ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
 

কথা ও কাহিনী



 সূচনা

একদিন এল যখন আর-একটা ধারা বন্যার মতো মনের মধ্যে নামল। কিছুদিন ধরে দিল তাকে প্লাবিত করে। ইংরেজি অলংকারশাস্ত্রে এই শ্রেণীর ধারাকে বলে ন্যারেটিভ। অর্থাৎ কাহিনী। এর আনন্দবেগ যেন থামতে চাইল না। আমার কাব্যভূগোলে আর-একটা দ্বীপ তৈরি হয়ে উঠল। মনের সেই অবস্থায় কখনো কখনো কাহিনী বড়ো ধারায় উৎসারিত হয়ে নাট্যরূপ নিল।

এ-সব লেখার ভালোমন্দ বিচার করা অনাবশ্যক, চিন্তার বিষয় এর মনস্তত্ত্ব। রচনার প্রবৃত্তি অনেক থাকে নিষ্ক্রিয়, হঠাৎ কোনো-একটা প্রান্তে উদ্‌বোধিত হলে যারা ছিল অজ্ঞাতবাসে তারা যথোচিত সূত্রে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে কথার কবিতাগুলিকে ন্যারেটিভ শ্রেণীতে গণ্য করলেও তারা চিত্রশালা। তাদের মধ্যে গল্পের শিকল নেই, তারা এক-একটি খণ্ড খণ্ড দৃশ্য।

ছবির অভিমুখিতা বাইরের দিকে, নিরাবিল দৃষ্টিতে স্পষ্ট রেখায়। সেইজন্যে মনের মধ্যে এই ছবির প্রবর্তনা এমন বিষয়বস্তুকে স্বভাবত বেছে নেয় যার ভিত্তি বাস্তবে। এই সন্ধানে এক সময়ে গিয়ে পড়েছিলুম ইতিহাসের রাজ্যে। সেই সময়ে এই বহির্দৃষ্টির প্রেরণা কাব্যে ও নাট্যে ভিড় করে এসেছিল ইতিহাসের সঞ্চয় নিয়ে। এমনি করে এই সময়ে আমার কাব্যে একটা মহল তৈরি হয়ে উঠেছে যার দৃশ্য জেগেছে ছবিতে, যার রস নেমেছে কাহিনীতে, যাতে রূপের আভাস দিয়েছে নাটকীয়তায়।

                        উৎ‌সর্গ

         সুহৃদ্‌বর শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানাচার্য
                                            করকমলেষু

                  সত্যরত্ন তুমি দিলে- পরিবর্তে তার
                  কথা  কল্পনা মাত্র দিনু উপহার 

                                  শিলাইদহ
                             
অগ্রহায়ণ ১৩০৬


                           কথা
 

                                  কথা কও, কথা কও

অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে

          কেন বসে চেয়ে রও?

          কথা কও, কথা কও।

যুগযুগান্ত ঢালে তার কথা

          তোমার সাগরতলে,

কত জীবনের কত ধারা এসে

          মিশায় তোমার জলে।

সেথা এসে তার স্রোত নাহি আর,

কলকল ভাষ নীরব তাহার—

তরঙ্গহীন ভীষণ মৌন,

          তুমি তারে কোথা লও!

হে অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার

কথা কও, কথা কও।

 

কথা কও, কথা কও।

স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,

          অচেতন তুমি নও—

          কথা কেন নহি কও!

তব সঞ্চার শুনেছি আমার

          মর্মের মাঝখানে,

কত দিবসের কত সঞ্চয়

          রেখে যাও মোর প্রাণে!

হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে

কাজ করে যাও গোপনে গোপনে,

মুখর দিনের চপলতা-মাঝে

          স্থির হয়ে তুমি রও।

হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে

কথা কও, কথা কও।

 

কথা কও, কথা কও।

কোনো কথা কভু হারাও নি তুমি,

          সব তুমি তুলে লও—

          কথা কও, কথা কও।

তুমি জীবনের পাতায় পাতায়

          অদৃশ্য লিপি দিয়া

পিতামহদের কাহিনী লিখিছ

          মজ্জায় মিশাইয়া।

যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই

তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই,

বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী

          স্তম্ভিত হয়ে বও।

ভাষা দাও তারে হে মুনি অতীত,

          কথা কও, কথা কও।