মায়ার খেলা (গীতিনাট্য)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পঞ্চম দৃশ্য
কানন
অমর। দিবসরজনী আমি যেন কার
আশায় আশায় থাকি।
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ,
তৃষিত আকুল আঁখি।
চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই,
সদা মনে হয় যদি দেখা পাই,
‘কে আসিছে’ ব’লে চমকিয়ে চাই
কাননে ডাকিলে পাখি।
জাগরণে তারে না দেখিতে পাই,
থাকি স্বপনের আশে—
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়
বাঁধিব স্বপনপাশে।
এত ভালোবাসি এত যারে চাই
মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই,
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে
তাহারে আনিবে ডাকি॥
প্রমদা সখীগণ অশোক ও কুমারের প্রবেশ
কুমার। সখী, সাধ করে যাহা দেবে তাই লইব।
সখীগণ। আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণমন।
কুমার। দাও যদি ফুল, শিরে তুলে রাখিব।
সখী। দেয় যদি কাঁটা?
কুমার। তাও সহিব।
সখীগণ। আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণমন।
কুমার। যদি একবার চাও, সখী, মধুর নয়ানে
ওই আঁখি-সুধা-পানে চিরজীবন মাতি রহিব।
যদি কঠিন কটাক্ষ মিলে?
কুমার। তাও হৃদয়ে বিঁধায়ে চিরজীবন বহিব।
সখীগণ। আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি,
তুমি মনে মনে চাহ প্রাণমন॥
প্রমদা। আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল,
শুধাইল না কেহ।
সে তো এল না, যারে সঁপিলাম
এই প্রাণ মন দেহ।
সে কি মোর তরে পথ চাহে—
সে কি বিরহগীত গাহে
যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে
আমি ত্যজিলাম গেহ।
মায়াকুমারীগণ। নিমেষের তরে শরমে বাধিল,
মরমের কথা হল না।
জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে
রহিল মরমবেদনা।
প্রমদার প্রতি
অশোক। ওগো সখী, দেখি দেখি মন কোথা আছে।
সখীগণ। কত কাতর হৃদয় ঘুরে ঘুরে হেরো কারে যাচে।
অশোক। কী মধু, কী সুধা, কী সৌরভ,
কী রূপ রেখেছ লুকায়ে!
সখীগণ। কোন্ প্রভাতে কোন্ রবির আলোকে
দিবে খুলিয়ে কাহার কাছে!
অশোক। সে যদি না আসে এ জীবনে, এ কাননে পথ না পায়।
সখীগণ। যারা এসেছে তারা বসন্ত ফুরালে
নিরাশ প্রাণে ফেরে পাছে॥
প্রমদা। এ তো খেলা নয়, খেলা নয়।
এ যে হৃদয়দহনজ্বালা সখী।
এ যে প্রাণভরা ব্যাকুলতা, গোপন মর্মের ব্যথা,
এ যে কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরণ ঢালা।
কে যেন সতত মোরে ডাকিয়ে আকুল করে,
যাই-যাই করে প্রাণ— যেতে পারি নে।
যে কথা বলিতে চাহি তা বুঝি বলিতে নাহি—
কোথায় নামায়ে রাখি, সখী, এ প্রেমের ডালা।
যতনে গাঁথিয়ে শেষে পরাতে পারি নে মালা॥
প্রথমা সখী। সে জন কে, সখী, বোঝা গেছে
আমাদের সখী যারে মনপ্রাণ সঁপেছে।
দ্বিতীয়া ওতৃতীয়া। ও সে কে, কে!
প্রথমা। ওই-যে তরুতলে বিনোদমালা গলে
না জানি কোন্ ছলে বসে রয়েছে।
দ্বিতীয়া। সখী, কী হবে—
ও কি কাছে আসিবে কভু! কথা কবে!
তৃতীয়া। ও কি প্রেম জানে! ও কি বাঁধন মানে!
