ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কালমৃগয়া

পঞ্চম দৃশ্য


                 [শিকারীগণের প্রবেশ]

            ইমন কল্যাণ  একতালা
  বনে বনে সবে মিলে চলো হো!  চলো হো!
ছুটে আয়, শিকারে কে রে যাবি আয়!
         এমন রজনী বহে যায় রে!
ধনুর্বাণ বল্লম লয়ে হাতে
        আয় আয় আয়, আয় রে!
        বাজা শিঙা ঘন ঘন—
        শব্দে কাঁপিবে বন,
        আকাশ ফেটে যাবে,
        চমকিবে পশু পাখি সবে,
        ছুটে যাবে কাননে কাননে—
        চারি দিক ঘিরে যাব পিছে পিছে।
        হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ


            [
দশরথের প্রবেশ]
                সিন্দুড়া
 
শিকারীগণ।  জয়তি জয় জয় রাজন্, বন্দি তোমারে,
          কে আছে তোমা-সমান।
ত্রিভুবন কাঁপে তোমার প্রতাপে,
        তোমারে করি প্রণাম
!

      
দশরথ।                [শিকারীদের প্রতি]

                              বাহার
  গহনে গহনে যা রে তোরা,
         নিশি ব'হে যায় যে।
তন্ন তন্ন করি অরণ্য
      করী বরাহ খোঁজগে!
     এই বেলা যা রে!
     নিশাচর পশু সবে
     এখনি বাহির হবে—
ধনুর্বাণ নে রে হাতে চল্ ত্বরা চল্।
     জ্বালায়ে মশাল-আলো
               এই বেলা আয় রে

                                       [
প্রস্থান
প্রথম শিকারী।  চল্ চল্ ভাই,
  ত্বরা ক’রে মোরা আগে যাই।
দ্বিতীয়।            প্রাণপণ খোঁজ্ এ বন, সে বন।
তৃতীয়।            চল্ মোরা ক’জন ও দিকে যাই।
প্রথম।             না না ভাই, কাজ নাই—
                     হোথা কিছু নাই— কিছু নাই—
                     ওই ঝোপে যদি কিছু পাই।
তৃতীয়।            বরা! বরা!
প্রথম।                    আরে, দাঁড়া দাঁড়া,
  অত ব্যস্ত হ'লে ফস্কাবে শিকার।
  চুপি চুপি আয়, চুপি চুপি আয়
        ওই অশথতলায়।
এবার ঠিকঠাক হয়ে সবে থাক্—
সাবধান, ধর বাণ, সাবধান, ছাড়ো বাণ্—
২।৩ জন।        গেল গেল, ওই ওই পালায় পালায়।
               চল্ চল্—
ছোট্ রে পিছে, আয় রে ত্বরা যাই

                                 [
প্রস্থান

           [বিদূষকের সভয়ে প্রবেশ]

            দেশ —খেমটা
প্রাণ নিয়ে তো সটকেছি রে,
        ওরে বরা, করবি এখন কি!
                 বাবা রে!
আমি চুপ ক'রে এই
         আমড়াতলায় লুকিয়ে থাকি।
এই মরদের মুরোদখানা,
দেখেও কি রে ভড়কালি না—
বাহবা, সাবাস তোরে,
         সাবাস্ রে তোর ভরসা দেখি।
গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে
ব্রাহ্মণীরে ঘরে ফেলে
          কোথা এলেম এ ঘোর বনে!
মনে আশা ছিল মস্ত
চলবে ভালো দক্ষিণ হস্ত —
হা রে রে পোড়া কপাল,
        তাও যে দেখি কেবল ফাঁকি
!

        [
শিকারীগণের প্রবেশ]

            শঙ্করা
 
শিকারীগণ। ঠাকুরমশয়, দেরি না সয়
  তোমার আশায় সবাই ব'সে।
শিকারেতে হবে যেতে,
মিহি কোমর বাঁধো ক'ষে!
বন বাদাড় সব ঘেঁটেঘুঁটে
আমরা মরি খেটেখুটে.
তুমি কেবল লুটে পুটে
পেট পোরাবে ঠেসেঠুসে!
বিদূষক। কাজ কি খেয়ে, তোফা আছি—
  আমায় কেউ না খেলেই বাঁচি!
শিকার করতে যায় কে মরতে—
ঢুঁসিয়ে দেবে বরা' মোষে!
টু খেয়ে তো পেট ভরে না,
সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে


