ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
স্পর্শমণি
ভক্তমাল
নদীতীরে বৃন্দাবনে
সনাতন একমনে
জপিছেন নাম,
হেনকালে দীনবেশে
ব্রাহ্মণ চরণে এসে
করিল প্রণাম ।
শুধালেন সনাতন,
‘ কোথা হতে আগমন,
কী নাম ঠাকুর ? '
বিপ্র কহে, ‘কিবা কব,
পেয়েছি দর্শন তব
ভ্রমি বহুদূর ।
জীবন আমার নাম,
মানকরে মোর ধাম,
জিলা বর্ধমানে —
এতবড়ো ভাগ্যহত
দীনহীন মোর মতো
নাই কোনোখানে ।
জমিজমা আছে কিছু,
করে আছি মাথা নিচু,
অল্পস্বল্প পাই ।
ক্রিয়াকর্ম-যজ্ঞযাগে
বহু খ্যাতি ছিল আগে,
আজ কিছু নাই ।
আপন উন্নতি লাগি
শিব-কাছে বর মাগি
করি আরাধনা ।
একদিন নিশিভোরে
স্বপ্নে দেব কন মোরে —
পুরিবে প্রার্থনা !
যাও যমুনার তীর,
সনাতন গোস্বামীর
ধরো দুটি পায় !
তাঁরে পিতা বলি মেনো,
তাঁরি হাতে আছে জেনো
ধনের উপায় ।'
শুনি কথা সনাতন
ভাবিয়া আকুল হন —
‘ কী আছে আমার !
যাহা ছিল সে সকলি
ফেলিয়া এসেছি চলি —
ভিক্ষামাত্র সার ।'
সহসা বিস্মৃতি ছুটে,
সাধু ফুকারিয়া উঠে,
‘ ঠিক বটে ঠিক ।
একদিন নদীতটে
কুড়ায়ে পেয়েছি বটে
পরশমানিক ।
যদি কভু লাগে দানে
সেই ভেবে ওইখানে
পুঁতেছি বালুতে —
নিয়ে যাও হে ঠাকুর,
দুঃখ তব হবে দূর
ছুঁতে নাহি ছুঁতে ।'
বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি
খুঁড়িয়া বালুকারাশি
পাইল সে মণি,
লোহার মাদুলি দুটি
সোনা হয়ে উঠে ফুটি,
ছুঁইল যেমনি ।
ব্রাহ্মণ বালুর'পরে
বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে —
ভাবে নিজে নিজে ।
যমুনা কল্লোলগানে
চিন্তিতের কানে কানে
কহে কত কী যে !
নদীপারে রক্তছবি
দিনান্তের ক্লান্ত রবি
গেল অস্তাচলে —
তখন ব্রাহ্মণ উঠে
সাধুর চরণে লুটে
কহে অশ্রুজলে,
‘ যে ধনে হইয়া ধনী
মণিরে মান না মণি
তাহারি খানিক
মাগি আমি নতশিরে ।
এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মানিক ।
২৯ আশ্বিন ১৩০৬
বন্দী বীর
পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে শিখ—
নির্মম নির্ভীক ।
হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয়
ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্ ।
নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ ।
‘
অলখ নিরঞ্জন '
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন ।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্ঝন্ ।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল,
‘ অলখ নিরঞ্জন ! '
এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
না রাখে কাহারো ঋণ ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
চিত্ত ভাবনাহীন ।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর
এসেছে সে এক দিন ।
দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
তন্দ্রা যেতেছে ছুটে ।
কাদের কণ্ঠে গগন মন্থ,
নিবিড় নিশীথ টুটে —
কাদের মশালে আকাশের ভালে
আগুন উঠেছে ফুটে !
পঞ্চনদীর তীরে
ভক্তদেহের রক্তলহরী
মুক্ত হইল কি রে !
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
ছুটে যেন নিজনীড়ে ।
বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালো
পঞ্চনদীর তীরে ।
মোগল-শিখর রণে
মরণ-আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
দুইজনা দুইজনে ।
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ
যুঝে ভুজঙ্গ-সনে ।
সেদিন কঠিন রণে
‘ জয় গুরুজির' হাঁকে শিখ বীর
সুগভীর নিঃস্বনে
।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
‘ দীন্ দীন্' গরজনে ।
গুরুদাসপুর
গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল
তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খল গত
বাঁধি লয়ে গেল ধরে
দিল্লিনগর- ' পরে ।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
গুরুদাসপুর গড়ে ।
সম্মুখে চলে মোগল-সৈন্য
উড়ায়ে পথের ধূলি,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
বর্শাফলকে তুলি ।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে,
বাজে শৃঙ্খলগুলি ।
রাজপথ-' পরে লোক নাহি ধরে,
বাতায়ন যায় খুলি ।
শিখ গরজয়, ‘ গুরুজির জয় '
পরানের ভয় ভুলি ।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে
দিল্লিপথের ধূলি ।
পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি ।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
বন্দীরা সারি সারি
‘ জয় গুরুজির' কহি শত বীর
শত শির দেয় ডারি ।
সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ
নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
বন্দার এক ছেলে ।
কহিল, ‘ ইহারে বধিতে হইবে
নিজহাতে অবহেলে ।'
দিল তার কোলে ফেলে
কিশোর কুমার, বাঁধা বাহু তার,
বন্দার এক ছেলে ।
কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে
লইল বক্ষে টানি ।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে
রাখে দক্ষিণ পাণি,
শুধু একবার চুম্বিল তার
রাঙা উষ্ণীষখানি ।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
ছুরিকা খসায়ে আনি
বালকের মুখ চাহি
‘ গুরুজির জয়' কানে কানে কয়,
‘ রে পুত্র, ভয় নাহি ।'
নবীন বদনে অভয় কিরণ
জ্বলি উঠি উৎসাহি -
কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল
বালক উঠিল গাহি
‘ গুরুজির জয় ! কিছু নাহি ভয় '
বন্দার মুখ চাহি ।
বন্দা তখন বামবাহুপাশ
জড়াইল তার গলে,
দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে
ছুরি বসাইল বলে -
‘ গুরুজির জয়' কহিয়া বালক
লুটালো ধরণীতলে ।
সভা হল নিস্তব্ধ
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক
সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি '
একটি কাতর শব্দ ।
দর্শনজন মুদিল নয়ন,
সভা হল নিস্তব্ধ ।
৩০ আশ্বিন
১৩০৬