ও কী মায়াগুণে মন লয়েছে।
দ্বিতীয়া। বিভল আঁখি তুলে আঁখিপানে চায়,
যেন কোন্ পথ ভুলে এল কোথায় ওগো!
তৃতীয়া। যেন কোন্ গানের স্বরে শ্রবণ আছে ভরে,
যেন কোন্ চাঁদের আলোয় মগ্ন হয়েছে॥
অমর। ওই মধুর মুখ জাগে মনে।
ভুলিব না এ জীবনে কী স্বপনে কী জাগরণে।
তুমি জান বা না জান,
মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে
হৃদয়ে সদা আছ ব’লে।
আমি প্রকাশিতে পারি নে,
শুধু চাহি কাতর নয়নে॥
সখীগণ। তারে কেমনে ধরিবে, সখী, যদি ধরা দিলে।
প্রথমা। তারে কেমনে কাঁদাবে যদি আপনি কাঁদিলে।
দ্বিতীয়া। যদি মন পেতে চাও মন রাখো গোপনে।
তৃতীয়া। কে তারে বাঁধিবে তুমি আপনায় বাঁধিলে।
সকলে। কাছে আসিলে তো কেহ কাছে রহে না।
কথা কহিলে তো কেহ কথা কহে না।
প্রথমা। হাতে পেলে ভুমিতলে ফেলে চলে যায়।
দ্বিতীয়া। হাসিয়ে ফিরায় মুখ কাঁদিয়ে সাধিলে।
নিকটে আসিয়া প্রমদার প্রতি
অমর। সকল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি যারে
সে কি ফিরাতে পারে সখী!
সংসারবাহিরে থাকি জানি নে কী ঘটে সংসারে।
কে জানে হেথায় প্রাণপণে প্রাণ যারে চায়
তারে পায় কি না পায়, জানি নে—
ভয়ে ভয়ে তাই এসেছি গো অজানা-হৃদয়-দ্বারে।
তোমার সকলি ভালোবাসি— ওই রূপরাশি,
ওই খেলা, ওই গান, ওই মধুহাসি।
ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারি—
কোথায় তোমার সীমা ভুবনমাঝারে॥
সখীগণ। তুমি কে গো, সখীরে কেন জানাও বাসনা।
দ্বিতীয়া। কে জানিতে চায় তুমি ভালোবাস কি ভালোবাস না।
প্রথমা। হাসে চন্দ্র, হাসে সন্ধ্যা, ফুল্ল কুঞ্জকানন,
হাসে হৃদয়বসন্তে বিকচ যৌবন।
তুমি কেন ফেল শ্বাস, তুমি কেন হাস না।
সকলে। এসেছ কি ভেঙে দিতে খেলা—
সখীতে সখীতে এই হৃদয়ের মেলা—
দ্বিতীয়া। আপন দুঃখ আপন ছায়া লয়ে যাও।
প্রথমা। জীবনের আনন্দপথ ছেড়ে দাঁড়াও।
তৃতীয়া। দূর হতে করো পূজা হৃদয়কমল-আসনা॥
অমর। তবে সুখে থাকো সুখে থাকো—আমি যাই—যাই।
প্রমদা। সখী, ওরে ডাকো, মিছে খেলায় কাজ নাই।
সখীগণ। অধীরা হয়ো না, সখী,
আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।
অমর। ছিলাম একেলা সেই আপন ভুবনে,
এসেছি এ কোথায়।
হেথাকার পথ জানি নে—ফিরে যাই।
যদি সেই বিরামভবন ফিরে পাই।
প্রস্থান
প্রমদা। সখী, ওরে ডাকো ফিরে।
মিছে খেলা মিছে হেলা কাজ নাই।
সখীগণ। অধীরা হোয়ো না, সখী,
আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে॥
প্রস্থান
মায়াকুমারীগণ। নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না।
জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে রহিল মরমবেদনা।
চোখে চোখে সদা রাখিবারে সাধ—
পলক পড়িল, ঘটিল বিষাদ—
মেলিতে নয়ন মিলালো স্বপন, এমনি প্রেমের ছলনা॥