ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কল্পনা

 উন্নতিলক্ষণ


ওগো পুরবাসী, আমি পরবাসী
       জগত্‍‌ব্যাপারে অজ্ঞ,
শুধাই তোমায়  পুরশালায়
       আজি  কিসের যজ্ঞ?
সিংহদুয়ারে পথের দু ধারে
       রথের না দেখি অন্ত—
কার সম্মানে ভিড়েছে এখানে
       যত উষ্ণীষবন্ত?
বসেছেন ধীর অতি গম্ভীর
      দেশের প্রবীণ বিজ্ঞ,
প্রবেশিয়া ঘরে সংকোচে ডরে
       মরি আমি অনভিজ্ঞ
কোন্ শূরবীর জন্মভূমির
       ঘুচালো হীনতাপঙ্ক?
ভারতের শুচি যশশশীরুচি
       কে করিল অকলঙ্ক?
রাজা মহারাজ মিলেছেন আজ
       কাহারে করিতে ধন্য?
বসেছেন এঁরা পূজ্যজনেরা
       কাহার পূজার জন্য?
 
            উত্তর                  
গেল সে সাহেব ভরি দুই জেব
       করিয়া উদর পূর্তি,
এরা বড়োলোক করিবেন শোক
       স্থাপিয়া তাহারি মূর্তি
           
অভাগা কে ওই মাগে নাম সই,
       দ্বারে দ্বারে ফিরে খিন্ন,
তবু উত্‍‌সাহে রচিবারে চাহে
       কাহার স্মরণচিহ্ন?
সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসে হায়
       নয়ন অশ্রুসিক্ত,
হৃদয় ক্ষুণ্ণ খাতাটি শূন্য,
       থলি একেবারে রিক্ত!
যাহার লাগিয়া ফিরিছে মাগিয়া
       মুছি ললাটের ঘর্ম,
স্বদেশের কাছে কী সে করিয়াছে?
       কী অপরাধের কর্ম?
             
                উত্তর
আর কিছু নহে, পিতাপিতামহে
       বসায়ে গেছে সে উচ্চে,
জন্মভূমিরে সাজায়েছে ঘিরে
       অমরপুষ্পগুচ্ছে

                
দেবী দশভূজা, হবে তাঁরি পূজা,
        মিলিবে স্বজনবর্গ—
হেথা এল কোথা দ্বিতীয় দেবতা,
       নূতন পূজার অর্ঘ্য?
কার সেবা-তরে আসিতেছে ঘরে
       আয়ুহীন মেষবত্‍‌স?
নিবেদিতে কারে আনে ভারে ভারে
       বিপুল ভেট্‌কি মত্‍‌স্য?
কী আছে পাত্রে যাহার গাত্রে
       বসেছে তৃষিত মক্ষী?
শলায় বিদ্ধ হতেছে সিদ্ধ
       মনুনিষিদ্ধ পক্ষী
দেবতার সেরা কী দেবতা এঁরা
       পূজাভবনের পূজ্য—
যাঁহাদের পিছে পড়ে গেছে নীচে,
       দেবী হয়ে গেছে উহ্য?
 
           উত্তর 
ম্যাকে, ম্যাকিনন, অ্যালেন, ডিলন
       দোকান ছাড়িয়া সদ্য
সরবে গরবে পূজার পরবে
       তুলেছেন পাদপদ্ম
          — 
 
এসেছিল দ্বারে পূজা দেখিবারে
       দেবীর বিনীত ভক্ত,
কেন যায় ফিরে অবনতশিরে
       অবমানে আঁখি রক্ত?
উত্‍‌সবশালা, জ্বলে দীপমালা,
       রবি চলে গেছে অস্তে—
কুতূহলীদলে কী বিধান-বলে
       বাধা পায় দ্বারীহস্তে?
ইহারা কি তবে অনাচারী হবে,
       সমাজ হইতে ভিন্ন?
পূজাদানধ্যানে ছেলেখেলা-জ্ঞানে
    এরা মনে মানে ঘৃণ্য?
 
             উত্তর
 না না, এরা সবে ফিরিছে নীরবে
       দীন প্রতিবেশীবৃন্দে—
সাহেব-সমাজ আসিবেন আজ,
      এরা এলে হবে নিন্দে
         
                
 
লোকটি কে ইনি, যেন চিনি চিনি,
       বাঙালি মুখের ছন্দ—
ধরনে ধারণে অতি অকারণে
       ইংরাজিতরো গন্ধ!
কালিয়া-বরন, অঙ্গে পরন
       কালো হ্যাট কালো কুর্তি,
যদি নিজদেশী কাছে আসে ঘেঁষি
       কিছু যেন কড়ামূর্তি!
ধুতি-পরা দেহ দেখা দিলে কেহ
       অতিশয় লাগে লজ্জা,
বাংলা আলাপে রোষে সন্তাপে
       জ্বলে ওঠে হাড় মজ্জা!
ইঁহারা কি শেষ ছাড়িবেন দেশ?
       এঁরা কি ভারতদ্বেষ্টা?
এঁদের কি তবে দলে দলে সবে
       বিজাতি হবার চেষ্টা?
 
