জীবনস্মৃতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড
(বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিক্ষারম্ভ
১ "আমার দাদা সোমেন্দ্রনাথ, আমার ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ
[গঙ্গোপাধ্যায়] এবং আমি।" পান্ডুলিপি ২ মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – র-কথা ৩ বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপের পাঠশালায় – ছেলেবেলা, অধ্যায় ৮ ৪ দ্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – প্রণীত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ |
আমরা তিনটি বালক১ একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম। আমার
সঙ্গীদুটি আমার চেয়ে দুইবছরের বড়ো। তাঁহারা যখন গুরুমহাশয়ের২
কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল৩,
কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই।
কেবল মনে পড়ে, 'জল পড়ে পাতা নড়ে'। তখন 'কর, খল' প্রভৃতি বানানের
তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি 'জল পড়ে পাতা নড়ে৪।
আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে
পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও
শেষ হয় না―
তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না―
মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া,
সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল।
এই শিশুকালের আর-একটা কথা মনের মধ্যে বাঁধা পড়িয়া গেছে। আমাদের
একটি অনেক কালের খাজাঞ্চি ছিল, কৈলাস মুখুজ্যে তাহার নাম। সে আমাদের ঘরের আত্মীয়েরই
মতো। লোকটি ভারি রসিক। সকলের সঙ্গেই তাহার হাসিতামাশা। বাড়িতে নূতনসমাগত
জামাতাদিগকে সে বিদ্রূপে কৌতুকে বিপন্ন করিয়া তুলিত। মৃত্যুর পরেও তাহার কৌতুকপরতা
কমে নাই, এরূপ জনশ্রুতি আছে। একসময় আমার গুরুজনেরা প্ল্যাঞ্চেট-যোগে পরলোকের সহিত
ডাক বসাইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত ছিলেন। একদিন তাঁহাদের প্ল্যাঞ্চেটের পেন্সিলের রেখায়
কৈলাস মুখুজ্যের নাম দেখা দিল। তাহাকে জিজ্ঞাস করা হইল, তুমি যেখানে আছ সেখানকার
ব্যবস্থাটা কিরূপ, বলো দেখি। উত্তর আসিল, আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি, আপনারা বাঁচিয়াই
তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।
সেই কৈলাস মুখুজ্যে আমার শিশুকালে অতি দ্রুতবেগে মস্ত একটা ছড়ার
মতো বলিয়া আমার মনোরঞ্জন করিত। সেই ছড়াটার প্রধান নায়ক ছিলাম আমি এবং তাহার মধ্যে
একটি ভাবী নায়িকার নিঃসংশয় সমাগমের আশা অতিশয় উজ্জ্বলভাবে বর্ণিত ছিল। এই যে
ভুবনমোহিনী বধূটি ভবিতব্যতার কোল আলো করিয়া বিরাজ করিতেছিল, ছড়া শুনিতে শুনিতে
তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত। আপাদমস্তক তাহার যে বহুমূল্য অলংকারের
তালিকা পাওয়া গিয়াছিল এবং মিলনোৎসবের যে অভূতপূর্ব সমারোহের বর্ণনা শুনা যাইত,
তাহাতে অনেক প্রবীণ-বয়স্ক সুবিবেচক ব্যক্তির মন চঞ্চল হইতে পারিত―
কিন্তু বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানাবর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য
সুখচ্ছবি দেখিতে পাইত, তাহার মূল কারণ ছিল সেই দ্রুত-উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা এবং
ছন্দের দোলা। শিশুকালের সাহিত্যরসভোগের এই দুটো স্মৃতি এখনো জাগিয়া আছে―
আর মনে পড়ে, 'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।' ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।
তাহার পরে যে কথাটা মনে পড়িতেছে তাহা ইস্কুলে যাওয়ার সূচনা।
একদিন দেখিলাম, দাদা এবং আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয় সত্য ইস্কুলে গেলেন, কিন্তু আমি
ইস্কুলে যাইবার যোগ্য বলিয়া গণ্য হইলাম না। উচ্চৈঃস্বরে কান্না ছাড়া যোগ্যতা প্রচার
করার আর-কোনো উপায় আমার হাতে ছিল না। ইহার পূর্বে কোনোদিন গাড়িও চড়ি নাই বাড়ির
