ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কল্পনা

 

                               স্বপ্ন

          দূরে বহুদূরে
    
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে
মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা
         
বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে
 
         
মহাকাল-মন্দিরের মাঝে
তখন গম্ভীর মন্দ্রে সন্ধ্যারতি বাজে
জনশূন্য পণ্যবীথি, ঊর্ধ্বে যায় দেখা
অন্ধকার হর্ম্য-পরে সন্ধ্যারশ্মিরেখা

         
প্রিয়ার ভবন
বঙ্কিম সংকীর্ণ পথে দুর্গম নির্জন
দ্বারে আঁকা শঙ্খ চক্র, তারি দুই ধারে
দুটি শিশু নীপতরু পুত্রস্নেহে বাড়ে
         
তোরণের শ্বেতস্তম্ভ-পরে
সিংহের গম্ভীর মূর্তি বসি দম্ভভরে
 
প্রিয়ার কপোতগুলি ফিরে এল ঘরে,
ময়ূর নিদ্রায় মগ্ন স্বর্ণদণ্ড-পরে
         
হেনকালে হাতে দীপশিখা
ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সোপানের পরে
সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো সন্ধ্যাতারা করে
অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস
ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস
প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন-অন্তরে
চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে
         
দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়
নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
 
         
মোরে হেরি প্রিয়া
ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া
আইল সম্মুখে— মোর হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধালো শুধু, সকরুণ আঁখি,
হে বন্ধু, আছ তো ভালো?’ মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু, কথা আর নাহি
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি, নাম দোঁহাকার
দুজনে ভাবিনু কত—  মনে নাহি আর
দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা-পানে,
অঝোরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে

দুজনে ভাবিনু কত দ্বারতরুতলে
         
নাহি জানি কখন কী ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণ করে, কুলায়প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো, মুখখানি তার
নতবৃন্তপদ্মসম  বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে, ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস
 
           রজনীর
 অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার
         
দীপ দ্বারপাশে
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে
         
শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে

  বোলপুর
৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৪