ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
গুরু
গোবিন্দ
‘ বন্ধু, তোমরা ফিরে যাও ঘরে
এখনো সময় নয় ' —
নিশি অবসান, যমুনার তীর,
ছোটো গিরিমালা, বন সুগভীর,
গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া
অনুচর গুটি ছয় ।
‘ যাও রামদাস, যাও গো লেহারি,
সাহু, ফিরে যাও তুমি ।
দেখায়ো না লোভ, ডাকিয়ো না মোরে
ঝাঁপায়ে পড়িত কর্মসাগরে —
এখনো পড়িয়া থাক্ বহু দূরে
জীবনরঙ্গভূমি ।
‘ ফিরায়েছি মুখ, রুধিয়াছি কান,
লুকায়েছি বনমাঝে ।
সুদূরে মানবসাগর অগাধ
চিরক্রন্দিত-ঊর্মি-নিনাদ,
হেথায় বিজনে রয়েছি মগন
আপন গোপন কাজে ।
‘ মানবের প্রাণ ডাকে যেন মোরে
সেই লোকালয় হতে ।
সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই
চমকিয়া উঠে বলি ‘ যাই যাই ',
প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই
প্রবল মানবস্রোতে ।
তোমাদের হেরি চিত চঞ্চল,
উদ্দাম ধায় মন ।
রক্ত-অনল শত শিখা মেলি
সর্পসমান করি উঠে কেলি,
গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন
কোষমাঝে ঝন্ ঝন্ ।
‘ হায়, সেকি সুখ, এ গহন ত্যজি
হাতে লয়ে জয়তুরী
জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে,
রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে,
অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া
হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি !
‘ তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি,
বন্ধন করি তায়
রশ্মি পাকড়ি আপনার করে
বিঘ্ন বিপদ লঙ্ঘন ক ' রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
প্রতিকূল ঘটনায় ।
‘ সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ,
পড়ে যায় কেহ ভূমে ।
দ্বিধা হয়ে বাধা হতেছে ভিন্ন,
পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন,
আকাশের আঁখি করিছে খিন্ন
প্রলয়বহ্নিধূমে ।
‘ শত বার করে মৃত্যু ডিঙায়ে
পড়ি জীবনের পাড়ে ।
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক,
লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
গরজিছে দুই ধারে ।
‘ কভু অমানিশা নীরব নিবিড়,
কভু বা প্রখর দিন ।
কভু বা আকাশে চারি - দিক - ময়
বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়ো হয়,
কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে
ভেঙে পড়ে দয়াহীন ।
‘‘ আয় আয় আয়' ডাকিতেছি সবে,
আসিতেছে সবে ছুটে ।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার,
সুখ সম্পদ মায়া মমতার
বন্ধন যায় টুটে ।
‘ সিন্ধুমাঝারে মিশিছে যেমন
পঞ্চ নদীর জল,
আহ্বান শুনে কে কারে থামায়,
ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায়,
পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া
উন্মাদ কোলাহল ।
‘ কোথা যাবি ভীরু, গহন গোপনে
পশিছে কণ্ঠ মোর ।
প্রভাতে শুনিয়া ‘ আয় আয় আয় '
কাজের লোকেরা কাজ ভুলে যায়,
নিশীথে শুনিয়া ‘ আয় তোরা আয় '
ভেঙে যায় ঘুমঘোর ।
‘ যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক,
ভরে যায় ঘাট বাট ।
ভুলে যায় সবে জাত-অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান অপমান
ব্রাহ্মণ আর জাঠ ।
‘ থাক্ ভাই, থাক্, কেন এ স্বপন —
এখনো সময় নয় ।
এখনো একাকী দীর্ঘ রজনী
জাগিতে হইবে পল গণি গণি
অনিমেষ চোখে পূর্ব গগনে
দেখিতে অরুণোদয় ।
‘ এখনো বিহার কল্পজগতে,
অরণ্য রাজধানী —
এখনো কেবল নীরব ভাবনা,
কর্মবিহীন বিজন সাধনা,
দিবানিশি শুধু বসে বসে শোনা
আপন মর্মবাণী ।
‘ একা ফিরি তাই যমুনার তীরে
দুর্গমগিরিমাঝে ।
মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে,
মিশাতেছি গান নদীকলরোলে,
গড়িতেছি মন আপনার মনে,
যোগ্য হতেছি কাজে ।
‘ এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
আরো কতদিন হবে !
চারি দিক হতে অমর জীবন
বিন্দু বিন্দু করি আহরণ
আপনার মাঝে আপনারে আমি
পূর্ণ দেখিব কবে !
‘ কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব —
‘ পেয়েছি আমার শেষ !
তোমরা সকলে এসো মোর পিছে,
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে,
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ !
‘‘ নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
নাহি আর আগু - পিছু ।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ —
নাই তার কাছে জীবন মরণ,
নাই নাই আর কিছু ।'
‘ হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মতো —
‘ উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,
ওই চেয়ে দেখো কতদূর হতে
তোমার কাছেতে ধরা দিবে ব ' লে
আসে লোক কত শত ।
‘‘ ওই শোনো শোনো কল্লোলধ্বনি,
ছুটে হৃদয়ের ধারা ।
স্থির থাকো তুমি, থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতো আলস তেয়াগি,
এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা ।'
‘ ওই চেয়ে দেখো দিগন্ত - পানে
ঘনঘোর ঘটা অতি ।
আসিতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে —
তাই বসে বসে হৃদয় - আলয়ে
জ্বালাতেছি আলো, নিবিবে না ঝড়ে,
দিবে অনন্ত জ্যোতি ।
‘ যাও তবে সাহু, যাও রামদাস,
ফিরে যাও সখাগণ ।
এসো দেখি সবে যাবার সময়
বলো দেখি সবে ‘ গুরুজির জয় ',
দুই হাত তুলি বলো ‘ জয় জয়
অলখ নিরঞ্জন' । '
বলিতে বলিতে প্রভাততপন
উঠিল আকাশ - ' পরে ।
গিরির শিখরে গুরুর মুরতি
কিরণছটায় প্রোজ্জ্বল অতি —
বিদায় মাগিল অনুচরগণ,
নমিল ভক্তিভরে ।
২৬ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৫