মায়ার খেলা (গীতিনাট্য)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সপ্তম দৃশ্য
কানন
অমর শান্তা অন্যান্য পুরনারী ও পৌরজন
স্ত্রীগণ। এস’ এস’, বসন্ত, ধরাতলে।
আন’ কুহুতান, প্রেমগান,
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’ নবযৌবনহিল্লোল, নব প্রাণ,
প্রফুল্ল নবীন বাসনা ধরাতলে।
পুরুষগণ। এস’ থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত
নবপল্লবপুলকিত
ফুল-আকুল-মালতিবল্লি-বিতানে—
সুখছায়ে মধুবায়ে এস’ এস’
এস’ অরুণচরণ কমলবরণ
তরুণ উষার কোলে।
এস’ জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে,
কলকল্লোল-তটিনী-তীরে—
সুখসুপ্ত সরসীনীরে এস’ এস’॥
স্ত্রীগণ। এস’ যৌবনকাতর হৃদয়ে,
এস’ মিলনসুখালস নয়নে,
এস’ মধুর শরমমাঝারে,
দাও বাহুতে বাহু বাঁধি,
নবীন কুসুমপাশে রচি দাও নবীন মিলনবাঁধন॥
শান্তার প্রতি
অমর। মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।
মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
কুহকলেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরনছটাতে।
হেরো পুরানো প্রাচীন ধরণী হয়েছে শ্যামলবরনী
যেন যৌবনপ্রবাহ ছুটেছে কালের শাসন টুটাতে।
পুরানো বিরহ হানিছে, নবীন মিলন আনিছে,
নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে॥
স্ত্রীগণ। আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে
মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগল মুরতি।
পুরুষগণ। ফুলগন্ধে আকুল করে, বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে,
নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে-
স্ত্রীগণ। তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি।
আনো আনো ফুলমালা, দাও দোঁহে বাঁধিয়ে।
পুরুষগণ। হৃদয়ে পশিবে ফুলপাশ, অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন।
স্ত্রীগণ। চিরদিন হেরিব হে
মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগল মুরতি॥
প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ
অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!
শান্তা। আহা, কে গো তুমি মলিনবয়নে
আধোনিমীলিত নলিননয়নে
যেন আপনারি হৃদয়শয়নে
আপনি রয়েছ লীন।
পুরুষগণ। তোমা তরে সবে রয়েছে চাহিয়া,
তোমা লাগি পিক উঠিছে গাহিয়া,
ভিখারি সমীর কানন বাহিয়া
ফিরিতেছে সারা দিন।
অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!
শান্তা। যেন শরতের মেঘখানি ভেসে
চাঁদের সভাতে দাঁড়ায়েছ এসে,
এখনি মিলাবে ম্লান হাসি হেসে—
কাঁদিয়া পড়িবে ঝরি।
পুরুষগণ। জাগিছে পূর্ণিমা পূর্ণ নীলাম্বরে,
কাননে চামেলি ফুটে থরে থরে,
হাসিটি কখন ফুটিবে অধরে
রয়েছি তিযাষ ধরি।
অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া॥
সখীগণ। আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুমকোমল—
কার অনাদরে আজি ঝরে যায়!
