ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
 

কথা ও কাহিনী
          


         পণরক্ষা

‘ মারাঠা দস্যু আসিছে রে ওই,
      করো করো সবে সাজ '
আজমীর গড়ে কহিলা হাঁকিয়া
      দুর্গেশ দুমরাজ ।
বেলা দু'পহরে যে যাহার ঘরে
     সেঁকিছে জোয়ারি রুটি,
দুর্গতোরণে নাকাড়া বাজিছে
     বাহিরে আসিল ছুটি ।
প্রাকারে চড়িয়া দেখিল চাহিয়া
      দক্ষিণে বহু দূরে
আকাশ জুড়িয়া উড়িয়াছে ধুলা
      মারাঠি অশ্বখুরে ।
‘ মারাঠার যত পতঙ্গপাল
     কৃপাণ-অনলে আজ
ঝাঁপ দিয়া পড়ি ফিরে নাকো যেন '
      গর্জিলা দুমরাজ ।

মাড়োয়ার হতে দূত আসি বলে,
      ‘ বৃথা এ সৈন্যসাজ,
হেরো এ প্রভুর আদেশপত্র
      দুর্গেশ দুমরাজ !
সিন্দে আসিছে, সঙ্গে তাঁহার
      ফিরিঙ্গি সেনাপতি —
সাদরে তাঁদের ছাড়িবে দুর্গ
      আজ্ঞা তোমার প্রতি ।
বিজয়লক্ষ্মী হয়েছে বিমুখ
      বিজয়সিংহ- ' পরে —
বিনা সংগ্রামে আজমীর গড়
      দিবে মারাঠার করে ।'
‘ প্রভুর আদেশে বীরের ধর্মে
      বিরোধ বাধিল আজ '
নিশ্বাস ফেলি কহিলা কাতরে
       দুর্গেশ দুমরাজ ।

মাড়োয়ার-দূত করিল ঘোষণা,
       ‘ ছাড়ো ছাড়ো রণসাজ ।'
রহিল পাষাণ-মুরতি - সমান
        দুর্গেশ দুমরাজ ।
বেলা যায় যায়, ধূ ধূ করে মাঠ,
        দূরে দূরে চরে ধেনু —
তরুতলছায়ে সকরুণ রবে
        বাজে রাখালের বেণু ।
‘ আজমীর গড় দিলা যবে মোরে
       পণ করিলাম মনে,
প্রভুর দুর্গ শত্রুর করে
       ছাড়িব না এ জীবনে ।
প্রভুর আদেশে সে সত্য হায়
       ভাঙিতে হবে কি আজ ! '
এতেক ভাবিয়া ফেলে নিশ্বাস
       দুর্গেশ দুমরাজ ।

রাজপুত সেনা সরোষে শরমে
        ছাড়িল সমর-সাজ ।
নীরবে দাঁড়ায়ে রহিল তোরণে
        দুর্গেশ দুমরাজ ।
গেরুয়া-বসনা সন্ধ্যা নামিল
       পশ্চিম মাঠ-পারে ;
মারাঠি সৈন্য ধুলা উড়াইয়া
        থামিল দুর্গদ্বারে ।
‘ দুয়ারের কাছে কে ওই শয়ান,
       ওঠো ওঠো, খোলো দ্বার ।'
নাহি শোনে কেহ — প্রাণহীন দেহ
       সাড়া নাহি দিল আর ।
প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে
        বিরোধ মিটাতে আজ
দুর্গদুয়ারে ত্যজিয়াছে প্রাণ
        দুর্গেশ দুমরাজ ।

 

অগ্রহায়ণ ১৩০৬