মায়ার খেলা (গীতিনাট্য)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ষষ্ঠ দৃশ্য
গৃহ
শান্তা। অমরের প্রবেশ
অমর সেই শান্তিভবন ভুবন কোথা গেল—
সেই রবি শশী তারা, সেই শোকশান্ত সন্ধ্যাসমীরণ,
সেই শোভা, সেই ছায়া, সেই স্বপন।
সেই আপন হৃদয়ে আপন বিরাম কোথা গেল,
গৃহহারা হৃদয় লবে কাহার শরণ।
শান্তার প্রতি
এসেছি ফিরিয়ে, জেনেছি তোমারে,
এনেছি হৃদয় তব পায়—
শীতল স্নেহসুধা করো দান,
দাও প্রেম, দাও শান্তি, দাও নূতন জীবন॥
মায়াকুমারীগণ। কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এসো কাছে।
ভুবন ভ্রমিলে তুমি, সে এখনো বসে আছে।
ছিল না প্রেমের আলো, চিনিতে পার নি ভালো,
এখন বিরহনলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে॥
শান্তা। দেখো, সখা, ভুল করে ভালোবেসো না।
আমি ভালোবাসি ব’লে কাছে এসো না।
তুমি যাহে সুখী হও তাই করো সখা,
আমি সুখী হব ব’লে যেন হেসো না।
আপন বিরহ লয়ে আছি আমি ভালো—
কী হবে চির আঁধারে নিমেষের আলো!
আশা ছেড়ে ভেসে যাই, যা হবার হবে তাই—
আমার অদৃষ্টস্রোতে তুমি ভেসো না॥
অমর। ভুল করেছিনু, ভুল ভেঙেছে।
এবার জেগেছি, জেনেছি—
এবার আর ভুল নয়, ভুল নয়।
ফিরেছি মায়ার পিছে পিছে।
জেনেছি স্বপন সব মিছে।
বিঁধেছে বাসনা-কাঁটা প্রাণে—
এ তো ফুল নয়, ফুল নয়!
পাই যদি ভালোবাসা হেলা করিব না,
খেলা করিব না লয়ে মন।
ওই প্রেমময় প্রাণে লইব আশ্রয় সখী,
অতল সাগর এ সংসার—
এ তো কূল নয়, কূল নয়॥
প্রমদার সখীগণের প্রবেশ
দূর হইতে
সখীগণ। অলি বার বার ফিরে যায়,
অলি বার বার ফিরে আসে—
তবে তো ফুল বিকাশে।
প্রথমা। কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না, মরে লাজে, মরে ত্রাসে।
ভুলি মান অপমান দাও মন প্রাণ,
নিশি দিন রহো পাশে।
দ্বিতীয়া। ওগো আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও
হৃদয়রতন-আশে।
সকলে। ফিরে এসো ফিরে এসো, বন মোদিত ফুলবাসে।
আজি বিরহরজনী, ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে॥
অমর। কে আমায় ফিরে ডাকে।
ফিরে যে এসেছে তারে কে মনে রাখে।
মায়াকুমারীগণ। বিদায় করেছ যারে নয়নজলে
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো।
আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুমবনে
তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে?
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো।
অমর। আমি চলে এনু বলে কার বাজে ব্যথা।
কাহার মনের কথা মনেই থাকে।
আমি শুধু বুঝি, সখী, সরল ভাষা—
সরল হৃদয় আর সরল ভালোবাসা।
তোমাদের কত আছে, কত মন প্রাণ,
আমার হৃদয় নিয়ে ফেলো না বিপাকে॥
মায়াকুমারীগণ। সেদিনো তো মধুনিশি প্রাণে গিয়েছিল মিশি,
মুকুলিত দশ দিশি কুসুমদলে।
দুটি সোহাগের বাণী যদি হত কানাকানি,
যদি ঐ মালাখানি পরাতে গলে!
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো।
অমরের প্রতি
শান্তা। না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে!
ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে,
কাহার জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরান জ্বলে!
পড় নি কাহার নয়নের ভাষা,
বোঝ নি কাহার মরমের আশা,
দেখ নি ফিরে—
কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দ’লে॥
অমর। আমি কারেও বুঝি নে, শুধু বুঝেছি তোমারে।
তোমাতে পেয়েছি আলো সংশয়-আঁধারে।
ফিরিয়াছি এ ভুবন, পাই নি তো কারো মন,
গিয়েছি তোমারি শুধু মনের মাঝারে।
এ সংসারে কে ফিরাবে —কে লইবে ডাকি
আজিও বুঝিতে নারি, ভয়ে ভয়ে থাকি।
কেবলই তোমারে জানি, বুঝেছি তোমার বাণী
তোমাতে পেয়েছি কূল অকূল পাথারে॥
প্রস্থান
সখীগণ। প্রভাত হইল নিশি কানন ঘুরে,
বিরহবিধুর হিয়া মরিল ঝুরে।
ম্লান শশী অস্তে গেল, ম্লান হাসি মিলাইল—
কাঁদিয়া উঠিল প্রাণ কাতর সুরে।
প্রমদার প্রবেশ
প্রমদা। চল্ সখী, চল্ তবে ঘরেতে ফিরে—
যাক ভেসে ম্লান আঁখি নয়ননীরে।
যাক ফেটে শূন্য প্রাণ, হোক্ আশা অবসান—
হৃদয় যাহারে ডাকে থাক্ সে দূরে॥
প্রস্থান
মায়াকুমারীগণ। মধুনিশি পূর্ণিমার ফিরে আসে বার বার,
সে জন ফেরে না আর যে গেছে চলে।
ছিল তিথি অনুকূল, শুধু নিমেষের ভুল—
চিরদিন তৃষাকুল পরান জ্বলে।
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো॥