বাহিরও হই নাই, তাই সত্য যখন ইস্কুল-পথের ভ্রমণবৃত্তান্তটিকে অতিশয়োক্তি-অলংকারে
প্রত্যহই অত্যুজ্জ্বল করিয়া তুলিতে লাগিল তখন ঘরে আর মন কিছুতেই টিকিতে চাহিল না।
যিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি আমার মোহ বিনাশ করিবার জন্য প্রবল চপেটাঘাতসহ এই
সারগর্ভ কথাটি বলিয়াছিলেন, "এখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছে, না যাবার জন্য
ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে।" সেই শিক্ষকের নামধাম আকৃতিপ্রকৃতি আমার কিছুই
মনে নাই―কিন্তু
সেই গুরুবাক্য ও গুরুতর চপেটাঘাত স্পষ্ট মনে জাগিতেছে। এতবড় অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী
জীবনে আর-কোনোদিন কর্ণগোচর হয় নাই।
১ গৌরমোহন আঢ্যের বিদ্যালয় স্থাপিত ১৮২৩।
বিদ্যালয়টি তখন "গরানহাটায় গোরাচাঁদ বশাকের বাটীতে" অবস্থিত ছিল। ২ সারদাদেবী (১৮২৪-৭৫), বিবাহ ১৮২৯-৩০। মতান্তরে (রবীন্দ্র কথা পৃ ১-৪): সারদাদেবীর জন্ম, ইং ১৮২৬; বিবাহ ফাল্গুন ১২৪০[১৮৩৪]। ৩ সারদাদেবীর "কাকার দ্বিতীয় পক্ষের বিধবা স্ত্রী", "তিনি প্রায় মায়ের[সারদাদেবী] সমবয়সী ছিলেন।" ―জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর আত্মচরিত, পাণ্ডুলিপি |
কান্নার জোরে ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে১
অকালে ভরতি হইলাম। সেখানে কী শিক্ষালাভ করিলাম মনে নাই কিন্তু একটা শাসনপ্রণালীর
কথা মনে আছে। পড়া বলিতে না পারিলে ছেলেকে বেঞ্চে দাঁড় করাইয়া তাহার দুই প্রসারিত
হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একত্র করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইত। এরূপে
ধারণাশক্তির অভ্যাস বাহির হইতে অন্তরে সঞ্চারিত হইতে পারে কি না তাহা
মনস্তত্ত্ববিদ্দিগের আলোচ্য।
এমন করিয়া নিতান্ত শিশুবয়সেই আমার পড়া আরম্ভ হইল। চাকরদের মহলে
যে-সকল বই প্রচলিত ছিল তাহা লইয়াই আমার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়। তাহার মধ্যে
চানক্যশ্লোকের বাংলা অনুবাদ ও কৃত্তিবাস-রামায়ণই প্রধান। সেই রামায়ণ পড়ার একটা
দিনের ছবি মনে স্পষ্ট জাগিতেছে।
সেদিন মেঘলা করিয়াছে; বাহিরবাড়িতে রাস্তার ধারের লম্বা
বারান্দাটাতে খেলিতেছি। মনে নাই সত্য কী কারণে আমাকে ভয় দেখাইবার জন্য হঠাৎ
'পুলিসম্যান' 'পুলিসম্যান' করিয়া ডাকিতে লাগিল। পুলিসম্যানের কর্তব্য সম্বন্ধে
অত্যন্ত মোটামুটি রকমের একটা ধারণা আমার ছিল। আমি জানিতাম, একটা লোককে অপরাধী বলিয়া
তাহাদের হাতে দিবামাত্রই, কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া
জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার
মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিসকর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম। এরূপ নির্মম শাসনবিধি হইতে
নিরপরাধ বালকের পরিত্রাণ কোথায় তাহা ভাবিয়া না পাইয়া একেবারে অন্তঃপুরে দৌড় দিলাম;
পশ্চাতে তাহারা অনুসরণ করিতেছে এই অন্ধভয় আমার সমস্ত পৃষ্ঠদেশকে কুণ্ঠিত করিয়া
তুলিল। মাকে২ গিয়া আমার আসন্ন বিপদের সংবাদ জানাইলাম;
তাহাতে তাঁহার বিশেষ উৎকণ্ঠার লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। কিন্তু আমি বাহিরে যাওয়া
নিরাপদ বোধ করিলাম না। দিদিমা, আমার মাতার কোনো-এক সম্পর্কে খুড়ি৩,
যে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেন সেই মার্বেলকাগজ-মণ্ডিত কোণছেঁড়া-মলাটওয়ালা মলিন
বইখানি কোলে লইয়া মায়ের ঘরের দ্বারের কাছে পড়িতে বসিয়া গেলাম। সম্মুখে অন্তঃপুরের
আঙিনা ঘেরিয়া চৌকোণ বারান্দা; সেই বারান্দায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হইতে অপরাহ্নের ম্লান
আলো আসিয়া পড়িয়াছে। রামায়ণের কোনো-একটা করুণ বর্ণনায় আমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে
দেখিয়া দিদিমা জোর করিয়া আমার হাত হইতে বইটা কাড়িয়া লইয়া গেলেন।