ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
কল্পনা
প্রকাশ
হাজার হাজার বছর কেটেছে, কেহ তো কহে নি কথা--
ভ্রমর ফিরেছে মাধবীকুঞ্জ, তরুরে ঘিরেছে লতা,
চাঁদেরে চাহিয়া চকোরী উড়েছে, তড়িৎ খেলেছে মেঘে,
সাগর কোথায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া তটিনী ছুটেছে বেগে,
ভোরের গগনে অরুণ উঠিতে কমল মেলেছে আঁখি,
নবীন আষাঢ় যেমনি এসেছে চাতক উঠেছে ডাকি!
এত যে গোপন মনের মিলন ভুবনে ভুবনে আছে,
সে কথা কেমনে হইল প্রকাশ প্রথম কাহার কাছে!
না জানি সে কবি জগতের কোণে কোথা ছিল দিবানিশি,
লতাপাতা চাঁদ মেঘের সহিতে এক হয়ে ছিল মিশি!
ফুলের মতন ছিল সে মৌন মনের আড়ালে ঢাকা,
চাঁদের মতন চাহিতে জানিত নয়ন স্বপনমাখা,
বায়ুর মতন পারিত ফিরিতে অলক্ষ্য মনোরথে
ভাবনা-সাধনা-বেদনা-বিহীন বিফল ভ্রমণপথে—
মেঘের মতন আপনার মাঝে ঘনায়ে আপন ছায়া
একা বসি কোণে জানিত রচিতে ঘনগম্ভীর মায়া।
দ্যুলোকে-ভূলোকে ভাবে নাই কেহ আছে সে কিসের খোঁজে,
হেন সংশয় ছিল না কাহারো সে যে কোনো কথা বোঝে।
বিশ্বপ্রকৃতি তার কাছে তাই ছিল নাকো সাবধানে,
ঘন ঘন তার ঘোমটা খসিত ভাবে ইঙ্গিতে গানে।
বাসরঘরের বাতায়ন যদি খুলিয়া যাইত কভু
দ্বারপাশে তারে বসিতে দেখিয়া রুধিয়া দিত না তবু।
যদি সে নিভৃত শয়নের পানে চাহিত নয়ন তুলি
শিয়রের দীপ নিবাইতে কেহ ছুঁড়িত না ফুলধূলি।
শশী যবে নিত নয়নে নয়নে কুমুদীর ভালোবাসা
এরে দেখি হেসে ভাবিত, এ লোক জানে না চোখের ভাষা।
নলিনী যখন খুলিত পরান চাহি তপনের পানে
ভাবিত এজন ফুলগন্ধের অর্থ কিছু না জানে।
তড়িৎ যখন চকিত নিমেষে পালাত চুমিয়া মেঘে
ভাবিত, এ খ্যাপা কেমনে বুঝিবে কী আছে অগ্নিবেগে!
সহকারশাখে কাঁপিতে কাঁপিতে ভাবিত মালতীলতা,
আমি জানি আর তরু জানে শুধু কলমর্মরকথা।
একদা ফাগুনে সন্ধ্যাসময়ে সূর্য নিতেছে ছুটি,
পূর্বগগনে পূর্ণিমা চাঁদ করিতেছে উঠি-উঠি,
কোনো পুরনারী তরু-আলবালে জল সেচিবার ভানে
ছল করে শাখে আঁচল বাধায়ে ফিরে চায় পিছুপানে,
কোনো সাহসিকা দুলিছে দোলায় হাসির বিজুলি হানি—
না চাহে নামিতে, না চাহে থামিতে, না মানে বিনয়বাণী,
কোনো মায়াবিনী মৃগশিশুটিরে তৃণ দেয় একমনে—
পাশে কে দাঁড়ায়ে চিনেও তাহারে চাহে না চোখের কোণে।
হেনকালে কবি গাহিয়া উঠিল, ‘নরনারী, শুন সবে,
কত কাল ধরে কী যে রহস্য ঘটিছে নিখিল ভবে!
এ কথা কে কবে স্বপনে জানিত, আকাশের চাঁদ চাহি
পাণ্ডুকপোল কুমুদীর চোখে সারা রাত নিদ নাহি।
উদয়-অচলে অরুণ উঠিলে কমল ফুটে যে জলে
এত কাল ধরে তাহার তত্ত্ব ছাপা ছিল কোন্ ছলে!
এত যে মন্ত্র পড়িল ভ্রমর নবমালতীর কানে
বড়ো বড়ো যত পণ্ডিতজনা বুঝিল না তার মানে!’
শুনিয়া তপন অস্তে নামিল শরমে গগন ভরি,
শুনিয়া চন্দ্র থমকি রহিল বনের আড়াল ধরি!
শুনে সরোবরে তখনি পদ্ম নয়ন মুদিল ত্বরা,
দখিন-বাতাস বলে গেল তারে— সকলি পড়েছে ধরা!
শুনে ‘ছিছি’ ব’লে শাখা নাড়ি নাড়ি শিহরি উঠিল লতা,
ভাবিল, মুখর এখনি না জানি আরো কী রটাবে কথা!
ভ্রমর কহিল যূথীর সভায়, ‘যে ছিল বোবার মতো
পরের কুত্সা রটাবার বেলা তারো মুখ ফোটে কত!
শুনিয়া তখনি করতালি দিয়ে হেসে উঠে নরনারী—
যে যাহারে চায় ধরিয়া তাহায় দাঁড়াইল সারি সারি।
‘হয়েছে প্রমাণ’ ‘হয়েছে প্রমাণ’ হাসিয়া সবাই কহে—
‘যে কথা রটেছে একটি বর্ণ বানানো কাহারো নহে।’
বাহুতে বাহুতে বাঁধিয়া কহিল নয়নে নয়নে চাহি,
‘আকাশে পাতালে মরতে আজি তো গোপন কিছুই নাহি।’
কহিল হাসিয়া মালা হাতে লয়ে পাশাপাশি কাছাকাছি,
‘ত্রিভুবন যদি ধরা পড়ি গেল তুমি আমি কোথা আছি!’
হায় কবি হায়, সে হতে প্রকৃতি হয়ে গেছে সাবধানী—
মাথাটি ঘেরিয়া বুকের উপরে আঁচল দিয়েছে টানি।
যত ছলে আজ যত ঘুরে মরি জগতের পিছু-পিছু
কোনোদিন কোনো গোপন খবর নূতন মেলে না কিছু।
শুধু গুঞ্জনে কূজনে গন্ধে সন্দেহ হয় মনে
লুকানো কথার হাওয়া বহে যেন বন হতে উপবনে;
মনে হয় যেন আলোতে ছায়াতে রয়েছে কী ভাব ভরা—
হায় কবি, হায়, হাতে হাতে আর কিছুই পড়ে না ধরা।
১৩০৪