ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কল্পনা

       

          রাত্রি

মোরে করো সভাকবি ধ্যানমৌন তোমার সভায়
           হে শর্বরী, হে অবগুণ্ঠিতা!
তোমার আকাশ জুড়ি যুগে যুগে জপিছে যাহারা
          বিরচিব তাহাদের গীতা
তোমার তিমিরতলে যে বিপুল নিঃশব্দ উদ্‌যোগ
          ভ্রমিতেছে জগতে জগতে
আমারে তুলিয়া লও সেই তার ধ্বজচক্রহীন
          নীরবঘর্ঘর মহারথে

তুমি একেশ্বরী রানী বিশ্বের অন্তর-অন্তঃপুরে
          সুগম্ভীরা হে শ্যামাসুন্দরী,
দিবসের ক্ষয়হীন বিরাট ভাণ্ডারে প্রবেশিয়া
          নীরবে রাখিছ ভাণ্ড ভরি
নক্ষত্র-রতন-দীপ্ত নীলাকান্ত সুপ্তিসিংহাসনে
          তোমার মহান্ জাগরণ
আমারে জাগায়ে রাখো সে নিস্তব্ধ জাগরণতলে
          নির্নিমেষ পূর্ণ সচেতন!
 
কত নিদ্রাহীন চক্ষু যুগে যুগে তোমার আঁধারে
          খুঁজেছিল প্রশ্নের উত্তর
তোমার নির্বাক্ মুখে একদৃষ্টে চেয়েছিল বসি
          কত ভক্ত জুড়ি দুই কর
দিবস মুদিলে চক্ষু, ধীরপদে কৌতূহলী-দল
          অঙ্গনে পশিয়া সাবধানে
তব দীপহীন কক্ষে সুখদুঃখ জন্মমরণের
          ফিরিয়াছে গোপন সন্ধানে

স্তম্ভিত তমিস্রপুঞ্জ কম্পিত করিয়া অকস্মাৎ
          অর্ধরাত্রে উঠেছে উচ্ছ্বাসি
সদ্যস্ফুট ব্রহ্মমন্ত্র আন্দোলিত ঋষিকণ্ঠ হতে
          আন্দোলিয়া ঘন তন্দ্রারাশি
পীড়িত ভুবন লাগি মহাযোগী করুণাকাতর,
          চকিতে বিদ্যুত্‍‌রেখাবৎ‌
তোমার নিখিললুপ্ত অন্ধকারে দাঁড়ায়ে একাকী
          দেখেছে বিশ্বের মুক্তিপথ
 
জগতের সেই-সব যামিনীর জাগরূকদল
          সঙ্গীহীন তব সভাসদ্
কে কোথা বসিয়া আছে আজি রাত্রে ধরণীর মাঝে,
          গনিতেছে গোপন সম্পদ—
কেহ কারে নাহি জানে, আপনার স্বতন্ত্র আসনে
          আসীন স্বাধীন স্তব্ধচ্ছবি—
হে শর্বরী, সেই তব বাক্যহীন জাগ্রত সভায়
          মোরে করি দাও 
সভাকবি!

১৩০৬