ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
 

কথা ও কাহিনী
 


        অভিসার

বোধিসত্ত্বাবদান-কল্পলতা

 

    সন্ন্যাসী উপগুপ্ত

মথুরাপুরীর প্রাচীরের তলে

       একাদা ছিলেন সুপ্ত

নগরীর দীপ নিবেছে পবনে,

দুয়ার রুদ্ধ পৌর ভবনে,

নিশীথের তারা শ্রাবণগগনে

      ঘন মেঘে অবলুপ্ত।

 

কাহার নূপুরশিঞ্জিত পদ

   সহসা বাজিল বক্ষে !

সন্ন্যাসীবর চমকি জাগিল,

স্বপ্নজড়িমা পলকে ভাগিল,

ঢ় দীপের আলোক লাগিল

           ক্ষমাসুন্দর চক্ষে।

 

নগরীর নটী চলে অভিসারে

   যৌবনমদে মত্তা।

অঙ্গে আঁচল সুনীল বরন,

রুনুঝুনু রবে বাজে আভরণ

সন্ন্যাসী-গায়ে পড়িতে চরণ

    থামিল বাসবদত্তা।

 

প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাঁহার

     নবীন গৌরকান্তি-

সৌম্য সহাস তরুণ বয়ান,

করুণাকিরণে বিকচ নয়ান,

শুভ্র ললাটে ইন্দুসমান

    ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি।

 

কহিল রমণী ললিত কণ্ঠে,

    নয়নে জড়িত লজ্জা,

ক্ষমা করো মোর কুমার কিশোর,

দয়া কর যদি গূহে চলো মোর,

এ ধরণীতল কঠিন কঠোর

     এ নহে তোমার শয্যা।’  

 

সন্ন্যাসী কহে করু বচনে,

    'অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে,

এখনো আমার সময় হয় নি,

যেথায় চলেছে যাও তুমি ধনী,

সময় যেদিন আসিবে আপনি

     যাইব তোমার কুঞ্জে।’

 

সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎ শিখায়

        মেলিল বিপুল আস্য।

রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে,

প্রলয়শঙ্খ বাজিল বাতাসে,

আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে

     হাসিল অট্রহাস্য।

        ...

বর্ তখনো হয় নাই শেষ,

      এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা ।

বাতাস হয়েছে উতলা আকুল,

পথতরুশাখে ধরেছে মুকুল,

রাজার কাননে ফুটেছে বকুল

      পারুল রজনীগন্ধা ।

 

অতি দূর হতে  আসিছে পবনে

     বাঁশির মদির মন্দ্র ।

জনহীন পুরী, পুরবাসী সবে

গেছে মধুবনে ফুল-উৎসবে

শূন্য নগরী নিরখি নীরবে

     হাসিছে পূর্ণচন্দ্র ।

 

নির্জন পথে জ্যোৎস্না আলোতে

      সন্ন্যাসী একা যাত্রী।

মাথার উপরে তরুবীথিকার

কোকিল কুহরি উঠে বারবার,

এতদিন পরে এসেছে কি তাঁর

         আজি অভিসাররাত্রি ?

 

নগর ছাড়ায়ে গেলেন দণ্ডী

    বাহিরপ্রাচীরপ্রান্তে।

দাঁড়ালেন আসি পরিখার পারে

আম্রবনের ছায়ার আঁধারে

কে ওই রমণী প’ড়ে এক ধারে

     তাঁহার চরণোপান্তে !

 

নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায়

    ভরে গেছে তার অঙ্গ

রোগমসীঢালা কালী তনু তার

লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার

বাহিরে ফেলেছে, করি’ পরিহার

    বিষাক্ত তার সঙ্গ ।

 

সন্ন্যাসী বসি আড়ষ্ঠ শির

     তুলি নিল নিজ অঙ্কে

ঢালি দিল জল শুস্ক অধরে,

মন্ত্র পড়িয়া দিল শির’ পরে,

লেপি দিল দেহ আপনার  করে

    শীতচন্দনপঙ্কে

 

ঝরিছে মুকুল, কূজিছে কোকিল,

   যামিনী জোছনামত্তা ।

‘কে এসেছে তুমি ওগো দয়াময়’

শুধাইল নারী, সন্ন্যাসী কয়

‘আজি রজনীতে হয়েছে সময়,

      এসেছি বাসবদত্তা !’

                    ১৯ আশ্বিন ১৩০৬