            উত্তর
 এঁরা সবে বীর, এঁরা স্বদেশীর
       প্রতিনিধি বলে গণ্য—
কোট-পরা কায় সঁপেছেন হায়
       শুধু স্বজাতির জন্য
             
অনুরাগভরে ঘুচাবার তরে
       বঙ্গভূমির দুঃখ
 সভা মহতী, এর সভাপতি
       সভ্যেরা দেশমুখ্য
এরা দেশহিতে চাহিছে সঁপিতে
       আপন রক্তমাংস—
তবে  সভাকে ছেড়ে কেন থাকে
        দেশের অধিকাংশ?
কেন দলে দলে দূরে যায় চলে,
       বুঝে না নিজের ইষ্ট,
যদি কুতূহলে আসে সভাতলে,
       কেন বা নিদ্রাবিষ্ট?
তবে কি ইহারা নিজ-দেশ-ছাড়া
       রুধিয়া রয়েছে কর্ণ
দৈবের বশে পাছে কানে পশে
       শুভকথা এক বর্ণ?
 
           উত্তর
 না, না, এঁরা হন জনসাধারণ,
       জানে দেশভাষামাত্র,
স্বদেশসভায় বসিবারে হায়
       তাই অযোগ্য পাত্র
 
               
 বেশভূষা ঠিক যেন আধুনিক,
       মুখ দাড়ি-সমাকীর্ণ,
কিন্তু বচন অতি পুরাতন,
       ঘোরতর জরাজীর্ণ
উচ্চ আসনে বসি একমনে
       শূন্যে মেলিয়া দৃষ্টি
তরুণ  লোক লয়ে মনুশ্লোক
       করিছে বচনবৃষ্টি
জলের সমান করিছে প্রমাণ
       কিছু নহে উত্‍‌কৃষ্ট
শালিবাহনের পূর্ব সনের
       পূর্বে যা নহে সৃষ্ট
শিশুকাল থেকে গেছেন কি পেকে
       নিখিল পুরাণতন্ত্রে?
বয়স নবীন করিছেন ক্ষীণ
       প্রাচীন বেদের মন্ত্রে?
আছেন কি তিনি লইয়া পাণিনি,
       পুঁথি লয়ে কীটদষ্ট?
বায়ুপুরাণের খুঁজি পাঠ-ফের
       আয়ু করিছেন নষ্ট?
প্রাচীনের প্রতি গভীর আরতি
       বচনরচনে সিদ্ধ—
কহ তো শায়, প্রাচীন ভাষায়
       কতদূর কৃতবিদ্য?
 
            উত্তর
ঋজুপাঠ দুটি নিয়েছেন লুটি,
       দু সর্গ রঘুবংশ—
মোক্ষমুলার তে অধিকার
       শাস্ত্রের বাকি অংশ
             
 
পণ্ডিত ধীর মুণ্ডিতশির,
       প্রাচীন শাস্ত্রে শিক্ষা—
নবীন সভায় নব্য উপায়ে
       দিবেন ধর্মদীক্ষা
কহেন বোঝায়ে, কথাটি সোজা ,
       হিন্দুধর্ম সত্য—
মূলে আছে তার কেমিস্ট্রি আর
       শুধু পদার্থতত্ত্ব
টিকিটা যে রাখা ওতে আছে ঢাকা
       ম্যাগ্নেটিজ্‌ম্ শক্তি—
তিলকরেখায় বৈদ্যুত ধায়,
       তাই জেগে ওঠে ভক্তি
সন্ধ্যাটি হলে প্রাণপণবলে
       বাজালে শঙ্খঘণ্টা
মথিত বাতাসে তাড়িত প্রকাশে
       সচেতন হয় মনটা
এম-এ ঝাঁকে ঝাঁক শুনিছে অবাক্
       অপরূপ বৃত্তান্ত—
বিদ্যাভূষণ এমন ভীষণ
       বিজ্ঞানে দুর্দান্ত!
তবে ঠাকুরের পড়া আছে ঢের—
       অন্তত গ্যানো-খণ্ড,
হেল্‌ম্‌হত্‍‌স অতি বীভত্‍‌স
       করেছে লণ্ডভণ্ড!
 
           উত্তর
 কিছু না, কিছু না, নাই জানাশুনা
       বিজ্ঞান কানাকৌড়ি—
লয়ে কল্পনা লম্বা রসনা
       করিছে দৌড়াদৌড়ি
১৩০৬