        [
হাসিতে হাসিতে শিকারীগণের প্রস্থান]

                মিশ্র সিন্ধু
   
বিদূষক।   আঃ   বেঁচেছি এখন।
          শর্মা   ও দিকে আর নন।
গোলেমালে ফাঁকতালে সটকেছি কেমন।
! দেখে বরা'র দাঁতের পাটি
লেগেছিল দাঁত-কপাটি,
পড়ল খ'সে হাতের লাঠি      
        কে জানে কখন।
চুলগুলা সব ঘাড়ে খাড়া,
চক্ষু-দুটো মশাল-পারা,
গোঁ-ভরে হেঁট-মুখে তাড়া      
          কল্লে সে যখন—
রাস্তা দেখতে পাই নে চোখে,
পেটের মধ্যে হাত পা ঢোকে,
চুপসে গেল ফাঁপা ভুঁড়ি 
         শঙ্কাতে তখন।

                        [প্রস্থান]

       [শিকার স্কন্ধে
শিকারীগণের প্রবেশ]
          এনেছি মোরা এনেছি মোরা
          রাশি রাশি শিকার!
          করেছি ছারখার,
          সব   করেছি ছারখার!
          বন-বাদাড় তোলপাড়,
          করেছি রে উজাড়
!
                     [
গাইতে গাইতে প্রস্থান

         [বনদেবীদের প্রবেশ]
              মিশ্র মল্লার —পোস্ত
কে এল আজি এ ঘোর নিশীথে
সাধের কাননে শান্তি নাশিতে।
মত্ত করী যত পদ্মবন দলে
         বিমল সরোবর মন্থিয়া।
ঘুমন্ত বিহগে কেন বধে রে
        সঘনে খর শর সন্ধিয়া!
তরাসে চমকিয়ে হরিণ হরিণী
        স্খলিত চরণে ছুটিছে!
স্খলিত চরণে ছুটিছে কাননে,
        করুণ নয়নে চাহিছে।
আকুল সরসী, সারস সারসী
        শরবনে পশি কাঁদিছে।
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
        বিপদ-ঘনছায়া ছাইয়া।
কি জানি কি হবে, আজি এ নিশীথে,
        তরাসে প্রাণ ওঠে কাঁপিয়া

                                  [
প্রস্থান

        [দশরথের প্রবেশ]
না জানি কোথা এলুম, এ যে ঘোর বন।
কোথা সে করীশিশু, কোথা লুকালো!
একে তো জটিল বন, তাহে আঁধার ঘন!
যাক্-না যাবে সে কত দূর, কত দূর—
যাব পিছে পিছে—
না না না না, ও কী শুনি!
ওই সে সরযূতীরে করিছে সলিল পান
শবদ শুনি যে ওই, এই তবে ছাড়ি বাণ!
 
           নেপথ্যে বনদেবীগণ
হায় কী হ'ল! হায় কী হ'ল!

   [বাণাহত ঋষিকুমারের নিকট দশরথের গমন]
          বেহাগ —আড়াঠেকা

           কী করিনু হায়!
এ তো নয় রে করীশিশু! ঋষির তনয়!
নিঠুর প্রখর বাণে রুধিরে আপ্লুতকায়,
কার রে প্রাণের বাছা ধুলাতে লুটায়!
কী কুলগ্নে না জানি রে ধরিলাম বাণ,
কী মহাপাতকে কার বধিলাম প্রাণ!
দেবতা; অমৃতনীরে হারা প্রাণ দাও ফিরে,
নিয়ে যাও মায়ের কোলে মায়ের বাছায়!
 
         [মুখে জলসিঞ্চন]

         খট্ —ঝাঁপতাল
 

ঋষিকুমার। কী দোষ করেছি তোমার,
  কেন গো হানিলে বাণ!
একই বাণে বধিলে যে
দুটি অভাগার প্রাণ।
শিশু বনচারী আমি!
কিছুই নাহিক জানি—
ফল মূল তুলে আনি,
করি সামবেদ গান!
জন্মান্ধ জনক মম
তৃষায় কাতর হয়ে
রয়েছেন পথ চেয়ে—
কখন যাব বারি লয়ে।
মরণান্তে নিয়ে যেও,
এ দেহ তাঁর কোলে দিও—
দেখা, দোখো, ভুলোনাকো,
কোরো তাঁরে বারিদান।
মার্জনা করিবেন পিতা,
তাঁর যে দয়ার প্রাণ!
          [মৃত্যু]