ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
সামান্য
ক্ষতি
দিব্যাবদানমালা
বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
স্বচ্ছসলিলা বরুণা ।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
কাশীর মহিষী করুণা ।
সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
জনহীন রাজশাসনে ।
নিকটে যে ক ' টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
কূজন উঠিছে কাননে ।
আজি উতরোল উত্তর বায়ে
উতলা হয়েছে তটিনী ।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে —
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
নেচে চলে যেন নটিনী ।
কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
নারী কণ্ঠের কাকলি ।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি - উচ্ছ্বাসে
আকাশ উঠিল আকুলি ।
স্নান সমাপন করিয়া যখন
কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, ‘ উহু ! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী —
শীত নিবারিব অনলে ।'
সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে ।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
কহে সহাস্য আননে —
ওলো
তোরা আয় ! ওই দেখা যায়
কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল ' —
এত বলি রানী রঙ্গ বিভল
হাসিয়া উঠিল মধুরে ।
কহিল মালতী সকরুণ অতি,
একি পরিহাস রানীমা !
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি ?
এ কুটির কোন্ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী
বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা ! '
রানী কহে রোষে, ‘ দূর করি দাও
এই দীনদয়াময়ীরে ।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
আগুন লাগালো কুটিরে ।
ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল ।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
বহ্নি আকাশ জুড়িল ।
পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
জ্বালাময়ী যত নাগিনী ।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
বাজিল দীপক রাগিণী ।
প্রভাতপাখির আনন্দ গান
ভয়ের বিলাপে টুটিল —
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল ।
ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
প্রলয়লোলুপ রসনা ।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী - সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
দীপ্ত - অরুণ - বসনা ।
তখন সভায় বিচার - আসনে
বসিয়াছিলেন ভূপতি ।
গৃহহীন প্রজা দলে দলে আসে,
দ্বিধাকম্পিত গদগদ ভাষে
নিবেদিল দুঃখ সংকোচে ত্রাসে
চরণে করিয়া বিনতি ।
সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা
রক্তিমমুখ শরমে ।
অকালে পশিলা রানীর আগার —
কহিলা, ‘ মহিষী, একি ব্যবহার !
গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার
বলো কোন্ রাজধরমে ! '
রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী,
গৃহ কহ তারে কী বোধে !
গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির,
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর ?
কত ধন যায় রাজমহিষীর
এক প্রহরের প্রমোদে ! '
কহিলেন রাজা উদ্যত রোষ
রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে —
যতদিন তুমি আছ রাজরানী
দীনের কুটিরে দীনের কী হানি
বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি —
বুঝাব তোমার নিদয়ে ।'
রাজার আদেশে কিংকরী আসি
ভূষণ ফেলিল খুলিয়া —
অরুণবরন অম্বরখানি
নির্মম করে খুলে দিল টানি,
ভিখারি নারীর চীরবাস আনি
দিল রানীদেহে তুলিয়া ।
পথে লয়ে তারে কহিলেন রাজা,
মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে —
এক প্রহরের লীলায় তোমার
যে ক ' টি কুটির হল ছারখার
যত দিনে পার সে - ক ' টি আবার
গড়ি দিতে হবে তোমারে ।
বৎসরকাল দিলেম সময়,
তার পরে ফিরে আসিয়া
সভায় দাঁড়ায়ে করিয়া প্রণতি
সবার সমুখে জানাবে যুবতী
হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি
জীর্ণ কুটির নাশিয়া ।'
২৫
আশ্বিন ১৩০৬