর শুনতে চান?
আচার্য। না না থাক্, বলো না। কিন্তু যূনকেরা যে অত্যন্ত
ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি –
পঞ্চক। তাদের সম্বন্ধে আপনার কি কোনো বিশেষ আদেশ আছে?
আচার্য। না না, আদেশ আমার কিছুই নেই। যদি ভুল করতে হয় তবে ভুল
করো গে –তুমি ভুল করো গে—আমাদের কথা শুনো না।
পঞ্চক। ওই উপাচার্য আসছেন –বোধ করি কাজের কথা আছে—বিদায় হই।
[প্রস্থান
উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ
উপাচার্য। (উপাধ্যায়ের প্রতি) আচার্যদেবকে তো বলতেই হবে। উনি
নিতান্ত উদ্বিগ্ন হবেন— কিন্তু দায়িত্ব যে ওঁরই।
আচার্য। উপাধ্যায়, কোনো সংবাদ আছে নাকি?
উপাধ্যায়। অত্যন্ত মন্দ সংবাদ।
আচার্য। অতএব সেটা সত্বর বলা উচিত।
উপাধ্যায়। আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা
খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।
আচার্য। উত্তর দিকটা তো একজটা দেবীর।
উপাধ্যায়। সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসকে
সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।
উপাচার্য। এখন কথা হচ্ছে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী।
আচার্য। আমার তো স্মরণ হয় না। উপাধ্যায় বোধ করি -
উপাধ্যায়। না, আমিও তো মনে আনতে পারি নে। আজ তিনশো বছর এ
প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয় নি— সবাই ভুলেই
মহাপঞ্চক। পঞ্চক, নির্লজ্জ বানর কোথাকার, থাম বলছি, থাম!
পঞ্চক। গান