ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
মূল্যপ্রাপ্তি
অবদানশতক
অঘ্রাণে শীতের রাতে
নিষ্ঠুর শিশিরঘাতে
পদ্মগুলি গিয়াছে মরিয়া—
সুদাস মালীর ঘরে
কাননের সরোবরে
একটি ফুটেছে কী করিয়া ।
তুলি লয়ে বেচিবারে
গেল সে প্রাসাদদ্বারে,
মাগিল রাজার দরশন —
হেনকালে হেরি ফুল
আনন্দে পুলকাকুল
পথিক কহিল একজন,
‘অকালের পদ্ম তব
আমি এটি কিনি লব,
কত মূল্য লইবে ইহার ?
বুদ্ধ ভগবান আজ
এসেছেন পুরমাঝ
তাঁর পায়ে দিব উপহার ।'
মালী কহে, ‘এক মাষা
স্বর্ণ পাব মনে আশা ।'
পথিক চাহিল তাহা দিতে —
হেনকালে সমারোহে
বহু পূজা-অর্ঘ্য বহে
নৃপতি বাহিরে আচম্বিতে ।
রাজেন্দ্র প্রসেনজিৎ
উচ্চারি মঙ্গলগীত
চলেছেন বুদ্ধদরশনে —
হেরি অকালের ফুল
শুধালেন, ‘কত মূল ?
কিনি দিব প্রভুর চরণে ।'
মালী কহে, ‘হে রাজন্,
স্বর্ণমাষা দিয়ে পণ
কিনিছেন এই মহাশয় ।'
‘দশ মাষা দিব আমি'
কহিলা ধরণীস্বামী,
‘বিশ মাষা দিব' পান্থ কয় ।
দোঁহে কহে ‘দেহো দেহো',
হার নাহি মানে কেহ —
মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত ।
মালী ভাবে যাঁর তরে
এ দোঁহে বিবাদ করে
তাঁরে দিলে আরো পাব কত !
কহিল সে করজোড়ে,
‘দয়া করে ক্ষম মোরে —
এ ফুল বেচিতে নাহি মন ।'
এত বলি ছুটিল সে
যেথা রয়েছেন বসে
বুদ্ধদেব উজলি কানন ।
বসেছেন পদ্মাসনে
প্রসন্ন প্রশান্ত মনে,
নিরঞ্জন আনন্দমূরতি ।
দৃষ্টি হতে শান্তি ঝরে,
স্ফুরিছে অধর - ' পরে
করুণার সুধাহাস্যজ্যোতি ।
সুদাস রহিল চাহি —
নয়নে নিমেষ নাহি,
মুখে তার বাক্য নাহি সরে ।
সহসা ভূতলে পড়ি
পদ্মটি রাখিল ধরি
প্রভুর চরণপদ্ম - 'পরে ।
বরষি অমৃতরাশি
বুদ্ধ শুধালেন হাসি,
‘কহো বৎস, কী তব প্রার্থনা ।'
ব্যাকুল সুদাস কহে, ‘প্রভু, আর কিছু নহে,
চরণের ধূলি এক কণা ।'
২৬ আশ্বিন ১৩০৬
নগরলক্ষ্মী
কল্পদ্রুমাবদান
দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে
জাগিয়া উঠিল হাহারবে,
বুদ্ধ নিজভক্তগণে
শুধালেন জনে জনে,
'ক্ষুধিতের
অন্নদানসেবা
তোমরা লইবে বল কেবা ?'
শুনি তাহা রত্নাকর শেঠ
করিয়া রহিল মাথা হেঁট ।
কহিল সে কর জুড়ি,
'ক্ষুধার্ত
বিশাল পুরী,
এর ক্ষুধা মিটাইব আমি
এমন ক্ষমতা নাই স্বামী ! '
কহিল সামন্ত জয়সেন,
'যে
আদেশ প্রভু করিছেন
তাহা লইতাম শিরে
যদি মোর বুক চিরে
রক্ত দিলে হ'ত
কোনো কাজ—
মোর ঘরে অন্ন কোথা আজ ! '
নিশ্বাসিয়া কহে ধর্মপাল,
'কী
কব, এমন দগ্ধ ভাল,
আমার সোনার খেত
শুষিছে অজন্মা - প্রেত,
রাজকর জোগানো কঠিন —
হয়েছে অক্ষম দীনহীন ।'
রহে সবে মুখে মুখে চাহি,
কাহারো উত্তর কিছু নাহি ।
নির্বাক্ সে সভাঘরে
ব্যথিত নগরী - ' পরে
বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি
সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি ।
তখন উঠিল ধীরে ধীরে
রক্তভাল লাজনম্রশিরে
অনাথপিণ্ডদসুতা
বেদনায় অশ্রুপ্লুতা,
বুদ্ধের চরণরেণু লয়ে
মধু কণ্ঠে কহিল বিনয়ে —
'ভিক্ষুণীর
অধম সুপ্রিয়া
তব আজ্ঞা লইল বহিয়া ।
কাঁদে যারা খাদ্যহারা
আমার সন্তান তারা,
নগরীরে অন্ন বিলাবার
আমি আজি লইলাম ভার ।'
বিস্ময় মানিল সবে শুনি —
'ভিক্ষুকন্যা
তুমি যে ভিক্ষুণী !
কোন্ অহংকারে মাতি
লইলে মস্তকে পাতি
এ-হেন কঠিন গুরু কাজ !
কী আছে তোমার কহো আজ ।'
কহিল সে নমি সবা-কাছে,
'শুধু
এই ভিক্ষাপাত্র আছে ।
আমি দীনহীন মেয়ে
অক্ষম সবার চেয়ে,
তাই তোমাদের পাব দয়া —
প্রভু-আজ্ঞা হইবে বিজয়া ।
'আমার
ভাণ্ডার আছে ভরে
তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে ।
তোমরা চাহিলে সবে
এ পাত্র অক্ষয় হবে ।
ভিক্ষা - অন্নে বাঁচাব বসুধা —
মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা ।'
২৭ আশ্বিন ১৩০৬