কেন কাছে আস’, কেন মিছে হাস’,
কাছে যে আসিত সে তো আসিতে না চায়।
সুখে আছে যারা সুখে থাক্ তারা,
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা—
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখীজনে যেন দেখিতে না পায়।
তারা দেখেও দেখে না,
তারা বুঝেও বুঝে না,
তারা ফিরেও না চায়॥
শান্তা। আমি তো বুঝিছি সব, যে বোঝে না-বোঝে,
গোপনে হৃদয় দুটি কে কাহারে খোঁজে।
আপনি বিরহ গড়ি আপনি রয়েছে পড়ি,
বাসনা কাঁদিছে বসি হৃদয়সরোজে।
আমি কেন মাঝে থেকে দুজনারে রাখি ঢেকে,
এমন ভ্রমের তলে কেন থাকি মজে॥
প্রমদার প্রতি
অশোক। এতদিন বুঝি নাই, বুঝেছি ধীরে—
ভালো যারে বাস তারে আনিব ফিরে।
হৃদয়ে হৃদয় বাঁধা, দেখিতে না পায় আঁধা—
নয়ন রয়েছে ঢাকা নয়ননীরে॥
শান্তা ও স্ত্রীগণ। চাঁদ হাসো, হাসো—
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
পুরুষগণ। কত দুখে কত দূরে আঁধারসাগর ঘুরে
সোনার তরণী দুটি তীরে এসেছে।
মিলন দেখিবে বলে ফিরে বায়ু কুতুহলে,
চারি ধারে ফুলগুলি ঘিরে এসেছে।
সকলে। চাঁদ হাসো, হাসো—
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে॥
প্রমদা। আর কেন, আর কেন
দলিত কুসুমে বহে বসন্তসমীরণ।
ফুরায়ে গিয়েছে বেলা— এখন এ মিছে খেলা—
নিশান্তে মলিন দীপ কেন জ্বলে অকারণ।
সখীগণ। অশ্রু যবে ফুরায়েছে তখন মুছাতে এলে
অশ্রুভরা হাসিভরা নবীন নয়ন ফেলে!
প্রমদা। এই লও, এই ধরো— এ মালা তোমরা পরো—
এ খেলা তোমরা খেলো, সুখে থাকো অনুক্ষণ॥
অমর। এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়নজলে
এ মলিন মালা কে লইবে।
ম্লান আলো ম্লান আশা হৃদয়তলে,
এ চিরবিষাদ কে বহিবে।
সুখনিশি অবসান— গেছে হাসি, গেছে গান—
এখন এ ভাঙা প্রাণ লইয়া গলে
নীরব নিরাশা কে সহিবে॥
শান্তা। যদি কেহ নাহি চায় আমি লইব,
তোমার সকল দুখ আমি সহিব।
আমার হৃদয় মন সব দিব বিসর্জন,
তোমার হৃদয়ভার আমি বহিব।
ভুল-ভাঙা দিবালোকে চাহিব তোমার চোখে—
প্রশান্ত সুখের কথা আমি কহিব॥
অমর ও শান্তার প্রস্থান
মায়াকুমারীগণ। দুখের মিলন টুটিবার নয়—
নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়।
নয়নসলিলে যে হাসি ফুটে গো,
রয় তাহা রয় চিরদিন রয়॥
প্রমদা। কেন এলি রে, ভালোবাসিলি, ভালোবাসা পেলি নে।
কেন সংসারেতে উঁকি মেরে চলে গেলি নে।
সখীগণ। সংসার কঠিন বড়ো— কারেও সে ডাকে না,
কারেও সে ধরে রাখে না।
যে থাকে সে থাকে আর যে যায় সে যায়—
কারো তরে ফিরেও না চায়।
প্রমদা। হায় হায়, এ সংসারে যদি না পূরিল
আজন্মের প্রাণের বাসনা,
চলে যাও ম্লানমুখে, ধীরে ধীরে ফিরে যাও—
থেকে যেতে কেহ বলিবে না।
তোমার ব্যথা তোমার অশ্রু তুমি নিয়ে যাবে—
আর তো কেহ অশ্রু ফেলিবে না॥
প্রস্থান
মায়াকুমারীগণ
সকলে। এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।
প্রথমা। শুধু সুখ চলে যায়।
দ্বিতীয়া। এমনি মায়ার ছলনা।
তৃতীয়া। এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
সকলে। তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান-অভিমান।
প্রথমা। তাই এত হায়-হায়।
দ্বিতীয়া। প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সকলে। সখী, চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরালো,
মিছে আর কেন বলো।
প্রথমা। শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সকলে। সখী, চলো।
প্রথমা। প্রেমের কাহিনী গান হয়ে গেল অবসান।
দ্বিতীয়া। এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল॥