ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
বিবাহ
রাজস্থান
প্রহর-খানেক রাত হয়েছে শুধু,
ঘন ঘন বেজে ওঠে শাঁখ ।
বরকন্যা যেন ছবির মতো
আঁচল-বাঁধা দাঁড়িয়ে আঁখি নত,
জানলা খুলে পুরাঙ্গনা যত
দেখছে চেয়ে ঘোমটা করি ফাঁক ।
বর্ষারাতে মেঘের গুরুগুরু —
তারি সঙ্গে বাজে বিয়ের শাঁখ ।
ঈশান কোণে থমকে আছে হাওয়া,
মেঘে মেঘে আকাশ আছে ঘেরি ।
সভাকক্ষে হাজার দীপালোকে
মণিমালায় ঝিলিক হানে চোখে —
সভার মাঝে হঠাৎ এল ও কে,
বাহির-দ্বারে বেজে উঠল ভেরী !
চমকে ওঠে সভার যত লোক
উঠে দাঁড়ায় বর-কনেরে ঘেরি ।
টোপর-পরা মেত্রিরাজকুমারে
কহে তখন মাড়োয়ারের দূত,
‘ যুদ্ধ বাধে বিদ্রোহীদের সনে,
রামসিংহ রানা চলেন রণে —
তোমরা এসো তাঁরি নিমন্ত্রণে
যে যে আছ মর্তিয়া রাজপুত ।'
‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় '
গর্জি উঠে মাড়োয়ারের দূত ।
‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় '
মেত্রিপতি ঊর্ধ্বস্বরে কয় ।
কনের বক্ষ কেঁপে ওঠে ডরে,
দুটি চক্ষু ছলো ছলো করে —
বরযাত্রী হাঁকে সমস্বরে,
‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় '
‘ সময় নাহি মেত্রিরাজকুমার '
মহারানার দূত উচ্চে কয় ।
বৃথা কেন উঠে হুলুধ্বনি,
বৃথা কেন বেজে ওঠে শাঁখ !
বাঁধা আঁচল খুলে ফেলে বর,
মুখের পানে চাহে পরস্পর —
কহে, ‘ প্রিয়ে, নিলেম অবসর,
এসেছে ওই মৃত্যুসভার ডাক ।'
বৃথা এখন ওঠে হুলুধ্বনি,
বৃথা এখন বেজে ওঠে শাঁখ !
বরের বেশে টোপর পরি শিরে
ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার ।
মলিন মুখে নম্র নতশিরে
কন্যা গেল অন্তঃপুরে ফিরে,
হাজার বাতি নিবল ধীরে ধীরে —
রাজার সভা হল অন্ধকার ।
গলায় মালা, টোপর - পরা শিরে
ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার ।
মাতা কেঁদে কহেন, ‘ বধূবেশ
খুলিয়া ফেল্ হায় রে হতভাগী ! '
শান্তমুখে কন্যা কহে মায়ে,
‘ কেঁদো না মা, ধরি তোমার পায়ে,
বধূসজ্জা থাক্ মা, আমার গায়ে -
মেত্রিপুরে যাইব তাঁর লাগি ।'
শুনে মাতা কপালে কর হানি
কেঁদে কহেন, ‘ হায় রে হতভাগী ! '
গ্রহবিপ্র আশীর্বাদ করি
ধানদূর্বা দিল তাহার মাথে ।
চড়ে কন্যা চতুর্দোলা- ' পরে,
পুরনারী হুলুধ্বনি করে,
রঙিন বেশে কিংকরী কিংকরে
সারি সারি চলে বালার সাথে ।
মাতা আসি চুমো খেলেন মুখে,
পিতা আসি হস্ত দিলেন মাথে ।
নিশীথ-রাতে আকাশ আলো করি
কে এল রে মেত্রিপুরদ্বারে !
‘ থামাও বাঁশি' কহে, ‘ থামাও বাঁশি —
চতুর্দোলা নামাও রে দাসদাসী ।
মিলেছি আজ মেত্রিপুরবাসী
মেত্রিপতির চিতা রচিবারে ।
মেত্রিরাজা যুদ্ধে হত আজি,
দুঃসময়ে
কারা এলে দ্বারে ? '
‘ বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি '
চতুর্দোলা হতে বধূ বলে,
‘ এবার লগ্ন আর হবে না পার,
আঁচলে গাঁঠ খুলবে না তো আর —
শেষের মন্ত্র উচ্চারো এইবার
শ্মশান-সভায় দীপ্ত চিতানলে ।'
‘ বাজাও বাঁশি, ওরে, বাজাও বাঁশি '
চতুর্দোলা হতে বধূ বলে ।
বরের বেশে মোতির মালা গলে
মেত্রিপতি চিতার'পরে শুয়ে ।
দোলা হতে নামল আসি নারী,
আঁচল বাঁধি রক্তবাসে তাঁরি
শিয়র- ' পরে বৈসে রাজকুমারী
বরের মাথা কোলের'পরে থুয়ে ।
নিশীথ-রাতে মিলনসজ্জা - পরা
মেত্রিপতি চিতার'পরে শুয়ে ।
ঘন ঘন জাগল হুলুধ্বনি,
দলে দলে আসে পুরাঙ্গনা ।
কয় পুরোহিত ‘ ধন্য সুচরিতা ',
গাহিছে ভাট ‘ ধন্য মৃত্যুজিতা ',
ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল চিতা —
কন্যা বসে আছেন যোগাসনা ।
জয়ধ্বনি উঠে শ্মশান - মাঝে,
হুলুধ্বনি করে পুরাঙ্গনা ।
১১ কার্তিক ১৩০৬