ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কালমৃগয়া

ষষ্ঠ দৃশ্য


          কুটীর
     অন্ধ ঋষি
মিশ্র ঝিঁঝিট খাম্বাজ মধ্যমান
অন্ধ ঋষি আমার প্রাণ যে ব্যাকুল হয়েছে
  হা তাত, একবার আয় রে।
ঘোরা রজনী, একাকী,
কোথা রহিলে এ সময়ে!
প্রাণ যে চমকে মেঘগরজনে
কী হবে কে জানে!

           [লীলার প্রবেশ]
       রামকেলী কাওয়ালি

বল বল, পিতা, কোথা সে গিয়েছে।
কোথা সে ভাইটি মম কোন্ কাননে,
       কেন তাহারে নাহি হেরি!
খেলিবে সকালে আজ বলেছিল সে,
       তবু কেন এখনো না এল?
বনে বনে ফিরি 'ভাই ভাই' করিয়ে,
       কেন গো সাড়া পাই নে!

          বেহাগ কাওয়ালি
 
অন্ধ।         কে জানে কোথা সে!
  প্রহর গণিয়া গণিয়া বিরলে
       তারি লাগি ব'সে আছি!
একা হেথা, কুটীরদুয়ারে—
        বাছা রে, এলি নে!
ত্বরা আয়, ত্বরা আয়, আয় রে—
        জল আনিয়ে কাজ নাই,
তুই যে আমার পিপাসার জল!
       কেন রে জাগিছে মনে ভয়!
কেন আজি তোরে,
       হারাই-হারাই  মনে হয়
                       কে জানে!
                           [লীলার প্রস্থান

         [মৃতদেহ লইয়া দশরথের  প্রবেশ]

                  সিন্ধু চৌতাল
অন্ধ। এতক্ষণে বুঝি এলি রে!
  হৃদিমাঝে আয় রে, বাছা রে!
কোথা ছিলি বনে এ ঘোর রাতে,
এ দুর্য্যোগে, অন্ধ পিতারে ভুলি!
আছি সারানিশি হায় রে
পথ চাহিয়ে, আছি তৃষায় কাতর—
দে মুখে বারি! কাছে আয় রে!

              রাজবিজয়ী
দশরথ।  অজ্ঞানে করো হে ক্ষমা, তাত, ধরি চরণে—
           কেমনে কহিব, শিহরি আতঙ্কে।
আঁধারে সন্ধানি শর খরতর
        করী-ভ্রমে বধি তব পুত্রবর,
        গ্রহদোষে পড়েছি পাপপঙ্কে!

        [দশরথ-কর্তৃক ঋষির নিকটে
          ঋষিকুমারের মৃতদেহ স্থাপন]
অন্ধ। কী বলিলে, কী শুনিলাম, এ কি কভু হয়!
  এই-যে জল আনিবারে গেল সে সরযূতীরে—
কার সাধ্য বধে, সে যে, ঋষির তনয়!
সুকুমার শিশু সে যে, স্নেহের বাছা রে,
আছে কি নিষ্ঠুর কেহ বধিবে যে তারে!
না না না, কোথা সে আছে— এনে দে আমার কাছে,
সারা নিশি জেগে আছি, বিলম্ব না সয়।
এখনো যে নিরুত্তর— নাহি প্রাণে ভয়!
রে দুরাত্মা— কী করিলি—

            [অভিশাপ]
        পুত্রব্যসনজং দুঃখং
        যদেতন্মম সাংপ্রতম্
        এবং ত্বং পুত্রশোকেন
        রাজন্ কালং করিষ্যসি॥

          মিশ্র ভূপালি কাওয়ালি
 
দশরথ। ক্ষমা করো মোরে, তাত,
  আমি যে পাতকী ঘোর
না জেনে হয়েছি দোষী,
মার্জনা নাহি কি মোর!
ও! সহে না যাতনা আর,
শান্তি পাইব কোথায়
তুমি কৃপা না করিলে
নাহি যে কোনো উপায়!
আমি দীন হীন অতি—
ক্ষম ক্ষম কাতরে,
প্রভু হে, করহ ত্রাণ
এ পাপের পাথারে।

   কাফি আড়াঠেকা
 
অন্ধ। আহা, কেমনে বধিল তোরে!
  তুই যে স্নেহের পুতলি, সুকুমার শিশু ওরে!
বড় কি বেজেছে বুকে! বাছা রে,
কোলে আয়, কোলে আয় একবার—
ধূলাতে কেন লুটায়ে, রাখিব বুকে ক'রে!

         [কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে অবস্থান ও
          অবশেষে উঠিয়া দাঁড়াইয়া
          দশরথের প্রতি]

            নটনারায়ণ

       শোক তাপ গেল দূরে,
       মার্জনা করিনু তোরে!
 
          [পুত্রের প্রতি]

               প্রভাতী
যাও রে অনন্ত ধামে মোহ মায়া পাশরি
        দুঃখ আঁধার যেথা কিছুই নাহি।
জরা নাহি, মরণ নাহি, শোক নাহি যে লোকে,
       কেবলই আনন্দস্রোত চলিছে প্রবাহি!
যাও রে অনন্তধামে, অমৃতনিকেতনে,
       অমরগণ লইবে তোমা উদার-প্রাণে!
দেব-ঋষি রাজ-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি যে লোকে
      ধ্যানভরে গান করে এক তানে!
যাও-রে অনন্ত ধামে জ্যোতির্ময় আলয়ে,
      শুভ্র সেই চিরবিমল পুণ্য কিরণে—
যায় যেথা দানব্রত সত্যব্রত পুণ্যবান
      যাও বৎস, যাও সেই দেবসদনে!

             [যবনিকাপতন]

  [পুনরুত্থান ঋষিকুমারের মৃতদেহ ঘেরিয়া বনদেবীদের গান]

              ঝি!ঝিট খাম্বাজ একতালা

          সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়,
কোথা সে লুকাল, কোথা সে হায়।
    কুসুমকানন হয়েছে ম্লান,
    পাখিরা কেন রে গাহে না গান,
        ও! সব হেরি শূন্যময়,
             কোথা সে হায়!
    কাহার তরে আর ফুটিবে ফুল,
    মাধবী মালতী কেঁদে আকুল।
সেই যে আসিত তুলিতে জল,
সেই যে আসিত পাড়িতে ফল,
    ও সে! আর আসিবে না,
           কোথা সে হায়!

          যবনিকাপতন

          সমাপ্ত